আমরা যাদের উত্তরসূরী
প্রিয়নবির প্রিয়তম সহচর ও জননন্দিত গভর্র
সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ)
নাসীম আরাফাত
এক বিশাল আনন্দ মিছিল। মক্কার অলিগলি ঘুরে আনন্দ মিছিলটি তানঈম প্রান্তরের দিকে এগুচ্ছে। এ আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে মক্কার যুব-কিশোর আর পৌঢ়-বৃদ্ধরা। শুধু কি তাই, ঘরদোড় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে অনেক কিশোরী যুবতীও। থেকে থেকে ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হচ্ছে লাত উযযার জয়ধ্বনি। করতালি আর উল্লাস ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে মরুপ্রান্তর। মিছিলের নেতৃত্বে রয়েছে কোরাইশ সর্দারগণ। সবার আগে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলছে এক শৃঙ্খলিত বন্দীকে, নাম তার খুবাইব। রাসূলের সাহাবী। অত্যন্ত একনিষ্ঠ সহচর। মুশরিকরা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাঁকে বন্দী করেছে। এখন আনন্দ মিছিল করে তানঈম প্রান্তরে নিয়ে যাচ্ছে, তাঁকে শূলে চড়াবে, নির্মমভাবে হত্যা করবে এবং বদরে নিহত মুশরিকদের হত্যার প্রতিশোধ নেবে। প্রতিহিংসার জ্বালা প্রশমিত করবে। মনের এই জিঘাংসা মেটাতে নিরপরাধ অসহায় এই সাহাবীকে বন্দী করেছে। এখন আনন্দ মিছিল করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে।
সাঈদ ইবনে আমির। মক্কার এক তরুণ যুবক। যৌবনের জোয়ারে টইটুম্বুর তার দেহ-মন। অনুসন্ধিৎসু আর জিজ্ঞাসু তার অন্তর। দূরন্ত দুর্বার আর অপ্রতিরোধ্য তার গতি-প্রকৃতি। আজকের এই উল্লাস মিছিল থেকে সে-ও পিছিয়ে নেই। হাজারো যুবকের সাথে সে-ও চললো আনন্দ মিছিলের সাথে। অনুসন্ধিৎসু মন তাকে নিয়ে এলো শৃঙ্খলিত বন্দীর অতি নিকটে। গভীরভাবে চার দিকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেললেন। দেখলেন শৃঙ্খলিত খুবাইবের চেহারায় ভয়ের কোন ছাপ নেই। কোনো ভীতি নেই। নির্বিকার নিশ্চিন্ত এক সুখী মানুষ। যেন প্রশান্তির বন্যা বইছে তার হৃদয়-নদীতে। এ দৃশ্যে সাঈদ অত্যন্ত বিস্মিত হলেন।
ধীরে ধীরে আনন্দ মিছিলটি তানঈম প্রান্তরে পৌঁছলো। একেবারে শূলিকাষ্ঠের গোড়ায় গিয়ে থামলো। করতালি আর লাত-উযযার জয়ধ্বনিতে চির শান্ত তানঈম প্রান্তর মুখরিত হয়ে উঠলো। সাঈদ ইবনে আমিরের অনুসন্ধানী দৃষ্টি আবার ফিরে এলো বন্দী খুবাইরের দিকে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তার নেই কোনো ব্যাকুলতা, মৃত্যুর ভয়াল বিভীষিকার আতংকে নেই কোনো বিষন্নতা। যেন কোন আজব ভূবনের মানুষ তিনি।
ইতিমধ্যে সাঈদ ইবনে আমির শোরগোল আর অট্টহাসির মাঝে খুবাইবের ধীর স্থির প্রশান্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কুরাইশ সর্দারদের লক্ষ্য করে তিনি বলছেন, 'আপনারা কি মৃত্যুর পূর্বে আমাকে দু'রাকাত নামায পড়ার সুযোগ দিবেন?' খুবাইর (রাঃ) মুশরিকদের নিশ্ছিদ্র বেষ্টনীর মাঝে দাঁড়িয়ে দু'রাকাত নামায পড়ছেন। এতো নামায নয়, এ যেন আল্লাহর প্রেম-প্রীতি আর ভালবাসার এক অনুপম দৃশ্য। আত্মসত্তা ভুলে তিনি যেন চলে গেছেন সুদূর কোনো অদৃশ্যলোকে। যেন গোপন অভিসারে নির্জন স্থানে প্রেমাস্পদের কানে কানে মিটিমিটি কথা বলছেন। তারপর জীবনের সঞ্চিত সকল প্রেম ভালবাসা উজাড় করে মহা প্রভু পরওয়ারদেগারের পদতলে সিজদায় লুটিয়ে পড়ছেন।
