JustPaste.it

সিরাতে রাসূল (সাঃ)

 

নবীজির দরবারে উম্মতের প্রতিনিধিরা

আবুল হাসান আলী নদভী

=====================================================================

 

        ইতিহাসবিদ এবং লেখকদেরকে আল্লাহ যেন ক্ষমা করেন । কেননা পবিত্র থেকে পবিত্রতর, উত্তম থেকে উত্তম সময়েও তারা ইতিহাস আশ্রিত চিন্তা-চেতনা পরিত্যাগ করতে পারেন না । কয়েক মূহুর্তের জন্যও তারা এর থেকে স্বাধীন হতে পারেন না । যেখানেই তারা থাকেন নিজের জ্ঞান ও গবেষণার আবহে নিঃশ্বাস নিতে থাকেন । সব সময় অতীতের সাথে বর্তমানের সম্পর্ক জুড়তে চান । কোন দৃশ্য দেখে তাদের মন অতি তাড়াতাড়ি অতীতের সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে হাতড়ে বেড়ায়, যার ফলশ্রুতিতে এ দৃশ্য বাস্তবের রূপ নিয়েছে ।

 

        গতকাল আমি মসজিদে নববীর রওজায়ে জান্নাতে বসা ছিলাম । আমার চতুষ্পার্শে নামাযী ও ইবাদাতগুযারদের সমারোহ ছিল । তাদের মাঝে কেউ ছিল সেজদায়, আবার কেউ রুকুতে । কালামে পাক তেলাওয়াতের শব্দ কানে আসছিল । মনে হচ্ছিল যেন মৌমাছির মৌচাকে গুঞ্জন রব করছে । সে সময়কার পরিবেশটা এরকম ছিল যে, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরকে সামান্য সময়ের জন্য আমার ভুলে যাওয়া উচিত ছিল । কিন্তু ইতিহাসের পুরনো স্মৃতিগুলো আষাড়ের ঘন বৃষ্টি ধারার ন্যায় আমার মন ও অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল । মনের উপর আমার কোনো শক্তিই চলছিল না ।

 

        আমার কাছে এরূপ অনুভব হচ্ছিল যে, এ উম্মতের কতিপয় বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ও রাহনুমাদেরকে নতুন জীবন দান করা হয়েছিল । আর প্রতিনিধি দলের ন্যায় তারা একের পর এক নববী দরবারে উপস্থিত হচ্ছিলেন । এরপর এই মহিমান্বিত মসজিদে সালাত আদায় করবার পর সেই মহামহিম নবীকে হাদিয়া স্বরূপ সালাম, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অর্ঘ পেশ করছিলেন । আর তার অসীম অনুগ্রহের স্বীকারোক্তি করছিলেন । তারা সবাই স্থান, কাল ও শ্রেণীর ব্যবধান সত্ত্বেও সমস্বরে এ কথার স্বাক্ষ্য প্রদান করছিলেন যে,  তিনিই সেই যিনি আল্লাহর নির্দেশ তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, দূর্ভাগ্য থেকে সৌভাগ্যের দিকে, সৃষ্টির দাসত্ব থেকে লা শারীক আল্লাহর ইবাদতের দিকে, অপরাপর ধর্মের জুলুম-নির্যাতন থেকে ইসলামের ইনসাফ ও ন্যায় নীতির দিকে এবং দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে প্রশস্ততার দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন । তাঁরা স্বীকার করেছেন,তারা ইসলামেরই ফসল, তাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব ও জীবন-নবুওয়াতেরই অনুগ্রহ । আল্লাহ না করুন,তাদের কাছ থেকে সেই সব কিছু ফিরিয়ে নেওয়া হয় যা এই নবীর উসিলায় আল্লাহ তাদের দান করেছেন । যদি নবুওয়াতের সেই সব পুরষ্কার তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় যেগুলোর কারণে দুনিয়ায় তারা ইজ্জত ও সম্মানের উপযুক্ত হয়েছেন তবে তাদের অস্তিত্ব প্রাণহীন একটি জড়ো কাঠামো এবং অস্পষ্ট ও নিরর্থক কিছু আঁক-জোক ও আকৃতির বেশি কিছু হবে না । এবং তারা ইতিহাসের সেই অন্ধকার যুগের দিকে ফিরে যাবেন যেখানে বিদ্যমান ছিল জংলী নিয়ম এবং শাসন ছিল জুলুম,নির্যাতন ও পাশবিকতার । আর সমূলে উৎপাটিত হয়ে যাবে বর্তমান তাহযীব তমদ্দুন ও সভ্যতা সংস্কৃতি ।

 

