JustPaste.it

একজন কিশোরী ও একটি ক্লাশিনকভ

উম্মে নাঈম

==================================================

 

        রুশ সেনাদের শক্তিশালী, অত্যাধুনিক ও বিশালকার ট্যাংক বহর উঁচু নিচু অসম পথ অতিক্রম করে বিজয়ী কাফেলার মত উন্নত শিরে অপ্রতিরোধ্য গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। চলন্ত ট্যাংকগুলোর গম্ভির আওয়াজ ও সেনাদের মূহমূহ জয়ধ্বনি পাহাড়গুলোকে কাঁপিয়ে তুলেছে। ট্যাংক ও সাজোয়া গাড়ীর ওপরে কাস্তে হাতুড়ে আঁকা লাল পতাকা পত্ পত্ করে উড়ছে। 

 

        তাদের এতটা নির্ভিক হওয়ার কারণ, তারা গোয়েন্দা সংস্থা ‘খাদের’ মাধ্যমে আগেই অবগত হয়েছে যে, এ এলাকাটি জনমানব শূন্য বিরাণ। কোন মনুষ্য এখানে নেই। এর কিছুদিন পূর্বে লাল পতাকা উড়িয়ে এখানে যারা এসেছিলো তাদের দৈত্তের মত ট্যাংকগুলো স্পন্দিত জীবনের কল কাকলীতে মুখর এই জনপদটিকে মাটির সাথে গুড়িয়ে দিয়ে ধ্বংসের জ্বলন্ত স্বাক্ষর রেখে গেছে। উপরন্তু রাস্তা ঘাটের জীর্ণ দশা, বিধ্বস্ত ঘর বাড়ী ও ভুতুড়ে পরিবেশ এরই স্বাক্ষ্যর বহন করছে।

 

        অতএব যেখানে একটি শত্রুও অবশিষ্ট নেই। প্রতিরোধের সম্মুখীন হওয়ার কোন আশংকাই যেখানে নেই, সে স্থান দিয়ে নির্ভিক চিত্তে চলতে বাঁধা কোথায়? কে ঠেকায় তাদের অগ্রযাত্রা?

 

        তারা উত্তাল তরঙ্গের মত মাতাল হয়ে উৎকণ্ঠাহীনভাবে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। ভাবখানা এমন, তাদের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না।

 

        কিন্তু জনমানব শূন্য মৌনতার নিরবতা ভেদ করে হঠাৎ সামনের পাহাড় থেকে বুলেটের আওয়াজ ভেসে এলো।  তারা থমকে দাড়ালো, কোন পাহাড় থেকে বুলেট গুলো আসছে তা ঠাওর করতে পারছে না। ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। সবই অপ্রত্যাশিত, এমন একটা পরিস্থিক্তির জন্য তারা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।

 

        মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছট ফট করছে তরতাজা ক’টি প্রাণ। একটি বুলেটও ফাঁকা যায়নি। প্রতিটি বুলেট অব্যার্থ নিশানা হয়ে এক একটি বুক এফোড় ওফোঁড় করে অনতি দূরে লুকিয়ে গেলো। তাদের সাথে কেউ তামাশা করছে, না তারা মহাবিপদের সম্মুখীন তা বুঝে উঠতে পারছে না—সকলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

 

        একটু পরে বোকা রুশ বাহিনী কোন দিক নির্ণয় না করে বৃষ্টির মত গোলা বর্ষণ শুরু করলো। কেউ কেউ তড়ি ঘড়ি পজিশন নিল ঝোপে ঝাড়ের আড়ালে আবডালে। বিরাট ট্যাংক বাহিনী তাদের কাপুরুষতা ঢাকার জন্য ভারি ভারি গোলার আঘাতে সামনের পাহাড়গুলোর উপর চরম প্রতিশোধ নিচ্ছে। তাদের নিক্ষেপিত ভারি ভারি সেলগুলো চারিদেকে জাহান্নামের দহ সৃষ্টি করছে। বিরাণ জনপদটার যে দুচারটি ঘর বাড়ী ক্লান্তভাবে ধ্বংসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে ছিল তাও এবার জ্বলে ও ভেংগে ছার খার হয়ে গেল। তাদের বিষাক্ত সেলগুলো যেখানেই বিস্ফোরিত হয় সেখানেই সৃষ্টি হয কুন্ডুলি পাকানো আগুনের বিরাট বিরাট শিখা।

