হিজরতের প্রতিচ্ছবি
শহীদুল ইসলাম
===========================================================
(এক) নবুয়্যতের ত্রয়ােদশ বছর। কওমকে হেদায়েতের পথে তুলে আনার জন্য, বুঝানাের জন্য প্রিয় নবীর (সঃ) যত্নের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু নবুয়্যতের প্রথমদিনই কুরাইশরা নবীজীকে যেমন মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল, আজো তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার জন্যে মুহাম্মদ (সঃ) কে সমানে গালি দিচ্ছে। নিজ বংশ বনী হাশেম ও কুরাইশই তাঁর সবচেয়ে বড় দুশমন, এরাই তাকে অযথা মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে। যে কুরাইশ ছেলেরা মুহাম্মদ (সঃ)-কে 'আল-আমীন’ বলে ডাকতাে তারাই আজ আল-আমীনের গায়ে পাথর মারে। তার চলার পথে ময়লা, আবর্জনা ও কাঁটা বিছিয়ে রাখে। পাগল, লাত-ইবারেল দুশমন ইত্যাদি বলে তিরস্কার করে। এরাতাে সবাই স্ববংশীয় কুরাইশ-বনী হাশেম গােত্রেরই লােক। এতাে কিছু করেও এদের দুশমনী শেষ হয়নি। ৬২২ খৃষ্টাব্দে এসে তাদের ক্রোধ-হিংসা চরম আকার ধারণ করে। কারণ তখন মুহাম্মদ (সঃ) এর পৃষ্ঠপােষক, প্রাণ প্রিয় চাচা আবু তালিব আর বেঁচে নেই। সুখ-দুঃখের একান্ত সঙ্গিনী, বিপদের সান্তনা, হৃদয়-সম্পদ উজাড় করে অহর্নিশি ছায়ারমত অনুগামী, সহধর্মীনী, মহিয়সী খাদিজাতুল কোবরাও জান্নাতবাসী হয়েছেন। ঘরে মা হারা ফাতিমা (রাঃ)কে দেখে কেঁদে উঠে নবী হৃদয়, আর ঘর থেকে বের হলে নরপশুরা বর্ষন করে পাথর বৃষ্টি, “লাস্তা সুরসালান, লাস্তা মুরসালান” তুমি নবী না, তুমি রাসূল না ইত্যাদি বলে আওয়াজ তুলে। কাফেরদের এসব কটুক্তিতে ব্যথায় ভরে ওঠে মন। দাওয়াত কবুলের আশা ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় কাফিরদের এসব উচ্চারণ। কেউ তাঁকে উপহাস করে বলে, হে মুহাম্মদ! তােমাকে হত্যা করার জন্য একটি উন্নত তরবারি কিনেছি, আবার কোন দুরাচার বলে ওঠে, হে আহমদ! তােমাকে বধ করতে আমি একটা তেজী ঘােড়া ক্রয় করেছি।
তবে কাফেরদের নির্যাতনে নবীজী (সঃ) কষ্ট পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু হতাশাগ্রস্থ হননি। কখনও এদের জন্য বদ দুয়াও করেননি কোন দিন। কুরাইশদের এ শত্রুতার অন্যতম কারন ছিল, এরা বুঝতে পেরেছিল, আমরা যত দুশমনিই করি না কেন, তারপরও মক্কার বহু কীর্তিপুরুষ মুহাম্মদ (সঃ)-এর দলে ভিড়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন তার সমর্থকের সংখ্যা বাড়ছে। একদল আত্মত্যাগী সাহসী ও প্রভাবশালী লােক মুহাম্মদের (সঃ) কল্যাণার্থে সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত! ১৮ বছরের বাহাদুর যুবক আলী (রাঃ) যুলফিকার নিয়ে রাত দিন তাঁকে পাহারা দেয়। আবু বকর (রাঃ)- এর মত সম্পদশালী, জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞব্যক্তি ইসলামের স্বার্থে বৃষ্টিরমত ঢেলে দেয় দিনার দিরহাম। পালােয়ান উমর (রাঃ) মুহাম্মদ (সঃ) এর আত্মরক্ষায় নিজের বুক পেতে দেয় সবার আগে। মহাবীর হামযা (রাঃ) তাঁর সাথে লেগেই থাকে সারাদিন। এছাড়া উসমান (রাঃ), জাফরসহ (রাঃ) মক্কার এমন আরাে চারশ প্রবীণ ও তরুণ এবং তায়েফ ও মক্কার উপকণ্ঠে আরও প্রায় একহাজার অধিবাসী মুহাম্মদ (সঃ)-এর দাওয়াত