JustPaste.it

বাংলা সনের জন্মকথা

অধ্যাপক মুহাম্মাদ আবু তালিব

========================================================================

 

        বাংলা সন মূল হিজরী সনেরই বংশধর। বাংলা সনের জন্ম প্রসঙ্গ উঠলেই আগে হিজরী সনের কথা বলতে হয়। আমরা জানি, বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মভূমি মক্কার কুরাইশদের দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রীস্টাব্দে। এই হিজরীর স্মারক হিসেবে উক্ত সময় থেকেই একটি নতুন সনের প্রবর্তন হয়। হিজরতের স্মৃতিযুক্ত বলে এর নাম হয় ‘ হিজরী’ সন।

 

        ‘হিজরী' চান্দ্র সন । ইসলামী জগতের দ্বিতীয় খলীফা ওমরের (রাঃ) খিলাফতকালে (৬৩৮ খৃস্টাব্দে) তাঁরই নির্দেশে হিজরী সন প্রবর্তন হয়। অবশ্য হযরত ওমরের নির্দেশে তার খিলাফত কালে হলেও সনটি হিজরীর বৎসর থেকেই হয়েছে (জুলাই ১৬-৬২২ খ্রীঃ)। বলা বাহুল্য, এই দিনটি হিজরীর স্মারক হলেও হিজরতের দিন ছিল না। ঐতিহাসিক তাবারীর মতে এটি ছিল হিজরতের দিন থেকে ঠিক ২ (দুই) মাস ৮ দিন আগেকার । আর রাসূলুল্লাহর হিজরতের দিন ছিল রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার, মুতাবেক ২০ শে সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রীস্টাব্দ। ১ হিজরী সনের শুরু হয় মুহররম মাস থেকে।

 

        বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে করা যাচ্ছ! বলা প্রয়োজন, আরব দেশীয় নিয়ম অনুসারে ১ লা মুহররম থেকে সনের শুরু করতে গিয়ে এই ব্যতিক্রম দেখা দিয়েছে। বাংলা ও ইলাহি সনের ব্যাপারেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে।

 

        প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা প্রয়োজন, হিজরীর পূর্বেই আরব দেশে ‘আ’মুল ফীল' বা 'হস্তী - সন' নামে একটি নতুন সনের প্রবর্তন হয়েছিল। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ৫৭১ খ্রীস্টাব্দে হযরতের জন্মের ঠিক পঞ্চাশ কিংবা বায়ান্ন দিন আগে আবিসিনিয়ার খৃস্টান রাজার ইয়ামেনের প্রতাপশালী রাজ্যপাল আবরাহা (আসহাবুল ফীল) হযরতের পূর্বপুরুষদের প্রভুত্ব ক্ষুণ ও কা'বা শরীফকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিয়মিত হস্তী বাহিনীসহ মক্কা শরীফ আক্রমণ করে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় আবরাহার হস্তীবাহিনী সম্পূর্ণ দৈবদুর্ঘটনার শিকার হয় এবং সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সেই ঘটনার স্মারক হিসাবে সনটি ‘হস্তী - সন' নামে অভিহিত হয়। হিজরী সনের পূর্বকাল পর্যন্ত এই সন প্রচলিত ছিল! পবিত্র কুরআন শরীফে এই সুন্দর কাহিনীটি বিবত হয়েছে নিম্নরূপঃ

 

        “তোমরা কি দেখোনি তোমাদের প্রভু সেই হস্তীর অনুচরগণের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করেছিলেন? তিনি কি তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ। করে দেননি? এবং তিনি তাদের উপর ঝাঁকে ঝাকে পাখী পাঠিয়েছিলেন। তারা তাদের উপর কাকর বা ছোট ছোট পাথর (সিজ্জিল) নিক্ষেপ করেছিল। অতঃপর তিনি তাদের ভক্ষিত তৃণতুল্য করে দিয়েছিলেন। ২

 

        কথিত আছে, আবরাহার কা'বা শরীফ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে স্থানীয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিগণ অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবরাহার সৈন্যদলকে বাধাও দিয়েছিলেন। তবে কিছুতেই সেই পরাক্রান্ত বাহিনীর প্রতিরোধ করতে পারেননি। কিন্তু আল্লাহর গজবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

