JustPaste.it

আমরা যাদের উত্তরসূরী

হযরত বারায়া বিন মালেক আল-আনছারী (রাঃ)
ডঃ আব্দুর রহমান রাফাত পাশা
===================================

 


      হযরত রাসূলে করীম (ﷺ) এর কনিষ্ঠ খাদিম, জলিলুল কদর সাহাবী হযরত আনাছ বিন মালেক (রাঃ) এর ছোট ভাই ছিলেন বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারী। তিনি অত্যন্ত হালকা-পাতলা গড়নের ছিম-ছাম দেহ বিশিষ্ট ছিলেন। মাথায় ছিল কোঁকড়ানো চুল। এই যুবক সাহাবী ছিলেন এতই হালকা পাতলা, দেখলে মনে হত খুবই দুর্বল। অথচ তার বুদ্ধিমত্তা, অদম্য সাহসিকতা, প্রবল ঈমানী চেতনা ও অসাধারণ সমর কৌশল রীতিমত ইতিহাস হয়ে আছে।
      এই ক্ষীণ দেহের অধিকার বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারী শুধু মল্লযুদ্ধেই শতাধিক মুশরিক যোদ্ধাকে পরভূত করে জাহান্নামে প্রেরণ করেন। মল্ল যুদ্ধ ছাড়াও সম্মুখ সমরে যে কত কাফির ও মুশরিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে ইসলামের বিজয়কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তার ইয়াত্তা নেই। যুদ্ধের দামামা তার রক্তে এমন ক্ষীপ্রতা অ তেজস্বীতার সৃষ্টি করতো যে নিজ দল-বল পিছনে রেখে একাই শত্রুপক্ষে প্রাচীর ভেদ করে দু’মুখো তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তার এই ব্যাকুল অগ্রগামীতা লক্ষ্য করে খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ফারুক (রাঃ) তার প্রতি এক বিশেষ বিধি নিষেধ আরোপ করে। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সেনাপতিদের কাছে এই বলে ফরমান জারি করেনঃ 
      “বারা’য়া বিন মালিক আল আনসারীকে যুদ্ধক্ষেত্রে কোন ইউনিটের দায়িত্ব যেন না দেয়া হয়। কারণ আমি আশংকা করছি যে, শত্রুবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বারা’য়া বিন্ মালেক আল আনসারীর যুদ্ধ করার যে মানসিকতা রয়েছে, যার ফলে তার অধীনস্ত সমগ্র বাহিনীই শত্রুবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হবে”।
     বারা’য়া বিন্ মালেক আল্ আনসারী (রাঃ) এর ইতিহাস সৃষ্টিকারী অসংখ্য ঘটনাবলীর মধ্যে একটি মাত্র ঘটনা সম্মানিত পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হচ্ছে।
     হযরত বারা’য়া বিন্ মালেক আল আনসারী (রাঃ) এর সাহসিকতার পরিচয় ফুটে উঠে রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইন্তেকালের পর। যখন নবদীক্ষিত মুসলমানেরা দলে দলে ভন্ড নবীদের দলে শামিল হচ্ছিল। ইসলামের এই চরম দুরযোগ মুহূর্তে আল্লাহ যাদের দৃঢ় মনোবল এবং ঈমানী মজবুতী দান করেছিলেন, শুধু তারা ব্যতীত অন্য সকলেই মুরতাদদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তায়েফ, মক্কা ও মদীনাসহ বিক্ষিপ্ত কিছু গোত্র ছাড়া বাকী সর্বত্রই এই ফেতনা ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল।
    এই দুরযোগ মুহূর্তে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইসলামের হিফাজতের জন্য আমিরূল মুমিনীন হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে চতুর্মুখী ফেতনা মোকাবেলার যোগ্যতা ও দৃঢ়তা দান করেন। তিনি পাহাড়সম অটল হয়ে একাধারে যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের এবং ভন্ড নবী ও তাদের অনুসারী মুরতাদদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন। আনসার এবং মুহাজিরদের সমন্বয়ে তিনি সশস্ত্র দশটি বিশেষ বাহিনী তৈরী করে প্রত্যেক বাহিনীর জন্য আলাদা আলাদা ঝান্ডা নির্ধরণ করলেন। ভন্ডনবীদের সমূচিৎ শিক্ষা দিয়ে বিপদগামী ও ধর্মত্যাগী মুরতাদদের ইসলামে প্রত্যাবর্তনের জন্য এসব বাহিনীকে আরব বিশ্বের চতুর্দিকে প্রেরণ করেন।
