সিরাতে রাসূল (সাঃ)
মহানবী (সাঃ) এর বিদায় ভাষণঃমানবাধিকার সংরক্ষণ ও মানবতার মুক্তির সনদ
শহীদুল ইসলাম
=====================================================================
পাশ্চাত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক লর্ড ন্যাকটন ফারাসী DECLARATION OF THE RIGHTS MAN এর সংবিধান সম্পর্কে স্বগর্বে ঘোষণা করেছিলেন যে, সংক্ষিপ্ত হলেও এই পৃষ্ঠা কয়টির ওজন বিশ্বের সকল গ্রন্থাগার থেকে বেশী এবং 'নেপোলিয়নের কাহেরা কনভেনশন' এর চেয়েও এর গুরুত্ব অধিক এবং অনেক বেশী মূল্যবান ।
নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে,লর্ড ন্যাকটনের এ অভিমত অতিরঞ্জিত ও অপরিপক্ক । মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে যদি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বিদায় হজ্জের মহান ঘোষণাকে তুলনা করা হয় তবে ন্যাকটনের দাবীর অসাড়তা প্রমাণিত হবে । শুধু লর্ড ন্যাকটন কেন বিশ্ব সৃষ্টির আদি থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত মানব রচিত যত বিধি মানুষের জন্য রচিত হয়েছে কোন বিধানেই মানবতার সার্বিক মুক্তির পথ-নির্দেশ পাওয়া যায় না । বর্তমান বিশ্বের প্রচলিত জাতিসংঘ সনদও বিশ্ব মানবতার রক্ষা কবজ নয়, এ ব্যাপারটি এখন স্পষ্ট এবং প্রায় স্বীকৃত । জাতিসংঘ সনদ ও মানব রচিত অপরাপর প্রত্যেকটি সংবিধানই মানব কল্যাণ ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনুপযোগীতার পরিচয় বহন করছে । বর্তমান বিশ্ব মানবতার মুক্তির নিশ্চিত বিধানের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে । আর অপরদিকে, একদল অন্ধ বুদ্ধিজীবী কোন বিচার বিশ্লেষণ ছাড়াই ইসলামের বিশ্বজনীনতায় অমূলক সন্দেহের ধোঁয়া ছড়াচ্ছে । এমতাবস্থায়, বিদায় হজ্জে ঘোষিত মানবতার মুক্তির সনদসমূহ আমাদেরকে আরো দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে উচ্চারণ করা প্রয়োজন ।
প্রত্যয়ের আলোকে সন্দেহাতীতভাবে বলতে হবে । পৃথিবী সময়-যুগ ও কালের চক্রাবালে যত পরিবর্তনের আবর্তে পতিত হোক, সংস্কার ও আধুনিকীকরণের দাবী যত জোরে উচ্চারিত হোক,তবুও বিদায় হজ্জের ঘোষণার চেয়ে বেশী মানব কল্যাণমুখী কোনো নীতিমালা কেউ দিতে পারে নি, ভবিষ্যতেও দিতে পারবে না । আজ পৃথিবীর কোণায় কোণায় নিপীড়িত মানবতার মুক্ত চর্চা হচ্ছে বটে তবে একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, মানব কল্যাণের আড়ালে এসব নতুন নতুন চিন্তা-ফিকির ক্রমেই বিশ্বকে করে তুলছে মানব বসবাসের অযোগ্য । বিশ্বের আনাচে-কানাচে মানবতা আজ পদদলিত, বিপর্যস্ত ।
বিংশ শতাব্দীর দোড় গোড়ায় মানবতা যেভাবে পদদলিত হচ্ছে, যেভাবে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা বিশ্ব মোড়লদের হাতে পিষ্ট হচ্ছে, অতীত ইতিহাসে এমন মানব হন্তারকদের খোঁজ কমই পাওয়া যায় । যারা বর্তমানে মানবতা রক্ষায় পাহারাদারীর ভূমিকায় দন্ডায়মান, তাদের হাতই আজ পীড়িত, মানব খুনে রঞ্জিত ।