 

        সে যাই হোক, 'হস্তী - সন' এই দুর্ঘটনার স্মারক সাল হিসাবে প্রবর্তিত হয়েছিল। হিজরী সনের প্রবর্তনের ফলে ধীরে ধীরে হস্তী - সনেরও অস্তিত্ব লোপ পায়। এবার মুল বিষয়ে আসা যাক। বাংলা - ভারত উপমহাদেশে হিজরী সনের আগমন সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, ঘটনাটি নিতান্তই হালের নয়। স্বয়ং বিশ্ব নবীর জীবনকালেই আরব বণিক দল এদেশে ইসলামের সাম্য, মৈত্রী ও মানবতার বাণী প্রচার করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত গাযী - দরবেশ - মুজাহিদীনের অক্লান্ত সংগ্রাম সাধনার ফলে এদেশে ইসলামী শাসন । কায়েম হয়েছে। প্রথমে সিন্ধু - পাঞ্জাবে, শেষে এসেছে বাংলা - আসামে। বাংলাদেশে ইসলামী শাসন যখন কায়েম হয়েছে তখন খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতক উত্তীর্ণ হয়েছে। যার শুরু ধরা যেতে পারে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর বংঙ্গ বিজয় কাল থেকে ( ৬০০ হিঃ = ১২০৩ খ্রীঃ)। বখতিয়ারের বংঙ্গ জয় কালে এদেশে লক্ষণ সেনের রাজত্বকাল। চলছিল এবং লক্ষণ সেনের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘লক্ষণ সংবতের’ (লসং) প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। যতদূর জানা যায়, সমকালিন বাংলাদেশে ‘লক্ষণ সংবত’ ছাড়া শকাব্দ (৭৮ খ্রীঃ পূঃ) ইত্যাদি সন প্রচলিত ছিল। শকাব্দই ছিল তন্মধ্যে প্রধান। শকাব্দ বা মহারাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রতিষ্ঠান রাজ সালিবাহনের এবং বিক্রম সম্বৎ মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত কাব্য ‘মেঘদূত' বর্ণিত উজ্জয়নী রাজ বিক্রমাদিত্যের স্মৃতিসূচক। একাদশ শতকের বিখ্যাত মনীষী ও ভ্রমণকারী আবু রায়হান আলবেরুনী তার বিখ্যাত ভারত তত্ত্বমূলক আরবী গ্রন্থে (১০৩০ খ্রীঃ) সমকালীন ভারতে প্রচলিত সনগুলোর যে তালিকা দিয়েছে তা এইঃ

 

        ১. শ্রী হর্ষ প্রচলিত সন (শ্রী হর্ষাব্দ)

 

        ২. বিক্রমাদিত্য প্রচলিত সন (বিক্রম সম্বৎ)

 

        ৩. সকারি (সালিবাহন) প্রচলিত সন (শাককলা)

 

        ৪. বল্লভ প্রচলিত সন (বল্লভকলা)

 

        ৫. গুপ্ত প্রচলিত সন (গুপ্তকলা)

 

        তার মতে, শ্রী হর্ষের সন কনৌজ এবং মথুরায় প্রচলিত ছিল। তার কালে বিক্রমাদিত্যের ৪০০ বৎসর, মতান্তরে ৬৬৪ বৎসর আগে ছিল। শককলার উদ্ভব বিক্রমকলার ১৩৫ বৎসর পরে; বল্লভ কলা ও গুপ্তকলা শককলার ২৪১ বৎসর পরে! এই হিসেবে ‘বিক্রম সম্বৎ'কে (আধুনিক মতে) আদর্শ ধরলে এ সবের কাল দাঁড়ায় যথাক্রমে -৪৫৮ খ্রীস্টপূর্ব; ৫৮ খ্রীষ্টপূর্ব; ৭৭ খ্রীস্টাব্দ, ৩১৮ খ্রীস্টাব্দ ও ৩১৮ খ্রীস্টাব্দ। ৩

