JustPaste.it

দেশে দেশে ইসলাম

 

মুসা তারিকের দেশ মরক্কোর অতীত ও বর্তমান

নাসীম আরাফাত

========================================================================

 

        কিংডম অফ মরক্কো। ইতিহাস, ঐতিহ্য আর গর্বের দেশ। মুসা, তারিক, উকবা আর ইউসুফ ইবনে তাসফীনের দেশ। ইবনে বতুতা আর ইবনে খলদুনের দেশ। যুগ যুগান্তর ধরে কালসন্ধিক্ষণে আটলান্টিক মহাসাগরের পূর্বতীরে অবস্থিত এই দেশটি বহু কালােত্তীর্ণ মনীষী, অকুতােভয় বীর মুজাহিদের জন্ম ভূমি। যাদের বীরত্ব গাঁথা ও বিরচিত কালজয়ী গ্রন্থ পাঠে তন্ময় হয় মন ও মনন, বিস্ময়ে বিমােহিত হয় হৃদয়। আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এ দেশটির আয়তন ১,৭১,১১৭ বর্গমাইল। লােক সংখ্যা ২ কোটি ১৬ লক্ষ। প্রায় সকলেই মুসলমান। রাষ্ট্রীয় ভাষা আরবী। উর্বর ও অর্থ প্রসবিনী এদেশের ভূগর্ভ আর ভুপৃষ্ঠ। লােহা, কয়লা, সীসা, দস্তা, কোবাল্ট, তামা, ম্যাঙ্গানিজসহ ফসফেটের বিশাল খনি রয়েছে এদেশের ভূগর্ভে। পৃথিবীর ৭২% ফসফেট শুধু মরক্কোর ভূগর্ভেই সঞ্চিত রয়েছে। আর ভূপৃষ্ট যেন ফলফলাদি ও খাদ্য দ্রব্যের পসরা খুলে বসেছে। গম, বার্লি, ভুট্টা, কমলা, খেজুর, আঙ্গুর, টমেটোসহ নানা প্রকার খাদ্যদ্রব্য ও সুস্বাদু ফলফলাদি উৎপন্ন হয়। তাছাড়া আটলান্টিক মহাসাগর খুলে দিয়েছে মৎস্য আহরণের অবারিত দ্বার। মরক্কো শুধুমাত্র ১৯৮১ সালেই ১,৪৩,১১১ মেট্রিক টন মাছ রপ্তানী করে, যার মুল্য প্রায় ১০০ কোটি দেরহাম! কার্পেট, বস্ত্র, চামড়াজাত দ্রব্য ও পাটও এদেশের এক অর্থকরী শিল্প।

 

ইসলাম-পূর্ব মরক্কো

        বারবার সম্প্রদায় হলাে, মরক্কোর আদিবাসী। তারা গােত্রে গােত্রে দল বেধে বসবাস করতাে। সভ্যতা, মানবতার কোন চিহ্ন তাদের মাঝে ছিলাে না। দয়া-মায়া ও হৃদ্যতার সাথে তারা অপরিচিত ছিলাে। হিংস্র পশুর ন্যায় তারা বিচরণ করতাে। কারণে অকারণে, বিভিন্ন ছল ছুতােয় এরা যুদ্ধে লিপ্ত হতাে। এদের সামাজিকতা ছিলাে অত্যন্ত অদ্ভুত ও বিচিত্র প্রকৃতির। কোন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের অধীনতা এরা সহ্য করতে পারতাে না। তাই তারা দুর্গম সাহারা মরুর কোলে বা বন্ধুর আটলাস পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করতাে। কার্থেজিয়ানদের পর রােমানরা এদেশ শাসন করে। ৬৮৩ খৃস্টাব্দে রােমানদের শাসনামলে মুসলিম, মুজাহিদরা মরক্কো আক্রমণ করে এবং এ ভূখণ্ড মুসলিম সাম্রাজ্যের করতল গত করে নেয়।

 

