JustPaste.it

ইনসাফের আদালতে

 

ইসলামে নিবেদিত নিপিড়ীত মানুষের ফরিয়াদ

কাজী হাসসান

==================================================

 

        আধুনিক বিশ্বের বিশাল এক সংগঠন হল রাষ্ট্র। মানুষের সমাজবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনের প্রয়োজনে এই সংগঠনের উদ্ভব। রাষ্ট্র নামক সংগঠনটিকে যারা পচিালনা করেন। তাদের সরকার বলা হয়। কোন দেশের সকল মানুষের পক্ষে সরকার পরিচালনায় অংশ গ্রহণ করা সম্ভব নয় যদিও এ অধিকার সকলের আছে। তাই রাষ্ট্রের নাগরিকগণ কিছু সংখ্যক লোককে এই দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। আর এই দায়িত্ব প্রাপ্ত লোকগণকে নিয়েই গঠিত হয় সরকার। এই সরকারের সদস্যরা দেশের মালিক বা রাষ্ট্রপ্রভু নন। তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি সেবক মাত্র! দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অভাব পূরণ, সামাজিক সমস্যা সমাধান, জীবনের নিরাপত্তা বিধান, তাদের মৌলিক অধিকার পুরণ ও রক্ষা করা অর্থাৎ জনকল্যাণ সাধনই এই সরকার গঠনের মূল উদ্দেশ্য।

 

        সরকারের সদস্যরা জনগণেরই একটা অংশ। তাই এৱা জনগণের সুখ-দুঃখেরও সম-অংশীদার। দেশের মানুষ যদি অনাহারে কষ্ট পায় তবে তারাও অনাহারী থাকবে। দেশের মানুষের যদি বস্ত্র না থাকে তবে তাদেরও বস্ত্রের অভাব ভোগ করতে হবে। মোটকথা, রাষ্ট্রের জনগণের অপেক্ষা সরকারের সদস্যরা কখনই অধিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকারী নয়। যদি রাষ্ট্রের জনগণ ক্ষুধার্থ থাকে, বস্ত্রের অভাবে, ঔষধের অভাবে, বাসস্থানের অভাবে কষ্ট পায়, অপরদিকে শাসক শ্রেণী একই সময়ে প্রসাদোপম অট্টালিকায় বাস করে, ভুরি ভোজনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে, চিকিৎসার জন্য অত্যাধুনিক ও ব্যয়বহুল ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে তা নিশ্চয়ই জুলুমের নামান্তর। এমন শাসক শ্রেণী জনগণের দেয়া দায়িত্বের খেয়ানতকারী ও জালিম বই কি?

 

        আমাদের এই বাংলাদেশের বয়স বাইশ পার হয়ে তেইশে পড়েছে। জনগণ তাদের ভগ্যন্নোয়নের জন্য অনেক সেবক তথা সরকারও নিযুক্ত করেছে। কিন্তু হয়েছে কি ভাগ্যের উন্নতি? সরকার নিয়োগের মুল উদ্দেশ্যটি একটি বারের মতোও কি বাস্তবায়িত হয়েছে? জনগণের প্রতিনিধিরা কি কখনো জনগণের সুখ দুঃখের সম-ভাগীদার হয়েছে? এ প্রশ্নের সমাধান সম্মানিত পাঠকগণের ওপর ন্যাস্ত করলাম।

 

        দীর্ঘ বাইশ বছর শেষে এই ১৯৯৩ সালে দেশে বেকার জনসংখ্যার পরিমাণ দাড়িয়েছে ৩০% অর্থাৎ তিন কোটি ষাট লক্ষ। ভাসমান ও গৃহহীন জনসংখ্যা হল ৬ লক্ষের কিছু বেশী। কম করে হলেও ১০ লক্ষ ভিক্ষুক, অঙ্গহীন, কর্মক্ষমতাহীন-প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। পেটের জ্বালায় ঘৃণ্য পতিতাবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে ৫ লাখ নারী। এ সমস্ত অসহায়, বেকার, কর্মক্ষমতাহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। সকলের জন্য শিক্ষা, সার্বজনীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, সকলের জন্য বাসস্থান, সকলের জন্য ডাল-ভাত সংস্থান করার ওয়াদা দিয়ে দফার পর দফা পেশ করে বহু সরকার ক্ষমতায় এসেছে। অন্য দিকে এসব মানুষের দফা রফাই ঘটেছে ক্রমান্বয়ে। শাসক শ্রেণী একদিকে এসব গাল ভরা বুলি আওড়িয়েছে অন্যদিকে বার্ষিক জমা-খরচের হিসেব তথা বাজেটে এসব মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে।

