আল্লাহর সাহায্য আমি স্বচক্ষে দেখেছি
কমান্ডার আমজাদ বেলাল
===========================================================
ভারতের স্বাধীনতার দিবস ১৫ই আগস্ট । ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে সেদিন উদযাপিত হয় কলাে দিবস। চোখে পড়ে সর্বত্র কালাে পতাকা! লােকজন কালাে পােশাক পরে রাস্তায় নামে। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সরকারী অনুষ্ঠান ছাড়া কোন আনন্দ-উৎসব কাশ্মিরে উদযাপিত হয় না। ১৫ই আগস্টের পরিবর্তে কাশ্মিরী জনসাধারণ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ই আগস্ট- এ উৎসব পালন করে। ১৪ই আগস্ট সকাল থেকেই আনন্দ-উৎসব শুরু হয়। যুবক-বৃদ্ধকিশােররা পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা বুকে জড়িয়ে রাস্তায় নামে। প্রতিটি ঘরে আজাদীর প্রতীক চাঁদ তারা খচিত সবুজ ঝান্ডা শােভা পায়। রাস্তার মােড়ে মােড়ে সবুজ ব্যানারে স্বাধীনতার দাবী ও ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও শাহাদাদের অমর বাণী লিখে টানানাে হয়।
১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। ১৫ই আগস্ট ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণার দিবস। ১৬ই আগস্ট খান ইয়ারের শহীদ দিবস। ১৭ই আগস্ট জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যু দিবস এবং ১৮ই আগস্ট শহীদ মীর ফয়েজ মৌলভী ফারুকের স্মরণ দিবস পরপর পালিত হয়। এই পাঁচদিন সমগ্র কাশ্মিরে দখলদার সৈন্যরা সতর্ক অবস্থায় টহল দেয়। মুজাহিদরা নানা কৌশলে জনগণকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করে এবং প্রতিরােধের নিত্য নতুন কৌশল আবিস্কার করে।
এবছরও প্রতি বছরের ন্যায় ১৪ই আগস্ট অত্যন্ত শান-সওকতের সাথে পালন করা হয়। প্রতিটি ঘরে সবুজ ঝান্ডা উড়ানাে হয়। প্রত্যেক মােড়ে সবুজ ব্যানার শােভা পায়। তাতে ভারত বিরােধী নানা শ্লোগান লিখিত হয়। আমি একটি দ্বিতলা বাড়ীর জানালা দিয়ে এই দৃশ্য দেখছিলাম। আমাদের ঘর থেকে পনেরাে ষােলটা ঘর পরে একটি ব্যানার টানানাে ছিল। তাতে পাকিস্তানের পক্ষে ও ভারতের বিরুদ্ধে দু’টি শ্লোগান লেখা ছিল। ব্যানারের এক পাশের রশি ছিড়ে ব্যানারটি রাস্তার উপর ঝুলতে ছিল। ইসহাক নামক এক মুজাহিদ সেটাকে উপরে তুলে পুনরায় বাঁধতে ছিলাে। এমন সময় একটি সাজোয়া গাড়ী চলে আসে। গাড়ী থেকে সৈন্যরা রশি হেলতে দেখে উপরে তাকায়। ইসহাক তখনও খুটির ওপর। তারা তাকে নিচে নামিয়ে রাস্তায় দাড় করিয়ে গুলী করে। তাকে হত্যা করেই সৈন্যরা থামেনি। তার দেহ থেকে মাথা কেটে আলাদা করে সামনে অগ্রসর হয়। কিছুদূর অগ্রসর হলে জামার উপর পাকিস্তানী পতাকার ব্যাজ আটা দু'জন মুজাহিদ তাদের সামনে পড়ে। সৈন্যরা নির্বিচারে তাদের ওপর গুলী চালায়। সাথে সাথে মুজাহিদদ্বয় রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। সাজোয়া গাড়ী আরাে অগ্রসর হয়ে আমাদের বাড়ীর সম্মুখে এসে দাড়ায়। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। এপাশ দিয়ে গুলী চালাতেই ওপাশ দিয়ে অন্য মুজাহিদরা ওদের ওপর গুলী ছােড়ে। চার ঘন্টা ব্যাপী লড়াই চলার পর অপর পাশের মুজাহিদদের গুলী ফুড়িয়ে যায়। সেই সুযােগে বেঁচে যাওয়া সৈন্যরা পালিয়ে যায়। এই লড়াইয়ে চারজন মুজাহিদ শহীদ হয়। অপর পক্ষে সতেরােজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