    ভন্ডনবী ও তাদের অনুসারী মুরতাদদের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল বনু হানিফা সম্প্রদায়ের মুসায়লামাতুল কাযযাবের। মুসায়লামাতুল কাযযাব তার নিজস্ব গোত্র এবং সন্ধিতে আবদ্ধ সম্প্রদায় সমূহের সুদক্ষ চল্লিশ হাজার যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এই বাহিনী ইসলামের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ ছিল। যাদের অধিকাংশই ছিল সংকীর্ণ ভৌগলিক ও বংশীয় জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসী। যারা ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধের পরিবর্তে গোত্রীয় গোড়ামী, সংকীর্ণতা ও আঞ্চলিকতার শিকারে পরিণত হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকের ভাষ্য এই ছিলঃ
       “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিঃসন্দেহে মুসায়লামাতুল কাযযাব একজন ভন্ডনবী এবং হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) সত্যবাদী নবী। কিন্তু আমাদের কছে সত্যবাদী নবীর চেয়ে স্বগোত্রীয় ভন্ডনবী ও মিথ্যাবাদী মুসায়লামাতুল কাযযাব ভাল”। 
      আমিরুল মু’মিনীন হযরত আবু বকর (রাঃ) মুসায়লামাতুল কাযযাবের মোকাবেলা করার জন্য আবু জেহেলের ছেলে একরামার নেতৃত্বে যে বাহিনী প্রেরণ করেছিলেন, মুসায়লামাতুল কাযযাবের বিশাল বাহিনীর প্রচণ্ড হামলার মুখে পরাজিত হয়ে তারা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। অতঃপর হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে আনসার এবং মুহাজির সাহাবাদের মধ্যে বিশিষ্ট যোদ্ধাদের সমন্বয় গঠিত যে বাহিনী প্রেরণ করেন তাদের মধ্যে হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারীও ছিলেন।
      হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ভন্ডনবী মুসায়লামাতুল কাযযাব এবং তার অনুসারীদের সমুচিৎ শিক্ষা দিয়ে পুনরায় ইসলামে দীক্ষিত করার জন্য সাহাবী যোদ্ধাদের এই বিশেষ বাহিনী নিয়ে দ্রুতগতিতে নজদের ‘ইয়ামামা’ নামক প্রান্তরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। মুহূর্তের মধ্যেই উভয় পক্ষের মধ্যে এক প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলো। যুদ্ধ শুরুর প্রায় সাথে সাথেই মুসায়লামাতুল কাযযাবের বিশাল সশস্ত্র বাহিনী মুসলিম বাহিনীকে কাবু করে ফেলে। অবস্থা এই দাড়ায় যে, সু-শৃংখল মুসলিম বাহিনীর পায়ের নীচের মাটি যেন ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল। নিজেদের অবস্থান থেকে ক্রমেই তারা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। এ নাজুক মুহুর্তে মুসায়লামাতুল কাযযাবের বাহিনী অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের তাবুতে হামলা করে তাবুর খুঁটি উপড়ে ফেলে। এমনকি সেখানে অবস্থানরত খালিদ বিন ওয়ালিদের স্ত্রীকে হত্যার জন্য উদ্যত হলে মুসায়লামাতুল কাযযাব বাহিনীরই একজন যোদ্ধা জাহেলিয়াতের প্রথানুযায়ী “যুদ্ধ ক্ষেত্রে শিশু ও নারীদের হত্যা কয়া কাপরুষোচিত ও গর্হিত কাজ” –একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তা’কে রক্ষা করেন।
      এ চরম বিশৃংখল অবস্থায় মুসলিম যোদ্ধারা নিশ্চিত পরাজয়ের আশংকায় ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে। তারা একথা মনে করছিলেন যে, মুসায়লামাতুল কাযযাবের কাছে আজ পরাজয়ের পর এই আরব বিশ্বে ইসলামের নাম উচ্চারণ করার মত আর কোন ব্যাক্তি অবশিষ্ট থাকবে না। শিরক মুক্ত এই জাজীরাতুল আরবে তৌহীদের বাণী উচ্চারণ ও আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্য কেউ সাহস করবে না।
      সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের নিজ তাবু আক্রান্ত হওয়ার পর এই চরম নাজুক মুহূর্তে খালিদ বিন ওয়ালিদ বিক্ষিপ্ত মুসলিম বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ পুনর্গঠিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সাথে সাথে তিনি মুহাজির, আনসার, শহরবাসী ও মরুবাসী বন্ধু যোদ্ধাদের ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক কোম্পানীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন ঝান্ডা নির্ধারন করেন। যেন প্রত্যেক বাহিনী স্বীয় অস্তিত্বের স্বার্থেই শত্রু বাহিনির মকাবেলায় মরণপণ চেষ্টা চালায় এবং কোন গ্রুপের পক্ষ থেকে দুর্বলতা প্রকাশ পায় তাও চিহ্নিত করা সহজ হয়।
      কিছুক্ষণের মধ্যেই উভয় বাহিনীর মাঝে পুনরায় যুদ্ধ বেঁধে গেল। ভয়াবহ সে যুদ্ধ! মুসলিম যোদ্ধারা এর পূর্বে এমন মারাত্মক কোন সংঘর্ষ কখনও প্রত্যক্ষ করেননি। এবার বীর বিক্রমে মুসলিম বাহিনী শত্রুবাহিনীর উপ্র ঝাপিয়ে পড়ল। তারা মুসালামাতুল কাযযাব বাহিনীর যোদ্ধাদের ধরাশায়ী করে ইয়ামামার ময়দান লাশের স্তুপ পরিণত করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। অপর পক্ষে, মুসায়লামাতুল কাযযাবের বাহিনী তাদের এই মারাত্মক ক্ষয়-ক্ষতি প্রত্যক্ষ করেও যুদ্ধ ময়দানে তখনও পাহাড়ের মত অটল হয়ে মুসলমানদের মোকাবেলা অব্যাহত রাখল। মুসলিম যোদ্ধারা ঈমানী চেতনায় বলীয়ান হয়ে যুদ্ধের ক্ষিপ্রতাকে আরও তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছিল।
      হযরত ছাবেত বিন কায়েস (রাঃ) মুসলিম যোদ্ধাদের আনছার বাহিনীর ঝান্ডাবরদার ছিলেন। তিনি যুদ্ধের এই তীব্রতাকে লক্ষ্য করে তার পরিচালিত বাহিনীর এই ঝান্ডাকে পিছনে সরিয়ে নিতে হতে পারে, তা আঁচ করে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ ময়দানে তার দু’পায়ের হাটু পর্যন্ত মাটির নীচে গেড়ে ফেললেন। মুহূর্তেই শত্রু সৈন্যরা তার দু’পায়ের হাটু পর্যন্ত মাটির নীচে গেড়ে ফেললেন। মুহূর্তেই শত্রু সৈন্যরা তার বহনকৃত ঝান্ডাকে ভুলুন্ঠিত করার জন্য তার ওপর আঘাত হানতে শুরু করল। তিনি একহাতে ঝান্ডাকে সমুন্নত রেখে অন্য হাতে তরবারী পরিচালনা করে এ আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে এক পর্যায়ে দুশমনের তরবারীর আঘাতে দ্বি’খন্ডিত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
      যুদ্ধের এই তীব্রতা অ প্রচন্দতার মাঝে মুহাজির বাহিনীর মধ্য হতে আমিরুল মু’মিনীন হযরত উমর (রাঃ) এর ভাই যায়েদ ইবনুল খাত্তাব দুশমনের উপর আরও তীব্র গতিতে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য মোহাজিরদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছিলেনঃ
      “হে যোদ্ধারা! আরও ক্ষীপ্র গতিতে আঘাত হান, সম্মুখ পানে অগ্রসর হও, শত্রুদের উপর ঝাপিয়ে পড়। হে যোদ্ধারা! জেনে রাখ, এটাই তোমাদের প্রতি আমার শেষ আহবান। হয় আজ মুসায়লামাতুল কাযযাবকে নিশ্চিহ্ন করবো অথবা শহীদ হয়ে আল্লাহ্র দরবারে পৌঁছে যাব”।
      এ আহবানের সাথে সাথেই সমস্ত মুসলিম মুজাহিদ নব চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে শত্রু বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আঘাত হানতে শুরু করল। হযরত যায়েদ বিন খাত্তাব (রাঃ) দু’হাতে তরবারী চালাতে চালাতে ক্ষীপ্র গতিতে দুশমনদের মাঝে ঢুকে পরলেন। অসংখ্য মুরতাদদের ধরাশায়ী করার এক পর্যায়ে শত্রুর আঘাতে তিনি শাহাদাতের কোলে ঢলে পড়ে তার কৃত ওয়াদাকে বাস্তবে প্রমাণিত করেন।