        সহসা আমার দৃষ্টি এক দিকে ফিরে গেল । আমি দেখলাম, বাবে জিবরীল[২] দিয়ে একদল লোক প্রবেশ করেছেন । তারা সবাই ছিলেন গাম্ভীর্য এবং গভীর ধ্যানমগ্নতায় ডুবন্ত । তাদের সপ্রতিভ ললাট থেকে হচ্ছিল ইলমের জ্যোতি ও মেধার স্পষ্ট নিদর্শন । বাবে রহমত ও বাবে জিবরীলের মাঝখানে তারা ছড়িয়ে পড়লেন । তাদের সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে, তাদের গণনা করার কোনো প্রশ্নই আসে না । আমি দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম," এরা কারা?উত্তরে সে বললঃ "এরা এই উম্মতের ইমাম, রাহনুমা ও নকীবদল । এরা মানবজাতির নির্বাচিত ও গর্ব করার মতো নমুনা । তাদের প্রত্যেকেই বিরাট এক জনগোষ্ঠীর ইমাম, বিশাল এক লাইব্রেরি ও চিন্তাধারার স্থপতি, পূর্ণ এক বংশধারার মুরব্বী এবং স্বতন্ত্র জ্ঞান ও বিষয়ের ভিত্তি নির্মাতা, তাদের চিরন্তন নিদর্শনাবলী ও অক্ষয় কীর্তি সমূহ আজও জ্বলজ্বল করছে । তাদের জ্ঞান সাধনা, অধ্যাবসায় ও গবেষণার আলোয় কত অসংখ্য অগণিত মানুষ নিজেদের জীবনের সফর অতিবাহিত করেছে । তাড়াতাড়ি করে কয়েকজন ব্যক্তিত্বের নামও সে আমাকে বলেছিল । ইমাম মালেক,ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, লাইছ বিন সা'দ মিশরী, ইমাম আওযায়ী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম ইবনু তাইমিয়া,ইমাম ইবনে কুদামা, আবু ইসহাক শাতেবী, ইবনে হুমাম, ইমাম শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী । দেশ, কাল, জন্মভূমি মর্যাদা এবং ইলমী ও দ্বীনি দিক থেকে যদিও তাদের মাঝে অনেক ব্যবধান রয়েছে তবুও সকলে এই স্থানে নববী দরবারে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেছেন এবং অনুশোচনায় বিগলিত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছেন ।

 

        আমি দেখলাম, সর্বাগ্রে তারা যারপরনাই ভীত কম্পিত ও একাগ্র হয়ে দু'রাকাত তাহিয়াতুল মসজিদ আদায় করলেন । অতঃপর অত্যন্ত বিনয়ের সাথে রওজা শরীফের দিকে অগ্রসর হলেন এবং খুব ভেবে চিন্তে সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবহ কিছু বাক্য দ্বারা সালাম পেশ করলেন । আমার কাছে এরূপ মনে হল, তাদের আওয়াজ এখনো আমার কানে গুঞ্জন করছে । তাদের চোখে ছিল অশ্রু এবং গলার স্বরে ছিল আদ্রতা । তারা বলছিলেন, "ইয়া রাসূলাল্লহ!যদি আপনার চিরন্তন, সুষ্ঠু, সুপ্রশস্ত ও সর্বব্যাপী শরীয়ত ও শরীয়তের মূলনীতিগুলো না হতো যার দ্বারা মানুষের মন ও মানুষের যোগ্যতা নতুন নতুন ফল ও ফুলের গাছ সৃষ্টি করেছে এবং দুনিয়ার আঁচল ভরে দিয়েছে মূল্যবান ও সুগন্ধযুক্ত ফুল দ্বারা যদি এর বুদ্ধিদীপ্ত ও অলৌকিক এই জীবন বিধান না হত, যে বিধান মানুষের চিন্তা-চেতনা শাণিত করেছে ও মানুষের মাঝে উদ্ভাবনী যোগ্যতার সৃষ্টি করেছে, তা হলে এই বিশাল ইলমে ফিকহ ও ইসলামী আইনশাস্ত্র অস্তিত্বে আসত না এবং এতো বড় ইসলামি লাইব্রেরীও সৃষ্টি হতো না যার সামনে সকল ধর্মীয় সাহিত্য নগণ্য মাত্র । যদি ইলম ও জ্ঞানের প্রচার প্রসারে এবং আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও পরিপূর্ণ কুদরতের চিন্তা ফিকির করতে এমন বলিষ্ঠভাবে আপনি দাওয়াত না দিতেন তবে ইলমের এই সুবিশাল মহীরুহ বেশী দিন পর্যন্ত এমন পত্র-পল্লবে বিকশিত হতো না, না তো এর ছায়া পুরো দুনিয়াকে এমনভাবে পরিবেষ্টন করতো যেমন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে । মানুষের মেধা পূর্বের ন্যায় শিকল দ্বারা বাধা থাকত এবং দুনিয়া থাকত আলো থেকে অনেক দূরে । "

 

