JustPaste.it

আমাদের দেশের চালচিত্র

 

আর নয় মিথ্যা অহমিকা

ফারুক হোসাইন খান

 

            গত ১৯শে মে বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলে এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। দু'শ কিলোমিটার গতিতে এ ঘূর্ণিঝড় সর্বপ্রথম আঘাত হানে দেশের সর্ব দক্ষিণের দ্বীপ শাহপরী, সেন্টমার্টিনে। গভীর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট এ সামুদ্রিক ঝড় একের পর এক উপকূলীয় এলাকায় ধ্বংসতান্ডব চালিয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়। ঘূর্ণিঝড়ের দানবীয় শক্তিতে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজার, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, সন্দীপসহ চট্টগ্রাম, বান্দরবন, নোয়াখালী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার কাচা বাড়ী ঘর, গাছপালা ফসলী জমিন। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি ও এর প্রকৃতি অনুধাবন করে আবহাওয়া অধিদপ্তর ২৪ ঘন্টা আগেই চট্টগ্রামে ১০ নম্বর ও মংলা এলাকায় ৮ নম্বর বিপদ সংকেত প্রচার করে জনগণকে সতর্ক করে দেয়। অত্র এলাকার মানুষ এ দীর্ঘ সময় সীমাহীন উদ্বেগ উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটায়। তারা ১৯৯১ সালের অনুরূপ এক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞত। সেবার উপকূলীয় এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। প্রত্যেকটি পরিবার জান মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। তাই আবহাওয়া অফিস কর্তৃক বিপদ সংকেত প্রচারিত হওয়ার পর পরই এবার সর্বস্তরের মানুষ সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেয় উপকূলীয় সাধারণ মানুষ!

               ঘূর্ণিঝড়ের সময় কার্যপোলক্ষে আমি চট্টগ্রাম বন্দর শহরে অবস্থান করছিলাম। হাতের কাছে রেডিও নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ পরিস্থিতি, অবস্থান সম্পর্কে খবর পাচ্ছিলাম। ১৯ মে সকাল থেকেই চট্টগ্রামের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর মাঝে মাঝে হালকা দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল চট্টগ্রাম শহরের ওপর দিয়ে। সকাল ১০টার দিকে রেডিওর আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিন মারফত জানতে পারলাম যে, কক্সবাজার ও টেকনাফে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। যার গতিবেগ ১০০-১৫০ কিঃ মিঃ। ঝড়ো হাওয়ার দাপটে জেলার অন্যান্য স্থান টেকনাফ, মহেষখালী, সেন্টমার্টিনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার খবরও পেলাম কিছুক্ষণ পরে। খবরে আরও বলা হলো যে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নিম্নাঞ্চল ৪ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে চট্টগ্রামেও ঝড়ো হাওয়ার প্রকোপ বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাতাসের গতিবেগও।

             রেডিও মারফত জানতে পারলাম, কক্সবাজারের ওপর দিয়ে প্রচন্ড গতিতে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বিকেল ৩টার দিকে ঘূর্ণিঝড় তার দানবীয় শক্তি নিয়ে চট্টগ্রামের ওপর আঘাত হানতে শুরু করে। তখন বাতাসের গতিবেগ ১৮০ কিঃ মিঃ থেকে ২০০ কিঃ মিঃ পর্যন্ত। আমরা সবাই গৃহে আবদ্ধ থেকে আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি আর বাতাসের গতির উল্টো দিকের জানালাপথে বাইরে ঝড়ের তান্ডব দেখতে থাকি। কিছুক্ষণের মধ্যে বাহিরের জগতের খবর পাবার একমাত্র উৎস রেডিওর ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত খবরা-খবর প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। আমরা ধরে নেই, সম্ভবত ঝড়ো হাওয়া আবহাওয়া অফিসের যন্ত্রপাতির ওপরও আক্রোশ মিটিয়েছে, অথবা চট্টগ্রামের সাথে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়েছে। অগত্যা বহিঃর্বিশ্ব থেকেও আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। এরপর রাত ৯টায় ঝড় থামা পর্যন্ত বাংলাদেশের সকল রেডিও স্টেশন ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে দেশবাসীকে উৎকণ্ঠিত রাখা ছাড়া কোন সঠিক সংবাদ দিতে পারেনি। তবে চট্টগ্রাম শহরের ওপর দিয়ে যখন ২০০ কিঃ মিঃ বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছিল, ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ কেউ আল্লাহকে স্মরণ করছে, কেউ আজান দিচ্ছে, কেউ দোয়া ইউনুস পড়ছে, তখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হয়তো ইবলিসের বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। যতবারই রেডিও অন করি শুনতে পাই নিয়মিত অনুষ্ঠান, পল্লিগীতি, রবীন্দ্র সংগীত, উপজাতীয় গানের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। যেন বিপদগ্রস্থ মানুষের সাথে উপহাস করছে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে রেডিও বন্ধ করে রেখে দেই। বাহিরে তখন প্রলয়কান্ড, প্রচন্ড গতির ঝড়ো হাওয়ায় খড় খুটোর মতো উড়ছে টিন, গাছের ডাল। কাচা ও টিনসেড ঘর-বাড়ী আক্রোশের শিকার হয় সবচেয়ে বেশী। ঝড়ো হাওয়ায় কত মানুষের কত পরিশ্রম কষ্টের বিনিময়ে গড়ে ওঠা শান্তির আবাস মূহুর্তের মধ্যে বিধ্বস্থ হয়ে যায়, তুলোর মতো চালের টিন উড়ে কোথায় গিয়ে পরে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিশাল বিশাল গাছ উপড়ে বিল্ডিংয়ের ওপর পড়ছে, বৈদ্যুতিক টাওয়ার, ল্যাম্প পোস্ট, রাস্তার পাশে স্থাপিত বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপনের বোর্ড ভূপাতিত হচ্ছে। চারিদিকে মানুষের আর্তচিৎকার ঝড়ো পরিবেশকে আরও ভীতিকর করে তোলে। আমাদের পাশ্ববর্তী একটি টিনসেড বাড়ীর ওপর কোথেকে অসংখ্য টিন উড়ে এসে ভয়ঙ্কর শব্দে আঘাত হানে। ফলে সে বাড়ীর লোকজনও আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়।