গ্রহণ করে তাওহীদের ওপর বিশ্বাস এনেছে। ওদিকে ইয়াসরিবের (মদীনার) ছােট-বড়, খ্যাত-অখ্যাত বলতে গেলে সব লােকই মুহাম্মদের ভক্ত এবং তাঁর কথায় খুব বেশী প্রভাবিত ও গভীর আস্থাশীল। তাই এখনাে যদি তাকে প্রতিরােধ না করা হয় তাহলে আমাদের তিয়াত্তর কাতারে ফেলে সে বাজিমাত করবে। আর ইয়াসরিবের লােকদের সাথে তাঁর যে দহরম মহরম চলছে তাতে যে কোন সময় সােনার হরিণ আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রবল হয়ে ওঠছে।
কাজেই কোনভাবেই তাকে মক্কা ছেড়ে যাওয়ার সুযােগ দেয়া যাবে না। তাহলে সে তাঁর যাদুমাখা বক্তৃতা আর কবিতা (কুরআন) শুনিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই জগতের মানুষ ভক্ত বানিয়ে ফেলবে। তারপর বিশাল বাহিনী সাজিয়ে সুযােগমত আমাদের ওপর যে আঘাত হানবে না সে গ্যারান্টি কে দিবে? কাজেই আর কালবিলম্ব করা চলবে না। এ সমস্যা এখনই চুকিয়ে ফেলতে হবে। এদিকে রাসূল (সঃ)-এর নিকট কুরাইশদের এ ষড়যন্ত্রের কথা পৌছে যায়। হুজুর (সাঃ)ও সাহাবাদের হিজরতের নির্দেশ দিয়ে দিলেন। প্রতি দিন এক দু’জন সাহাবী হিজরত করে মদীনায় চলে যাচ্ছে। কোন কোন সাহাবী আরজ করলেন, হুজুর! স্বদেশ ত্যাগ করার চেয়ে আমাদেরকে নির্দেশ দিন আমরা দুমশনদের ঘাড় ভেঙ্গে দেই। -তাঁদের একথার জবাবে রাসূল (সঃ) বল্লেন, “নিঃসন্দেহে তােমরা সাহস রাখাে এদের সাথে লড়তে। তবে আল্লাহ তা'আলা আমাকে ‘রাহমাতুললিল আলামীন’ করে পাঠিয়েছেন। আমার ইচ্ছা হয় না যে, নিজ গােত্র-আত্মীয়দের সাথে লড়াই করি। এর চেয়ে বরং দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালাে।” কিন্তু এমতাবস্থায় কি করে শত্রু বেষ্টিত অবস্থায় আমরা আপনাকে ছেড়ে যাব। বরং আপনার পরিবার পরিজন সহ আমরা সবাই একদিনে মক্কা ত্যাগ করে চলে গেলে কেমন হয় ? তোমাদের সাথে প্রকাশ্যে আমার যাওয়া ঝুকিপূর্ণ। এভাবে যেতে দেখলে কুরাইশরা আমাদের ওপর চড়াও হবে। হেরেমে কাবাতে এমন রক্তপাত হােক, এ বেয়াদপি আমরা করতে পারি না। আর নিজ কওমের দুর্নাম ছড়াতেও আমি চাই না। কারণ "ইন্নাকা লা-আলা খুলুকিন আযীম” আপনি শ্রেষ্ঠতম চরিত্রের অধিকারী” – তাে আমার পরিচয়। তােমরা আল্লাহ, রাসূলের নির্দেশে ঠাণ্ডা মাথায় মক্কা ছেড়ে চলে যাও। তবে সকলের শেষে হযরত উমর (রাঃ) প্রকাশ্যে দিনের বেলায়, অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে স্বদেশভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় রওয়ানা হলেন।
৬২২ খৃষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর। মক্কার মিলনায়তন দারুল নাদওয়ায় প্রতিদিনের মত আজও কাফেরদের বৈঠক বসেছে। শয়তান শায়খে নজদীর বেশধরে বৈঠকের সভাপতিত্ব করে। সব শেষে সে সিদ্ধান্ত দিলাে, মুহাম্মদ (সঃ)-কে হত্যা করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। যেই কথা সেই কাজ। সাথে সাথে আবু জাহেল ঘােষণা দিল, একক কোন গােত্র মুহাম্মদকে হত্যা করলে হয়ত গােত্র কলহ দেখা দিতে পারে। কাজেই প্রত্যেক গােত্রের শক্তিশালী যুবকদের একটি দল সম্মিলিত ভাবে আজ রাতেই মুহাম্মদ (সঃ)কে হত্যা করবে।