খুবাইবের (রাঃ) এই অদৃশ্যপূর্ব নামায কাফেরদের চিন্তা-চেতনায় এক প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করলো। কপালের রেখায় রেখায় একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন তীব্র আকারে ফুটে উঠছিলো। আহ! কি সুন্দর নামায। কি চমৎকার প্রভূভক্তি। নিরাকার রবের সামনে কি এমনিভাবে আত্মভোলা হওয়া যায়? জীবনের অন্তিম মুহূর্তে কি ইবাদতকেই শেষ আকাংখা হিসাবে গ্রহণ করা যায়? এমনি বহু প্রশ্নবানে জর্জরিত হচ্ছিলো তাদের বিবেক-বুদ্ধি। ইতিমধ্যে দু'রাকাত নামায শেষ করলেন খুবাইব (রাঃ)। ফিরে তাকালেন কোরাইশ সর্দারদের দিকে। বললেন, “তোমাদের যদি এমন ধারণা না হতো যে, মৃত্যুর ভয়ে আমি নামায দীর্ঘ করছি, তবে আমি আমার নামাযকে আরো দীর্ঘ করতাম”। এরপর সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) দেখলেন, মুশরিকরা তার শরীরের একেকটি অঙ্গ নির্মমভাবে কেটে নিচ্ছে আর প্রশ্ন করছে, খুবাইব তুমি কি চাও যে, মুহাম্মদ তোমার স্থানে হবে আর তুমি চিরমুক্তি পাবে? উত্তরে রক্তাক্ত খুবাইব (রাঃ) অত্যন্ত দৃঢ় অবিচল ও প্রতিবাদী কণ্ঠে বলছেন, আল্লাহর কসম, “নিরাপদে আমি পরিজনের নিকট ফিরে যাব আর মুহাম্মদ (সাঃ) এর পায়ে একটি মাত্র কাটা ফুটবে, তাও বরদাশত করব না।” অমনি কাফেরদের চিৎকার আর অট্টহাসিতে তানঈম প্রান্তর মুখরিত হয়ে উঠলো। ‘হত্যা কর এই সাহাবীকে। শূলিতে দে এক্ষুণি। কেটে টুকরো টুকরো করে ফেল।’
এরপর সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) দেখলেন, শূলিবিদ্ধ খুবাইবের (রাঃ) দৃষ্টি আকাশের নীলিমায় আটকে গেছে। অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলছেন, প্রভূ হে, এদের সংখ্যা গুণে নিন। নির্মমভাবে যেখানে আছে সেখানেই নিঃশেষ করুন। কাউকে জীবনে ছাড়বেন না। তারপর অগণিত বর্শা ও তরবারীর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ছিন্নভিন্ন দেহ থেকে তার প্রাণ পাখি নীল আকাশের নিঃসীম নীলিমায় উড়ে গেল। কাফেরদের বেষ্টনীর মাঝে পড়ে রইলো তার নিষ্প্রাণ দেহটি। খুবাইবের (রাঃ) শাহাদাতের পর বধ্যভূমি থেকে সবাই ফিরে এলো। জনশূন্য হয়ে পড়লো তানঈম প্রান্তর। জীবন যাত্রাপথের বহু ঘটনা দুর্ঘটনার আবর্তে সবাই ভুলে গেল খুবাইবের (রাঃ) শাহাদাতের বিস্ময়কর ঘটনাগুলো। কিন্তু সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) ছিলেন অন্য ধাতের লোক। ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। মুহূর্তের জন্যও তার অন্তর থেকে খুবাইবের (রাঃ) শাহাদাতের বিস্ময়কর ঘটনাগুলো মুছে যায়নি।
দিবাশেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলে ঘুমের ঘোরে তাকে স্বপ্নে দেখতেন। ভয়ে আতংকে ঘুম ভেঙ্গে যেতো তার। শিউরে উঠতেন তিনি। আবার দিবালোকে কল্পনার জগতে খুবাইব (রাঃ) এসে হাজির হতেন। শূলিকাষ্ঠের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ধীরস্থির ও শান্ত চিত্তে দু'রাকাত নামায পড়ার প্রাণবন্ত চিত্র ভেসে উঠতো তার মানসপটে। একেকটি দৃশ্যের পর সর্বশেষে যখন কোরাইশের উপর বদ দোয়ার শব্দগুলো তার কর্ণকুহরে গুঞ্জন তুলতো, তখন তার শরীর ভয়ে কাঁপতে থাকতো। মনে হতো আকাশ থেকে এই বুঝি মক্কায় ভয়াবহ বজ্রাঘাত নেমে আসবে। এখুনি বুঝি আকাশ থেকে বিশাল পাথর খন্ড পড়ে। মক্কা নগরী ধূলিস্মাৎ হয়ে যাবে।
খুবাইবের এই শাহাদাতের ঘটনা সাঈদ ইবনে আমিরের অন্তরে এক আলোর বন্যা বইয়ে দিলো। তাঁর চিন্তা জগতে এক বিরাট বিপ্লব সৃষ্টি করলো। তত্ত্বজ্ঞানের অফুরন্ত ভান্ডারে ভরে গেল তার হৃদয়-মন। তিনি বুঝলেন, ক্ষণিকের এই জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভোগ-বিলাস নয়। বরং এ জীবনের লক্ষ্য হলো বিশ্বাস ও আকীদার পথে আমরণ জিহাদ চালিয়ে যাওয়া।
