JustPaste.it

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

কুরবানীঃ উৎসর্গীত হৃদয়ের পরম উৎসর্গের নামঃ 
তাৎপর্য, মাসাইল ও আহকাম

মাওলানা মুহাম্মাদ মুহিউদ্দীন


কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্য। এর গোড়ায় রয়েছে পিতা কর্তৃক সর্বাধিক প্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালানোর এক বে নজীর ইতিহাস; আল্লাহর অগাধ প্রেম ও অনুপম আনুগত্যের এক জ্বলন্ত নিদর্শন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আঃ) থেকে অব্যাহতভাবে চলে আসছে কুরবানীর এ ধারা।
কুরবান আরবী কুরবুন থেকে বুৎপন্ন। এর আভিধানিক অর্থ নৈকট্য অর্জন করা। শরীয়াতের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের নিয়তে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নির্দিষ্ট ধরনের পশু যবাহ করাকে কুরবান বা কুরবানী বলা হয়। 
কুরবানী করা ওয়াজিব। তবে সকলের উপর নয়। মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সমপরিমাণ টাকা বা সম্পদ আছে এমন সুস্থ মস্তিষ্ক, প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুকীম, (যে শরয়ী মুসাফির নয়) মুসলিম নর-নারীর উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। পাগল, না-বালেগ ও শরয়ী মুসাফিরের উপর কোন অবস্থাতেই কুরবানী ওয়াজিব হয়না। কুরবানীর নেসাবে বছর পূর্তি শর্ত নয়। ফেতরার ন্যায় কুরবানীর দিনে নেসাব পরিমান সম্পদের মালিক হলেই কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যাবে। কুরবানী ওয়াজিব নয় এমন ব্যক্তি যদি কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করে তবে,তার উপরও কুরবানী ওয়াজিব হয়ে যায়। ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী না করা মারাত্মক অন্যায়। এ প্রসংগে মহানবী (সাঃ) বলেন-“সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করলনা সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।”
জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১ ও ১২ এ তিন দিনের যে কোন একদিন এ কুরবানী করতে হয়। ১০তারিখে করাই ভাল। কুরবানী রাতেও করা যায়। কিন্তু দিনে করাই উত্তম। ১০-ই জিলহজ্বের ফজরের ওয়াক্ত থেকে কুরবানীর সময় শুরু হয়ে যায়। তবে যেসব অঞ্চলে জুমা ও ঈদের নামায বৈধ,সেসব এলাকায় ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করা জায়েয নয়। পক্ষান্তরে ঈদ ও জুমার নামায হয়না, এমন স্থানের লোকেরা ফজরের পর পরই কুরবানী করে ফেলতে পারে।

ঈদুল আযহার সুন্নতসমূহঃ

(১) ঈদুল আযহার রাত্রিতে সওয়াবের উদ্দেশ্যে জেগে এবাদত করা সুন্নত।
(২) যিল- হজ্বের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত জামাআত সহকারে মুকিম অবস্থায় ফরয নামায আদায় করার পর একবার তকবীরে তশরীক উচ্চস্বরে বলা ওয়াজিব। মুসাফির মহিলা ও একাকী নামায পড়ে এমন ব্যক্তিদের উপরও ওয়াজিব বলে কোন কোন আলেম বলেন। তাই তাঁদের পক্ষেও তাকবীর বলা উত্তম। তবে মহিলারা তাকবীর আস্তে বলবে।
(৩) যে কোরবানী করে, তার জন্যে নামাযের পূর্বে কিছু না খাওয়া এবং নামাযের পর কোরবানীর গোশত থেকে খাওয়া সুন্নত।
(৪) যে ব্যক্তি কোরবানী করার ইচ্ছা রাখে, তার জন্যে চাঁদ দেখার পর কোরবানী না করা পর্যন্ত গোফ ও নখ না কাটা মুস্তাহাব। (বেহেশতী- গওহর)

রাসুল (সঃ) এর ঈদের নামাযঃ

নবী করীম (সাঃ) নামাযান্তে মুসল্লীদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন। মুসল্লীরা কাতারে বসে থাকত। তিনি তাদের উদ্দেশ্যেও ওয়াজ করতেন, জরুরী নসিহত করতেন এবং আদেশ ও নিষেধ জারি করতেন। কোথাও কোন সেনাবাহিনী পাঠাতে চাইলে সে সময়ই তা পাঠাতেন। ঈদগাহে কোন মিম্বর থাকত না। মসজিদের মিম্বরও সেখানে আনা হত না। তিনি মাটিতে দাড়িয়েই ভাষণ দিতেন।- (যাদুল মা'আদ)