এই ঘটনার পরে হযরত জিব্রাঈল আমীন (আঃ) রাসূল (সঃ)-কে জানিয়ে দিলেন, “মুহাম্মদ! কাফেররা আপনাকে বন্দী করে রাখবে অথবা হত্যা করবে অথবা আপনাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করবে। এরা চক্রান্তের জাল বুনেছে, আল্লাহ্ তা'আলাও কৌশল করেছেন যিনি সর্ব শ্রেষ্ঠ সু-কৌশলী।” জিব্রাঈল (আঃ) আরাে বলেন, হে নবী! আপনি সমুদ্র উপকূল ঘেষে 'কেনসারুন’ শহর হয়ে সফরের যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তা পরিবর্তন করে আল্লাহ তা'আলা ইঙ্গিত করেছেন আপনাকে সােজা মদীনা চলে যাওয়ার জন্য। 'অতঃপর আরাে কিছু দিক নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে জিব্রাইল (আঃ) চলে গেলেন। হযরত আলীকে (রাঃ) সাথে নিয়ে মহানবী কা'বা প্রাঙ্গণ থেকে বাড়ি আসার পথে দেখলেন, আবু জাহেলের নেতৃত্বে একদল বিজলী চমকানাে নেজা-তলােয়ার নিয়ে রাস্তার মােড়ে টহল দিচ্ছে নবীজী (সঃ)-কে দেখে পিশাচ আবু কাফের। জাহেল বলে উঠলাে, এইতাে মুহাম্মদ! যে বলে বেড়ায়, “তােমরা যদি আমার কথায় ঈমান আন, তাহলে আখেরাতে মর্যাদা ও জান্নাত পাবে; অন্যথায় তলােয়ারের আঘাতে তােমরা মৃত্যু বরণ করবে, আর জাহান্নাম হবে তােমাদের ঠিকানা। "হ্যা। আমি যা বলি তা সত্য; অবশ্যই একদিন প্রতিফলিত হবে আমার কথা।
নিশ্চয়ই তােমরা নিক্ষিপ্ত হবে জাহান্নামের আস্তাকুড়ে।” দৃঢ়কণ্ঠে একথা বলে, হুজুর (সঃ) বাড়ী চলে এলেন। বাড়ি এসে আলী (রাঃ)কে বলেন আলী! আজ রাতেই আমাকে মক্কা ছেড়ে চলে যেতে হবে। তুমি আমার বিছানায় শুয়ে থাকবে, ভয় নেই! কাফেররা তােমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এ আমার চরম সৌভাগ্য, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমি জীবনের ভয় করি না। আপনি সুখে থাকুন, সুস্থ্য থাকুন, নিরাপদে থাকুন। পাশ থেকে ফাতিমা (রাঃ) সব কথা শুনে ভয়ে-শংকায় তাঁর অন্তরাত্মা কেঁদে উঠলাে। তার দু'চোখ গড়িয়ে পড়ছিলাে অশ্রুধারা। কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, আব্বাজান! এ অভাগা মেয়েকে আপনি কোথায় ফেলে যাচ্ছেন? আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে না মা! আলী ও তােমার সৎমা সাওদা তােমার কাছেই থাকবে।
আব্বাজান! আপনাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব! তােমাদের বিরহ ব্যাথা আমাকেও বিচলিত করে তুলছে। তবে খুব তাড়াতাড়ি তােমরা আমার সাথে মিলিত হবে। কান্নকাটি করাে না, জেনে রাখ, বিচ্ছেদ ছাড়া প্রকৃত মিলনের আনন্দ উপভােগ ও উপলব্ধি করা যায় না।
(দুই) ১২ই সেপ্টেম্বর, ২৭শে সফরের অন্ধকার রাত। তারকারাজীও যেন লজ্জায় মেঘের কোলে লুকাতে যাচ্ছে। নিকষ কালাে আধারে জগতময় থমথমে ভাব বিরাজিত। প্রায় মধ্য রাত। হুজুর (সঃ) বিছানা ছেড়ে উঠে অজু বানিয়ে আলী (রাঃ)-কে ডাকলেন। কতিপয় লােকের নাম উচ্চারণ করে বললেন, আমার কাছে 'আমানত রাখা এ মাল-সম্পদ গুলাে তুমি তাদের কাছে পৌছে দিও। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি দরজা বন্ধ করে আমার বিছানায় শুয়ে পড়। নবীয়ে দু'জাহান (সঃ) দরজা খুলে বেরিয়ে দেখলেন, ধারালাে অস্ত্রে সজ্জিত কাফেরদল তাঁর ঘরের চতুর্দিক ঘিরে রেখেছে। কি আশ্চর্য, ওরা সব যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন! তিনি একমুষ্টি ধুলাে হাতে তুলে সুরায়ে ইয়াসীনের 'ওয়াহুম লা ইয়ুবসিরুন” পর্যন্ত পাঠ করে শত্রুদের প্রতি ছুড়ে মারলেন। আল্লাহর নির্দেশে প্রতিটি কাফেরের চোখে গিয়ে বিধল তাঁর নিক্ষিপ্ত বালু কণা গুলাে।