 

        আলবেরুনীর মতে, রাজা বিক্রমাদিত্যই সকদের দমন করেন, তবে তিনি ভিন্নতর বিক্রমাদিত্য। আধুনিক মতে, ইনি প্রতিষ্ঠানরাজ সলিবাহান। শকাব্দ সালিবাহনেরই স্মৃতি সূচক । মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই এদেশে ইসলামী সভ্যতার স্মারক হিজরী সনেরই প্রতিষ্ঠা হয়। এই সন একটানাভাবে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে পৌঁছে। বাংলা সনের প্রবর্তন হয় সম্রাট আকবরেরই রাজত্বকালে এবং তাঁরই নির্দেশে। ঘটনাটি এইরূপঃ সম্রাট আকবর দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন হিজরী ৯৬৩ সনে (১৫৫৬ খ্রীঃ)। তাঁর রাজত্বের উনবিংশতি বৎসরে রাজকার্য নির্বাহের নানা অসুবিধা দেখা দেয়। এই সময় বাংলাদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (১৫৭৬ খ্রীঃ)। বিশেষ করে হিজরী সনের দুর্বলতার কারণে বৎসরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। কেননা চান্দ্র সন চন্দ্রের অস্থিরতার কারণে প্রতি বৎসর নিদিষ্ট মৌসুমে নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ করার অসুবিধা দেখা দেয়। সৌর সনে অবিশ্য এই অসুবিধা নেই, ফলে সৌর সন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিখ্যাত ‘আইন - ই - আকবরী' পাঠে জানা যায়, সম্রাটের দরবারের কতিপয় প্রভাবশালী কর্মচারীও হিজরী সনের বিরুদ্ধে আপত্তি তোলেন এবং একটি নতুন সনের জন্য আবদারও করেন। সম্রাট নিজেও হিজরী সনের দুর্বলতার বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকায় অবিলম্বেই এ বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। নিদের্শনায় বলা হয় “যেহেতু ভারতের প্রচলিত সনগুলো সৌর পদ্ধতির এবং তার মাসগুলো চন্দ্র পদ্ধতির, তাই আমার নির্দেশ এই যে, প্রস্তাবিত সনটি যেন পূর্ণাঙ্গ সৌর পদ্ধতির হয়।” ৪

 

        এই গ্রন্থেই পাওয়া যায়, সম্রাটের নেক নজরের ফলে যে নবতর সনের প্রবর্তন হয় তাতে মূল মাসের দিনগুলি অর্ধলুপ্ত হয় এবং মাসগুলিও সৌর পদ্ধতির হয়।” ৫

 

এখানে স্মর্তব্য এই যে, সম্রাট ইতিপূর্বে ‘দীন - ই - ইলাহি' নামে একটি অভিনব (বাতিল) ধর্মমত প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন। বর্তমান সনটিও 'ইলাহি সন' (উণশধভণ ঋরট) নামে পরিচিত হলেও আসলে এর সঙ্গে কোন ধর্মের সম্পর্ক ছিল না। শিরাজী সাহেব আরবী হিজরী ও শুরগানি বা পারসিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এই সনের উদ্ভাবন করেন। ইলাহি সনের উদ্ভাবন সম্পর্কে জানা যায়, বিজাপুরের সুলতানের পূর্বতন সভাসদ মহাপণ্ডিত আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী সম্রাটের দরবারে নিযুক্ত হওয়ার পর সম্রাট তাঁকেই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার অর্পণ করেন (৯৯২ হিঃ ১৫৮৪ খ্রীঃ)। শিরাজী সাহেবের বিদ্যাবত্তা ও অর্পিত কাজের দক্ষতা সম্পর্কে সমকালীন ঐতিহাসিক আবুল ফজল সাহেব বলেন, “যদি এমন দুর্ঘটনা কোনদিন ঘটে যে, দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো বিনষ্ট হয়, আর শিরাজী সাহেব জীবিত থাকেন, তাহলে একা তিনিই তার পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবেন।” ৬

 