      আবু হুযায়ফার কৃতদাস হযরত ছালেম (রাঃ) এর উপর মুহাজির বাহিনীর ঝান্ডা বহন করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। মুহাজিরগণের অনেকেই তার প্রতি আশংকা পোষণ করেছিল যে, যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে তিনি সন্ত্রস্তবোধ করবেন। তারা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,  “আমরা আশংকা করছি যে, তুমি যুদ্ধের প্রচন্ডতায় ভীত হয়ে পশ্চাদপসরণ না করে বস’। প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, “আমি যদি এ যুদ্ধে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করি তাহলে আমার চেয়ে নিকৃষ্টতম হাফেজ কুরআন আর কে হতে পারে? অতঃপর তিনি বীর বিক্রমে দুশমনদের প্রতি আঘাত হানতে হানতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। মুরতাদদের তরবারীর আঘাতের পর আঘাতে তার গোটা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। কিন্তু এতদসত্বেও তিনি ইসলামের ঝান্ডাকে এক মুহুর্তের জন্য ভূলুন্ঠিত হতে দেননি।
       কিন্তু এ যুদ্ধে বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারীর বীরত্বের কাছে এসব ঘটনা একেবারে নগন্য বলে মনে হবে। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ উভয় পক্ষের প্রাণপন রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এই প্রচণ্ডতার মধ্যে চুড়ান্ত আঘাতের মাধ্যমে ইসলামের বিজয় ছিনিয়ে আল আনছারী (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “দুশমনদের উপর ঝাপিয়ে পড় হে আনসার যুবক….” । হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের এই নির্দেশ পেয়ে হযরত বারা’য়া (রাঃ) তাঁর বাহিনীর যোদ্ধাদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেনঃ
      “হে আনছার ভাইয়েরা! কখনো আপনারা মদীনায় ফিরে যাওয়ার চিন্তা করবেন না। এ মুহূর্ত হতেই আপনাদের জন্য আর মদীনা নয়। তাওহীদের বাণীকে চিরসমুন্নত করে জান্নাতের পানে অগ্রসর হোন”।
      এই বলে তিনি তার বাহিনী নিয়ে শত্রু বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়লেন। হযরত বারা’য়া বিন মালেক (রাঃ) দক্ষতার সাথে দু’ধারী তরবারী চালিয়ে তার দু’পার্শ্বের দুশমনদের ধরাশায়ী করে সম্মুখ অগ্রসর হতে লাগলেন। মুসায়লামাতুল কাযযাব এর যোদ্ধাদের শিরচ্ছে করতে করতে তিনি এক মহা কান্ড সৃষ্টি করলেন। এ আঘাতে মুসায়লামাতুল কাযযাব ও তার বাহিনীর মধ্যে হঠাৎ ভীতি ও ত্রাসের সৃষ্টি হলো। অবস্থা বে-গতিক দেখে তারা যুদ্ধ ময়দান সংলগ্ন বাগানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলো। যে বাগানটি পরবর্তী সময়ে অগণিত মৃত্যু দেহের স্তুপের কারণে “হাদিকাতুল মাউত” বা “মৃত্যুর বাগান” নামে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিল।