আল কুরআনে এ বিষয়টিকে আল্লাহ তাআলা এভাবে তুলে ধরেছেনঃ "আর (আপনি যখন বালু নিক্ষেপ করেছিলেন), তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহর কুদরতি হাতই নিক্ষেপ করেছিল।” কাফের দল অন্ধের মত ঠায় দাড়িয়ে রইল। হুজুর (সঃ) এদের বন্ধন, ভেদ করে সােজা আবুবকর (রাঃ)-এর বাড়ির দিকে হেটে গেলেন। আবু বকর (রাঃ) তখনও তাঁর বাড়ীর আঙ্গিনায় দাড়িয়ে অপেক্ষমান। তিনি নবীজীকে ঘরের পিছনের দরজা খুলে ভেতরে বসালেন। ব্যস্ত নিঃশ্বাস নিয়ে মহানবী (সঃ) বললেন, আবু বকর! এক্ষুণি আমাদের রওয়ানা করতে হবে। সৃষ্টির সেরা, মানবতার নবী, সাইয়্যেদুল মুরসালীণ (সঃ)-কে রাতের আঁধারে পিছনের খিড়কী দিয়ে বিদায় জানালাে আবু বকর (রাঃ) পরিবার। তাঁরা মােনাজাত করছিলেন, “হে প্রভু! রাসূল (সঃ)কে তুমি হেফাজত কর। সমূহ বিপদ থেকে তাঁকে রক্ষা কর। তাঁর কোন অমঙ্গল করনা তুমি।” আবু বকর (রাঃ)- এর ঘর থেকে আড়াই ক্রোশ দূরে “গারে সাউর”। জনপদ ছেড়ে আবু বকর (রাঃ) রাসুল (সঃ)-কে নিয়ে নির্জন পথে হাটতে লাগলেন। ধারালাে মরু কাঁকরের আঘাতে আর কাঁটাযুক্ত লতাগুল্ম পেচিয়ে নবীজীর স্বাভাবিক পথ চলা বারবার ব্যহত হয়। হােচট খেয়ে তিনি পাথরের উপর পড়ে যান। কিছুক্ষণ চলার পর আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় নবীজীর পদদ্বয় মুবারক।
মহাবিপদের একান্ত সাথী সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) এ সময় রাসূলে আকরাম (সঃ)কে নিজের পিঠে তুলে নেন। রাসূলকে পিঠে তুলে এ কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে অতি কষ্টে তিনি “গারে সাউর” পর্যন্ত পৌঁছালেন। তখন পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে। কাঁটা ও পাথরের আঘাতে আবু কবর (রাঃ)- এর পা থেকে দর দর করে রক্ত ঝরছে। কিন্তু এ দিকে তার কোনই ভ্রুক্ষেপ নেই। অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহা পরিষ্কার করে নিজের চাদর টুকরাে টুকরাে করে গর্ত গুলো বন্ধ করে হুজুর (সঃ)-কে ভিতরে ডেকে নিজের উরুর ওপর কাত করে শুইয়ে দিলেন। একটি ছিদ্র যা খােলা ছিল সেটি পায়ের গােড়ালি দ্বারা চেপে রাখলেন যেন এর ভিতরের সাপ বিচ্ছু বেরুতে না পারে। চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় গুহাভিমুখে তাকিয়ে রইলেন আবু বকর (রাঃ)। প্রিয় সঙ্গীর উরুতে মাথা রাখাবস্থায়, দুর্গম পথের ক্লান্তি রাসূলের (সঃ) চোখে তন্দ্রা নিয়ে এলাে। এমন সময় গর্ত চেপে রাখা পায়ে সর্পদংশনের অসহ্য ব্যথায় নবী সঙ্গীর এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লাে রাসূল (সঃ)- এর চেহারায়। নজীবী (সঃ) চোখ মেলে দেখলেন, আবু বকর (রাঃ)- এর সর্বাঙ্গ বিষে কালো হয়ে গেছে। তারপরও তিনি রাসূল (সঃ) এর আরামে ব্যঘাত হয় এ আশংকায় নড়েননি একচুলও। রাসূল (সঃ) দুয়া পড়ে ক্ষত স্থানে পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দিলে সাথে সাথে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন আবু বকর (রাঃ)। ঘর ছেড়ে হুজুর (সঃ) চলে আসার একটু পরেই শয়তান এসে কাফেরদের হাঁকলাে, ও হে আহমকের দল, তােমরা বসে কি করছ! মুহাম্মদ (সঃ) তাে তোমাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কাফের দল চোখে মুখে হাত কচলিয়ে দেখলো, ঠিকইতাে বলছে বুড়াে।