              বিকাল ৫টার দিকে একবার ঝড় সম্পূর্ণ থেমে যায়। আমরা বাহিরের অবস্থা পর্যবেক্ষণে বের হয়ে হতবাক হয়ে যাই। প্রকৃতির কাছে মানুষ কত যে অসহায়, তার নজীর সর্বত্র চোখে পড়ে। ভাঙ্গা গাছপালা, বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ী, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া টিনের স্তুপ, উপড়ানো ল্যাম্পপোস্ট, ছেড়া বৈদ্যুতিক তার ঝড়ের নির্মমতার সাক্ষ্য দিচ্ছে। সন্ধ্যার পরে ঘূর্ণিঝড় তার সর্ব শক্তি নিয়ে আবার আঘাত হানে, একটানা তিন ঘন্টা যাবৎ তা অব্যাহত থাকে। এবারের আঘাত ছিল আগেরবারের চেয়েও ভয়াবহ। প্রথমবার ঝড়ো বাতাস পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হচ্ছিল, এবার তার উল্টো দিক থেকে প্রবাহিত হতে থাকে। রাত্রের ভূতুড়ে অন্ধকার কেটে যাবার পর যেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহরের চেহারা দেখতে পেলাম। চট্টগ্রাম শহরকে চেনা যাচ্ছিল না। টাইগার পাস থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত রাস্তার দু'পাশের বিজ্ঞাপনী সংস্থার বিল বোর্ড, লাইটপোস্ট সব কিছুই একাকার, রাস্তার পাশে স্তুপ হয়ে আছে। গাড়ীতে করে ঢাকা আসার পথে সর্বত্রই একই অবস্থা দেখতে পেলাম।

              ঢাকায় এসে পত্র-পত্রিকা রেডিও টিভিতে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির খবর পেতে লাগলাম। সরকার প্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন এমপি, সরকারী কর্মকর্তারা ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় সফর, বিপন্ন মানুষকে সমবেদনা জানানো, ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ প্রভৃতির সচিত্র খবরও দেখলাম টেলিভিশনের পর্দায়। জাহাজ ও হেলিকপ্টার ভর্তি করে ত্রাণ সামগ্রী যাচ্ছে উপদ্রুত এলাকায় সে খবরও সম্প্রচার হলো ফলাও করে।

               কিন্তু একি! এভাবে কেউ কি নিজের মুখে নিজেই চুন কালি মাখে! নিজের লালিত বিশ্বাস, আদর্শের প্রতি এভাবে কেউ কি পদাঘাত করে নাকি! 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস' এ বিশ্বাসের কট্টর অনুসারীদের এত ছোটাছুটি, হা হুতাশ কেন? তারাতো সকল ক্ষমতার উৎস, জনগণের প্রতিনিধি, অতএব তাদের ক্ষমতার পরিধিতো আরও ব্যাপক, বিশাল হবার কথা। তাদের এত বিচলিত হওয়া কি মানায়!

              তারা কেন সকল ক্ষমতার উৎস জনগণকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত প্রদান করে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলল! তাদের কেন বাড়ীঘর সব ফেলে রেখে সাইক্লোন আশ্রয় কেন্দ্র, স্কুল-কলেজ ভবনে আশ্রয় নেয়ার আহ্বান জানানো হলো? সকল ক্ষমতার উৎস (?) জনগণকে এত ভীত সন্ত্রস্ত কাপুরুষের ভূমিকায় নামানো হলো কেন? সকল ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের কেন এত তুচ্ছ একটা বায়ু শক্তিকে প্রতিহত করার কথা বলা হয়নি। জনগণকে কেন এ বেপরোয়া বায়ুর লাগাম টেনে ধরার কথা বলা হলো না, ঘ্রাণ বায়ুকে সমুদ্রকে অশান্ত করার সুযোগ দেয়া হলো কেন?