মরক্কোতে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি

        ৬৮৩ সালে আমীরুল মােমেনীন হযরত মােয়াবিয়া (রাঃ)-র শাসনামলে সেনাপতি উকবা ইবনে নাফের নেতৃত্বে মুজাহিদ বাহিনী প্রথম মরক্কো আক্রমণ করে। তারা রােমান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন। তারপর তারা মরক্কোর আদিবাসীদের ইসলামী শিক্ষাদীক্ষা দানে এবং তাদেরকে ইসলামী সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিবান করতে আত্মনিয়ােগ করেন। তাদেরকে ইসলামের শান্তির সুশীতল ছায়ায় আহবান জানান। পূর্ণ উদ্যোগে তাদের দাওয়াতের কার্যক্রম চলতে থাকে। ইতিমধ্যে এক হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে।

 

        অসভ্য বারবার গােত্রের সংঘবদ্ধ একদল যােদ্ধা ভারী অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিশি রাতে ঘুমন্ত মুসলিম সেনা ছাউনীতে আক্রমণ চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুসলিম সেনাদের মাঝে ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। যার যা ছিলাে তা দিয়েই প্রতিরােধ গড়ে তােলে। কিন্তু পরিকল্পিত ও সুসংহত বাহিনীর সামনে তারা টিকে থাকতে পারল না। একের পর এক সকলেই শাহাদতের কোলে ঢলে পড়ে।

 

        ৭০৫ সালে সেনাপতি মুসআব ইবনে নুসাইরের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী আবার মরক্কো আক্রমণ করে এবং বিজিত মরক্কোতে তারা ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়িত করেন। মানুষের মাঝে শান্তি স্থিতিশীলতা ফিরে আসে।

 

        ৭১১ সালে মরক্কোর পার্শ্ববর্তী দেশ স্পেনের জনগণ অমানুষিক নিপীড়ন ও জুলুম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলে মরক্কো রাজ্যের প্রশাসকের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করে, তাদের রক্ষা করার জন্য কাতর আবেদন জানায়। সেনাপতি তারেক ইবনে যিয়াদ তাদের ডাকে সাড়া দেন। ক্ষুদ্র একদল বীর সেনা নিয়ে, নৌযানে চেপে বসেন। কিংবদন্তী আছে যে, নিজেরা ফিরে আসার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেন। স্পেনের মাটিতে নেমে বাঁচার একমাত্র অবলম্বন নৌযানগুলােও পুড়ে ফেলেন। তার পর মৃত্যুর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে খৃস্টান বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাধারণ জনগণকে খৃস্টানদের হাত থেকে রক্ষা করে ইসলামে দীক্ষিত করেন।

 

        ৭৪৪ সালে উমাইয়া বংশােদ্ভূত ইদ্রীস ইবনে আব্দুল্লাহ মরক্কোকে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রে রূপায়িত করেন। ফেজকে রাজধানী বানিয়ে রাজ্য শাসন শুরু করেন। ৭৯১ সালে তাঁর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় ইদ্রীস সিংহাসনে আরােহন করেন।

 

        ১১০০ সালে মুসলিম মুবাল্লিগরা মরক্কোর আনাচে কানাচে ইসলামের দাওয়াত পৌছে দিতে শুরু করে। ইসলামের সত্যতা, মহানুভবতা ও অনুপম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে বারবার গােত্রের লােক দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। সৃষ্টি হয় গােত্রে গোত্রে মধুর ভ্রাতৃত্বের মিলন। যা ইতিপূর্বে ছিলাে অকল্পনীয়- অভাবনীয়। তখন মরক্কোর রাজা ছিলেন আবু বকর ইবনে উমর। তার অমলীন চরিত্র, তাকওয়া, পরহেজগারী ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রজ্ঞা ও যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতায় সকল প্রজা মুগ্ধ ছিলাে। তার মহানুভবতা বারবারদের মাঝে ভীষণ আলােড়ন সৃষ্টি করে, তাই সকলে মিলে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র কায়েম করে। এই মুরাবিত বংশ ১০৬১ থেকে ১১৪৯ সাল পর্যন্ত মরক্কো শাসন করে। মুসলমানদের এই শক্তি দেখে কিছু বারবার ভীত শংকিত হয়ে পরে। মুসলিম শক্তিকে তারা তাদের অস্তিত্বের ওপর হুমকি মনে করে। ফলে তারা তাদের দুর্গম বন্ধুর ঘাটি থেকে বেরিয়ে মুসলিম বাহিনীর ওপর চোরাগুপ্তা হামলা শুরু করে। সমুদ্র উপকূলীয় ঐশ্বর্য্যবান শহরগুলােতে আক্রমণ করে লুটতরাজ শুরু করে। মুরাবিত রাজা উপকূলীয় শহর গুলাের নিরাপত্তার জন্য একটি শক্তিশালী সেনা ইউনিট তৈরীতে আত্মনিমগ্ন হন। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই তিনি ইহলােক ত্যাগ করেন।