 

        পাহাড়গুলো থেকে কোন বুলেট আর আসছে না। রুশ বাহিনী ভাবছে, হয়তো এতক্ষণে আক্রমণকারীরা নরকের দ্বারে গিয়ে ঠেকেছে। তাদের শরীরের সবটুকু রক্ত এতক্ষণে এদেশের তৃষ্ণিত রঙ্গা মাটিরা চুষে চুষে খেয়ে ফেলেছে। যেমনভাবে রক্ত পানি করে জংগলের নেকড়েরা।

 

        এমনি সময় তাদের ভাবনার পর্দা হেদ করে ডান দিকের পাহাড় থেকে এক ঝাক গুলি এসে তাদেরকে আলিঙ্গন করলো।  আলিঙ্গনাবদ্ধ বুলেটগুলোর যন্ত্রণায় কয়েকজন নওজোয়ান পাষাণ পাহাড়ের কোলে লুটিয়ে পড়ল।

 

        থেমে থেমে চোর গোপ্তা আক্রমণ রুশ বাহিনীকে অস্থির করে তুলছে। দোর্দন্তু রুশবাহিনী এবার চরম অসহায়ত্ব বোধ করছে। কত দিক থেকে কত শতজনে আক্রমণ করছে তা এখনো বুঝতে পারছে না। তাই পালাবার পথ খুঁজছে। কিন্তু পালাবে কোথায়, মনে হচ্ছে যেন তিন দিকের পাহাড়গুলোর চূড়ায় চূড়ায় অসংখ্য মুজাহিদ মটার তাক করে বসে আছে। পালাবার পথও রুদ্ধ। বেঁচে থাকার একমাত্র পথ ট্যাংকের গোলাদ্বারা পাহাড় গুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে সামনে ময়দান তৈরী করা। তাই একের পর এক আঘাত, ভারী ভারী অস্ত্রের আঘাত। কিন্তু একটি পাহাড়ও ভাংগছে না। সামনে বাড়তে পারছে না। এদিকে লাশের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। রক্তে রঞ্জিত অসংখ্য লাল সৈন্য জনমের মত ঘুমিয়ে গেছে। |

 

        নিজ সেনাদের লাশের বহর দেখে ভীত সন্ত্রস্ত কমান্ডার একটু সাহস সঞ্চয় করে নির্দেশ দিল, সামনে বাড়া! এমনি মূহুর্তে ওদিকের পাহাড়ি থেকে একঝাক বুলেট এসে অগ্রগামী বাহিনীর বুকগুলো ঝাঝরা করে দিল। কমাণ্ডার মৃত্যু অনিবার্য ভেবে সৈন্যদেরকে সামনে বাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চিৎকার দিয়ে বলল, সামনে বাড়!

 

        ঠিক এই মূহুর্তে গর্জে উঠল আর একটি পাহাড়। লুটিয়ে পড়লো কয়েক ডজন রুশ সেনা। তারা আহ উহ করছে। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে তারই কোলে ঢলে পড়ছে। রক্তের বন্যায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে নেপত্যের আক্রমণটা এবার যুৎসই হয়েছে।

        সেনাদের অগ্রগামী লাইন ভেঙ্গে গেছে। বাকী যারা বেঁচে আছে তারা হতাশা ও উৎকণ্ঠার গহীন সাগরে হাবু ডুবু খাচ্ছে। লাল পতাকাবাহী তথাকথিত বিপ্লবীরা এবার তাদের রাঙ্গা রক্তে ভেলার মত ভাসছে। |

 