তিনি বুঝলেন, হৃদয়ের গভীরে যে ঈমানের শাখা-প্রশাখা পৌঁছে যায়, তা বহু বিস্ময়কর কাহিনী সৃষ্টি করে। বহু অলৌকিক ঘটনার জন্ম দেয়। তিনি আরো বুঝলেন, যে মহান ব্যক্তিকে তার সহচরবৃন্দ, সঙ্গী-সাথীরা এমনিভাবে হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে পারে, তিনি নিঃসন্দেহে উর্ধ্বলোকের সাহায্যপুষ্ট কোনো মহান নবী বৈ অন্য কিছু নন। এরপর আল্লাহ তা'আলা সাঈদ ইবনে আমেরের (রাঃ) রুদ্ধ অন্তর ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। সমবেত কাফেরদের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। কোরাইশের পৌত্তলিক পাপ- পংকিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র ঘোষণা করলেন।
নও মুসলিম সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) নিজেকে আর মক্কায় ধরে রাখতে পারলেন না। রাসূলের ভালবাসা তাকে মদীনার দিকে তীব্র আকর্ষণ করতে লাগলো। অবশেষে ব্যাকুল অস্থির চিত্তে সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) মদীনায় হিজরত করলেন।
মদীনায় পৌঁছে সাঈদ ইবনে ‘আমির (রাঃ) রাসূলের সাহচর্য অবলম্বন করলেন। রাসূলের মজলিসে বসেন। ইহলৌকিক-পারলৌকিক কথা শুনেন। দিনে দিনে তিনি ঈমানী বলে আরো বলীয়ান হয়ে উঠলেন। খায়বর ও তৎপরবর্তী সকল জিহাদে তিনি রাসূলের পাশে পাশে থেকে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। রাসূলের ইনতেকালের পর তিনি খলীফা আবু বকর ও খলীফা উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর হাতের উম্মুক্ত তলোয়ার হয়ে যান। ইসলামের সেবায় তিনি তাদের সকল হুকুম অবলীলাক্রমে মেনে নিতেন। তিনি তখন প্রকৃত মুমিনের এক অনন্য উপমা। দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত ক্রয়ের পাকা সওদাগর, আল্লাহর রেজামন্দি ও সন্তুষ্টি অর্জনে এক কামেল মুমিন। খলীফাদ্বয়ও তাঁর সততা, খোদাভীরুতা, তাকওয়া, পরহেজগারী সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন। তাই তারা তাঁর উপদেশবাণী, দিক নির্দেশনা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে শুনতেন।
একবারের ঘটনা। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তখন সবেমাত্র খলীফা হয়েছেন। ঠিক তখন একদিন সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) তাঁর নিকট গেলেন। বললেন, 'শুন উমর, তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি। জনসাধারণের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে। আর আল্লাহর ব্যাপারে কাউকে ভয় করবেনা। মনে রাখবে, তোমার কথা যেন কাজের খেলাফ না হয়। কারণ প্রকৃত ও শ্রেষ্ঠ কথা তা, বাস্তবায়ন যাকে সত্যায়িত ও বলিষ্ঠ করে। শুন উমর, দূর ও নিকটের মুসলমানদের প্রতি তোমার দৃষ্টিকে সর্বদা সজাগ রাখবে। তোমার ও তোমার পরিজনের জন্য তুমি যা ভালবাস জনসাধারণের জন্য তা-ই ভালবাসবে এবং তোমার ও তোমার পরিজনের জন্য যা অপছন্দ কর তা তাদের জন্য অপছন্দ করবে। সত্য বাস্তবায়নে তুমি জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়, আল্লাহর আহকাম বাস্তবায়নে কোনো ব্যক্তির তিরস্কারের ভয় করো না।'