 

        ১০৬১ সালে বাদশাহ আবু বকর ইবনে উমরের ইনতেকালের পর তার সুযােগ্য সাহসী ভ্রাতুস্পুত্র ইউসুফ ইবনে তাসফীন বাদশাহ নির্বাচিত হন। পিতৃব্যের ন্যায় ভ্রাতুস্পুত্রের ব্যাপারে ও মরক্কোর জনগণ ছিলে ঐকমত। পিতব্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউসুফ ইবনে তাসফীন সম্মুখ যাত্রা শুরু করেন। উপকূলীয় শহরগুলােতে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করে তিনি দাওয়াতের কাজে নিমগ্ন হন এবং তাবলীগী সংস্থাগুলাের মাধ্যমে আফ্রিকার নিবিড় প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলােতে ইসলামের আলাে পৌঁছে।

 

        ইবনে তাসফীনের শাসনামলেই স্পেনের বিশাল মুসলিম রাজ্য ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উন্মেষ ঘটে এবং এ দেশগুলো পরস্পর আত্মঘাতী যুদ্ধে ও বিরােধীতায় লিপ্ত হয়। খৃস্টানরা সুযােগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে ছিলো। তারা একটি মুসলিম রাজ্যে আক্রমণ করে মুসলমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং সাধারণ অসহায় মুসলমানদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালায়। অবলা মা-বােনদের সম্ভ্রম-চাদর ছিন্ন করেছে পশুর হিংস্রতা নিয়ে। এ সংবাদে ইউসুফ ইবনে তাসফীন ব্যাকুল হয়ে পড়েন। তিনি স্পেনীয় মুসলমানদের জানমাল ও সম্ভ্রম রক্ষার্থে ছুটে আসেন মরক্কো থেকে। অসহায় মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং জেলেকার প্রান্তরে খৃস্টান বাহিনীকে শােচনীয় ভাবে পরাজিত করে মুসলমানদেরকে খৃস্টান করতল থেকে মুক্ত করেন। ১১০৬ সাল পর্যন্ত ইবনে তাসফীনের শাসনকাল ছিলাে মরক্কোর স্বর্ণযুগ। তারপর থেকে মুরাবিত বংশে চরম নৈরাজ্য নেমে আসে, ভােগ বিলাসিতায় তারা গা ভাসিয়ে দেয়। দেশময় দেখা দেয় চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা।

 

        ১১৪৭ সালে আল মুওয়াহিদ বংশের উত্থান হয়। প্রচণ্ড শক্তিধর এই বংশের বীর পুরুষ আব্দুল মিলান ইবনে আলীর নেতৃত্বে তারা মরক্কোর শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় এবং ক্রমাগত ১২৯৬ সাল পর্যন্ত মরক্কো শাসন করে। এরপর বনী মােরিন বংশের উত্থান হয়। তারা তিন শত বৎসর পর্যন্ত মরক্কো শাসন করে। ১৪৬৮ সালে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। মােরিনদের শাসনামলেই বিখ্যাত পর্যটক ও বিজ্ঞানী ইবনে বতুতা ও সমাজ বিজ্ঞানের জনক ইবনে খলদুনের জন্ম হয়।

 

        ১৬শত' শতাব্দীতে বনু সায়াদ বংশ মরক্কোর রাজ-ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় এবং ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত মরক্কো শাসন করে। এ বংশের সুলতান আহমদ মনসুরের যুগ ছিলাে এক স্বর্ণোজ্জ্বল যুগ। এ যুগে মরক্কো সব ক্ষেত্রে উন্নতির শীর্ষে পৌছতে সক্ষম হয়।

 