কুরবানীর ফজিলতঃ

আগেই বলেছি, কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এর ফজিলত অপরিসীম। হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা) এর বর্ণনা সাহাবাগণ একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের এ কুরবানী প্রথাটা কি? রসূল (সঃ) বললেন, এটা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নাত। জিজ্ঞাসা করা হলো, এতে আমাদের লাভ কি? বললেন, কুরবানীকৃত পশুর এক একটি চুল ও পশমের বিনিময়ে তোমাদেরকে একটি করে নেকী দেয়া হবে।
আরেক হাদীসে রাসূল (সাঃ) বলেন, কুরবানীকৃত পশুর রক্তের প্রথম ফোটাটি মাটিতে পরার আগেই কুরবানী দাতার বিগত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
কানযুল উম্মালের এক হাদীসে রসূল (সাঃ) বলেন, 'তোমরা মোটা তাজা পশু দেখে কুরবানী কর। এ পশু পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে।' ইবনে মাজার এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে, নবী করীম (সাঃ) বলেন, “কুরবানীর দিনে কুরবানী করার চেয়ে উত্তম ইবাদত দ্বিতীয়টি আর নেই। কুরবানীকৃত জন্তুটি কিয়ামতের দিন শিং, খুর ও পশম সহ আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। কুরবানীর পশুর-রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। অতএব সন্তুষ্টচিত্তে তোমরা কুরবানী কর।”
রাসূল (সাঃ) একদিন হযরত ফাতেমা (রাঃ)কে বললেন, “ফাতেমা! তুমি তোমার কুরবানীর পশুর নিকট উপস্থিত থাক। কারণ, পশু যবেহ করার পর রক্তের প্রথম ফোটাটি মাটিতে পরার সাথে সাথে তোমার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে।” শুনে ফাতেমা (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ ফজিলত কি শুধু আমারই জন্যে? রাসুল (সাঃ) বললেন, “এ ফজীলত আমাদের জন্যে এবং সকল মুসলমানের জন্যে।”

কুরবানীর পশুঃ

ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, গরু, মহিষ ও উট এ দু'প্রকার জন্তু দ্বারা কুরবানী করা যায়। প্রথম তিনটি মাত্র এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে এবং পরের তিনটি সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায় তবে শর্ত হলো, সকলের নিয়ত খাঁটি ভাবে সওয়াবের জন্য হতে হবে। সাত শরীকের কোন এক জনের নিয়তে সামান্যতম গরমিল থাকলে কারো কুরবানীই আদায় হবে না। বস্তুত কুরবানী নিছক কোন আনুষ্ঠানিকতা বা গোশত খাওয়ার মহড়া নয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং তাকওয়া ও খোদাপ্রেমের বহিঃপ্রকাশই এর মূল উদ্দেশ্য। কাজেই নিয়তটা একান্ত ভাবে সওয়াবের জন্যই হওয়া চাই।
ছাগল পূর্ণ এক বছর বয়স্ক হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বা যদি এতটুকু মোটাতাজা হয় যে দেখতে এক বছরের মনে হয় অথচ তার বয়স এক বছর নয়, তবুও তদ্বারা কুরবানী করা জায়েয হবে। গরু ও মহিষ দু'বছরের আর উট পাঁচ বছরের হওয়া আবশ্যক। এর কম বয়সী পশু কুরবানীর জন্য যথেষ্ট নয়।
পশু বিক্রেতা যদি পূর্ণ বয়স ব্যক্ত করে এবং বাহ্যিক অবস্থা দৃষ্টে তা অস্বীকারও করা যায় না, তবে তার কথার উপর নির্ভর করা জায়েয আছে।
কুরবানীর পশু মোটাতাজা ও নিখুঁত হওয়া বাঞ্ছনীয়। পশুর কিছু কিছু ত্রুটি এমন আছে যা থাকলে তদ্বারা কুরবাণী জায়েয হয় না। জন্মগত ভাবে যে পশুর শিং নেই কিংবা ছিল পরে মাঝখান থেকে ভেঙ্গে গেছে তার কুরবানী জায়েয আছে। তবে শিং যদি মূল থেকেই উপড়ে যায় তাহলে তার দ্বারা কুরবানী দুরুস্ত হবে না! খাসী ছাগলের কুরবানী শুধু জায়েযই নয় বরং উত্তমও বটে। অন্ধ, কানা ও ল্যাংড়া জন্তুর কুরবানী দুরস্ত নেই। তদ্রুপ এমন রুগ্ন ও দুর্বল জন্তু যার কুরবানীর স্থান পর্যন্ত নিজে পায়ে হেটে যাওয়ার শক্তি নেই, তার কুরবানীও জায়েয নেই।
যে জন্তুর এক তৃতীয়াংশের বেশী কান বা লেজ ইত্যাদি কাটা, তার কুরবানীও জায়েয নেই। যে জন্তুর দাঁত সম্পূর্ণ কিংবা অধিকাংশ নেই তার কুরবানী জায়েয নেই। তদ্রপ জন্মগত ভাবে একেবারেই যে জন্তুর কান নেই তার কুরবানীও জায়েয নেই। নিখুঁত জন্তু ক্রয় করার পর যদি কুরবানীর প্রতিবন্ধক কোন ত্রুটি দেখা দেয়, তখন ক্রেতা যদি নেসাবের অধিকারী ধনী না হয়, তাহলে তার জন্য সে জন্তু কুরবানী করা জায়েয। আর যদি লোকটি নেসাবের অধিকারী ধনী হয়, তাহলে তাকে তার পরিবর্তে অন্য পশু কুরবানী করতে হবে। 