ক্রেক ডাউন
ক্রেক ডাউনের নাম শুনতেই ভয়ে আশংকায় শরীরের সবগুলাে লােম দাড়িয়ে যায়। ক্রেক ডাউনের নাম শুনতেই হৃদয় পটে এমন ভয়াবহ এক চিত্র ভেসে উঠে যা সুস্থ্য মানুষও কল্পনা করলে অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। ক্রেক ডাউনের নামে ওদের পাশবিকতা ও নির্মম অত্যাচারের কথা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। এই সময় নওজোয়ানদের ঘর থেকে বের করা হয়। বৃদ্ধ দুর্বল ও কমজোর লােকদের টেনে হিচড়ে বাইরে আনা হয়। বাচ্চারা ওদের বুটের তলায় পিষ্ট হয়। হায়েনার মত মহিলাদের ইজ্জত লুটে খায়। পিশাচদের নখরাঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় তাদের শরীর ও হৃদয়। তিন দিন পর্যন্ত খােলা আকাশের নিচে ক্ষুধা ও পিপাসা নিয়ে পরিচয় ও তল্লাশি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের অবস্থান করতে হয়। হাত পা অবশ হয়ে যায়। কোন এলাকায় মুজাহিদ আছে বলে সন্দেহ হলেই তারা সেখানে ক্রেক ডাউন বসায়। গভীর রাতে সমগ্র এলাকা সৈন্যরা ঘিরে ফেলে।
এর পর প্রতি দশ মিটার অন্তর দুজন সৈন্য বন্দুক উঁচিয়ে দাড়িয়ে থাকে। ভােরের আলাে ফোটার সাথে সাথে মাইক দিয়ে ঘােষণা করা হয়, এই এলাকায় ক্রেক ডাউন বসান হয়েছে। অতএব সকল জনসাধারণ নিজ নিজ ঘর থেকে বের হয়ে অমুক মাঠে ‘সক্তি প্যারেডের” জন্য যেন একত্রিত হয়। এলাকার সকল পুরুষ, মহিলা ও শিশুরা সে মাঠে একত্রিত হয়। এর পর সৈন্যরা ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালায়। যদি কোন ঘরে কাউকে লুকানাে পাওয়া যায় তবে তাকে সাথে সাথে গুলী করে হত্যা করে। এই সময় ঘরের মূল্যবান জিনিস পত্র সৈন্যরা হাতিয়ে নেয়। সব বাড়ী-ঘরের তল্লাশী শেষ হলে নির্দিষ্ট মাঠে অপেক্ষারত লােকজনের "সক্তি প্যারেড” শুরু হয়। বয়স অনুযায়ী তাদেরকে বিভিন্ন লাইনে দাড় করিয়ে পরিচয় পর্ব শুরু হয়। সকলকে সর্বপ্রথম প্রমাণ করতে হয় যে, সে কাশ্মিরী কিনা। এরপর একটি গাড়ীতে বসা সরকারী গুপ্তচর বাহিনীর সামনে এক এক করে সবাইকে হাজির করা হয়। যদি গুপ্তচররা কোন ব্যক্তিকে মুজাহিদ বলে সন্দেহ করে তবে গাড়ীর হর্ণ বেজে উঠে। অথবা সৈন্যদেরকে ইশারায় বিষয়টা জানিয়ে দেয়া হয়। যাদের প্রতি সন্দেহ না হয় তাদেরকে চলে যেতে বলা হয়। দেহ তল্লাশী সহ সকলকে নানা ধরণের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এ সময় ভারতীয় সৈন্যরা বিনা প্ররােচনায় অশ্রাব্য ভাষায় গালী গালাজ করে।
১৮ই আগস্ট সন্ধ্যায় আমার অবস্থান থেকে বের হয়ে, শ্রীনগরে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত দোওয়ার মাহফিলে অংশ গ্রহণ করি। দোয়ার মাহফিলের পর মসজিদে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নদী পার হয়ে অপর পারে যাওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। আমার মেজবান এসময় নদী পারি দিতে বারণ করলেন। রাতের বেলা নদীতে কোন নৌকা চলাচলের শব্দ পেলে সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি ছােড়ে। সাতার না জানায় এবং পুল দিয়ে অপর পারে যাওয়া নিরাপদ নয় ভেবে সে