বিনীত কন্ঠে তখন উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বললেন, সাঈদ বল তো কে তা পারবে? উত্তরে সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, 'তোমাকে এবং তোমার মত যাদেরকে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উম্মতের শাসক বানিয়েছেন, তারাই তা পরবে।'
এবার উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেলেন। সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ)-কে খিলাফতের কাজে সহায়তার আহবান করে বললেন, শুন সাঈদ, আমি তোমাকে হিমস নগরীর গভর্নর বানাচ্ছি। সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) ভয় পাওয়া লোকদের মত কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘ভাই উমর! তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, তুমি আমাকে পরীক্ষায় ফেলো না।’
এবার উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) একটু ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, ছি ছি এটা কেমন কথা! আমার মাথায় তোমরা দায়িত্বের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দূরে থাকতে চাও? আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে এবার ছাড়ছিনা! তারপর তিনি তাঁকে হিমস নগরীর গভর্নর বানিয়ে দিলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন; সাঈদ, বাইতুল মাল থেকে কি তোমার ভাতা চালু করে দিবো? সাঈদ ইবনে আমের (রাঃ) বললেন, না, তার প্রয়োজন নেই। দিলে তা আমার প্রয়োজনের তুলনায় বেশী হয়ে যাবে। তারপর তিনি হিমস নগরীতে চলে গেলেন।
সাঈদ ইবনে ‘আমির (রাঃ) হিমস যাবার পর বেশ কিছু দিন চলে গেলো। ইতিমধ্যে হিমস নগরী থেকে মদীনায় একটি প্রতিনিধি দল এলো। এরা আমীরুল মুমিনীনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত, অতি পরিচিত! উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তাদের বললেন। তোমরা আমাকে হিমসের দরিদ্র লোকদের একটি তালিকা তৈরী করে দাও। আমি তাদের অভাব পূরণের চেষ্টা করবো। প্রতিনিধি দল একটি তালিকা তৈরী করে আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট পেশ করলেন। তিনি তালিকাটি নিয়ে চোখ বুলালেন। কয়েকটি নাম পড়ার পরই তাঁর দৃষ্টি আটকে গেলো একটি নামের উপর “সাঈদ ইবনে আমির”। বিস্ময় ভরা কণ্ঠে তিনি বললেন, কে এই সাঈদ ইবনে আমির? প্রতিনিধিদল বললো, আমাদের গভর্ণর। আমাদের আমীর। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর বিস্ময় বেড়ে গেলো, তিনি বললেন, তোমাদের আমীর দরিদ্র! প্রতিনিধিদল বললো, খোদার কসম করে বলছি, কখনো এমন হয় যে, কয়েক দিন পর্যন্ত তার ঘরে আগুন পর্যন্ত জ্বলে না। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তাদের কথা শুনে কাঁদতে লাগলেন। কান্নার কারণে অশ্রুধারা তার শশ্রু সিক্ত করে ফেললো। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি শান্ত হলেন এবং এক হাজার দিনারের একটি থলে তাদের হাতে দিয়ে বললেন, সাঈদ ইবনে আমিরের নিকট আমার সালাম পৌঁছাবে এবং বলবে যে, উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এগুলো আপনার প্রয়োজন পূরণের জন্য পাঠিয়েছে।