       প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানাবিধ ক্ষয় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাগানটি উচু ও প্রশস্ত দূর্ভেদ্য প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত ছিল। যুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে প্রাণ রক্ষার জন্য মুসায়লামাতুল কাযযাব ও তার অনুসারী যোদ্ধারা বাগানে আশ্রয় নিয়ে দ্রুত এর একমাত্র গেটটি বন্ধ করে দেয়। অতঃপর নিজেরা নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে তার ভিতর থেকে মুসলমান বাহিনীর উপর বৃষ্টির মত তীর বর্ষণ শুরু করে। এতে মুসলমানদের নিশ্চিত বিজয় আবার অনিশ্চিয়তার দ্বার প্রান্তে যেন উপনীত হয়। মুসলিম যোদ্ধাদের পক্ষে তাদের মোকাবেলা করার সমস্ত পথ যেন রুদ্ধ হয়ে আসে। এ অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর অন্যতম বির যোদ্ধা হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনসারী (রাঃ) যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে শত্রুদের প্রতি এক চরম অ শেষ আঘাত হানার জন্য পরিকল্পনা নেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি ঢাল সংগ্রহ করে তার বাহিনীর লোকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমি এ ঢালের উপরে বসে পড়ি, তোমরা ১০/১২টি বর্ষা ফলকের সাহায্যে উপরে তুলে আমাকে এ গেটের ভিতরে নিক্ষেপ কর। হয় আমি দুশমনদের হাতে শহীদ হয়ে যাব অথবা ভিতরে গিয়ে তোমাদের জন্য এ সুরক্ষিত বাগানের গেট খুলে দিব”।
      দেখতে না দেখতেই হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারী (রাঃ) উন্মুক্ত তরবারী হাতে বৃহদাকার ঢালটির উপর বসে পড়লেন। অত্যন্ত হালকা-পাতলা ও ছিপ ছিপে আনছার যুবক হযরত বারা’য়াকে কয়েক জনে খুব সহজেই ঢালে বসিয়ে মাথার উপরে তুলে নিলেন এবং সাথে সাথে অন্য কয়েকজন বর্ষাধারী তাদের বর্ষা ফলকে তাকে উপরে তুলে গেটের ভিতরে মুসায়লামাতুল কাযযাবের হাজার হাজার অনুগত যোদ্ধার মাঝে সজোরে নিক্ষেপ করলেন। হযরত বারা’য়া অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের মাঝে বজ্রপাতের ন্যায় লাফিয়ে পড়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে গেট রক্ষী বাহিনীর উপুর অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে গেট রক্ষী বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করলেন। অন্যদিকে মুসায়লামাতুল কাযযাবের দূর্ধর্ষ সৈন্যরা চতুর্দিক থেকে ভিমরুলের মত তাঁর গোটা দেহকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেললো। কিন্তু হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারী (রাঃ) সিংহের মত বর্ষার আঘাতে হুংকার ছেড়ে তাদের বেষ্টনী ভেদ করে পরিশেষে গেট খুলে দিতে সমর্থ হলেন। এদিকে সাথে সাথে অপেক্ষমান বীর মুসলিম যোদ্ধারা আল্লাহু আকবার ধ্বনীতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে বাঁধ ভাংগা স্রোতের মত ভিতরে ঢুকতে শুরু করলেন। সে ছিল এক নজীর বিহীন ভয়াল চিত্র। মুহূর্তেই উভয় পক্ষের মধ্যে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। মুসলমানদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে মুসায়লামাতুল কাযযাবের বাহিনী প্রাণ ভয়ে দিক বিদিক ছুটাছুটি করতে লাগলো আর মুসলিম যোদ্ধারা এ সুযোগে তাদের দলে দলে নিঃশেষ করে সম্মুখের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত সেখানে মুসায়লামাতুল কাযযাবের অবশিষ্ট বিশ হাজার সৈন্যের কবর রচনা করে ফেলে তাদেরকে জাহান্নামের অতল গহবরে নিক্ষেপ করা হলো। সমস্ত বাগান বিশ হাজার মুরতাদের লাশের স্তুপে পরিণত হয়ে গেল। 