দশম হিজরী । (৬২৩ খ্রিস্টাব্দ) ফেব্রুয়ারী মাস । মহানবী (সাঃ) প্রথম বাইতুল্লাহ শরীফ হজ্জ্ব ব্রত পালনের সংকল্প করলেন । যদিও নবম হিজরীতে হজ্ব ফরয করা হয়েছিল তবে তৎক্ষনাত মক্কায় হজ্ব ব্রত পালন করার মতো অনুকূল পরিবেশ ছিল না । দশম হিজরীতে তিনি সকল সাহাবীকে হজ্ব যাত্রার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন । সকল আযওয়াজে মুতাহহারাতকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথে যাওয়ার কথা বললেন । মরু আরবের রুক্ষ আবহে খুশির ঢেউ উঠলো । চতুর্দিক থেকে মুসলমানগণ হজ্ব কাফেলায় এসে শরীক হতে লাগলেন । চারদিক থেকে সাহাবীদের কাফেলা ঢলের মতো এসে মিশে যেতে লাগলো জনসমুদ্রে ।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন,'রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চব্বিশ জিলকদ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ২২ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার মদীনা থেকে বের হয়ে যুলহুলাইফায় এসে অবস্থান করেন । সেখানে এসে গোসল করলেন এবং এক প্রকার ঘাস( খাতমী) দ্বারা মাথা ধুয়ে মিশকের সুগন্ধি মাখলেন গায়ে মাথায় । তাঁর মাথায় চুলগুলো তখন চিকচিক করছিল । মসজিদে দু'রাকাত নামায পড়ে দু'পাট্টা সেলাইবিহীন কাপড়ের একটি পরিধান করে অন্যটি দিয়ে শরীর আবৃত করলেন । এরপর উচ্চ আওয়াজে তালবিয়া পাঠ করলেন, "লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক,লাব্বাইকা লা শারীকালাকা লাব্বাইক,ইন্নাল হামদা ওয়া ন্নিয়মাতালাকা ওয়াল মূলক লা শারীকালাকা লাব্বাইক । " হজ্ব মিছিল মক্কা অভিমুখে এগিয়ে চললো ।
৮ জিলহজ্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিনায় পৌঁছলেন । মিনা প্রান্তরে যুহর, আসর, মাগরিব, ইশা ও ফজরের নামায আদায় করলেন । ৯ জিলহজ্ব বেলা বেড়ে উঠার সাথে সাথে সেখান থেকে রওয়ানা হলেন । পথিমধ্যে 'নাসরা' নামক স্থানে পৌঁছালে রৌদ্রতাপ থেকে বাঁচার জন্য উটের হাওদা আনতে নির্দেশ দিলেন এবং কাসওয়া নামক উটনীর পিঠে আরোহন করে আরাফাতের ময়দানে পৌঁছালেন । তখন আরাফাতের ময়দান সাহাবীদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ । সমবেত সকল সাহাবীদের কন্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে তালবিয়া, তাসবিহ ও আল্লাহর পবিত্রতা । ঐতিহাসিকদের কারো মতে, সেদিনের ঐতিহাসিক হজ্ব সমাবেশে ১ লাখ ৪০ হাজার মতান্তরে ১ লাখ ২৪ হাজার সাহাবী উপস্থিত ছিলেন । এই বিপুল সংখ্যক সাহাবী সেদিন মহানবী (সাঃ) এর সাথে ঘোষণা করলেনঃ"হে খোদা, তোমার কাছে হাজির হয়েছি । হে প্রভু!তোমার সমকক্ষ কেউ নেই । সকল প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই । তোমার রাজত্বের অংশীদার কেউ নয় প্রভু, আমি তোমার দরবারে হাজির!"
পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, এই নীল আসমান ইতিপূর্বে যমীনের উপরে হয়তো এর চেয়ে অধিক মানব সমাবেশ দেখেছে তবে আল্লাহর প্রেমে, রহমত ও বরকতের বারিধারায় স্নাত পুতঃপবিত্র লোকদের এমন মহা সম্মেলন পৃথিবী দ্বিতীয়টি কোন দিন প্রত্যক্ষ করে নি । সর্বযুগের শ্রেষ্ঠতম মহা মানবের নেতৃত্বে আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের যোগ্য অনুসারীদের এই সমাবেশের মতো মর্যাদা পৃথিবীর আর কোন সমাবেশের ভাগ্যে জুটবে না ।
দ্বিপ্রহরের পর সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়লে নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রিয় বাহন কাসওয়ায় সওয়ার হয়ে ঘোষণা করলেন বিশ্ব মানবতার সর্বকালের মুক্তির পয়গাম, যাকে স্বীয় পরিপূর্ণতায় বলা হয় "CHARTER OF HUMAN FREEDOM" । 'শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার সনদ' ।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বক্তৃতা শুরু করলেন । সোয়া লক্ষ সাহাবীর বিরাট সমাবেশে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা । আড়াই লক্ষ চক্ষুর দৃষ্টি নবীজি (সাঃ)এর পবিত্র চেহারায় স্থির হয়ে গেল । এই বিশাল সমাবেশ আদব, সম্মান, মর্যাদা ও আনুগত্যের এমন এক মহান নজির ছিল যে, প্রত্যেকের কানেই রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর পবিত্র বাণীর ধ্বনী পৌঁছে যাচ্ছিল । রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ঐ দিনের কথাগুলো ছিল ব্যাপক, বিস্তৃত এবং গভীরতায় পরিপূর্ণ । ইসলামী জীবন বিধানের শেষ অধ্যায়টুকুর সম্পূর্ণ সমাপ্তি ঘটেছে এই দিন । পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন বিধানের উপসংহার বিধৃত হয়েছিল তাঁর কন্ঠে । পৃথিবী সেই দিনের (বিদায় হজ্জের) মতো মানব দরদী, কল্যাণকামী, রহমত ও বরকতের আঁধার, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠাকামী শ্রেষ্ঠ সম্রাটকে কোন দিন আর বক্তৃতা দিতে দেখবে না । দেখবে না এমন আত্মনিবেদিত মানব কল্যাণকামী সৈনিকদের মহামিলন ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, " হে লোকসকল!তোমরা আমার কথা শুনো । অতঃপর বললেন, " শুনে রাখ,হতে পারে, এই দিনের এই ময়দানে, এই শহরে এটাই তোমাদের সাথে আমার শেষ দেখা । এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা জান,এটি কোন শহর?সাহাবীগণ বললেন, 'আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন । ' তিনি বললেন, 'এটি পবিত্র ও রক্ষিত শহর । এরপর বললেন, 'জানো,এটা কোন মাস?উত্তর দেয়া হলো, 'আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভালো জানেন । 'নবীজি (সাঃ) বললেন, 'এটা পবিত্র মাস' । নবীজি (সাঃ) বললেন, তোমরা জান,আজ কোন দিবস?সাহাবীগণ বললেন, 'আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশী জানেন । 'বললেন, 'আজ পবিত্রতম দিবস' ।
তাঁর ২০ বছরের ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ কর্মজীবনের স্বীকৃতি সাহাবীদের মুখে উচ্চারিত হলো এভাবে, আপনি আপনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন । আমরা আপনার কর্মময় জীবনের স্বাক্ষী । অন্যদিক্র, আল্লাহর পক্ষ থেকে দ্বীনের পূর্ণতা ঘোষণা দিয়ে বলা হলঃ"আজ আমি তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করেছি এবং আমার নিয়ামতের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছি এবং এই দ্বীনের অধিকারী হওয়ায় তোমাদের প্রতি আমি সন্তুষ্ট । "