হিমসে পৌছে প্রতিনিধি দল সাঈদ ইবনে আমিরের বাড়িতে এলো এবং থলেটি দিয়ে আমীরুল মুমিনীনের সালামসহ সংবাদটি পৌঁছালো। সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) থলেটি খুলেই দেখেন, ঝকঝকে দিনারে ঠাসা। বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে মুহূর্তকাল তাকিয়ে রইলেন, তারপর তা দূরে সরিয়ে দিতে দিতে অত্যন্ত বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ)-এর কণ্ঠস্বরে তার স্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন এবং ভীত কণ্ঠে বললেন, কি হলো!! কি হয়েছে!! আমীরুল মুমিনীন কি তবে ইন্তেকাল করেছেন? সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, না, না, বরং তার চেয়েও ভয়াবহ।
স্ত্রী বললেন, তবে কি মুসলিম বাহিনী কোন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে?
সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, বরং তার চেয়েও ভয়াবহ।
স্ত্রী বললেন, বলোনা তাহলে হয়েছে কী?
সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, দুনিয়া এসে গেছে। আমার আখেরাতকে বরবাদ করার জন্য আমার ঘরে ফিতনা এসে গেছে।
স্ত্রী বললেন, ফেতনা দূরে সরিয়ে দিন। সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, তুমি কি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে?
স্ত্রী বললেন, হ্যা, নিশ্চয় করবো। তারপর সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) খলীফার দেয়া দিনারগুলো ভাগ করে অনেকগুলো থলেতে রাখলেন এবং হিমসের দরিদ্র মুসলমানদের মাঝে তা বন্টন করে দিলেন।
এ ঘটনার কিছুদিন পর আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) জনসাধারণের অবস্থা পর্যালোচনা করতে বেরুলেন। হিমস নগরীতে এলে নগরবাসী তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে এলো। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) তখন জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা তোমাদের আমীরকে কেমন পেলে? তারা তখন উমর ইবনে খাত্তার (রাঃ)-এর নিকট আমীরের বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ উত্থাপন করলো।
উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেন, আমি তখন তাদেরকে একটি মজলিসে ডাকলাম। আর মনে মনে বলছিলাম, 'হে আল্লাহ! আমি তো সাঈদকে বিশ্বাস করতাম, তুমি তার এ সম্পর্কে আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করবে না।'
সাঈদ ইবনে আমিরের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীরা এসে পৌঁছলে আমি তাদেরকে বললাম, আমীরের বিরুদ্ধে তোমাদের কি কি অভিযোগ আছে? তারা বললো, পূর্বাহ্নের আগে তিনি বাইরে আসেন না। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বললেন, সাঈদ, এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি? সাঈদ ইবনে আমের (রাঃ) তখন মুহূর্তকাল নীরব থেকে বলতে লাগলেন। আল্লাহর কসম আমি এর কারণ প্রকাশ করতে দারুন লজ্জা পাচ্ছি। কিন্তু এখন তা ব্যক্ত করা ছাড়া কোন উপায় নেই। তবে শুনুন, আমার গৃহে কোন পরিচারক বা পরিচারিকা নেই। তাই প্রত্যহ সকালে নিজ হাতে আটা গুলি, খামিরা করি ও রুটি বানাই। তারপর অজু করে জনকল্যাণমূলক কাজে বের হই। আমি বললাম, তোমাদের আরো অভিযোগ আছে কি? তারা বললেন, আছে—তিনি রাতে আমাদের ডাকে সাড়া দেন না। আমি বললাম, সাঈদ, এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি? সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম এ বিষয়টিও আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। তা সত্ত্বেও বলছি, আমি দিনকে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য নির্ধারিত করেছি। আর রাতকে ইবাদতের জন্য নির্ধারিত করেছি। আমি বললামঃ তোমাদের আর কোনো অভিযোগ আছে কি?