রাতের জন্য এপারেই থেকে গেলাম। রাত কাটিয়ে ভাের হতেই সৈন্যরা ক্রেক ডাউন দিয়ে সুপ্রভাত জানালো। নিরুপায় হয়ে আমিও সক্তি প্যারেডের জন্য নির্ধারিত স্থানে পৌছে যােয়ানদের লাইনে বসে পড়লাম। পার্শ্ববর্তী বৃদ্ধদের লাইন থেকে এক বৃদ্ধ অবিরাম চিৎকার করতে ছিলঃ “আমার পেটে ব্যথা করছে, আমাকে ঘরে নিয়ে চলাে।” এক সৈন্য এসে তার পেটে সজোরে লাথি মেরে বল্লো, "হারামজাদা, কমবখত, চুপ করে বস।” বৃদ্ধের পেটে সত্যি সত্যিই প্রচণ্ড ব্যথা করছিল। তার পক্ষে লাথি খেয়েও চুপ থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। সে পুনরায় কাতরাতে লাগলাে। এবার এক ক্যাপ্টেন এসে জিজ্ঞাসা করলাে, 'বাবাজী কি হয়েছে? বৃদ্ধ এবার তার পেটের ব্যাথার কথা খুলে বললাে।
ক্যাপ্টেন জওয়ানদের লাইনে দৃষ্টি বুলালো। সাত নাম্বারে আমি বসা ছিলাম। আমার উপর তার দৃষ্টি স্থির হওয়ায় আমার হৃদপিণ্ড দ্রুত হয়। সে আমাকে উঠে দাড়াতে ইশারা করে বললােঃ “তােমাকে শরীফ আদমী বলে মনে হয়, কোথা থেকে এসেছে? কি কাজ করাে? আচ্ছা মেডিকেল ষ্টোর চিননা”? “জি হ্যা, আমাদেরই একটা আছে।” “এই বাবাজীকে নিয়ে যাও! ঔষধ খাওয়াবে,তাড়াতাড়ি নিয়ে আসাে। তােমার পরিচয় নিতে হবে।” আমার হৃদয়ে আশার আলাে জ্বলে ওঠলাে। আচ্ছা দাড়াও তােমার সমাক্তি পর্ব আগে হয়ে যাক। এবার আমার পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যাচ্ছিল। এদিকে বাবাজী সমানে কাতরাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন সেই দিকে তাকিয়ে বললাে, এতে তাে অনেক সময় লাগবে। যাও তাড়াতাড়ি ঔষধ নিয়ে ফিরে আস। এবার আমি উঠে বাবাজীকে নিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হলাম। মনের গভীর থেকে বাবাজীর জন্য দোওয়া করলাম, আল্লাহ তােমার মঙ্গল করুণ। বাবাও আমার জন্য দোয়া করলেন। আল্লাহ তােমারও মঙ্গল করুন। আমি আবার বললাম, আল্লাহ তােমাকে সুস্থ্য করুন। আমার এবারের কথায় বৃদ্ধের সন্দেহ জেগে উঠে। সে বলে, “তােমাকে আমার সন্দেহ হয়। আমি বল্লাম এ আবার কোন বিপদ। তাড়াতাড়ি কথা পাল্টিয়ে বললাম, বাবাজী তাড়াতাড়ি চল। ফিরে এসে সক্তি প্যারেডে অংশ নিতে হবে। পিছন থেকে দু’জন সিপাই দৌড়ে এসে বললাে, "তাড়াতাড়ি করাে।' আমি বললাম বাবাজী চলতে পারছে না। বড় কষ্টে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। “আচ্ছা জলদী কর”। এই বলে তারা সিগারেট টানতে থাকে।
মেডিকেল ষ্টোরে পৌঁছলাম। ষ্টোরের মালিক আমাকে পূর্বেই চিনতাে। সে অবাক বিস্ময়ে বললােঃ আমজাদ, তুমি এখানে! বললাম হ্যা দোস্ত, জলদী পালাবার কোন ব্যবস্থা করাে। সে মেডিকেলে বসা এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললাে, "পােষাক বদলী করে এই বাবাজীর জামা টুপি পড়ে নাও। আমি নিজের জামা কাপড় রেখে বৃদ্ধের মাটিয়া রংয়ের জামা ও পুরান ফ্যাশনের উঁচু টুপি মাথায় দিয়ে হাতে আগুন হেঁকার গরম অঙ্গারের ছােট ঝুড়ি নিয়ে মাথা নিচু করে মেডিকেল ষ্টোর থেকে বের হয়ে পড়লাম। সৈন্যরা আলাপ আলােচনায় ব্যস্ত ছিল, দূর থেকে ওরা আমাকে ঠিক করতে পারেনি। তারা মাঝে মধ্যে দোকানের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করছিলাে। আমি গলীর মুখে অগ্রসর হয়ে অঙ্গারের ঝুড়ি ছুড়ে ফেলে