        এই দলটিকে আমি তৃপ্তি ভরে দেখতে পারি নি হঠাৎ আমার দৃষ্টি অপর একটি জামাআতের উপর গিয়ে পড়ল । যে জামাআতটি বাবে রহমত হয়ে ভেতরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল । তাকওয়া ও পরহেযগারী, ইবাদাত ও খোদাভীতির সুস্পষ্ট নিদর্শন পরিলক্ষিত হচ্ছিল তাদের চেহারায় । আমাকে বলা হলো, এই জামাআতে হাসান বসরী (রহঃ), উমার বিন আব্দুল আজীজ, সুফিয়ান সাওরী,ফুযায়েল বিন ইয়ায, দাউদ ত্বায়ী, ইবনুছ ছিমাক, শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী, নিজাম উদ্দীন আউলিয়া এবং আব্দুল ওয়াহহাব আল মুত্তাকীর ন্যায় বিখ্যাত ব্যক্তিরা রয়েছেন । যারা স্মরণ করিয়ে দেন নিজেদের ঈর্ষনীয় গুণের অধিকারী পূর্বসূরীদের কথা । নামাযের পর এরাও রওজা মুবারকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং নিজেদের নবী ও  ইমাম এবং সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষক  ও রাহনুমাকে দরুদ ও সালাম হাদিয়া পেশ করলেন । তাঁরা বলছিলেনঃ " হে আল্লাহর নবী! যদি আমাদের সামনে সেই আমলী উপমা না হতো যা আপনি পেশ করেছেন,নূরের সেই মিনার না হতো যা আপনি দাড় করিয়েছেন, যদি আপনি একথা না বলতেন, 'আয় আল্লাহ! জীবন তো পরকালের টাই । যদি আপনি এ অসিয়ত না করে যেতেন যে, দুনিয়ায় এমনভাবে জীবন অতিবাহিত কর যেমন কোনো মুসাফির বা পথচারী জীবন নির্বাহ করে । যদি জীবন চলার সেই পদ্ধতি না হতো যার উল্লেখ হযরত আয়েশা (রাঃ) এভাবে করেছেন, 'এক চাঁদের পর দ্বিতীয় চাঁদ, দ্বিতীয় চাঁদের পর তৃতীয় চাঁদ উঠে যেত অথচ তার ঘরে আগুন জ্বলতো না, উনুনে হাড়ি উঠতো না' । তা হলে আমরাও দুনিয়ার ওপর এভাবে পরকালকে প্রাধান্য দিতে পারতাম না, যৎ সামান্য জীবিকার উপর দিন গুজরান করতে পারতাম না । মনের কামনাগুলোকে এভাবে বসে আনতে পারতাম না এবং দুনিয়ার অপরূপ মাধুরী, শোভা, সৌন্দর্য্য, কমনীয়তা আর ক্ষমতা ও পদবীর আকর্ষণকে এভাবে মুকাবিলা করতে পারতাম না" ।

 

তাদের জ্ঞানগর্ভ শব্দগুলো আমার হৃদয়ে তখনো ভালোভাবে বিজড়িত হয়ে সারে নি, অকস্মাৎ আমার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো অপ্র একটি দলের উপর । যে দলটি খুবই ভীত জড়িত চরণে বাবুন-নিসা দিয়ে অতিক্রম করছিলেন । ইসলামী শিক্ষা ও মূলনীতির পরিপন্থী যে বাহ্যিক রূপচর্চা ও স্বেচ্ছাচার রয়েছে, এ দলটি ছিল তার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত । এরা ছিলেন আরব ও আজম, পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায়ের নেককার, ইবাদাত গুযার ও সতী স্বাধী মা বোনেরা । পরিপূর্ণ আদব, ভদ্রতা ও সৌজন্যসহ চাপাস্বরে নিজেদের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছিলেন  তারা এভাবেঃ

 

        "আমরা আপনার উপর দরুদ ও সালাম পাঠাচ্ছি, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ঐ শ্রেণীর দরুদ ও সালাম যাদের উপর আপনার অনেক বড় অনুগ্রহ রয়েছে । আল্লাহর সাহায্যে আপনি আমাদেরকে জাহিলিয়াতের শিকল ও অবরোধ, জাহেলী অভ্যাস ও চরিত্র,সমাজের জুলুম ও অত্যাচার এবং পুরুষ সমাজের বাড়াবাড়ি ও বলপ্রয়োগ থেকে মুক্তি দিয়েছেন । কন্যা সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করার কুৎসিত প্রথাকে চিরতরে আপনি বন্ধ করে দিয়েছেন । মায়েদের সাথে নাফরমানী করলে তার খারাপ পরিণামের ভীতিপ্রদ কথা আপনি শুনিয়েছেন । আপনি বলেছেনঃ জান্নাত মায়েদের পায়ের নিচে । আপনি সম্পত্তির উত্তরাধিকারে আমাদেরকে শরীক করেছেন । এরা তাতে মা, বোন, মেয়ে ও স্ত্রী হিসেবে আমাদের অংশ দিয়েছেন । আরাফাতের ঐতিহাসিক ভাষণেও আপনি আমাদেরকে ভুলেন নি । সেদিন আপনি বলেছেনঃ 'মহিলাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর । কেননা তাদেরকে তোমরা আল্লাহর নামে হাসিল করেছ । এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে আপনি পুরুষদেরকে স্ত্রীদের সাথে সদ্ব্যবহার, তাদের অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের সাথে উত্তমভাবে জীবন যাপন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন । আমাদের পক্ষ থেকে আল্লাহ যেন আপনাকে উত্তম থেকে উত্তমতর প্রতিদান দেন যা দেওয়া হয় আম্বিয়া, মুরসালীন ও আল্লাহর মনোনীত বান্দাদেরকে । "

 