কুরবানী করার নিয়মঃ

নিজে যবেহ করতে জানলে নিজের কুরবানী নিজ হাতে করাই উত্তম। অন্যথায় অন্য লোক দ্বারা করানো যায়। কিন্তু যবেহ করার সময় নিজে উপস্থিত থাকা শ্রেয়। 

কুরবানীর নিয়তঃ

শুধু মনে মনে করে নেয়াই যথেষ্ট মুখে কিছু বলার আবশ্যকতা নেই। তবে যবেহ করার সময় "বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার" অবশ্যই বলতে হবে। সুন্নত হলো, যবেহ করার জন্য পশুকে কিবলামুখী করে শুইয়ে দিয়ে “ইন্নি ওয়াজ জাহ...” দুআটি পাঠ করবে। আর যবেহ করার পর পাঠ করবে “আল্লাহুম্মা তাকাব্বালহু......” এ দু'আটি। 

কুরবানীর গোশত ও চামড়াঃ

যে পশু একাধিক অংশীদারে কুরবানী হয়, তার গোশত সমান সমান ওজন করে বন্টন করে নিবে। অনুমান করে বন্টন করা অনুচিত। উত্তম হলো, কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজেরা খাবে, একভাগ আত্মীয়- স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দান করবে এবং এক ভাগ গরীব মিসকীনদের বিলিয়ে দেবে। কুরবানীর গোশত বিক্রি করা হারাম এবং যবেহ কারী ও গোশত প্রস্তুতকারীদেরকে পারিশ্রমিকরূপে দেয়া না জায়েয। এর পারিশ্রমিক আলাদা প্রদান করবে।
কুরবানীর চামড়া বিক্রি না করে নিজে এবং নিজের পরিবার পরিজনের লোকেরা কাজে লাগাতে পারে। যেমনঃ জায়নামায, কিতাবের মলাট, দস্তরখান ও জুতা ইত্যাদি তৈরি করে ব্যবহার করা যায় এতে অসুবিধার কিছুই নেই। আবার গরীব মিসকীনকে খয়রাতও করা যায় । তবে এটা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়। কুরবানীর চামড়া, গোশত, চর্বি ইত্যাদি কোন অংশই কোন শ্রমের বিনিময় হিসাবে দেয়া জায়েয নয়। দিলে তার উপযুক্ত মূল্য সদকা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। 

 