কিন্তু উকি দিয়ে ঘরে একজনকে শােয়া দেখতে পেয়ে আর তেমন আমল দিল না তারা বুড়াের কথায়। সকাল বেলা নবীর বিছানায় হযরত আলী (রাঃ)কে পেয়ে চরম বিস্ময়ের সাথে কাফেররা আলীকে (রাঃ) বললাে, বল, মুহাম্মদ কোথায় ? আলী (রাঃ) স্বক্ষেদে বললেন, তােমরা কি আমাকে পাহারাদার নিযুক্ত করে ছিলে? আমি কি জানি তােমরাই তাে পাহারা দিলে রাতভর। আবু জাহেল এসে বললাে, ওহে নির্বোধের দল! তােমরা ব্যর্থ হয়ে একে শুধু ধমকাচ্ছাে। দিকে দিকে ছুটে যাও, কোথায় পালিয়েছে খুঁজে বের করা চাই। মুহূর্তের মধ্যে এ খবর সাড়া মক্কা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) চলে গেছে। তাঁকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ঘােষিত হলাে আকর্ষণীয় নানা পুরষ্কার। পুরস্কার লােভী কাফেররা চতুর্দিকে খোঁজাখুজি শুরু করে দিল। একদল কাফের ‘গারে সাউর’ এর কাছে গিয়ে বললাে, রাতের বেলায় ওরা আর বেশী দূর যেতে পারেনি। হয়ত এই গুহার মধ্যেই ওরা লুকিয়ে আছে। এ গুহায়ই তাদের পাওয়া যাবে। কুদরতের ইচ্ছায় অল্প সময়ের মধ্যে মাকড়সা জাল বানিয়ে গর্তের মুখ ঢেকে দিয়ে ছিলাে। আর একটি কবুতর এসে ডিম পেড়ে তাতে তা দিচ্ছিল। দলের অন্যেরা তাকে ধমক দিয়ে বল্লো, দেখতে পাচ্ছো না, গর্তের মুখে মাকড়সা জাল বানিয়ে রেখেছে আর কবুতর ডিম তা দিচ্ছে। মানুষ ঢােকলে মাকড়সার জাল থাকতাে নাকি? আর বুনো কবুতর বুঝি বাসা বানাত মানুষের মাথার ওপর? অন্য একজন চেচিয়ে বল্লো, আমি মুহাম্মদ (সঃ) এর জন্মের আগ থেকে এ গর্তটিকে এমনই দেখছি। চলাে এখানে সময় নষ্ট না করে অন্য দিকে খুঁজি। এসময় আবু বকর (রাঃ) গর্ত থেকে কাফেরদের কথােপকথন শুনে ভীত ন্ত্রস্থ হয়ে নবীজীকে বললেন, “ওরা যদি আমাদের দেখে ফেলে!” মহানবী (সঃ) তাঁকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “ভয় করাে না আবু বকর! আল্লাহ আমাদের সাথেই রয়েছেন। তিনি আমাদের খুবই কাছে।”
(তিন) ১২ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৬ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাসুল (সঃ) ও আবু বকর গারে সাউরে” অবস্থান করলেন। রাতের বেলায় সুযােগমত উভয়ে বেরিয়ে আসতেন ক্ষণিকের জন্য। আবু বকর (রাঃ)-এর আযাদ গােলাম আমের বিন জুহাইয়া ছাগল চড়ানাের ভান করে পাহারা দারীর কাজ আঞ্জাম দিচ্ছিলেন। আর তাদের আহারের জন্য বকরীর দুধের ব্যবস্থা করতেন। এ সময় আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রাঃ) দৃশ্যত কাফেরদের সাথে উঠাবসা করে তাদের গতি বিধি ও খবরা খবর রাত্রে হুজুর (সঃ)-কে অবহিত করতেন।
১৬ই সেপ্টেম্বর, ১লা রবিউল আউয়াল, রবিবার। শুক্লপক্ষের চাঁদ ক্ষণিকের জন্য উদিত হয়ে আধারে তলিয়ে গেছে। পাহাড়গুলাে নিরব নিঃস্তব্ধ দাড়িয়ে আছে। নীল আকাশের তারাগুলাে যেন ঝুকে পড়ছে।