এহেন শিরাজী সাহেব রাজদরবারে এসে সম্রাটের নির্দেশে শুধু নবতর ইলাহি সনেরই প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি তাঁরই আদর্শে বাংলা সনসহ আরও কতিপয় নবতর সৌর সনের প্রবর্তন করেন। পরবর্তী সনগুলো প্রয়োজন মুতাবিক ‘ফসলী সন’ নামে অভিহিত হয়। ইতিপূর্বেই সেগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি পূর্বতন হিজরী সনের মর্যাদা কিছুমাত্র ক্ষুন্ন বা পরিবর্তন না করে তারই উপর ভিত্তি করে বিবিধ সৌর সনের প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রত্যেক সনই স্বাধীন ও স্বমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। শুধু তাই নয়, প্রবর্তিত সনগুলো পূর্বতন সকল সনের প্রাসঙ্গিক দূর্বলতামুক্ত এবং অধিকতর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদ্ব্যতীত হিজরী সনের উপর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় একাধারে ইসলাম ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মুঘল সম্রাটের রাজকীয় ঐতিহ্য ও মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। সম্রাটের নির্দেশনামা জারী হয় হিজরী ৯৯২ সালের ৮ ই রবিউল আউয়াল , মুতাবিক ১০ ই মার্চ, ১৫৮৫ খ্রীস্টাব্দে এবং তা কার্যকরী হয় ৯৬৩ হিজরীর ২৮ শে রবিউল আউয়াল, মুতাবিক ১০ ই অথবা ১১ ই মার্চ ১৫৫৬ খ্রীস্টাব্দ থেকে। দিনটি সম্রাটের সিংহাসনে আরোহনের স্মারক হলেও সম্রাটের সিংহাসন আরোহণের দিন নয় - সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের দিন ছিল ২ রা রবিউল আউয়াল, মুতাবিক, ১৪ ই ফেব্রুয়ারী ১৫৫৭ খ্রীস্টাব্দ। ৭

 

        আরও উল্লেখ্য যে, ইলাহি সনের প্রথম দিনটি - নওরোজ বা নতুন দিন হিসেবে গৃহীত হয়েছিল এবং ইলাহি সনের মাসগুলি পারস্য সন থেকে গৃহীত হয়েছিল। পারসিক আদর্শ গৃহীত হওয়ায় এই দিনটিকেও ‘নওরোজ' এবং বিশেষ উৎসবের দিন বলে গৃহীত হয়েছিল। মুঘল সম্রাট গণ এই বিশেষ দিনটিকে ‘নওরোজ' হিসেবে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন। মনে হয় পারস্য সনের আদর্শে গৃহীত বলে সম্রাটের সিংহাসনে আরোহণের দিন না ধরে ২৬ দিন এগিয়ে পারস্য সনের প্রথম দিন থেকে এই নতুন সন গণনা শুরু করা হয়েছিল। এর ফলে সম্রাটের হিংহাসনে আরোহণের দিন না হলেও সিংহাসনে আরোহণের মাস ও বৎসরকে অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব হয়েছিল। বাংলা সনের গণনা শুরু তার একমাস পরে (১১ ই এপ্রিল, ১৫৫৬ খ্রীঃ মুতাবিক ১ লা বোশেখ, ১৪৭৮ শকাব্দ)। তাই দেখা যায়, মূল খ্রীস্টীয় সন থেকে এর বয়স ৫৯৩ বৎসর ৩ মাস ১১ দিন কম। মোটা মুটি বাংলা সনের সঙ্গে ৫৯৩ যোগ করলে খ্রীস্টীয় সনের হিসেব মেলে। বৎসরের প্রথম দিন হওয়ায় পয়লা বোশেখের গুরুত্বও বাঙালী জীবনে অধিক। ৮ এই দিনটি নববর্ষ বা হালখাতার দিন হিসাবে সম্মানিত। প্রশ্ন হতে পারে, ৯৬৩ হিজরীতে যদি বাংলা সনের জন্ম হয়ে থাকে, এবং যদি তার বয়স হিজরী সনের ধরা হয়ে থাকে তাহলে বাংলা সনের সঙ্গে হিজরী সনের বয়সের এত তারতম্য কেন? পক্ষান্তরে ৯৬৩ হিজরীতে প্রবর্তনের পর তো মাত্র ৪১৮ বৎসর অতিক্রম করছে। তাই স্বাভাবিক বয়স ধরলে তো বাংলা সনের বয়স হওয়া উচিত ৪১৮ বৎসর (১৩৮১-৯৬৩)। এর জবাব এই যে, ৯৬৩ হি . (১৫৫৬ খ্রীঃ) থেকে চালু হলেও আসলে সে ছিল তার দ্বিতীয় স্তর মাত্র।