তারা বললো; হ্যা, মাসে একদিন তিনি ঘর থেকে বের হন না। আমি বললাম, সাঈদ, এ ব্যাপারে তোমার বক্তব্য কি? সাঈদ ইবনে আমের (রাঃ) বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আমার এই পরিধেয় কাপড়টি ছাড়া অন্য কোন কাপড় নেই। তাই মাসে একবার তা ধৌত করি এবং শুকানোর অপেক্ষায় গৃহে অবস্থান করি। তারপর আমি বললাম, তোমাদের আর কোন অভিযোগ আছে কি? তারা বললো, হ্যা, মাঝে মধ্যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ফলে উপস্থিত জনসাধারণের কল্যাণ কর্ম ব্যাহত হয়। আমি বললাম, সাঈদ এর কারণ কি? তিনি বললেন, আমি মুশরিক অবস্থায় খুবাইব (রাঃ) এর মৃত্যুযাতনা ও তার শাহাদাত প্রত্যক্ষ করেছি। দেখেছি কোরাইশরা কি নির্মমভাবে তার দেহ থেকে একেকটি অংশ কেটে নিয়েছে। আর বলছে, তুমি কি চাও মুহাম্মদ তোমার স্থানে হবে আর তুমি নিরাপদে পরিজনের নিকট ফিরে যাবে? তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর কসম, মুহাম্মদের (সাঃ) পায়ে কাঁটা ফুটবে আর আমি নিরাপদে নির্বিঘ্নে পরিজনের মাঝে ফিরে যাবো, এটা কিছুতেই হতে পারে না। আল্লাহর কছম, আমি যখনই সে দিনের কথা চিন্তা করি তখন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়, কেন আমি তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলাম না। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না। একথা ভাবতেই আমি বেহুশ হয়ে পড়ি। নিঃসাড় হয়ে যায় আমার দেহ, আমার শিরা-উপশিরা।
তখন উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া আল্লাহর যিনি আমার ধারণাকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। তারপর উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) মদীনায় ফিরে এলেন এবং সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ)- এর নিকট এক হাজার দিনার পাঠালেন ।
স্ত্রী দিনারগুলো দেখে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ এবার আপনার খিদমত থেকে আমাদের বাঁচাবেন। আর দেরী নয়। কিছু খাবার কিনে আনুন, আর একজন গোলাম কিনে ফেলুন। সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, শোন, তুমি এর চেয়ে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় কোন বস্তু চাও কি? স্ত্রী বললেন, হ্যা তবে তা কি? সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, এ দিনারগুলো এমন এক মহান সত্ত্বার নিকট আমানত রাখবো, যিনি আমাদেরকে আমাদের তীব্র প্রয়োজনের মুহূর্তে ফিরিয়ে দিবেন। স্ত্রী বললেন, আচ্ছা তবে তা কিভাবে? সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) বললেন, আল্লাহকে ঋণ দেবো।
স্ত্রী আনন্দ ভরা কণ্ঠে বললেন বেশ, বেশ তাই করুন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম বিনিময় দিবেন।
সাঈদ ইবনে আমির (রাঃ) সে মজলিসে থাকতেই দিনারগুলো বিভিন্ন থলেতে ভাগ করে রাখলেন এবং একজনকে ডেকে বললেন, এ থলেটি ঐ বিধবাকে দিয়ে এসো। এ থলেটি ঐ এতিমদের দিয়ে এসো। এ থলেটি ঐ মিসকীনকে দিয়ে এসো। এভাবে বন্টন করে সব নিঃশেষ করে ফেললেন।
আল্লাহ সাঈদ ইবনে আমিরের প্রতি রহম করুন এবং আমাদেরকে তার মত জীবন পরিচালনায় তৌফিক দান করুন।