        এই কোমল শব্দগুলোর গুঞ্জরণ আমার কানে বেজে চলছিল, এমন সময় অপর একটি জামাত আমার দৃষ্টিগোচর হলো । যারা বাবুস সালামের দিক থেকে আসছিলেন । তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বিভিন্ন উলূল ও ফুনূনের ভিত্তি স্থাপনকারী, পথ প্রদর্শক ও নাহু, লুগাত, বালাগাতের ইমামগণ এ জামাতে রয়েছেন । এখানে আবুল আসাদ দুয়াইলী, খলিল বিন আহমদ, সীবওয়ায়, কিয়ারী,,আবু আলী ফারেসী, আবদুল কাহের জুরজানী, সাক্বাকী, মজিদুদ্দীন ফিরোযাবাদী, সাইয়েদ মুরতাজা বেলগ্রামীও আছেন । যারা নিজেদের ইলমের সালাম পেশ করছিলেন । দেখলাম, তারা খুবই উচ্চাঙ্গের ভাষা ও ভাবসমৃদ্ধ বাক্যে বলছেনঃ

 

        "ইয়া রাসূলুল্লাহ! যদি আপনি না হতেন, যদি এই মহিমান্বিত কিতাব না আসত, যদি আপনার মুখ নিঃসৃত এই হাদীসগুলো না হতো,এই শরীয়ত যদি না হতো যার সামনে আজ পুরো দুনিয়া আজ আনুগত্যের মাথা নত করেছে এবং এর কারণে আরবী ভাষা শিখতে ও এতে যোগ্যতা অর্জন করতে তারা বাধ্য হচ্ছে,তাহলে এই ইলমেরও অস্তিত্ব হতো না যার মাঝে আজ আমাদের ইমামত ও নেতৃত্বের মর্যাদা হাসিল হয়েছে । নাহু বয়ান,বালাগাত কোনটাই বাস্তবে রূপ লাভ করত না । এই বড় বড় অভিধান আর দেখা যেত না । না আমরা এই রাস্তায় এতো বলিষ্ঠ ও অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য তৈরি হতাম । আরবী ভাষা শিখা ও এতে পান্ডিত্য অর্জন করতে কেউ আগ্রহী হতো না । না এতে ঐ সব লেখক ও কলম সৈনিকদের আবির্ভাব হতো যাদের সাহিত্য ও ভাষাজ্ঞান স্বভাষীরাও বলিষ্ঠ ও লোহার ন্যায় দৃঢ় বলে মেনে নিয়েছে । ইয়া রাসূলাল্লহ!আপনিই আমাদের ও ইসলামের নিজস্ব এই ইলমের মাঝখানে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছেন । যে ইলম অস্তিত্বে এসেছে আপনার আগমনের পর । মূলত আপনিই আরব ও আজমে সংযোগ স্থাপনকারী । আপনার সত্তাই এ মধ্যবর্তী শূণ্যতা পূর্ণ করেছে এবং আরব ও আজমকে, পূর্ব ও পশ্চিমকে গলায় গলায় মিলিয়ে দিয়েছে । এবং এককে অপরের সাথে একান্তভাবে মিশিয়ে দিয়েছে ।

 

        আপনার কত বড় অনুগ্রহ রয়েছে আমাদের মেধা, স্মৃতিশক্তি ও ইলমী গভীরতার ওপর । আপনার কত বড় অবদান রয়েছে ইলমের এই দৌলতের উপর, মানুষের চিন্তা শক্তির উর্বরতার উপর, কলমের শিল্পকর্মের উপর । ইয়া রাসূলাল্লহ! যদি আপনি না আসতেন তবে হয়তো এই আরবী ভাষাও অন্যান্য অনেক ভাষার ন্যায় পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত । যদি কুরআন মাজীদের ন্যায় এই অবিনশ্বর ঐশীগ্রন্থ এই ভাষার সংরক্ষক না হতো তবে এ ভাষায় এতো পরিবর্তন পরিবর্ধন হতো যে, এর অবয়বই ভিন্ন রকমের হতো । এবং এটা একটা নতুন ভাষা লাভ করতো যেমনটা হয়েছে অপরাপর অনেক ভাষায় । আজমী শব্দমালা ও আঞ্চলিক ভাষা একে শোষণ বা গিলে ফেলত এবং এর মৌলিকতা ও যথার্থতা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেত । এটা আপনার সত্তার অস্তিত্ব, শরীয়তে ইসলামী ও এই পবিত্রতম গ্রন্থের বরকত যে এ ভাষাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছে । আলমে ইসলামীর জন্য এর সম্মান ও ভালোবাসা অবশ্য কর্তব্য করে দিয়েছে এবং প্রত্যেক মুসলমানের অন্তরকে এর ভালোবাসায় বাধ্য করেছে । আপনার সম্মানেই আল্লাহ তায়ালা এই ভাষাকে স্থায়িত্ব দান করেছেন ও এর উন্নতি অগ্রগতির জিম্মাদারি নিয়েছেন । প্রত্যেক ওই ব্যক্তির উপর যে এ ভাষায় কথা বলে, লেখালেখি  করে অথবা এ ভাষার কারণে  কোন উচ্চ মর্যাদা হাসিল করেছে তার উপর আপনার অনুগ্রহ রয়েছে । আর সে এই এহসানকে  কখনো অস্বীকার বা এর স্বীকার করা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে না । "