কুরবানীর চামড়ার মূল্যঃ

কুরবানীর চামড়া বিক্রি করে বিক্রয় লব্ধ মূল্য সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয তারাই এর উপযুক্ত পাত্র। যাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়, তাদেরকে কুরবানীর চামড়ার মূল্য দেয়াও জায়েয নেই। দ্বীন শিক্ষায় অধ্যয়নরত মাদ্রসার গরীব ও অনাথ ছাত্ররা কুরবানীর চামড়া ও তার মূল্যের সর্বাপেক্ষা বেশী দাবীদার। এদের দান করলে একদিকে যেমন সওয়াব পাওয়া যায় তেমনি অপর দিকে ইলমে দ্বীন চর্চার সহযোগিতাও করা হলো। তবে এর দ্বারা মাদ্রাসার শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দেয়া জায়েয নেই ।
বালেগ শিশুর পিতা যদি অর্থশালী হয়, তাহলে তাকে কুরবানীর চামড়া বিক্রয়লব্ধ মূল্য দেয়া যাবে না। তবে যদি ধনী লোকের প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান অর্থশালী না হয় তবে তাকে দেয়া জায়েয হবে। অনরূপ ধনী ব্যক্তির স্ত্রী ধনী না হলে তাকেও দেয়া যেতে পারে। না বালেগ শিশুর মা অর্থশালী কিন্তু বাপ অর্থশালী নয়, তবে তাকেও দেয়া যায়।
আপনি যাদের থেকে জন্মলাভ করেছেন, যেমনঃ মা, বাপ, দাদা-দাদী ও নানা-নানী এবং যারা আপনার থেকে জন্মলাভ করেছে, যেমনঃ ছেলে, মেয়ে ও নাতী-নাতনী এদের কাউকে আপনার কুরবানীর চামড়া বিক্রয় লব্ধ মূল্য দিতে পারবেন না। দিলে সদকা আদায় হবেনা। স্বামী স্ত্রীও একে অপরকে দিতে পারে না। এছাড়া অন্য যে কোন আত্মীয়কে দেয়া যাবে যদি সে যাকাত পাওয়ার উপযুক্ত হয়। শুধু তাই নয়, এদের দান করলে বরং দ্বিগুণ সাওয়াব পাওয়া যাবে। এক সওয়াব দানের আর এক সওয়াব আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের। কোন অমুসলিমকে এ সদকা দেয়া যায় না। যাকাত এবং অন্যান্য ওয়াজিব সদকার ন্যায় এ সদকা আদায় হওয়ার জন্যেও তামলিক শর্ত। 
অর্থাৎ এ সদকা নির্দিষ্ট কোন গরীব-মিসকীনকে মালিকানারূপে প্রদান করতে হবে, যাতে তার পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে মালিকানারূপে হস্তগত করা ব্যতীত অন্যান্য সদকার ন্যায় এ সদকাও আদায় হবে না। এ কারণে এ সদকার টাকা মসজিদ, মাদ্রাসা, হাসপাতাল, রাস্তা, পুল কিংবা অন্য কোন সেবা মূলক কাজে ব্যয় করা জায়েয নেই। তদ্রপ কোন লাওয়ারিশের কাফন-দাফন কিংবা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ আদায় করার খাতেও তা ব্যয় করা যাবেনা। কারণ এসব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে মালিক বানানোর শর্তটি পাওয়া যায় না।

কুরবানীর পরিবর্তে সদকা করাঃ

যদি কুরবানীর সময় অতিবাহিত হয়ে যায় আর কেউ অজ্ঞতা, অলসতা কিংবা অন্যকোন অজুহাতে কুরবানী করতে পারল না, তাহলে কুরবানীর মূল্য গরীব-মিসকীনদের সদকা করে দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে পশুর মূল্য সদকা করলে এ ওয়াজিব আদায় হবে। কারণ, কুরবানী একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। আর এক ইবাদত দ্বারা অন্য ইবাদত আদায় হয় না। যেমনঃ নামায পড়লে রোযা আদায় হয় না। 

একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা ও তার গুরুত্ত্বঃ

মাসআলাটি হলো, ধরুন দু'জন লোক। তাদের একজন ধনী—তার উপর কুরবানী ওয়াজিব। অপরজন গরীব তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। কুরবানী করার জন্য এরা দু'জনে দু'টো পশু ক্রয় করার পর দুটোই খোয়া গেল। অগত্যা আবার তারা দু'টো পশু ক্রয় করল। এরপর ভাগ্যক্রমে খোয়া যাওয়া পশু দুটোও পাওয়া গেল! এখন শরীয়াতের বিধান হলো গরীব লোকটিকে দুটো পশুই কুরবানী করতে হবে, আর ধনী লোকটিকে যে কোন একটি কুরবানী করলেই চলবে।
ব্যাপারটা কি? বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিষয়টা অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। গরীব বেচারাকে দু'টো পশু কুরবানী করতে হবে আর ধনী মহোদয়ের একটি করলেই চলবে, এ কেমন কথা! কিন্তু আসলে বিষয়টি মোটেই অযৌক্তিক নয়। বাহ্যত অযৌক্তিক মনে হলেও মূলত ইসলামী শরীয়াতের কোন বিধানই অযৌক্তিক নয়।
ব্যাপার হলো, যে লোকটি নেসাবের অধিকারী ধনী, কুরবানী করা আইনত তার উপর ওয়াজিব। এ ওয়াজিব হওয়ার সম্পর্ক নির্দিষ্ট কোন পশুর সঙ্গে নয়। অর্থাৎ এমন নয় যে, তাকে নির্দিষ্ট ভাবে এ পশুটিই কুরবানী করতে হবে। বরং যিম্মায় ওয়াজিব হওয়ার কারণে কুরবানীর নিয়তে যে কোন একটি পশু কুরবানী করলেই তার ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নেসাবের অধিকারী নয়, তার কুরবানী করা আইনতঃ ওয়াজিব নয়। কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় করার পর নির্দিষ্ট ভাবে ঠিক সেই পশুটিই কুরবানী করা তার উপর ওয়াজিব যে পশুটি সে কুরবানীর জন্য ক্রয় করেছে। অর্থাৎ শরীয়াত তার যিম্মায় কুরবানী ওয়াজিব করেনি বরং নিয়তের মাধ্যমে সে নিজেই নিজের উপর নির্দিষ্ট একটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব করে নিয়েছে।
এরপর দু'জনের পশু দুটো খোয়া যাওয়ার পর আবার যখন তারা পশু ক্রয় করল এবারও ঠিক একই কারণে গরীব লোকটির এ পশুটিও কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে গেল । তাই গরীব লোকটির দু'টো পশুই কুরবানী করতে হবে আর ধনী লোকটির যে কোন একটি করলেই চলবে। প্রথম বারের পশুটি খোয়া যাওয়ার পর যদি গরীব বেচারা অন্য পশু ক্রয় না করত, তাহলে তা পাওয়া যাওয়ার পর শুধু ওটা কুরবানী করলেই হতো, আর খোয়া যাওয়া পশুটি পাওয়া না গেলে তাকে আদৌ কুরবানী করতেই হতো না। কারণ যে নির্দিষ্ট পশুটি কুরবানী করা সে নিজের ওপর ওয়াজিব করে নিয়েছিল, তা তার হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছে। অতএব কুরবানী করবে সে কিভাবে। কিন্তু যার উপর কুরবানী ওয়াজিব, তার কুরবানী করে উপায় ছিল না, যে কোন একটি পশু তাকে কুরবানী করতেই হতো। কারণ তাঁর কুরবানীর সম্পর্ক নির্দিষ্ট কোন পশুর সঙ্গে নয় বরং তাঁর যিম্মায় যা ওয়াজিব, তা তাকে আদায় করতেই হবে। মোট কথা, যে ব্যক্তি নেসাবের অধিকারী ধনী শরীয়াত তার উপর যে কোন একটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব করে দিয়েছে। কাজেই যে কোন একটি পশু কুরবানী করলেই তাঁর দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। আর যে গরীব লোকটি নেসাবের অধিকারী নয়, শরীয়াত তার কুরবানী ওয়াজিব না করা সত্ত্বেও যখন সে স্বেচ্ছায় নিজের উপর নির্দিষ্ট দু'টো পশু কুরবানী করা ওয়াজিব করে নিয়েছে, তখন তাকে দুটোই কুরবানী করতে হবে। 