 

        চলতি বছরের বাজেটের কথাই ধরা যাক। অন্যান্য বছরের বাজেটের ন্যায় এ বাজেটেও দেশের বেকারদের ভাতা প্রদান বা নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, ভিক্ষুক, কর্ম ক্ষমতাহীন, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, ঋণগ্রস্থ, এতিমদের লালন-পালন এবং অভাবগ্রস্থদের সাহায্য করার জন্য আলাদা কোন বরাদ্ধ নেই। অথচ এরাও রাষ্ট্রের নাগরিক। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, তাদের এই মৌলিক অধিকার ও পাওনা পরিশোধ করার দায়িত্ব সরকারেরই। অভাব পূরণের জন্যই এরা সরকার নির্বাচন করে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যাদের কল্যাণের জন্যই সরকার, সেই সরকার এসব হতভাগাদের দুঃখের কথা ইচ্ছে করেই ভুলে যায়। নিজেদের ইচ্ছেমত দেশ শাসন ও বিচার করার আইন এবং সংবিধান রচনা করে এর সেই সংবিধানের প্রথমেই নিজেদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধার কথা লিখে নিয়েছে। হ্যা, বাংলাদেশের সংবিধানের কথাই বলছি। এই সংবিধানের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, ফুলমন্ত্রী, হাফমন্ত্রী, সিকি মন্ত্রী, সচিব, আমলাদের দায়িত্ব, অধিকার ও সুযোগ সুবিধার কথা বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যায় রয়েছে তাদের বেতন, ভাতা, চিকিৎসা ও ঐচ্ছিক অনুদানের পরিমাণের বিবরণ। অর্থাৎ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান চিকিৎসার অভাবে হাজারো, কষ্ট ভোগ করলেও এ সমস্ত পদাধিকারী ব্যক্তিগণ যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন জাতীয় সমস্যার তোয়াক্কা না করেই ততদিন গাড়ি-বাড়ি, চাকর, ড্রাইভার, বেতন, ভাতা অনুদান প্রভৃতি সুবিধা পেয়েই যাবেন। যতই দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থাক মাস শেষে বেতন / ভাতা তাদের খাড়া।

 

        তারা যে এর কিছুই পাবেন না তা নয়। তাদেরও জীবিকা অর্জনের তাগিদে আর্থিক সুবিধার প্রয়োজন আছে। তবে তারও একটা সীমা থাকা চাই। সরকারের সদস্যগণ জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের পর একজন নাগরিকের ভাগে যা পড়ে তাই ভোগ করতে পারেন, এর বেশী নয়। জনগণকে ভুখা-নাঙ্গা রেখে নিজেদের উদর ভর্তি আর মূল্যবান বসনে আবৃত করার অধিকার কোন শাসকের নেই। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে জাতীয় সম্পদের সুষম বন্টন করে দেয়ার পর তারা যদি ডাল-ভাত খায়, তবে শাসক শ্ৰেণীও ডাল-ভাত খাবে। সাধারণ মানুষের যদি গাড়িতে চড়ার সামর্থ থাকে তবেই সরকারের সদস্যরা গাড়িতে চড়তে পারেন। প্রতিটি নাগরিকের বাসস্থান সমস্যা সমাধান করে দিয়ে তবেই তারা সরকারী বাড়ি করতে পারেন। এটাই জন-কল্যাণকামী সরকারের বৈশিষ্ট্য, এটাই ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এর বিপরীত ব্যবস্থাকে কখনো জন-কল্যাণকামী বা ইনসাফ ভিত্তিক সরকার বলা যায় না।

 