 

        আমি তাদের এই শুকুর গুযারী, অকুন্ঠ স্বীকারোক্তি ও মহাসত্য কথাগুলো আগ্রহ ভরে শুনছিলাম, ইতোমধ্যেই আমার দৃষ্টি গিয়ে স্থির হলো 'বারে আব্দুল আযীযে' । [৪] এই দরজা দিয়ে এমন এক ফল প্রবেশ করছিলেন যাদের উপর বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিভিন্ন দেশের স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছিল । এ দলে শামিল ছিলেন দুনিয়ার বড় বড় সুলতান ও ইতিহাসের বিখ্যাত বিখ্যাত বাদশাহ ও শাসকবৃন্দ । হারুন রশীদ, অলীদ বিন আব্দুল মালিক, মালিক শাহ সেলজুকী, সালাহউদ্দিন আইয়্যুবী,মাহমুদ গজনবী, জাহের বেবারস, সুলাইমান আজম এবং আওরঙ্গজেব আলমগীরও এ দলে ছিলেন । দূত ও চাপরাসীদেরকে দরজার বাইরেই তারা রেখে এসেছিলেন । বিনয় ও নম্রতার স্বার্থক প্রতিচ্ছবি হয়ে অনুচ্চ রবে কথা বলতে বলতে দৃষ্টি আনত করে তারা চলছিলেন ।

 

        আমার চোখের সামনে তাদের ব্যক্তিত্ব ও অক্ষয় কীর্তিগুলো বিকশিত হয়ে উঠছিল । আমার দৃষ্টির সামনে সেই দীর্ঘ ও প্রশস্ত দুনিয়ার নকশা চলে এলো যেখানে তাদের রাজত্ব চলতো, তাদের ডংকা বাজত । দুনিয়ার বড় বড় সম্প্রদায়, শক্তিশালী সাম্রাজ্য ও অত্যাচারী বাদশাহদের উপর তাদের যে রাজত্ব  ও শাসন চলতো সে শাসনের চিত্র সহসা আমার দৃষ্টি সীমায় ফুটে উঠল । তাদের মাঝে ওই মহান সত্তাও ছিলেন যিনি আকাশের এক খন্ড মেঘ এ ঐতিহাসিক বাক্যটি বলেছিলেনঃ"যেখানে ইচ্ছা সেখানে গিয়েই তুমি বর্ষিত হতে পারো, তবে পরিশেষে তোমার ট্যাক্স আমার খাজাঞ্চিতেই আসবে । " তিনিও ছিলেন  [৬] যার সালতানাত এতো প্রশস্ত ছিলো যে, যদি সব থেকে দ্রুতগামী উষ্ট্রীর আরোহী রাজত্বের এক মাথা থেকে অপর মাথায় যেতে চাইত তবে সেখানে পনেরো মাসের কমে পৌঁছা কিছুতেই সম্ভব হতো না । এখানে সেই প্রতাপশালী শাসকও ছিলেন অর্ধ্ব পৃথিবীর উপর ছিল যার হুকুমত; আর বড় বড় বাদশাহরা পর্যন্ত বাধ্য থাকত যার কাছে ট্যাক্স পাঠাতে । [৭] এরকম শাসকও ছিলেন যার ভয়ে পুরো ইউরোপ কাঁপতে থাকত এবং যার সময়কালে মুসলিম জাতি সম্মানের এতো উচ্চ শিখিরে পৌঁছেছিল যে, কোন মুসলমান ইউরোপে গেলে তার দ্বীন,ধর্ম ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাবে গির্জার ঘন্টা বাজা বন্ধ হয়ে যেত । [৮] । ফলকথা, এ ধরনের কত বাদশাহই না সেদিন এই জামাতে উপস্থিত ছিলেন । মসজিদে নববীতে নামায আদায় করার জন্য তারা অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দরুদ ও সালামের হাদিয়া পেশ করতে চাচ্ছিলেন । তাঁরা এই সালাম পেশ করাকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান ও মর্যাদা, সবচেয়ে বড় কল্যাণ ও কামিয়াবীর কারণ বলে মনে করছিলেন । তাঁরা তামান্না করছিলেনঃ 'আহা!যদি তাদের এই নামায, এই দরুদ ও সালাম গ্রহণ করা হত!আমি দেখছিলাম, ভীত-কম্পিত চরণে ধীরে ধীরে তারা আগে বাড়ছিলেন । ভয় তাদের অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল । অল্প সময়ের মধ্যে তারা সুফফার নিকট পৌঁছে গেলেন, যা ছিল দরিদ্র সাহাবীদের আবাসস্থল । সামান্য সময়ের জন্য  সেখানে তারা থেমে গেলেন । ভক্তি ও শ্রদ্ধা, লজ্জা ও কুন্ঠা মিশ্রিত আবেগসহ সেই স্থানের দিক তারা দেখতে লাগলেন যা কখনো ছিল এমন সব দরিদ্র ও অসহায়দের ঠিকানা যাদের পায়ের ধূলি দ্বারা নিজেদের চোখের সুরমা বানাতেও তারা প্রস্তুত ।

 