যে ওহীর শুরু ২০ বছর আগে হেরা পর্বতের নির্জন গিরি গুহায় শুরু হয়েছিল সেই ওহীর সমাপ্তি ঘটলো আজ ময়দানের বিশাল সমাবেশে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, 'আমার আজকের কথাগুলো তোমরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছে দিও" । সেই দিন হতে রাসূলের মুক্তির বাণী অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছে দেয়ার কাজ চলছে, আজও অব্যহত রয়েছে এবং অনাগত ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে । এই শান্তির পয়গাম পৌঁছে দিয়ে এবং তা ধারণ করেই কেবল গড়া যেতে পারে শান্তিময় বিশ্ব । এউ উদ্দেশ্য হলো এই বিশ্বলোকে সাদা-কালো, রাজা-প্রজা,উঁচু-নিচু, প্রভু-দাস,শ্রমিক-মালিকের মধ্যে যে বৈষম্য প্রাচীর দিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছিল এই প্রাচীর ভেঙ্গে সাম্যের বন্ধন রচনা করা । মানবের জন্মগত স্বাধীন অধিকার সেই ঘোষণায় মূর্ত হয়ে উঠেছে ।
মানব সৃষ্ট বিভেদ রেখা তৈরি করে মানুষে মানুষে যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে তাকে গুড়িয়ে দিয়েছে এই ঘোষণা । শ্রেণী বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক কৌলিণ্য প্রথার জগদ্দল পাথর চাপা পড়ে যে মানবাত্মা গুমরে মরছিল বিদায় হজ্বের ঘোষণায় তার মুক্তির বাণী উচ্চারিত হয়েছে । জন্মগত স্বাধীন অধিকার কেড়ে নিয়ে মানুষ মানুষকে দাস-দাসীতে রুপান্তর করল, মানুষের উপর প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের হাতে বন্দী হলো মানুষ । কোথাও বংশ বৈষম্য আবার কোথাও বলে বৈষম্য বর্ণ, কোথাও জাতীয়তা, ভাষা আবার কোথাও ভৌগোলিক সীমানায় বন্দী হলো মানবতা । মানুষ মানুষকে এভাবে পশুত্বের গহ্বরে ঠেলে দেয় । মানুষ মানুষের কাছে পশুর মতো কেনা-বেচা হতে থাকে । এ স্থানে মানুষ বসেছে খোদার আসনে চড়ে আর অন্যস্থানে মানুষের মর্যাদা মিশে যাচ্ছে মাটির সাথে । একদল স্বাধীকার আদায়ে আত্মহুতি দিচ্ছে । অন্যদল, মানুষের অধিকার হরণে পৈশাচিক উন্মাত্ততায় নিধন যজ্ঞ চালাচ্ছে । মোট কথা, খোদার দেয়া নেয়ামত থেকে মানুষ একে অপরকে করছে বঞ্চিত, বিতাড়িত ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "সকল মানুষ সমান । মানবতার মর্যাদা ও সম্মান ভাস্বর হয়েছে তাঁর এ ভাষণে । আজকের জাতিসংঘের হাজার হাজার প্রতিনিধি তাদের CHARTER OF HUMAN RIGHTS প্রনয়ন করে দীর্ঘ ও আড়ম্বরপূর্ণ সেমিনারে এর মহত্ত্ব আলোচনা করে । কিন্তু এর বাস্তব প্রয়োগ ঘূর্নান্তরেও করতে পারে না তারা ।
পনেরশ বছর আগে আরাফাতের মরু প্রান্তরে একটি উটনীর পিঠে বসে মরু দুলাল যে বিশ্ব শান্তির পয়গাম দিয়েছেন দেড় হাজার বছর পর আজও পৃথিবীর কোণায় কোণায় এর আওয়াজ উচ্চারিত হচ্ছে, মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠায় ওই শাশ্বত বাণীর দিকে ফিরে যেতে চাচ্ছে ।
সে দিন তিনি বলেছিলেন