শিল্প বিপ্লব ও বিশ্ব ব্যাপী তার প্রভাব 

        স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাের প্রভাবে গােটা ইউরােপে শিক্ষা বিজ্ঞানের প্রসার ঘটে। তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনুদানে স্বপ্ন সময়ে বহু পণ্য সামগ্রী তৈরীতে সক্ষম হয়। তাই এই পণ্য দ্রব্য বাজারজাত করতে ইউরােপীয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাণিজ্যের ছলে শৃগালের ধূর্ততা নিয়ে বহু দেশের শাসন ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়। গােটা পৃথিবী তখন ইউরােপের মাত্র পাঁচ, ছটি দেশের করতলগত হয়ে পড়ে।

 

        এক্ষেত্রে ইংরেজরা ছিলাে খুবই ধুরন্ধর। ইংরেজরা তাদের কুট-বুদ্ধি ও শিয়ালীপনার মাধ্যমে পৃথিবীতে এমন বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলাে যে সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হতাে না।

 

        ১৮শত শতাব্দীতে নতুন বাজারের সন্ধানে ফ্রান্সসহ ইউরােপের অন্যান্য দেশের বণিক কাফেলাদের বাণিজ্য জাহাজগুলাে মরক্কোর বন্দরগুলােতে আগমন শুরু করে। প্রথমে বন্দরগুলােতে অপ্রতিরােধ্য আধিপত্য স্থাপন করে সম্ভুক গতিতে দেশের অভ্যন্তরে রাজ ক্ষমতায় তাদের বিষাক্ত ছােবল সম্প্রসারিত করতে শুরু করে। আত্মরক্ষার ছুতাে দেখিয়ে তারা মরক্কোতে ফ্রান্সের সেনা নিয়ে আসে। তারপর মরক্কোর শক্তি সামর্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।

 

        ১৮৩০ সালে ফ্রান্স নির্লজ্জভাবে আলজেরিয়া আক্রমণ করে দখল করে নেয়। ফলে আলজেরিয়ার মুসলিম নেতা বীর মুজাহিদ আব্দুল কাদের মরক্কোতে আশ্রয় নেয়। ১৮৪৪ সালে আগস্ট মাসে ফ্রান্স বাহিনী মরক্কোর তাজা প্রদেশে আক্রমণ চালায়। বহিশক্তির এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে মরক্কোর মুসলিম জনতা রুখে দাঁড়ায়, কিন্তু অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বিশাল বাহিনীর সামনে তারা পরাজয় বরণ করে এবং তাজা সহ গােটা মরক্কো ফ্রান্সের হাতে চলে যায়।

 

        মরক্কোর মুসলমানরা ছিলাে স্বাধীনতা প্রিয়, অকুতােভয়! গোলামীর শৃঙ্খল কিছুতেই তাদের ধাতে সইতাে না। এটা ফ্রান্সের কূটনীতি বিষাদ বুদ্ধিজীবীরা খুব ভাল করে জানতাে। তাই তারা মরক্কোর সিংহাসনে একজন পুতুল সরকার বসিয়ে রাজ্য শাসন করতে থাকে। আর মরক্কোবাসীদের অন্তরে এ ধারণা রাখে যে, মরক্কোর শাসন ক্ষমতা মরক্কোবাসীদের হাতেই রয়েছে। আর এই সুযােগে তারা মরক্কোর সকল সম্পদ শুষে নিতে থাকে। কিন্তু যে জাতি যুগে যুগে শার্দুল সন্তান প্রসব করে সে জাতি কি নিরব বসে থাকতে পারে। তাই মরক্কোর অগ্নি পুরুষ মুজাহিদে আজম আব্দুল করিম সশস্ত্র জিহাদের আহবান জানান। অমনি চার দিক থেকে ছুটে আসে ঘুমন্ত শার্দুল শাবকরা। স্বাধীনতার দৃপ্ত শপথে মারণাস্ত্র হাতে তুলে নেয়। চলতে থাকে ফ্রান্স বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ। দিশেহারা হয়ে পড়ে ফ্রান্সের বাহিনী। আত্মরক্ষাই তাদের নিকট বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।

 