        অথচ এই দেশে তাই ঘটছে। কৃষক রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শস্য উৎপাদন করে, শ্রমিক হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করে পণ্য উৎপাদন করে আবার তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন উপায়ে ট্যাক্স আদায় করে সরকারের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। অর্থনীতির মূল চালিকা এই কৃষক-শ্রমিকের অধিকাংশ নিয়মিত খেতে পায় না, লজ্জা নিবারণের কাপড় সংগ্রহ করতে পারে না, চিকিৎসার ঔষধ নেই, কারখানায় যাওয়ার পরিবহন সুযোগ নেই, কিন্তু তাদের নিকট থেকে আদায়কৃত অর্থে বিলাসী জীবন যাপন করে শাসক শ্রেণী। অথচ শ্রমিক-কৃষক সরবারকে ট্যাক্স দেয় এর বিনিময়ে তাদের ভাগ্য উন্নয়ন ও মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়ার প্রত্যাশায়। কিন্তু তাদের সেই মৌলিক অধিকার দ্বীধাহীন চিত্তে এড়িয়ে যাওয়া হয়। কখনো বা দারিদ্র এবং দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থার দোহাইও দেয়া হয়। এই একই ব্যক্তিবর্গ আবার সংবিধান, সংসদকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে দরিদ্র, অবহেলিত জনগণের মূল্যবান অর্থ অপচয় করে। শুল্ক মুক্ত গাড়ি, শিতাতপ নিয়ন্ত্রিত মূল্যবান আসবাবপত্র সজ্জিত বাসগৃহ ও অফিসসমূহ ব্যবহার করে থাকে। এভাবে সুকৌশলে সংবিধান ও সংসদকে শাসক শ্ৰেণী নিজেদের সুযোগ সুবিধা ও বিলাসী জীবন যাপনের হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছে। আর্থিক ও জীবন ধারণের সর্বাধুনিক সুযোগ সুবিধা হচ্ছে বর্তমান শাসক গোষ্ঠীর ব্যক্তিত্বের মাপকাঠি। যে যতবড় সরকারী কর্মকর্তা তার তত বড় বাড়ি, তত দামী গাড়ি, অফিস, তত বেশী সংখ্যক চাকর-বাকর থাকা চাই। এভাবে জনগণের অর্থ লুটপাট করে বিলাসবহুল জীবন যাপন করার সুবিধা যে সংবিধানে আইন বানিয়ে আদায় করে নেয়া হয়েছে তাকে মহা-পবিত্র সংবিধান আখ্যা দেয়া হয়েছে। আর "বিসমিল্লাহ……রাহিম” বলেই  উদ্ধোধন করা হয়েছে এই লুটপাটের সংবিধান।

 

        এই সংবিধান যতদিন অক্ষত থাকবে আর বৃটিশ উপনিবেশিক লুটেরা ডাকাতদের প্রণীত আইন কানুন দ্বারা দেশ শাসিত হবে ততোদিনে এদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি নেই। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যতই নিত্য নতুন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসুক না কেন লুটপাটের এ ধারাই অব্যাহত থাকবে। কেননা, এই সংবিধানের শুরুতেই তাদের জনগণের সম্পদ যথেচ্ছা অপব্যয় করার সুযোগ দিয়ে রেখেছে। কিন্তু বেকার অসহায়দের বেঁচে থাকার জন্য কোন ব্যবস্থা রাখেনি। এ ব্যবস্থায় জাতীয় সম্পদের সিংহভাগই প্রশাসনের কর্মকর্তাদের লালন-পালনে ব্যয় হয়। সুতরাং সীমিত সম্পদের বাকী ক্ষুদ্র অংশ দ্বারা বৃহৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন দুরাশাই হয়ে থাকবে। কোন রাজনৈতিক দলের নেতা বা সদস্যদের পৈত্রিক বিশাল সম্পদ রাজি নেই যা দ্বারা এই বিধি-বিধানের আওতায় ক্ষমতায় গিয়ে জনগণের চেহারা সোনা-রুপো দিয়ে মুড়িয়ে দেবে। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনীতি নিয়ে যারা রাজনীতি করে তাদের বাজেটই হল জনগণ থেকে ট্যাক্স আদায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর হ্রাস, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি। কবে এই বাড়ানো কমানো ভেল্কি খেলার মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আদায় করে প্রশাসন পরিচালনাই হল বাজেটের মূল উদ্দেশ্য জনকল্যাণ নয়। এই কর বাড়া-কমার ফলে হয়ত জনগণ একটাকা কম দামে চাল কিনবে, কিন্তু কাপড় কিনতে হবে পাঁচ টাকা বেশী দামে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি সেই একই তিমীরেই থমকে থাকছে। দরিদ্র, কর্মক্ষমতাহীন, মিসকীন, এতিম ও ফকিরদের কথাতো বাদ। তারা যেহেতু কর প্রদান করতে অক্ষম সেজন্যই বোধ হয় তাদের রাষ্ট্রের জন্ম লগ্ন থেকেই অবাঞ্চিত নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যতদিন দেশের সিংহভাগ এই অবাঞ্চিত বিবেচিত মানুষের উন্নতির চিন্তা না করা হবে ততদিন দেশের উন্নতির কামনা করাও স্বপ্ন হয়েই থাকবে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ এক হয়েও যদি বাজেট পেশ করে তবুও দেশের অবস্থা তথৈবচ হতে বাধ্য।