 

        আদি স্তরে অর্থাৎ ৬২২ খ্রীস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১৫৫৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত (৯৬৩ হিঃ) কোনরূপ ব্যতিক্রম না করে ১৫৫৭ (৯৬৪ হিঃ) খ্রীস্টাব্দ থেকে উভয়ের গতিপথ বদলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ হিজরী সনই রয়ে গেছে আর বাংলা সন সৌর পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এভাবে উভয় সনেরই হিসেব প্রতি বৎসর যথাক্রমে ১০/১১ দিন কম বেশি হয়েছে। বাংলা সন সৌর পদ্ধতির হওয়ায় প্রতি বৎসর ১০/১১ দিন পিছিয়ে গেছে এবং হিজরী সন চান্দ্র পদ্ধতির জন্যে গেছে ১০/১১ দিন এগিয়ে। উল্লেখ্য যে, চান্দ্র বৎসর প্রতি চলতি বৎসরে প্রায় ১১ দিন বাড়তে বাড়তে যখন তিন বৎসরে ৩২ দিনের বেশী তফাৎ হয়ে পরে তখন একটি চান্দ্র মাস বাদ দিয়ে ‘সাবন - মিতি’ করা হয়। চন্দ্রের সংক্রামণ (সংক্রামিত) ভোর বেলায় হলে বৎসরের ৩৫৪ দিনে এবং রাতে হলে ৩৫৫ দিনে চান্দ্র বৎসর ধরা হয়। সংক্রান্তির পর থেকে অর্থাৎ সূর্য যখন এক রাশি ছেড়ে অন্য রাশিতে প্রবেশ করে তখনই মাসের শুরু এবং চাদ যে মাসে যে নক্ষত্রে এসে পূর্ণিমা দেখায় তা থেকে মাসের নামকরণ করা হয়।

 

        যেমন, বৈশাখ মাসে চাদ বিশাখা নক্ষত্রে এসে পূর্ণিমা ঘটায় বলে তার নাম রাখা হয়েছে বৈশাখ এভাবে জৈষ্ঠ্য নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় নামে ‘আষাঢ়' ইত্যাদি নামকরণ করা হয়েছে। সে কথা যাক । পুরা তেত্রিশ বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পর হিজরী বাংলা সনে ১ বৎসরের ব্যতিক্রম ঘটে। এভাবে ৪৮ বৎসরের প্রায় ১৩ বৎসরের ব্যবধান রচিত হয়েছে। সুধী সমাজের অবগতির জন্যে একটি অংকের মাধ্যমে বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করা যাচ্ছো। মনে করুন, বর্তমানে হিজরী সন ১৩৯৪ যাচ্ছো। ১৩৯৪÷৩৩ = ৪২; ১৩৯৪–৪২ (পূর্বোক্ত ভাগফল) ১৩৫২ + ৬২২ = ১৯৭৪ খ্রীস্টাব্দ। এর থেকে ৫৯৩ বিয়োগ করলে বাংলা ১৩৮১ সাল মিলে। তবে প্রতি বৎসরই পূজা পার্বণের দিন পূর্ব বৎসরের তুলনায় ১০-১১ দিন করে তফাৎ হয়ে পরে। কিন্তু এই তফাৎ বেশী দিন বাড়তে দিলে অসুবিধে হয়, তাই প্রতি তিন বৎসর পর পর যখন এই বাড়তি দিনগুলি বত্রিশ দিনের অতিক্রম হয়, তখন একটি চান্দ্র মাসকে একেবারে হিসেব থেকে বাদ দিয়ে সৌর বৎসরের সঙ্গে মিল করা হয়। এই মিলকে ‘সাবন - মিতি’ এবং 'মলমাস' বা অতিরিক্ত মাস বলা হয়। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জগদানন্দ রায়ের ভাষায়, “চান্দ্র বৎসর প্রতি চলতি বৎসরে প্রায় ১১ দিন বাড়তে বাড়তে যখন তিন বৎসরে সাড়ে বত্রিশ দিন তফাৎ হয়ে পরে, তখন একটা চান্দ্র মাসকে একেবারে বাদ দেওয়া হয়। সংক্রান্তির পর হতে অর্থাৎ সূর্য যখন এক রাশি ছেড়ে অন্য রশিতে প্রবেশ করে, তখনই মাসের আরম্ভ হয়। কিন্তু চান্দ্র ও সূর্যের গতির গোলাযোগে এমন মাস ঘটে যাতে সংক্রান্তি হয় না। এই রকম অমান্ত মাসকেই বাদ দিবার নিয়ম আছে। এই বাদ দেওয়া চান্দ্র মাসকে বলা হয় মল বা অধিক মাস। ৯