        মুসলমানদের রক্ত নিয়ে যারা তামাশায় মেতে উঠে, মুসলমানদের রক্ত দিয়ে যারা জিঘাংসা চরিতার্থ করে, মুসলমানের রক্ত যাদের কাছে পানির মূল্যও রাখে না, আজ প্রকৃতি তাদেরকে উপহাস করে হাসছে আর বলছে, প্রতিশোধ, এরই নাম যথার্থ প্রতিশোধ।

 

        এখনও ওরা নির্ণয় করতে পারে নি যে, বুলেটগুলো ঠিক কোন দিক থেকে আসছে এবং আক্রমণকারীরা সম্ভাব্য কতজন হতে পারে, আক্রমণের তেজ ধারা তাদেরকে এসব ভাববারই অবকাশ দিচ্ছে না। |

 

        তবুও ব্যার্থতা ঢাকার ব্যার্থ কসরত। ট্যাংকগুলোর উদ্দেশ্যহীন অগ্নিবর্ষন। তন্দ্রালু-নিরব পাহাড়িকার গায়ে উপর্যুপরি আঘাত। পাহাড়গুলো থর থর করে কেপে উঠছে। তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, প্রয়োজনে যুগ যুগ ধরে অবিরাম গোলা বর্ষণ করবে। তবুও ব্যার্থতা ঢাকতে হবে। যেদিক ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছা, কামান দাগাও, সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাক। একটি প্রাণীও বেঁচে না থাকুক তাতে এতটুকু দুঃখবোধ জাগবে না। কেননা এদেশে তারা মানবতার ডাকে আসেনি, তারা এসেছে এশিয়ার এই হৃদপিন্ডটাকে দখল করতে চায় শুধু দখলদারিত্ব। এদেশের ধন-সম্পদ ও জনসম্পদ বাঁচলো কি মরল তাদের তো সেদিকে তাকাবার কথা নয়? সোজা কথায় তারা মানুষ চায় না মাটি চায়।

 

        কমাণ্ডার বহু কষ্ট করে নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে অনলো একটু সামনে আগাবার চেষ্টা করল। কিন্তু সাহসের অভাবে ব্যার্থ হলো। বার বার সামনে আগাবার চেষ্টা করে বারবার ব্যার্থ হলো। অগণিত লাশ তাপের পথ রোধ করে দাঁড়ায়।

 

        আঘাতের পর আঘাত খেয়ে কমাণ্ডারের হুশ এলো। জীবিত সেনাদেরকে হালকা অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ে ওঠার আদেশ করল। আর ট্যাংক বাহিনীকে যে কোন হামলা প্রতিহত করার জন্য হুশিয়ার থাকার পরামর্শ দিল।

 

গেরিলা সেনারা পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠে আক্রমণকারীদেরকে কুকুরের মত তেজ অনুভূতি নিয়ে হস্ত দন্ত করে খুঁজতে লাগল। কি আশ্চর্য, কোথাও একটি মানুষের গন্ধ নেই। বদমায়েশরা গেল কোথায়? মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে, না হাওয়ায় উরে গেছে, সবগুলো তো এভাবে বেঁচে যাবার কথা নয়। সহস্র গোলার আঘাতে কমপক্ষে দুচারটি লাশ পড়ে থাকাই ছিল স্বাভাবিক।

 

        প্রতিপক্ষের গোলা থেমে গেছে। অনেক্ষণ যাবৎ কোন বুলেট ইসলামের শত্রতায় ভরা এই ফেরাউনী বাহিনীর বুকে এসে বিধছে না। তাই কুফুরীর কালিমায় লেপ বুকগুলোয় সামান্য সাহসের সঞ্চার হয়েছে। যে হৃদয়গুলো ইসলামের সাথে চির শত্রুতায় চুক্তিবদ্ধ সেই হৃদয়গুলো আবার শত্রুতার দাহতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। চরম প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাঘ্রতা নিয়ে তারা আক্রমণকারীদেরকে খুঁজতে পাহাড়গুলো তন্ন তন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। ওদেরকে খুঁজে বের করতেই হবে।

 