 

        ক্ষমতার মসনদে বসে যারা এদেশ গরীব বলে সাধারণ মানুষকে প্রবোধ দিয়ে তাদের পাওনা সম্পর্কে অচেতন রাখতে চায় তারা আসলে এক নম্বর প্রতারক, ক্রিমিনাল। কেউ কি কখনো শুনেছে যে, এদেশ গরীব তাই অমুক মন্ত্রী না খেয়ে মরেছে, অমুক প্রেসিডেন্টের কাপড় কেনার টাকা ছিল না, চটের বস্তা পড়ে অফিস করেছে, কোন আমলা চিকিৎসার অভাবে অমুক সচিব মরে গেছে? এদেশ যদি গরীবই হবে তবে স্বাধীনতার পরে এক হাজার কোটিপতির জন্ম হল কি করে? এরা কি মাটি খুঁড়ে গজিয়েছে?

 

        মূলতঃ আমাদের এদেশ মোটেই গরীব, নয়। এদেশে যে সম্পদ আছে তা দিয়ে আমরা ভাল ভাবেই খেয়ে পরে বাঁচতে পারি। আমাদের দেশে প্রতি বছর কম করে হলেও দশ হাজার কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব। এ টাকা সঠিক ভাবে ব্যয় হলে ৪/৫ বছরের মধ্যেই এদেশের বেকার, শ্রমজীবি ও রুজিহীন-মজুর শ্রমিক, কর্মক্ষমতাহীন বা পঙ্গু ও ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিদের সমস্যা দূর করে দেশকে স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে গড়ে তোলা সম্ভব।

 

        বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক সাড়ে চারকোটি বেকার, অসহায়, ঋণগ্রস্থ, ফকির এতিম ও প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছে। ধরা যাক, প্রতিবছর এই দশ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় ১ কোটি মানুষকে ঋণ প্রদান, কারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থান, ব্যবসার মূলধন প্রদান ও বার্ষিক ভাতার ব্যবস্থা প্রভৃতির মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা করে দেয়া হল। এভাবে ৪/৫ বছর পরে দেশে অভাবী মানুষের কোন চিহ্ন পাওয়া যাবে কি? ইসলামী রাষ্ট্র একটি সত্যিকার কল্যাণ ও ইনসাফ ভিত্তিক রাষ্ট্র হবে, বলে ইসলাম সমাজের দুস্থ ও গরীবদের আর্থিক সমস্যা দূর করার জন্যই এই যাকাত বিধান প্রণয়ন করেছে। আর এই অর্থ ব্যয়ের জন্য ফকির, মিসকিন, দুস্থ, পঙ্গু, এতিম, ঋণগ্রস্তসহ মোট আটটি খাতকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই আল কুরআনে বিশ স্থানে নামাজ কায়েমের সাথে সাথে যাকাত আদায়েরও কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাকাতের অর্থ-ধনীদের কাছে গরীবদের একটা ন্যায্য পাওনা। এটা ধনীদের অনুগ্রহ বা দান নয়। ধনীরা এ পাওনা শোধ না করলে সরকারের দায়িত্ব তা আদায় করে গরীবদের বন্টন করে দেয়া।