        এর নিকটেই তাহিয়াতুল মসজিদ হিসেবে তাঁরা দু'রাকাত সালাত আদায় করলেন । এরপর তাঁরা সেই মহিমান্বিত কবরের দিকে অগ্রসর হলেন । অতঃপর তাদের ভক্তি,ভালোবাসা, আবেগ ও অনুভূতি, ইলম ও ঈমান যা কিছু তাদের মুখ দিয়ে বের করল তা তারা পেশ করলেন নবীজির দরবারে । তবে শরীয়তের আদবকে খেয়ালে রেখে এবং নির্ভেজাল তাওহীদকে সামনে রেখে । আমি শুনেছি তাঁরা বলছিলেনঃ

 

        "হে আল্লাহর রাসূল!যদি আপনি না হতেন, যদি আপনার এই জিহাদ এই দাওয়াত না হতো যা দুনিয়ার কোণে কোণে ছড়িয়ে গেছে এবং যার কারণে দুনিয়ার বড় বড় দেশ বিজিত হয়েছে যদি আপনার এই দ্বীন না হতো যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করার পর আমাদের পিতা ও পিতামহগণ অপমান ও  অপরিচয়ের ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বের হয়ে সম্মান, মর্যাদা, উচ্চাসন ও সাহসিকতার সুপ্রশস্ত জীবনে প্রবেশ করেছেন । অতঃপর তার ফলশ্রুতিতে তারা বড় বড় সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেছেন । দূরবর্তী দেশসমূহ বিজয় করেছেন এবং এমন সব সম্প্রদায় থেকে ট্যাক্স আদায় করেছেন যারা এর পূর্বে তাদেরকে লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যেত এবং ভেড়া, বকরির পালের ন্যায় তাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও হেফাজত করতো, যদি মূর্খতা থেকে ইসলামের দিকে, অজ্ঞাত পরিচয় ও গোত্রীয় জীবনের সংকীর্ণ গন্ডি থেকে পৃথিবী পরাজিত করার মত উন্নত জীবনের দিকে এই সম্মানজনক সফর না হতো যা সম্পন্ন হয়েছে একমাত্র আপনার বরকতে তা হলে দুনিয়ার কোথাও আমাদের ঝান্ডা সমুন্নত হতো না; আমাদের কাহিনী কখনো শোনা যেত না ।

 

        আমরা লতাপাতাহীন, শুকনো, বিরান মরুভূমিতে ও ঊষর প্রান্তরে ঝগড়ায় লিপ্ত থাকতাম যেখানে শক্তিশালীরা দূর্বলদের উপর জুলুম করত, বড়রা ছোটদের উপর সীমালঙ্ঘন করত । আমাদের আহার্য ছিল নীচু স্তরের, জীবন চলার গতি প্রবাহ ছিল এতই নিম্নমানের যে,তার চেয়ে নিম্নমানের কল্পনা করাই সম্ভব নয় । ক্ষুদ্র গ্রাম অথবা গোত্রীয় গন্ডি থেকে অগ্রসর হয়ে কোন কিছু চিন্তাভাবনা করার যোগ্যতাই আমাদের ছিল না । এখানেই আমাদের সম্পূর্ণ জীবন ও সম্পূর্ণ পরিশ্রম সীমিত ছিল । আমাদের তুলনা করা যেত পুকুরের মাছ ও কুয়োর ব্যাঙের সাথে । আমরা ছিলাম আমাদের ভ্রান্তির জালে বন্দি আর অহর্নিশ গাইতে থাকতাম নিজেদের অজ্ঞ, মূর্খ ও অশিক্ষিত পিতা-পিতামহদের গুণগান ।

 

        ইয়া রাসূলুল্লাহ!আপনি আমাদেরকে দ্বীনের আলো দান করেছেন । যার ফলে আমাদের চক্ষু খুলে গেছে, চিন্তাধারায় প্রশস্ততা এসেছে,দৃষ্টি শাণিত হয়েছে । এরপর আমরা এই প্রশস্ত ও পরিপূর্ণ দ্বীন এবং এই আধ্যাত্মিক সম্পর্ক নিয়ে আল্লাহর সুপ্রশস্ত এবং বিস্তৃত জমিনে ছড়িয়ে পড়েছি । আমাদের মৃত ও ঘুমন্ত যোগ্যতা জাগ্রত হয়েছে । আমরা এই যোগ্যতা দিয়ে শিরক, মূর্তিপূজা, অত্যাচার ও মূর্খতাকে সর্বশক্তি ব্যয় করে মুকাবিলা করেছি এবং এরকম শক্তিশালী হুকুমত কায়েম করেছি, যার ছায়ায় আমরা, আমাদের সন্তান-সন্ততি ও আমাদের ভাই বেরাদার শত শত বছর পর্যন্ত আরাম ও ফায়দা উঠাচ্ছি । আজকে আমরা আপনার খেদমতে নগণ্য গোলাম সুলভ ভক্তি ও শ্রদ্ধা পেশ করতে এসেছি । আর একে নিজেদের জন্য গর্ব ও নাজাতের কারণ বলে মনে করছি । আমরা অকপটে স্বীকার করছিঃ দ্বীনের আহকাম ও কানুন জারি করবার ব্যাপারে (যার দ্বারা আল্লাহ আমাদিগকে সম্মানিত করেছেন) আমাদের থেকে অবশ্যই বড় ধরনের ত্রুটি হয়েছে । আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি । অবশ্যই তিনি ক্ষমাকারী, পরম দয়ালু । "