প্রিয় পাঠক-পাঠিকাগণ। একটু অন্তর দৃষ্টি দিয়ে তাকালে আমাদের চোখে ভেসে উঠবে, 'গারে সাউরে’ কাছে হাওদা সাজানাে চারটি উট জাবর কাটছে। কাতারের প্রথম উঠটি হলাে আমের বিন। ফুহাইরার (রাঃ)। যিনি আঁধার রাতে রাসুল (সঃ)-এর সফর সঙ্গি। দ্বিতীয় উটটি আব্দুল্লাহ বিন দাইলামীর (রাঃ)—যিনি এ কাফেলার রাহবার। তৃতীয় উঠটি হুজুর (সঃ) হিজরতের সময় সওয়ার হওয়ার জন্য চারশত দিরহামের বিনিময়ে আবু বকর (রাঃ) থেকে খরিদ করেছেন কিছুদিন আগে। গুহা থেকে মাত্র চারগজ দূরে সর্বাঙ্গ কালাে কাপড়ে আবৃত এক ভাগ্যবতি তরুণী একটি পুটুলি হাতে ' দাড়িয়ে আছে। নাম তার আসমা। মা-আসমা খাবারের পুটুলিটা দাও, আমার হাওদার সথে বেঁধে নেই। আসমা (রাঃ) এগিয়ে পিতার হাতে পুটলিটা তুলে দিলেন। বেটি! পাথেয় তাে আনলে, কিন্তু এটি বাঁধার জন্য তাে কোন রশি আননি। একথা শুনে আসমা একটি বলিয়াড়ির আড়ালে গিয়ে নিজ পরিধেয় কাপড়ের নিম্নাংশ ছিড়ে এনে দিলেন তার আব্বার হাতে।
তা-ই রশি বানিয়ে আবু বকর খাদ্যের পুটুলিটা উটের হাওদার সাথে ঝুলিয়ে বেঁধে নেন। নবীয়ে দু’জাহান এদৃশ্য অবলােকন করে বললেন, "আবু বকর (রাঃ) পরিবার তাঁদের নবীর (সঃ) জন্য যে অবর্ণনীয় খিদমত করেছে, আল্লাহ তা'আলা এর নিবিময়ে তাদের উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন।” (আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উ ৎসর্গ হােক) ইয়া রাসূল আল্লাহ! (সঃ) আপনার বিরহ যে কত বেদনা বিধুর তা বুঝাতে পারব না। এই বলে আসমা ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বেটী, কেঁদে কেঁদে নিজেদেরকে দুর্বল করে ফেলাে না, অচিরেই তােমাদের সাথে আমরা মিলিত হব। ইনশা আল্লাহ। আসমা (রাঃ)কে শান্তনা দিয়ে দুয়া পড়ে হুজুর (সঃ) কাসওয়াতে আরােহণ করলেন, অতঃপর রাহবার আবদুল্লাহ বিন আরিকাত দাইলামী (রাঃ) পথ দেখানাের জন্য তাঁর উটকে আগে বাড়িয়ে সফর শুরু করেন। অল্পক্ষণের মধ্যে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল “গারে সাউরের” সেই ছােট কাফেলাটি।
(চার) শত্রুর শে্যণ দৃষ্টি এড়ানাের জন্য রাহবার আবদুল্লাহ (রাঃ) নববী কাফেলাকে সমুদ্র উপকূলের জনপদ ছেড়ে অচেনা ও দুর্গম পথ দিয়ে মদীনায় নিয়ে চলছেন। তাঁর দৃষ্টি অত্যন্ত সতর্ক। একহাতে তরবারি অন্য হাতে উটের লাগাম। পিছনে নবীজীর (সঃ) উটনী “কাস্ওয়া”। এরপর হযরত আবু বকর (রাঃ}, সবার পিছনে শেরদিল আমের বিন ফুহাইরা (রাঃ)। একটানা ১৪ দিন চললাে এই কাফেলা। পথে কত বিপদ দুঃখ-কষ্ট যে তাদের বরণ করতে হয়েছে তা সবিস্তারে এক্ষুদ্র নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়। জনমানবহীন এলাকা দিয়ে অগ্রসর হলেও এক পথিকের কাছে সন্ধান পেয়ে দ্রুত ঘােড়া ছুটিয়ে সুরাকা বিন মালেক এসে হাজির হয়েছে হুজুর (সঃ)কে ধরে নেয়ার জন্য। কিন্তু কাছাকাছি পৌছালে আকস্মিকভাবে তার ঘােড়ার পা শক্ত মাটিতে ধ্বসে যায়। সে হুজুর (সঃ) এর কাছে ক্ষমা চায় এবং অঙ্গিকার করে যে, কোন কাফেরকে সে এ কাফেলার সন্ধান দিবে না।
তারপর রাসূল (সঃ) এর দুয়ার বরকতে সুরাকা তার ঘােড়া ধ্বংস থেকে তুলে সােজা মক্কার পথে• চলে আসে এবং অন্য যারা খুঁজছিলাে তাদেরকে এ কথা বলে ফিরিয়ে দেয়, যে আমি এ পথে দেখে এসেছি তােমরা অন্য দিকে খোঁজ কর। একদিন চরম ক্ষুধা ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কাফেলা নিয়ে হুজুর উমে মা’বদ নামক এক মহিলার বাড়িতে উঠলেন। কিন্তু মহিলা অত্যন্ত অতিথি বৎসল হলেও তখন তাঁর ঘরে কোন আহার এবং দুধালাে কোন বকরী ছিল না। কিন্তু