 

        কিন্তু বৃটিশ আইনের অনুসারীরা ইসলাম অপেক্ষা বৃটিশ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করায় এদেশের গরীবের ভোগান্তি বেড়েই চলছে। যাকাত আদায় ও বন্টনে সরকার যথাযথ দায়িত্ব পালন না করায় এবং যাকাত প্রদানকারীদের সরকারের প্রতি আস্থা না থাকায় গরীব তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয়ে অনাহারে, বস্ত্রাভাবে পথে-ঘাটে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের পাওনা অর্থ দিয়ে ধনীরা বাড়ি বানাচ্ছে, গাড়ি কিনছে। বিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবে থাকছে তারা। যাকাত খাতের কোটি কোটি টাকা অনাদায়ী থাকায় তা ধনীদের হাতে থেকে তাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ক্রমশ স্ফিত করছে, বিলাসী বিদেশ ভ্রমণ ও মার্কেটিংয়ে ব্যয় হচ্ছে। জনগনের কল্যাণ করার নাম করে যারা ক্ষমতায় গেলো তারা যাকাত আদায় করে তাদের অভাব পূরণতো করছেই না, উপরন্তু জাতীয় সম্পদ বন্টন ব্যবস্থা থেকেও তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। এদের বাঁচার অধিকার, বাস করার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। রাজপথে ভুখা-নাঙ্গা অসহায় মৃত্যুই এদের পরিণতি হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

 

        তাদের এই অসহায় অবস্থা, করুণ পরিণতি প্রাকৃতিক বা আল্লাহর সৃষ্টি নয়। এটা কৃত্রিম, মানুষের সৃষ্টি। এর জন্য দায়ী সমাজের অর্থ লিপ্সু ধনীরা ও স্বার্থপর শাসকগোষ্ঠী। ধনীরা এদের পাওনা মেরে দিয়েছে — শোধ করেনি, অন্যদিকে সরকার পূজিবাদের ফাঁস গলায় পড়ে বিশ্ব ব্যাংক ও বিদেশী এনজিওদের পরামর্শ অনুযায়ী এই ধনীদেরই তোষণকারী বাজেট করছে। এ বাজেটে গরীবের জীবিকার কোন ব্যবস্থা নেই। এটা না করলে নাকি বিদেশী সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাই জাতিকে আজীবন ভিক্ষুক মানসিকতা সম্পন্ন করে রাখার জন্য একদিকে দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়াচ্ছে অন্যদিকে দেশকে পরনির্ভরশীল করে গড়ে তুলছে।

 

        পূর্বেই বলেছি, এদেশ গরীব নয় এবং বর্তমানে দেশে যে সমস্ত মানুষ দুস্থ ও গরীব রয়েছে তাও প্রাকৃতিক নয়, মানুষের সৃষ্টি। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্ব ব্যাঙ্ক, ধনীদেশ বা এনজিওদের কাছে ভিক্ষা চাওয়ারও কোন প্রয়োজন নেই। এর জন্য চাই জন-কল্যাণকামী সরকার, ইসলামী আদর্শের অনুসরণ, সৎ ও বিবেকবান নেতৃত্ব। দেশের জনগণ শাসকের চরিত্রে রঙিন হয়। শাসক যদি ন্যায়পরায়ন হয়, তবে জনগণও ন্যায়পরায়ন, সৎ ও ভালো হতে বাধ্য। পক্ষান্তরে শাসক যদি খারাপ চরিত্রের জালিম হয়, তবে জনগণও অসৎ ও উশৃঙ্খল হবে। এটাই বাস্তব সত্য। শাসক যদি জনগণের কল্যাণ চিন্তা করে তবেই জনগণের কল্যাণ হবে, নতুবা নয়।

 

*****