" হে মানব সকল!আমি আবার কোনো দিন তোমার সামনে এখানে দাঁড়াতে পারবো কি না এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই । জেনে রেখো, তোমাদের জীবন, মাল-ধনসম্পদ অন্যদের জন্য হারাম যেভাবে আজকের এই দিনে এই মাসে এই শহরে তোমাদের জীবন নিরাপদ ও অন্যদের জন্য হারাম ।
জেনে রেখো, মৃত্যুর পর তোমাদের সকলকে আল্লাহর কাছে কৃতকর্মের হিসাবের জন্য মুখোমুখি হতে হবে । খবরদার! আমার পর পথভ্রষ্ট হয়ে যেও না এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে হত্যা খেলায় মেতে উঠো না ।
মনে রেখো, জাহিলিয়্যাতের সকল কুসংস্কার ও অনাচার আমি ধ্বংস করে দিয়েছি । আমি আমার বংশধরদের খুনের বদলা না নিয়ে হত্যাকারীদের ক্ষমা করে দিলাম । জাহিলিয়াতের সকল প্রতিশোধ প্রথা আমি রহিত করে দিলাম । আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিবের প্রতিশোধ ক্ষমা করে দিলাম । সুদ প্রথা রহিত করলাম ।
হে লোক সকল! নারীদের জন্য তোমাদের কর্তব্য রয়েছে, সে সম্পর্কে আল্লাহকে ভয় করবে । নারীদের অধিকার ও প্রাপ্য আদায় করবে ।
আমি তোমাদের জন্য যে দু'টি বস্তু রেখে যাচ্ছি তা আঁকড়ে থাকবে তাহলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না । সে দুটি হলো,কিতাবুল্লাহ ও আমার সুন্নাহ ।
আমার পর আর কোনো নবী আসবে না । তোমরা ছাড়া আর কোনো নতুন উম্মতেরও সৃষ্টি হবে না । আল্লাহর ইবাদাত করবে, নামায আদায় করবে, যাকাত প্রদান করবে, রোজা রাখবে, হজ্ব করবে এবং (ইসলামী) শাসকের অনুগত্য করবে । তাহলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অনায়াসে ।
বিদায় হজ্ব-ভাষণের মূলধারা গুলো বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত মৌলিক মানব অধিকার ও চাহিদার জবাব পাওয়া যায়ঃ
প্রথমেই বলা হয়েছে, নিজে বাঁচো এবং অন্যকে বাঁচতে দাও । অথচ বর্তমানে তৃতীয় বিশ্ব বেঁচে থাকার সংগ্রামে শ্রান্ত । অন্যান্য শক্তি তাদের সাহায্য করছে না ।
প্রতিশোধ প্রবণতাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খতম করে দিয়েছেন । অথচ বর্তমান বিশ্ব প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে । "ব্যালেন্স অফ পাওয়ারের' নামে বর্তমান বিশ্বে চলছে অসম অস্ত্র প্রতিযোগিতা । আর অন্যদিকে চলছে অস্ত্র হ্রাস করণের নামে ক্ষুদ্রদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রচেষ্টা ।
নবীজি (সাঃ) নারীর অধিকার আদায়ে উৎসাহিত ও নিশ্চিত করেছিলেন । বর্তমানে যে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম 'WOMENS LIBERTY' এর নামে হচ্ছে । অথচ এই কথা পনেরোশ বছর আগেই বলা হয়েছে ।
তিনি মানুষের মধ্যে তাকওয়ার অনুশীলন ও খোদাভীতি জাগ্রত করার কিথা বলেছেন । কেননা কোন লোকের মনে আল্লাহর ভয় না থাকলে তার কাছ থেকে কোনো সৎ কাজ আশা করা যায় না । অদৃশ্য মহাশক্তি আল্লাহর কাছে মানুষের আন্তরিক দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে বর্তমান বিশ্ব চরম দায়বদ্ধহীনতায় আক্রান্ত ।
তিনি ঐক্য ও সম্প্রীতি সংরক্ষণে গুরুত্বারোপ করেছেন । একের জন্য অন্যকে নিরাপত্তাকর্মী বলেছেন ।
সুদ প্রথা রহিত করে অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার প্রশস্ত করেছেন ।
সকল মুসলমানের মূলনীতি ও সংবিধান হিসেবে কুরআনকে নির্ধারণ করেছেন এবং বলেছেন যে, নবুওয়্যাত খতম । আমিই শেষ নবী ।