দৌড় দিলাম। এবার শাের গােল পড়ে যায়। সৈন্যরা আমাকে ধরার জন্য দৌড়ে গলীর মুখে চলে আসে। ততক্ষণে আমি একটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে তার একটি ছিদ্র দিয়ে শক্তি প্যারেড দেখতে ছিলাম। তখন সক্তি প্যারেড শেষ হয়ে যাওয়ায় সৈন্যরা দ্বিতীয়বার খানা তল্লাশীতে আসেনি। পরে শুনলাম, সৈন্যরা আমার সম্পর্কে সেই বাবাজী ও মেডিকেল ষ্টোরের মালিকের কাছে জিজ্ঞাসা করেছে। তারা বলেছে, এখানে দাড়ানাে ছিল, কোন দিকে গিয়েছে। আমরা লক্ষ্য করিনি। অসুস্থ বাবাজী সৈন্যদের সামনে আমাকে কশিয়ে গালী গালাজ করে, সৈন্যরাও গালী দিতে দিতে সক্তি প্যারেডের মাঠে ফিরে যায়। এই ভাবে বৃদ্ধের পেটের ব্যথা আমার জন্য আবে-হায়াত হয়ে দাড়ায়। আমি জীবনে রক্ষা পাই।
ক্রেক ডাউনের এলাকার মুজাহিদরা এক গােপন মিটিংয়ে মিলিত হয়ে এই এলাকা দিয়ে আপাতত সৈন্যদের ওপর কোন আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি প্রস্তাব দিলাম, যদি এখান থেকে আক্রমণ নাও করা হয় তবুও পাহারার ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে সৈন্যরা যখন তখন ঘরে ঘরে তল্লাশী নিয়ে মুজাহিদের গ্রেফতার করার সুযােগ না পায়। আমার প্রস্তাব সকলে মেনে নিয়ে আমার ওপরই এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করে। আমি প্রত্যেক গ্রুপ থেকে দশজন মুজাহিদ নিয়ে সকল রাস্তার মুখে পাহারার ব্যবস্থা করি। প্রত্যেক গ্রুপের পাহারার স্থান ও সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এক গ্রুপের পর অপর গ্রুপ পালাক্রমে পাহারার দায়িত্ব পালন করে। এভাবে এই এলাকায় এই প্রথম পাহারার নিয়ম চালু হয়। যার ফলে সৈন্যরা এখানে প্রবেশ করতে ভয় পায়। তারা প্রবেশ করার চেষ্টা করলেই মুজাহিদরা গুলি ছােড়ে। সৈন্যরা গুলির শব্দ পেলেই এলাকা ত্যাগ করে চলে যায়। এর কিছুদিন পর আমার ট্রেনিং সেন্টারে যাওয়ার প্রয়ােজন হলে অন্য এক সহযােগীকে পাহারার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণ করে শ্রীনগর থেকে চলে আসি। আমাদের নিজস্ব তৈরী আমার রিমােট কন্ট্রোলে যান্ত্রিক গােলযােগ দেখা দেয়। আমি তা ঠিক করার জন্য শহরের এক মেকারের কাছে নিয়ে গেলাম। আমাদের নিজ হাতে তৈরী রিমােট কন্ট্রোল মেকারের বুঝে আসছিল না।
তাকে বুঝাতে বুঝাতে রাত এগারটা বেজে যায়। ঐ দিন এক গ্রুপ মুজাহিদ শহরের এক মিলিটারি পােষ্টের ওপর আক্রমণ করে। যার প্রতিশোধ নিতে সৈন্যরা ঐ রাতেই ক্রেক ডাউন ঘোষণা করে। যে স্থান দিয়ে মুজাহিদরা আক্রমণ করে তার নিকটেই একটি বসত বাড়ি ছিল। সেই বাড়ীর এক জোয়ান ছেলে দিল্লীতে ব্যবসা করতাে। ঘটনাক্রমে সে ঐদিনই দিল্লী থেকে বাড়ীতে এসেছে। সৈন্যরা তার ঘরে গিয়ে দরজার কড়া নাড়ে। কোন প্রতিবেশী দেখা করাতে এসেছে ভেবে বড় ভাই উঠে দরজা খুলে দেয়। আর সাথে সাথে ক্রুদ্ধ সৈন্যরা তার ওপর ব্রাশ ফায়ার চালায়। ছােট ভাই গুলীর শব্দ শুনে দৌতে আসে। এসে বড় ভাইর রক্তাক্ত দেহের ওপর লুটিয়ে পড়ে। নিহত ভাইর জন্য চোখের অশ্রু ঝরাবার পূর্বেই আরেকটি ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শােনা যায়। এক ভাইরের বুকে আর এক ভাই পড়ে গলাগলি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। হিংস্র হায়েনারা হাসি আনন্দে ভরপুর।