        এদিকে ১৯১২ সালে সােজচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মরক্কো দুটি সাম্রাজ্যের মাঝে ভাগাভাগি হয়ে যায়। স্পেন শাসিত মরক্কো ও ফ্রান্স শাসিত মরক্কো। কিন্তু স্পেন শাসিত অঞ্চলে স্পেন সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সৃষ্টি হয়। বীর মুজাহিদ আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে প্রবল আন্দোলন চলতে থাকে। পরিশেষে এ আন্দোলনের ঢেউ ফ্রান্স শাসিত মরক্কোতেও আঘাত হানে। গােটা মরক্কো তখন এক এ জলন্ত আগ্নেয়গিরি। অনন্যোপায় ফ্রান্স ও স্পেন তখন সম্মিলিত ভাবে স্বাধীনতাকামীদের প্রতিহত করে। প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় নির্বিবাদে। নিস্তেজ হয়ে পড়ে আন্দোলন। নেতাদের গ্রেফতার করে চালানাে হয় অমানুষিক অত্যাচার নিক্ষিপ্ত করা হয় নিকষ আধার কারা প্রকোষ্ঠে। ইতিমধ্যে ফ্রান্স মরক্কোতে ইসলাম বিরােধী আইন প্রণয়ন শুরু করে। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা আবার ফেটে পড়ে এবং ১৯২৭ সালে সিদি হােসেন রাজ সিংহাসনে আরােহন করে ইসলাম বিরােধী আইন বাতিলের জন্য ফ্রান্স কর্মকর্তাদের নিকট প্রবল দাবী জানায়। ফলে বাধ্য হয়ে ইসলাম বিরােধী আইন প্রত্যাহার করে নেয়।

 

        ১৯৩৫ সালে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ন্যাশনাল এ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিত্র শক্তি এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যুদ্ধ শেষে মরক্কোর স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিবে। কিন্ত যুদ্ধ শেষে ফ্রান্স তার ওয়াদা ভঙ্গ করে। ফলে স্বাধীনতা আন্দোলনকে তরান্বিত করতে সর্বদলীয় ইসতেকলাল পার্টি গঠন করা হয়। দুর্দম, দুর্বার আন্দোলন চলতে থাকে। আবার কেঁপে উঠে মরক্কো। আন্দোলনের লেলিহান শিখা ক্রমশ অগ্রসর হতে থাকে ফ্রান্স শক্তির দিকে। ফলে ১৯৫৬ সালে ২রা মার্চ ফ্রান্স ও ৭ই এপ্রিল স্পেন মরক্কোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। ফিরে পায় তাঞ্জিয়ার বন্দর, ইফান বন্দর। স্পেন তার অধীনের সাহারা মরুভুমির প্রায় ৭০ মাইল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যা মহামূল্যবান ফসফটে ভরপুর, টইটম্বুর।

 

স্বাধীনতা-উত্তর মরক্কো 

        পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিষাক্ত সয়লাব অনুপ্রবেশ করে মরক্কোতে। যার প্রভাবে আজ গােটা মরক্কো মাতােয়ারা! মনে হয় মরক্কোবাসী তাদের বীর পূর্ব পুরুষদের বীরত্ব ও ঐতিহ্য জলাঞ্জলি দিয়ে ইউরােপীয় ফ্যাশন প্রতিযােগিতায় নেমেছে। তদুপরি মরক্কোতে ইসলামপন্থী ও ইসলাম বিরােধী দুটি পরস্পর শ্রোতধারা বয়ে চলেছে। ইসলামী চিন্তা-চেতনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে একদল অকুতােভয় বীর মুজাহিদ। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় সরকার ও ক্ষমতাসীনদের ইসলামের প্রতি মৌখিক সামর্থন থাকলেও রাষ্ট্রীয় ভাবে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠার তেমন কোন চেতনা, উদ্যোগ নেই এবং এ ব্যাপারে রয়েছে অনিহা, অনাগ্রহ। আরাে পরিতাপের বিষয়, আজ মুসলিম বিশ্বের কথিত কর্ণধাররা অমুসলিম মস্তিষ্ক নিয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসে আছে। তাই মুসলিম দেশগুলােতেও ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সংস্থাগুলাে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র আঁতাত ও নির্যাতনের মুখে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মিশর, আলজেরিয়াসহ বহু দেশ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই এ শতাব্দীর নতুন প্রজন্মকে অগ্নিমনা হতে হবে। আত্ম জিজ্ঞাসা ও আত্ম সংশােধনের পথ ধরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে হবে।

 

 

═──────────────═