কিছু ত্রুটি ও তার সংশোধনঃ

কুরবানীর ব্যাপারে আমাদের সমাজে বেশ কিছু ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে একটি ত্রুটি হলো, অনেকে ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী করে না। কোন কোন বংশ তো এমনও আছে যে, তার কয়েক পুরুষ পর্যন্ত কেউ কখনো কুরবানী করেনি। অথচ কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ইসলামের একটি অন্যতম ঐতিহ্য, ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও আদায় না করা জঘন্যতম অপরাধ । মহানবী (সাঃ) বলেন, “সংগতি থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।”
ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী না করার কারণ সাধারণতঃ অলসতা গুরুত্বহীনতা ও কৃপণতা। কারণ যদি অলসতা হয়, তাহলে এ বাবত আমরা বলব যে, মানুষ দুনিয়ার হীন-স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যদিও তা অত্যাবশ্যক না হয় এবং সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যদি তা নিশ্চিত না হয়, কতই না টাকা কড়ি ব্যয় করে থাকে। তদুপরি দুনিয়ার সব কিছুই ধ্বংসশীল ও ক্ষয়িষ্ণু। তাহলে আখেরাতের স্বার্থ হাসিলে এবং আযাব থেকে রক্ষা লাভের ব্যাপারে অলসতা করা উচিত হবে কি? আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যাকে এত গুরুত্ব দিয়েছেন, তা অবহেলা করা ঈমান পরিপন্থী কাজ নয় কি? আর কুরবানী না করার কারণ যদি কৃপণতা হয় তা হলে তার সংশোধনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে কুরবানী করার উপকারিতা এবং না করার ক্ষতি স্মরণ করবে। এর পর ধীরে ধীরে কার্পণ্য দূর করার চেষ্টা করতে থাকবে।
অনেকে আবার এজন্য কুরবানী করে না যে, তারা কুরবানী ইবাদাত হওয়ার ব্যাপারে সন্ধিহান। তাঁদের ধারণা, কুরবানীর নামে পশু যবেহ করা জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করারই নামান্তর। এদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য, ইবাদতের মূল কথা হলো আল্লাহর আদেশ পালন করা। তাই কুরবানী করা আল্লাহর আদিষ্ট কাজ প্রমাণিত হওয়ার পর তা ইবাদত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, আল্লাহর এ বিধানের রহস্য কি? এর উত্তরে অনেক কথাই বলা যায়। কিন্তু সঠিক জবাব হলো, এধরনের প্রশ্ন করার অধিকার কারো নেই। কারণ আমরা আইন প্রণেতা নই যে, এর কারণ ও গুঢ়তত্ব আমাদের জানা থাকতে হবে। আমরা আল্লাহর আইনের বাহক ও বর্ণনাকারীমাত্র উকিল, ম্যাজিষ্ট্রেট বা জজের কাছে আইনের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া চরম বোকামী নয় কি? তাই আমরাও এর রহস্য উঘাটনের জন্য গলদঘর্ম হতে চাই না। ঈমানের দাবীও এটাই। তাছাড়া জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার কথা বলছেন? তাহলে শুনুন, কোন সম্পদ তখনই বিনষ্ট হচ্ছে বলে বলা যায়, যখন তদ্বারা কোন উপকার হয়। কুরবানী তো একটি অতি মহৎ জরুরী কাজ। সবচেয়ে বড় উপকার হলো, কুরবানী করলে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হন, যা এমন একটি উপকার যার মুকাবিলায় দুনিয়ার সবই তুচ্ছ! তাহলে বলুন, কুরবানী করায় সম্পদ বিনষ্ট হলো কোথায়?
আরেকটি ত্রুটি হলো এই যে, অনেকে নিতান্ত নিঃস্ব কিংবা সঞ্চিত সম্পদের তুলনায় তার ঋণ বেশী কিংবা অন্য কোন হক্কুল ইবাদ আদায় করা তার যিম্মায় ওয়াজিব। এমতাবস্থায় এসব উপেক্ষা করে তারা নিছক গৌরব কিংবা বংশগত ঐতিহ্য বজায় রাখার জন্য কুরবানী করে থাকে। এতে তারা দু'টি অন্যায়ে লিপ্ত হয়। প্রথমতঃ বান্দার হক নষ্ট করা। দ্বিতীয়তঃ অহংকার প্রদর্শন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে কোন লাভজনক কাজ তখন কাম্য যখন তাতে কোন ক্ষতি থাকবে না।