      অন্যদিকে এই দুঃসাহী বীর যোদ্ধা হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারী (রাঃ) যিনি এ গেট খুলতে গিয়ে তাঁর শরীরে আশিটির অধিক তীর, বর্ষা ও তরবারীর আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছিলেন, তাঁকে বিশেষ চিকিৎসার কন্য চিকিৎসা তাবিতে প্রেরণ করা হলো। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) দীর্ঘ এক মাস ধরে নিজে হযরত বারা’য়া (রাঃ) এর খিদমতে নিয়োজিত থাকলেন। ধীরে ধীরে হযরত বারা’য়া (রাঃ) সুস্থ হয়ে উঠলেন। তাঁর এই মহান ত্যাগ এবং কোরবানীর বদৌলতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তারই হাতে মুসলমানের এ যুদ্ধে বিজয় দান করে জাজিরাতুল আরবকে চিরদিনের জন্য ভন্ডনবী ও মুরতাদদের হাত থেকে পবিত্র করলেন।
      মুসায়লামাতুল কাযযাব বাহিনীর সাথে ইয়ামামার প্রান্তরে ‘হাদিকাতুল মাউতের’ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শাহাদাতের মৃত্যুর গৌরব থেকে মাহ্রুম হয়ে হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারী (রাঃ) শাহাদাতের তামান্নায় পরবর্তীতে একের পর এক সব যুদ্ধে বীরত্ব সাথে অংশগ্রহণ করেন। তার জীবনের সর্বোচ্চ আকাংখা তিনি যেন শাহাদাতের মৃত্যুর মাধ্যমে হযরত রাসূল কারীম (ﷺ)এর সাথে জান্নাতে মিলিত হতে পারেন।
      সর্বশেষে তিনি পারস্য সম্রাটের সাথে মুসলমানদের ‘তুসতর’ কেল্লা বিজয়ের জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক পর্যায়ে সৈন্যরা দূর্ভেদ্য ‘তুসতর’ কেল্লায় আশ্রয় নিয়ে এর দরজামুখ বন্ধ করে দেয়। মুসলিম যোদ্ধারা এই কেল্লার চর্তুপার্শ্বে অবস্থান নিয়ে কেল্লাটিকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ধীরে ধীরে সব রসদ ও সরঞ্জামাদি নিঃশেষ হয়ে আসলে পারস্য বাহিনী জীবন রক্ষার লড়াইয়ে এক ধ্বংসাত্মক কৌশল অবলম্বন করে। তারা লম্বা শিকলের মাথায় মাছ ধরা বড়সির মত লৌহ নির্মিত বড় বড় আংটা গুচ্ছ আগুনে পুড়িয়ে লাল করে কেল্লার উপ থেকে মুসলমানদের উপরে নিক্ষেপ করে তাতে আটকিয়ে যাওয়া যোদ্ধাদের ক্রেনের মত তুলে নিতে শুরু করে। এভাবে বেশ ক’জন মুসলিম যোদ্ধা এর নির্মম শিকারে পরিণত হয়। অকস্মাৎ একটি আংটা গুচ্ছ হযরত বারা’য়া বিন মালেকের বড় ভাই বেষ্টিত হয়ে তাকে তুলে নিতে শুরু করে। হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনসারী কাল বিলম্ব না করে এক লাফে শিকলটিকে ধরে ফেলে এক হাতে ঝুলন্ত অবস্থায় অন্য হাতে আনাছ (রাঃ) এর শরীরে বিদ্ধ গরম আংটাকে খুলতে শুরু করেন। লাল টকটকে পোড়া আংটার দাহে তাঁর হাতের গোশত পুড়ে ধোয়া বের হতে লাগলো। কিন্তু তিনি তাঁর জলন্ত হাতের অসহ্য কষ্টের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে হযরত আনাছ (রাঃ) কে আংটার হাত থেকে ছাড়ানো মাত্রই এক লাফে নীচে নেমে আসেন। তখন তাঁর পোড়া হাতে শুধু হাড়গুলো ছাড়া আর কোন গোশ্ত অবশিষ্ট ছিলনা।
     এই ‘তুসতর’ কেল্লা বিজয়ের যুদ্ধে তিনি আল্লাহ্র দরবারে শাহাদাতের মৃত্যুর জন্য দোয়া করেছিলেন। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর এই দোয়া কবুল করে নেন। এই যুদ্ধেরই এক পর্যায়ে তিনি শত্রুর তরবারীর আঘাতে শাহাদাতের মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বহু আকাংখিত শাহাদাতের মৃত্যুর মাধ্যমে তিনি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যের পথ রচনা করে পরবর্তী উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকেন।
     আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন জান্নাতে হযরত বারা’য়া বিন মালেক আল আনছারীর মুখমন্ডল উজ্জ্বল করুন ও মুহাম্মদ (ﷺ) এর উম্মতদের দর্শনে তাঁর চক্ষুদ্বয় শীতল আনন্দিত করুন এবং আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সহায় হোন।
 ভাষান্তরঃ অধ্যাপক আবুল কালাম পাটোয়ারী

 

 

 ******************************