হুযুর (সঃ) তার একটি দুর্বল-শীর্ণকায় বকরীর উলানে হাত দেয়া মাত্রই তা হৃষ্ট-পুষ্ঠ হয়ে দুধে ভরে যায় এবং হুজুর (সঃ) তা থেকে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে উম্মে মা’বাদের ঘরে রেখে আসেন পরশ মনির ছোঁয়া। দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষে ১৪দিন পর রাসূল (সঃ) মদীনার উপকণ্ঠে এসে পৌছালেন। পথে যদিও কষ্ট অনুভব হয়েছিলাে কিন্তু যখন মদীনার সুবিন্যস্ত বাড়ী ঘর ও খেজুর বাগানের নৈসর্গীক দৃশ্য চোখে পড়ল তখন মহানবীর প্রাণ জুড়িয়ে গেল। সকল ক্লান্তি ও দুঃখ তিনি ভুলে গেলেন। এদিকে মক্কা থেকে রওয়ানা হবার পর পরই মদীনায় খবর পৌঁছে গিয়েছিল যে, রাসূল (সঃ) মদীনায় আসছেন। তারপর থেকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনকারীরা প্রতিদিন মদীনার উপকণ্ঠে এসে সারাদিন রাসুলের জন্য অপেক্ষা করে সন্ধ্যা বেলা যার যার বাড়ী ঘরে চলে যেত।
৩০শে মে র শেষ বেলা—প্রায় সন্ধ্যা। অন্যান্য দিনের মত অভ্যর্থনা জ্ঞাপনকারী দল ভগ্নমনে যার যার ঘরে ফিরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পাহাড়ের চূড়া থেকে এক ইহুদী হেকে উঠলল, হে আরববাসী, তােমাদের নবী (সঃ) এসে গেছেন। ডাক শুনে মদীনার আনসারগণ পঙ্গপালের মত হুজুর (সঃ)- এর উটনীকে ঘিরে ফেললো। কিছু লােক শহরবাসীদের সংবাদ দেয়ার জন্য শ্লোগান দিতে দিতে আগে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে মদীনার কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়লাে মহানবী (সঃ)-এর আগমনী সংবাদ। সারা মদীনা জুড়ে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। ছেলে, বুড়াে, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশাের, তরুণ-তরুণী তথা সর্বস্তরের মানুষের ঢল নেমে এলাে মদীনার উপকণ্ঠে। যে নবীকে স্বীয় বংশের লােকেরা তাড়িয়ে দিল তাঁকেই হৃদয়ের সকল শ্রদ্ধাঞ্জলী দিয়ে বরণ করে নল মদীনাবাসী। কী পরম সৌভাগ্য তাদের! মদীনার আনসারগণ সেদিন বিশ্বনবী (সঃ)-কে যে প্রাণ ঢালা অভ্যর্থনা দিয়েছিলেন, পৃথিবীর কোন নেতা হৃদয়ের মাধুরী মাখা এমন অকৃত্রিম অভ্যর্থনা লাভের কল্পনাও করতে পারে না। এমন অভিষেক অনুষ্ঠান পৃথিবী কোন দিন প্রত্যক্ষ করেনি; করবেও না কোনদিন। আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলবী (রহঃ) বলেন, মদীনার অন্তঃপুর বাসীনী বধুরাও সেদিন অতি আনন্দ ও আবেগে বেরিয়ে এসেছিল মহানবী (সঃ)কে স্বাগত জানাতে। এটা হলাে কু’বা পল্লী, এ পল্লীতে রাসূল (সঃ) ১৪দিন অবস্থান করেন এবং কুলসুম বিন হদমের জায়গার ওপর একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। যে মসজিদ সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছেঃ “মসজুিদু উসিস আলা তাকওয়া!” এ সেই মসজিদ তাকওয়া পরহেজগারীর ওপরই যার প্রতিষ্ঠা।