 

        আমি এই বাদশাহদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছিলাম । আমার দৃষ্টি ছিল তাদের সৈম্য ও ভদ্র চেহারার দিকে । আমার কান লাগা ছিল তাদের নিষ্ঠাপূর্ণ ও আবেগজড়িত শব্দগুলোর উপর । যে শব্দ আমি ইতিপূর্বে তাদের থেকে কখনো শুনি নি । সহসা অপর একটি জামাআত প্রবেশ করলেন এবং এই সব বাদশাহ ও শাসকদের পরোয়া না করে তাদের কাতার হয়ে সামনে এসে গেলেন । এ রকম মনে হচ্ছিল যে, এই সব বাদশাহদের প্রভাব, জাঁকজমক, শক্তি এবং ক্ষমতা তাদের উপর কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে নি । আমি মনে মনে বললামঃ হয়ত তারা কবি-সাহিত্যিক হবেন নয়তো বিপ্লবী । আমার এ ধারণা ভুল হয় নি । কেননা এই জামাআতে উভয় দলেরই লোক ছিলেন । এখানে সাইয়েদ জামালুদ্দীন আফগানী, আমীর সাঈদ হালীম, মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, শায়েখ হাসানুল বান্নার পাশাপাশি তুরস্কের বিখ্যাত কবি মুহাম্মদ আকেফ এবং হিন্দুস্তানের ডক্টর মুহাম্মদ ইকবালও উপস্থিত ছিলেন । ভাষ্যকার হিসেবে তারা সর্বশেষে উল্লেখিত ব্যক্তিটিকে মনোনীত করলেন । যোগ্য ভাষ্যকার এই শব্দে নিজের ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটাচ্ছিলেনঃ

 

        "দো, জাহানের সর্দার, বদর ও হুনাইনের সেনাপতি,ইয়া রাসূলাল্লহ!আমি আপনার কাছে সেই জাতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করার জন্য এসেছি যারা আজও আপনার বিছানো নেয়ামতের দস্তরখানা থেকে খাদ্যকণা সংগ্রহকারী, আপনার রহমতের ছায়া ব্যতীত যাদের কোথাও আশ্রয় মিলে না, যারা আপনার লাগানো বৃক্ষের ফল বক্ষণ করছে তারা ঐ সব দেশে- যেগুলোকে আপনি অত্যাচারের পিঞ্জর থেকে স্বাধীন করেছেন এবং যেখানে মানবতার আলো ও মুক্ত বাতাস দান করেছেন, আজ তারা সেসব স্থানে স্বাধীনভাবে নিজেদের খেয়াল খুশিমত শাসন চালাচ্ছে, এরাই আজ ঐ হুকুমতের বুনিয়াদ উপড়ে ফেলছে যার উপর এই বৃহত্তর উম্মতের অস্তিত্ব নির্ভরশীল । এদের পথ প্রদর্শক ও নেতারা আজ চেষ্টা করছে যেন এ উম্মতের ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তায় ফাটল সৃষ্টি করে দিতে পারে । এরা ঐ জিনিসই জীবিত করতে চায় যা আপনি খতম করে দিয়েছিলেন । এরা ঐ বস্তুসমূহ বিগড়িয়ে ফেলছে যা আপনি গড়ে তুলেছিলেন । এই উম্মতকে এরা জাহেলী যুগের দিকে পুনরায় ফিরিয়ে নিতে চায় যেখান থেকে আপনি চিরদিনের জন্য তাদের বের করেছিলেন । এ ব্যাপারে তারা ইউরোপের অন্ধ অনুসরণ করছে, যারা নিজেরাই জঘন্য রকম আধ্যাত্ম্য শূন্যতা, হতাশা ও বিশ্বাস হীনতার স্বীকার ।

 

        এরা আল্লাহর নেয়ামতকে অকৃতজ্ঞতা দ্বারা পরিবর্তন করে নিজের জাতিকে ধ্বংসের দুয়ারে নিয়ে যেতে চায় । 'মুহাম্মদী চেরাগ' ও আবু লাহাবী চক্রান্তের' সংঘাত আজ পুনরায় কায়েম হয়েছে । দূর্ভাগ্যবশতঃ আবু লাহাবের শিবিরের দিকে ঐ সব লোকদেরকে দেখা যাচ্ছে ইসলামের দিকে নিজেদের সম্পর্কিত করে এবং আরবী ভাষায় কথা বলে । নিজেদের জাহেলি কীর্তিকলাপ এবং মানব ভাষ্কর্যের উপর এরা গর্ব করছে যা আপনি টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন । তারা ঐ সব ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত যারা ক্র‍য় করার সময় বেশী লয় এবং বিক্রি করার সময় কম দেয় । আপনার কাছ থেকে এরা বহু কৌশল অর্জন করেছে এবং সব রকম শক্তি ও সম্মান দ্বারা উপকৃত হয়েছে । এখন তারা যাদের পাহারাদার ও রক্ষক সে জাতির সাথে এ রকম আচরণ করছে যে, তাদেরকে বলপূর্বক ইউরোপের পায়ে ঢেলে দিতে চায় এবং তাদেরকে জাহেলি দর্শন,  ন্যাশনালিজম, সোশ্যালিজম, কমিউনিজমের হাওয়ালা করে দিচ্ছে ।