 

        মি . রায় আরও বলেন, এই মাসটিকে হিন্দুরা মাস বলেই গ্রাহ্য করেন না। কোন যাগযজ্ঞ পূজা - পার্বণ বা কোন শুভকার্যও এই মাসে তারা করেন না। সম্রাট আকবর তাঁর নির্দেশ নামাতে এই ‘মলমাস’ সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করে ভবিষ্যত সনগুলি যাতে এই শ্রেণীর দুর্বলতামুক্ত হয়, সেজন্য বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তাই বলাবাহুল্য, সম্রাট নির্দেশিত নতুন সন উদ্ভাবনের ফলে দেশীয় প্রাচীন সনগুলিও ত্রুটিমুক্ত হয়ে আত্মপ্রকাশের সুযোগ লাভ করেছিল এবং বাংলা সনই হলো তার পথ - প্রদর্শক।

 

 

 

বাংলা সনের জন্মদাতা

আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী

----------------------------------------------------------------

        তার নাম আমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী। সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার সদস্য না হলেও মর্যদার দিক দিয়ে ইনি দৈবে দশম রত্ন সদৃশ হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষ করে ফৈজী, আবুল ফযল ও বীরবলের পরেই তার নাম উচ্চারিত হত। শাহানশাহ আকবরের তিনি অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। আকবর তাকে কোন সময়েই কাছ ছাড়া করতেন না; এমনকি প্রমোদ ভ্রমণের সময়েও কিংবা শিকার কালেও তিনি তাঁকে সাথে নিতেন। আবুল ফযল তাঁর বিখ্যাত ‘আকবর নামা’ গ্রন্থে তার অসাধারণ বিদ্যাবত্তা, সাহস ও কর্মকুশলতার প্রশংসা করেছেন। এক স্থানে তিনি এমনও বলেছেন যে, যদি দেশের সমস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি বিলুপ্তও হয়, আমীর তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম। তাঁর উস্তাদ ছিলেন খাজা জামাল উদ্দিন মাহমুদ, কামান উদ্দীন শিরওয়ানী ও মীর গিয়াস উদ্দীন মনসুর শিরাজী। প্রথম জীবনে তিনি বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহের দরবার অলংকৃত করেন। ৯৯২ হিজরীতে (১৫৮৪ | খ্রীঃ) সুলতানের ইন্তেকালের পর তিনি সম্রাট আকবরের নিয়োগ পেয়ে দিল্লীর দরবারে আসন গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে রাজা টোডরমলের অর্থনৈতিক সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। অর্থনীতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনায় তিনি তাকে বিশেষ সহায়তা করেন। পরে - উক্ত বিভাগের ‘সদর’ বা অধ্যক্ষের পদে উন্নীত হন এবং তিন বৎসর বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে কর্ম পরিচালনার পর ‘আমিন উল মূলুক’ উপাধিতে ভূষিত হন। অতঃপর ‘আযাদ - উদ্ - দৌলা' উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বাংলা, ইলাহি ইত্যাদি সনের উদ্ভাবন। মীরাতুল আলম গ্রন্থে তাঁকে বিশেষ প্রজ্ঞাসম্পন্ন মনীষী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি একজন সূদক্ষ শিকারীও ছিলেন। আমীর - উল - আমারা' গ্রন্থে তাকে ‘ছে হাযারী' বা তিন হাযারী সেনাপতিও বলা হয়েছে। তাঁর বিশেষ বীরত্বেরও খ্যাতি ছিল। বীরত্বের জন্য তাঁর উপাধিও ছিল ‘রোস্ত সানী’ বা দ্বিতীয় রোস্তম।