                দু'শো মাইল গতিতে ঘূর্ণি বায়ু যখন জনগণের মহা সর্বনাশ ঘটাচ্ছিল, তখন জনগণ এত অসহায়ের ভূমিকা নিল কেন! সুপার পাওয়ার জনগণের হাতে থাকতেও তারা সামান্য বায়ু শক্তির কাছে কেন এত অসহায়ভাবে পরাজিত হলো?

               ক্ষমতার উৎসের অধিকারী জনগণ ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেছে, ঘর বাড়ী উড়ে গেছে, গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে, যোগাযোগের মাধ্যম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ফসলের জমীন ধ্বংস হয়ে গেছে, সমুদ্রের লোনা পানির প্রবাহে হাবুডুবু খেয়েছেন, আরও কত বিড়ম্বনা, দুঃখ-কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন, কিন্তু একটি বারও তাদের সুপার পাওয়ার ব্যবহার করতে পারলনা এ কেমন কথা। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস-এ বাক্যের প্রবক্তরা এ লজ্জা, এ ভীরুতা লুকোবেন কোথায়?

              সাম্প্রতিক এ ঘূর্ণিঝড় মিথ্যা অহমিকা পোষনকারী আল্লাহদ্রোহী, বিপথগামীদের প্রতি এক ভয়ঙ্কর চটেপাঘাত, তাদের জন্য মহা শিক্ষার গ্রহণের উপকরণ রয়েছে। যে মানুষের নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই, নিজের জন্ম মৃত্যু, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক, ধন সম্পদ লাভ বা দারিদ্র নিয়ন্ত্রণের ওপর কোন হাত নেই, তারা নাকি সকল ক্ষমতার উৎসের অধিকারী! বৃষ্টির অভাবে ফসলী জমিন ফেটে চৌচির হয়ে যায়, তবুও মানুষ কি পারে তার ইচ্ছায় এক ফোটা বৃষ্টি বর্ষণ করতে? সূর্য অস্ত গেলে গোটা দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়, মানুষের সাধ্য আছে সূর্যকে ঠেকিয়ে রেখে রাত্রের অন্ধকার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার? এ দুনিয়ায় সহজে কেউ মরতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু কোন মানুষের ক্ষমতা আছে কি মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার লাভ করে চির যৌবন ধরে রাখার?

               নেই, তবুও আল্লাহর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস কেন, নিজের জীবনের ওপরই যাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তারা আবার এ বিশাল জগত সমূহের সৃষ্টি কর্তার ক্ষমতার চেয়েও মহা ক্ষমতাধর হয় কিভাবে? এ কি ফেরাউনী দম্ভ নয়? এর ফলাফল কি? মহান করুণাময় আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, “মানুষের অবাধ্যতার কারণে জলে স্থলে অশান্তির সৃষ্টি হয় এবং তাদের আযাবে গ্রেফতার করা হয় সাময়িকভাবে, যেন তারা নিজেদের সংশোধন করার অবকাশ পায়।”(সুরা রুম)

             আল্লাহর এ ঘোষণা থেকে আল্লাহর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জকারীরা কোন শিক্ষা নেবেন কি? যদি না নেন এবং জনগণের সকল ক্ষমতার উৎস সম্পর্কিত বিশ্বাসে বদ্ধমূল থাকতে চান, তবে তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান, এ মহাক্ষমতাবান জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর ঘোষিত সাময়িক আজাব গজব থেকে জনগণকে সুরক্ষিত করুন, দুর্যোগ দুর্বিপাকের সময় তাদের আর বিভিন্ন ধরনের মহাবিপদ সংকেত দিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত না করে তাদের সম্ভাব্য বিপদ থেকে সুরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা দিন। আল্লাহর ক্ষমতাই যখন জনগণের হাতের মুঠোয় আছে, তবে ঘূর্ণিঝড়ের সময় এ থেকে হেফাজত করার জন্য জনগণকে আল্লাহর নিকট দোয়া চাওয়ার হাস্যকর আবেদন জানাবেন কেন, মোকাবিলা করতে সাহস দিন। সকল ক্ষমতার উৎস জনগণের জন্য এত চিড়া-মুড়ি, পুরোনো কাপড়-বিস্কুট পাঠানোর প্রয়োজন কি, বিশাল ক্ষমতাকে ব্যবহার করে রাতদিন হালুয়া-রুটি, গোশত-পোলাও খেয়ে সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিন।

           আল্লাহ আমাদের সকলকে ঘৃণিত শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা করুন।