ইবাদাতের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আরকানে ইসলামের প্রতি যত্নবান হতে বলেছেন । শেষ পর্যায়ে বলেছেন, শাসন কার্যের পরামর্শ ভিত্তিক ধারা অব্যাহত রাখবে । কোন সময় যেন ক্ষমতার লিপ্সায় সংঘাত সৃষ্টি না হয় ।
আমরা যদি নবী যুগের রোমান, ইরানী ও ভারত বর্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সাথে উপরোল্লিখিত বক্তব্যের তুলনা করি তাহলে এর সার্বজনীন স্বার্থকতা ও সফলতা বুঝতে সহজ হবে ।
নবী (সাঃ) এর যুগের আগে সমাজে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রী বলতে কোনো বস্তুর অস্তিত্ব ছিলো না । সকল দেশ ও জনপদে মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল । শ্রেণি বৈষম্যের এ প্রাচীর টিকিয়ে রাখার জন্য যুগে যুগে চলছে আইনের প্রহসন । রোমান সমাজের এক শ্রেণী ছিল অতি উচ্চ ও স্বাধীন মতামতের অধিকারী । নিম্ন শ্রেণীতে ছিল দাস-দাসীসহ অপরাপর তবকার লোকজন । এদের মধ্যে আবার বর্ণ,পেশা ও অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত ছিল । তখন জাস্টিনিয়ন এক আইন প্রণয়ন করে ঘোষণা করেছিলেন যে, এর চেয়ে মানবতাবাদী আইন জগতে আর হতে পারে না । বলাবাহুল্য কথিত মানবতাবাদী এই আইনের ধারা বলে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য আরো প্রকট হয়ে উঠে । এর ধারাগুলো ছিল নিম্নরূপঃ
(১) অতি উঁচু শ্রেণী । আমীর উমরা ও রাজকর্মচারীরা এর অন্তর্ভুক্ত ছিল । রাজদ্রোহিতা ছাড়া কোন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার শাস্তির বিধান ছিল না । অবশ্য রাজদ্রোহী হলে মৃত্যুদন্ডই ছিল তার শাস্তি ।
(২) সাধারণ উঁচু শ্রেণী । বিশেষ বিশেষ অপরাধে এদের মৃত্যুদন্ডের বিধান ছিল, আর সাধারণ অপরাধে জেল-হাজতে দন্ডিত করা হতো ।
(৩) নীচু শ্রেণী । লঘু অপরাধেও এদের সর্বনিম্ন শাস্তি ছিল মৃত্যদন্ড । কোন সময় এদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হতো । কখনো হিংস্র জানোয়ারের আহারে পরিণত করা হতো ।
ইরানের সামাজিক অবস্থাও এই ধরণের শ্রেণী বৈষম্যের দোষে আক্রান্ত ছিল । ইরানের সমাজেও চার শ্রেণীর মানুষের অবস্থান দেখা যায় ।
(১) ধর্মীয় গুরু শ্রেণী ।
(২) সৈনিক শ্রেণী ।
(৩) সরকারী আমলা ।
(৪) সর্বশেষ ছিল সাধারণ শ্রমজীবী কৃষক মজদুর শ্রেণী ।
অগ্নিপূজারীরা ছিল ইরানী সভ্যতার দন্ডমুন্ডের মালিক । সাধারণ মানুষ কখনো শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারতো না । রাজ্য পরিচালনায় এদের কোনো প্রভাব ছিল না । নীচু শ্রেণীর লোকেরা কোনো সরকারী কর্মচারী কর্মকর্তার আসন পেত না । এমনকি উঁচু শ্রেণীর সম্পত্তি কেনার অধিকারও ছিল না সাধারণ মানুষের ।
ভারত উপমহাদেশের সামাজিক অবস্থা ছিল তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নাজুক ও অমানবিক । হিন্দু ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতরা সমাজকে কত ভাগে বিভক্ত করে ছিল তার ইয়ত্তা নেই । হিন্দু নীচু শ্রেণির মানুষ যদি কখনো ব্রাহ্মণ ঠাকুরদের কথা শুনে ফেলতো তাহলে তাদের কান শীশা গলিয়ে বন্ধ করে দেয়া হতো । নীচু শ্রেণীর বসবাস ছিল সভ্যতাবর্গীদের চেয়ে অনেক দূরে -শহরের বাইরে অজোপাড়া গাঁয়ে । অস্পৃশ্য শ্রেণীর ঘরের আগুন দূর্বিপাকে কৌলিনদের ঘরে লেগে গেলে তারা ঘর অপবিত্র হয়ে গেছে বলে বাড়ী ছেড়ে চলে যেতো । মানবতার এমন অমর্যাদা ও দলন তখনকার পৃথিবীতেও আর কোথাও ছিল না ।