 

        যে মূর্তি থেকে আপনি কাবা শরীফ পাক করেছিলেন সেই মূর্তিই আজ মুসলিম জাতির মাথায় নতুন নতুন নামে, নতুন নতুন সাজে পুনরায় চড়ে বসেছে । আরব জাহানের কোন অংশ যা আপনার কেন্দ্র ও কেল্লা হওয়া উচিত ছিল -একটি সর্বব্যাপী বিদ্রোহ দেখা যাচ্ছে কিন্তু সেখানে কোন ফারুক( রাদ্বিয়াল্লহু আনহু) দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না; তাদের চিন্তা ও মনোজগতে ধর্মদ্রোহীতার আগুন দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়ছে তবে কোন আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লহু আনহু)কে দেখা যাচ্ছে না যিনি বীরত্বের সাথে ময়দানে আসবেন এবং এই আগুন নির্বাপিত করবেন ।

 

        আমার পক্ষ থেকে এবং আমার ঐ সাথীদের পক্ষ থেকে যাদের প্রতিনিধি ও ভাষ্যকার হওয়ার মর্যাদা আমার অর্জিত হয়েছে -মনের গহীন অতল কন্দর থেকে উথলে উঠা ভক্তি শ্রদ্ধার আবেগে আপ্লুত সালাম গ্রহণ করুন । আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি  এবং আল্লাহকে স্বাক্ষী বানিয়ে বলছিঃ" ঐ সব লিডার এবং নেতাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, যারা নিজেদের মুখ ইসলামের কেবলার দিক থেকে ফিরিয়ে ইউরোপের দিকে করে ফেলেছে । এরাই তারা,আপনার সাথে ও আপনার দ্বীনের সাথে যাদের কোন সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই । এমন অবস্থায়ও আমরা পূর্ণরূপে আপনার রীতিনীতির অনুসরণ ও আপনার আনুগত্যের কথা ঘোষণা করছি । জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত ইসলামের এই রশ্মিকে ইনশা আল্লাহ সুদৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে যাবো " ।

 

        সাহিত্যের অলংকার মন্ডিত এবং ঈমান ও বিশ্বাসে প্লাবিত এই শব্দগুলো তখনো শেষ হয় নি এমনি সময় হঠাৎ মসজিদে নববীর মিনার থেকে আযানের হৃদয়গ্রাহী শব্দ উচ্চকিত হলো । আল্লহু আকবার, আল্লহু আকবার,আল্লহু আকবার,আল্লহু আকবার.... । আমি সহসা সচকিত হয়ে গেলাম । ইতিহাসের আশ্রয়ে দাঁড়ানো কল্পনার এই সুন্দর ধারাক্রম নিমিষেই ছিন্ন হয়ে গেল ।

 

        আমি পুনরায় এ জগতে ফিরে এলাম যেখান থেকে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূরে । দেখছি, কেউ সালাত আদায় করছে, কেউ তিলাওয়াতে মশগুল । মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা জামাত ও প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে সালামের উপঢৌকন পেশ করছিলেন । ভাষা ও উচ্চারণগত পার্থক্যের সাথে আবেগ ও ভক্তির ঐকতান এক মায়াময় আবহের সৃষ্টি করে ছিল ।

 

        ভাষান্তরঃ জুবায়ের আহমদ আশরাফ ।

 

        ১ । এর দ্বারা সেই স্থানটিকে বোঝানো হয়েছে যে স্থানের ব্যাপারে হাদীস শরীফে এসেছেঃ আমার ঘর এবং মিম্বরের মাঝখানকার জায়গাটি জান্নাতের বাগানসমূহের মধ্য হতে একটি বাগান । (বুখারী শরীফ, খ-১,পৃ-২৫৩) ।

 

        ২ । বাবে জিবরীল--মসজিদে নববীর গুরুত্বপূর্ণ এবং পুরনো দরজা সমূহের একটি । যা রওযা শরীফের সবচেয়ে নিকটে অবস্থিত ।

 

        ৩ । মসজিদে নববীর পুরনো দরজা প্রথম যুগে যা মহিলাদের জন্য নির্ধারিত ছিল ।

 

        ৪ । মসজিদে নববীর এই নতুন দরজাটি নতুনভাবে নির্মাণের পর বাবে মজিদীর পাশে বানানো হয়েছে এবং সুলতান আবদুল আযীয বিন সউদের নামে নামকরণ করা হয়েছে ।

 

        ৫ । বাদশাহ হারুন রশীদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে ।

 

        ৬ । এখানে অলীদ  বিন আবদুল মালিককে বুঝানো হয়েছে ।

 

        ৭ । মালিক শাহ সেলজুকী ।

 

        ৮ । তুরস্কের বাদশাহ সুলাইমান আজম ।

 

═──────────────═