        হঠাৎ ওরা ধমকে দাড়ালো। মৃত্যুর আশংকায় ওদের হৃদয়গুলো থর থর করে কেঁপে উঠল। ছোট ছোট চলচিহ্ন দেখা যাচ্ছে। সামনে রক্তের লাল লাল ছাপ। এই যে এটা লাশ। ক্রোধে ফেটে পড়লো ওরা। বেয়নেট বের করে প্রাণহীন ঘাতকের বুকের মাঝখানে বসিয়ে দেবার ইচ্ছা করলো। কিন্তু একি, এ যে এক কিশোরী। জনমানবহীন এই জনপদটায় কেন এসেছিলো কুসুমের মত এই মেয়েটি? ওদের মনের কোনে অজান্তে একটু সহনভূতি জেগে উঠলো।

 

        কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না, ন’বছরের ছোট একটি মেয়ে আর তার হাতে একটি ক্লাশিনকত। সমস্ত শরীর রক্তাক্ত তার। বুকে বুলেটের আঘাত। আশ পাশের কোথাও কোন মুজাহিদের সন্ধান পাওয়া গেল না। তবে কি আমরা এতক্ষণ একজন কিশোরীর সাথে মুকাবিলা করেছি। লজ্জা এত লজ্জা লুকাবার জায়গা পৃথিবীতে কোথায়।

 

        অন্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত বিশাল ট্যাংক বাহিনীকে দীর্ঘ চার ঘন্টা ঠেকিয়ে রেখেছিল একা কিশোরী একটি ক্লাশিনকত দিয়ে। আর নিশ্চিৎ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে রুশ সেনাদের একাংশকে। বিরাঙ্গণা কিশোরী আফগানী বলেই এমনটা দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে।

 

        এই কিশোরী ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় ও মাতা-পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের অতৃপ্ত তৃষ্ণায় সেই দিন থেকে পাহাড়ে এসে উঠেছে যেনি রুশ বাহিনীর পাষাণ হৃদয় সেনারা তার পিতা-মাতাআত্মীয় স্বজনকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে এবং মাথা গুজার ঠাই প্রিয় ঘরটিকে যে দিন তারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

 

        কিশোরী অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুনছিল।  কখন আসবে প্রতিশোধ গ্রহণের সুভক্ষণ। যারা আমার পিতা-মাতাকে হত্যা করেছে, যারা আমার মাতা গুজার ঠাই ঘরটাকে পুড়িয়ে দিয়েছে, যারা আমার ফলের বাগান নষ্ট করেছে, যারা আমার প্রিয় মাতৃভূমি দখল করে নিয়েছে—আমার ক্লাশিনকটা দিয়ে তাদের একজনকে হলেও আমি হত্যা করব। বদলা আমি নিবই জীবনের বিনিময়ে হলেও।

 

        সুযোগ আসলো। মেয়েটি তার ক্লাশিনকভটা দিয়ে থেমে থেমে তিনদিকের পাহাড় থেকে আক্রমণ রচনা করে বিশাল বাহিনীকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিল। পিতা মাতা হত্যার প্রতিশোধ সুদে আসলে গ্রহণ করল। শেষ আকাংখা শাহাদাতের সুধা পান করার সৌভাগ্যও তার ঘটলো। সংযোজিত করলো বীরত্বগাঁথার পাতায় একটি বর্ণালী অধ্যায়। আর ইসলামের শত্রু সম্প্রসারণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের জানিয়ে দিল, মাযা’য ও মুআ’যের বোনেরা এখনো বেঁচে আছে। এখনও মুসলমানের ঘরে মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ও তারিক ইবনে যিয়াদের রূহানী মেয়েরা জীবিত আছে। দ্বীনের জন্য জীবনকে উৎসর্গিত করার মত মেয়েদের এখনও অভাব নেই। কেন না এদের ধমনীতে প্রবাহিত হচ্ছে, দিশ্ববিজয়ী মুসলিম সেনাদের তপ্তলহু। যাদের ইতিহাস,ভগর্বিত ইতিহাস, যাদের ইতিহাস বিজয়ের ইতিহাস। যারা পরাধীনতাকে কখনও মেনে নেয় না এবং পরাজয়কে কখনও গ্রহণ করে না।

******