একটি সংসারের সবকিছু লুটে নেয়ার পড়ও ওদের তৃপ্তি নেই। প্রতিহিংসা নিবৃত্ত করার জন্য রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়া এক নিরীহ বৃদ্ধকে গুলীর নিশানা বানায়। আরও সামনে অগ্রসর হয়ে দেখে, এক মহিলা সন্তান কোলে নিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে কিনারা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। রক্ত পিপাসু প্রতিশােধ পরায়ন ড্রাইভার খামাখা জীপটাকে সড়কের পাশ দিয়ে চালিয়ে শিশু সন্তানসহ মহিলাকে পিষে চলে যায়। আফসোস! এই হতভাগ্যদের সাহায্য করার জন্য খােদার সৈন্যরা কি এগিয়ে আসবে না? এই পৌত্তলিক মুর্তিপুজারী হিংস্র দানবদের সমুচিত জবাব দেয়ার মত বীর মুজাহিদরা আজ কোথায় ? পরিস্থিতি অত্যন্ত মারাত্মক আকার ধারণ করায় সেরাতে আর রাস্তায় বের হলাম না। ভােরে সৈন্যদের নির্দেশ মত সকলের সাথে এক মাঠে জমা হয়ে সক্তি প্যারেডের অপেক্ষা করতে লাগলাম। একে একে এবার আমার পালা। কাশ্মিরীদের জন্য দেওয়া একটি পরিচয় পত্র আমার কাছে ছিল। তা দেখিয়ে প্রাথমিক বিপদ দূর করলাম। এবার গুপ্তচরের সামনে দিয়ে যেতে হবে। একটি গাড়ীর মধ্যে গুপ্তচর মুখ ঢেকে বসে আছে। তার টর্চলাইটের মত চোখ দুটি জ্বল জ্বল করছে। কারাে ওপর সন্দেহ হলেই হর্ণ টিপে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষমান সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হওয়ার ব্যাপারে আমার তিল মাত্র সন্দেহ ছিল না। নিজেকে বাঁচাবার কোন উপায়ই খুঁজে পেলাম না। হাটার শক্তিও যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সর্ব শরীর থর থর করে কাঁপতে ছিল। পা ঠিক রাখতে পারছিলাম না। কোনক্রমে খােড়াতে খােড়াতে গাড়ীর পাশে এসে দাড়ালাম।
এবার আমি গুপ্তচরকে এবং গুপ্তচর আমাকে দেখতে থাকে, ভাগ্যের ফয়সালা দ্রুত আপন মঞ্জিলে অগ্রসর হচ্ছে। গুপ্তচর ডানে বামে চোখ বুলিয়ে দেখলাে, আসে পাশে সৈন্যরা দাড়ানাে আছে কিনা? এ পর আস্তে করে বললাে, “আমজাদ, তুমি সামনে চলে যাও।” আমার শরীর থেকে ঘাম ছুটে যায়। শরীরের রংও দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগলাে। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। হায়, গুপ্তচর আমাকে চিনে ফেলেছে। এখনই আমি গ্রেফতার হব। এক পা তুলে অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে অন্য পা জমে যায়। কি যে করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক কদম দু'কদম চলার পর আবার পা থেমে যায়, মনে হল যেন জমীনে আমার পা গেঁথে গেছে। আমি ভাবতে ছিলাম যে, সে আমাকে নিশ্চিত চিনে ফেলেছে। এখন ওরা বিড়ালের ইদুর ধরার মতাে আমাকে আশা নিরাশার দুলনির মাঝে গ্রেফতার হতে হবে। কিন্তু না হর্ণ বাজলাে না। কোন সৈনিকও আমাকে ধরতে আসলাে না। আল্লাহর রহমতে আমি সহিসালামতে বেরিয়ে আসলাম। পরে এই বিস্ময়কর ঘটনা সম্পর্কে স্থানীয় এক মুজাহিদকে আমি জিজ্ঞেস করলে সে বলে, ওই গুপ্তচরটি আমাদের মহল্লারই ছেলে। ভারতীয় সৈন্যরা তাকে গ্রেফতার করে ছয়মাস ইন্টারগেশন সেন্টারে রেখে চরম নির্যাতন চালিয়েছে। তার পর রেহাই দিয়ে ওকে জবরদস্তি গুপ্তচর বানিয়েছে। আজ পর্যন্ত কোন মুজাহিদকে সে ধরিয়ে দেয়নি।
(সমাপ্ত)
*****