১৪দিন পর শুক্রবার কুবা পল্লী থেকে রাসুল (সঃ) মদীনার মূল শহরের দিকে রওয়ানা হলেন। পথে বনী সালেম গােত্রে জুময়ার নামাজ আদায় করেন এবং খুতবা দেন যা ছিল রাসূল (সঃ) এর প্রথম জুময়া। নামাজ শেষে মদীনার আনসার ও মুহাজের সাহাবীগণ পরিবেষ্টিত হয়ে হুজুর (সঃ) আবার রওয়ানা হলেন! আল্লাহু আকবার” তাকবীরে মদীনার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠল। রাস্তার দু'পাশে সারি বেঁধে দাড়িয়ে গেল জনতা। নাজ্জার গােত্রের যুবকেরা খুশিতে নেজা তরবারি নিয়ে পথে পথে মহড়া দিচ্ছিল। রাসূলে পাকের (সঃ) সওয়ারী যখন কোন বাড়ির পাশ ঘেঁষে চলত তখন আত্ম নিবেদিত মানুষের ভীড় ঠেলে আনসারগণ , এসে আরজ করতেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই ঘর, এই মাল, এই সম্পদ, এই প্রাণ সবই আপনার জন্য উৎসর্গিত; আপনি কবুল করুন। তাদের এ শুভ কামনার জন্য রাসূল আকরাম (সঃ) তাদের কল্যাণে দুয়া করতেন। আনসারগণ তখন হুজুর (সঃ) ও আবু বকর (রাঃ)কে সাদা কাপড়ের জামা পরিয়ে দিয়ে ছিলেন। তাই নবাগত অনেকেই কে মুর্শিদ আর কে শিষ্য ঠাওর করতে পারছিলাে না। অবস্থা আঁচ করে আবু বকর (রাঃ) তখন একটি চাঁদরের দু' কোন উচু করে ধরে আর দু’কোন আরেক জনের হাতে দিয়ে মহানবী (সঃ)-এর মাথার ওপর শামিয়ানার মত উঁচু করে ধরেন। যারফলে নবাগতদের আর হুজুর (সঃ)-কে চিনতে অসুবিধা হলাে না। মহানবী (সঃ) মদীনা শহরের কেন্দ্রে পৌছলে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে খুশি-আনন্দে পুরুষ-নারীগণ সমস্বরে গাইতে ছিলাে।
তালা’আল বাদরু আলাই না মিছানিয়াতিল বেদাঈ ওয়াজাবাশ, শুকরু আলাইনা মাদাআ’লিল্লাহি দাঈ।”
কবির ভাষায়ঃ “দেখ চেয়ে ওই চাঁদ উঠেছে গগণ কিণারায়, তাঁর হাসির আভা ছাড়িয়ে গেল নিখিল দুনিয়া।” দফের তালে তালে নেচে ওঠলাে নাজ্জার গােত্রের কচি মেয়েরা। শ্রদ্ধামাখা হৃদয়ের মাধুবী দিয়ে তারা গাইতে শুরু করলাে“আমরা বালিকা সব বনি নাজ্জারের কি মজা, মুহাম্মদ (সঃ) পড়শী মােদের।” রাসূল পাক (সঃ) বালিকাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তােমরা কি আমাকে ভালবাসাে, আমাকে চাও? তারা আওয়াজ দিল, হ্যা! আমরা আপনাকে চাই, আপনাকে ভালােবাসি। আল্লাহর হাবীব (সঃ) বললেন, “আমিও তােমাদের চাই। তােমাদের মাঝেই আমি থাকব।। সেই আনসারী ছােটমনিদের কণ্ঠ আজো ভেসে বেড়াচ্ছে ইথারে। কিন্তু আমাদের শােনার মত কান, উপলব্ধি করার মত হৃদয় নেই। তাই আমরা তা বুঝতে ব্যর্থ! মদীনায় রাসূল আকরাম (সঃ) এর মেহমানদারী করার সৌভাগ্য কে অর্জন করবে এ নিয়ে আনসার সাহবাদের মধ্যে প্রতিযােগিতা শুরু হল। রাসূল (সঃ) ঘােষণা দিলেন, আমার উটনী যে বাড়ীতে গিয়ে থাকবে, সে বাড়ীতেই আমি মেহমান হব। অবশেষে আবু আইউব আনসারী (রাঃ) হলেন সেই সৌভাগ্যের অধিকারী। অবশ্য আবু আইউব আনসারী (রাঃ) এর সাথে রাসূলে পাকের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল পূর্ব থেকেই। মসজিদে নববী ও রাসূলে পাকের জন্য হুজরা তৈরী হওয়া পর্যন্ত তিনি সাত মাস সেখানেই অবস্থান করেছিলেন। মদীনা আসার পর বিশ্বনবীর (সঃ) পােয্য পুত্র যায়েদ (রাঃ)কে মক্কায় পাঠালেন। পরিবারের অন্যান্যদের নিয়ে আসতে। আবু বকর (রাঃ) ও চিঠি দিলেন আবদুল্লাহকে মদীনায় চলে আসার জন্য। কিছু দিনের মধ্যেই যায়েদ (রাঃ) হযরত ফাতিমা, উম্মে কুলসুম ও উম্মুল মু'মিনীন সওদা (রা) এবং আব্দুল্লাহ, হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে নিয়ে মদীনায় আগমন করলেন। আপনজনদের। পেয়ে এবার নবীজী (সঃ) মদীনায় রাষ্ট্রগঠন ও মুহাজির আনসারদেরকে সুসংঘটিত করার প্রতি আত্মনিয়ােগ করেন। এখানেই ইতি হলাে মহানবীর (সঃ) মক্কী জীবন।
*****