শাসকদের অবস্থানঃ
রাজা বাদশাহ বা শাসকদের অবস্থান ছিল খোদার স্থানে । তাদের মনে করা হতো চন্দ্র সূর্যের সন্তান । সাধারণ মানুষ রাজা বাদশাহ হওয়ার ক্ষমতা রাখতো না । ইরান ও রোমান শাসকদের মনে করা হতো, তারা খোদার অংশীদার । সম্রাটগণ আল্লাহর সাথে তাদের বংশধারা জুড়ে দিত । শাসককে সিজদা করা ধর্মীয় বিধানের অন্তর্ভুক্ত ছিল । তাদের হুকুমের বিদ্রোহ ছিল ধর্মের লঙ্ঘন ।
নারীর অবস্থাঃ
ইরানে নারীর অবস্থান দুই পর্যায়ে ছিল । কোন এক পর্যায়ে নারী যদি গর্ভধারণ করতো তাহলে গর্ভাবস্থায় তাকে হত্যা করা হতো এবং নিম্ন পর্যায়ের নারীর গর্ভজাত মেয়ে সন্তানদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে অধিকার ছিল না । ইচ্ছা করলে বউ বদল করার বিধান সম্মত ছিল । নারী জন্মকে অভিশাপ মনে করা হতো ।
দাস-দাসীদের অবস্থাঃ
গোলামদের মুক্তির বিধান ছিল না । ইচ্ছা করলে মালিক গোলাম বাঁদীকে জ্যান্ত হত্যা করতে পারতো । কোনক্রমে যদি গোলাম মুক্ত হয়ে যেত তবে সমাজে তার মর্যাদা ছিল না । উঁচু শ্রেণির সাথে তার কথাবার্তা, চলাফেরা নিষিদ্ধ ছিল । যেকোনো অজুহাতে আবার কেউ এদেরকে গোলামে পরিণত করে ফেলতো ।
আইন ও বিচার ব্যবস্থাঃ
পূর্বেই বলা হয়েছে, বিচার ব্যবস্থা শ্রেণী ভেদে বিভিন্ন প্রকার ছিল । উঁচু শ্রেণী ছিল বিচারের উর্ধ্বে । আবার নীচু শ্রেণীর কেউ কোন অপরাধ করলে ইরানে সেই অপরাধীসহ তার গোষ্ঠীকে হত্যা করা বৈধ ছিল ।
শ্রম-শোষণ ও সুদপ্রথাঃ
নীচু শ্রেণীর মানুষকে বিনা পারিশ্রমিকে অত্যাচারের মাধ্যমে শ্রমে বাধ্য করা হতো । সুদ প্রথার নিষ্পেষণে নীচু শ্রেণীর লোকের কোন দিন স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পেতো না ।
এই পর্যায়ে আমরা যদি রোমান, ইরান ও তখনকার ভারতবর্ষের সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মানবতাবোধকে তুলনা করি তাহলে আজও যে পাশ্চাত্যের খৃস্ট সমাজ ও ব্রাহ্মণ্য সমাজে সেই বৈষম্যের জের অবশিষ্ট আছে তা উপলব্ধি করা যায় ।
বিশ্বনবী (সাঃ) এর ঘোষণায় রয়েছে, "হে লোক সকল! তোমাদের মা ও তোমাদের আদি পিতা একজনই । আরবীর আজমীর উপর এবং আজমীর আরবীর উপর কোন প্রাধান্য নেই । তাই সাদার উপর কালোর, বাদামী রঙের উপর ফর্সার কোন গুরুত্ব নেই । তাকওয়া হলো মর্যাদার চাবিকাঠি ।
আল্লাহ তোমাদের মাধ্যমে বংশগত জাহেলিয়াতের মর্যাদা মুছে দিয়েছেন । তোমরা সকলেই আদমের সন্তান আর আদম মাটির সৃষ্টি ।
তোমরক যা আহার কর এবং পরিধান কর তা গোলামদেরও দাও ।
তোমাদের উপর নারীদের এবং নারীদের উপর তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে ।
পিতার অপরাধে পুত্রের এবং পুত্রের অপরাধের কারণে পিতার বিচার হবে না । কারও কৃতকর্মের জন্য অন্য ব্যক্তি দায়ী নয় ।
কোন হাবশী গোলামও যদি কুরআন অনুযায়ী তোমাদের চলতে নির্দেশ করে এবং শাসন করে তবে তার আনুগত্য করা তোমাদের জন্য ফরয ।
মানবতার মুক্তির জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট সার্বজনীন আইন পৃথিবীতে আছে কি এবং কেউ প্রণয়ন করতে পারবে কি ।
═──────────────═