 

        ৯৯৭ হিজরীতে (১৫৮৯ খ্রীঃ) খান্দেশ প্রদেশে ভ্রমণে যান। ফিরে এসে বিশেষভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন। কথিত আছে, দরবারের বিশিষ্ট হেকিম আলী তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা দেন; কিন্তু তিনি অগ্রাহ্য করে হরিসা' নামে বিশেষ কোন বস্তু গ্রহণ করেন এবং ফলে তার মৃত্যু হয়।

 

“তখতে সুলায়মানী” নামক স্থানে তার মাযার অবস্থিত রয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে তার বিখ্যাত সহকারী ও মনীষী ফৈজী একটি স্মরণীয় কবিতা লিখেছিলেন।

 

        অমীর ফতেহ উল্লাহ শিরাজী সম্পর্কে একটি কথা বিশেষভাবে বলা যায় যে, তিনি নিতান্ত সাধারণ মানুষ ছিলেন। ভবিষ্যতে বড় হওয়া বা অমর হওয়ার কোন উচ্চাকাঙক্ষাও তার বিশেষ ছিল না। কিন্তু বড় তিনি হয়েছিলেন বিজাপুরের মত একটি ছোট রাজদরবারে থেকেও আকবরের সুদৃষ্টি তিনি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আবুল ফজল, ফৈজী, বীরবলের মত বন্ধু লাভ করেছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা নবরত্ন সভার সদস্য না হয়েও তিনি তাদের সকলেরই শ্রদ্ধাভাজন হতে পেরেছিলেন। আজ বাংলা সনের জনকরূপে সূদূর। বাংলাদেশবাসীর কাছেও পরম আপনজনরূপে স্মরণীয় হয়ে রইলেন ।

 

 

 

 

        পাদটীকা

 

        ১ ক, মুহাম্মদ বিন জাবীর আল - তাবারী । তারীখ আল - উমাম ওয়া আল মুলুক, ২ য় খণ্ড (মূল আরবী), কায়রো, ১৩৫৭ হিঃ ১৯৩৯ খ্রীস্টপূর্ব, পৃঃ ১১০-১১৪। হযরত রাসূলুল্লাহ (সঃ) রবিউল আউয়াল মাসে মদীনায় পদার্প করার সঙ্গে সঙ্গেই সন গণনার নির্দেশ দিলেন।

 

        খ. Ain - i - Akbari, Tr . Jarrate . C. M. H., Vol . 11, 1968, P. 25-26 .

 

        ২ কুরআন শরীফ, সূরা ফীল, নং ১০৫ পারা ৩০

 

        ৩ Alberuni's I dia Ed . by Dr. Edward Sachau, Two volumes in one . Vol . 1, First Indian Reprint, 1964. , XLIX, p . 5 .

 

        ৪ আবুর ফযল, আকবর নামা ২য় খণ্ড, ইংরেজী অনুবাদঃ মি . বিভারিজ, পৃ . ২৩।

 

        ৫ পূর্বোক্ত পৃঃ ১৭ ।

 

        ৬ আইন - ই - আকবরী , পূর্বোক্ত ।

 

        8 পূর্বোক্ত ।

 

        9 মহম্মদের জীবন চরিত ও মহম্মদীয় রাজ্যের পুরাবৃত্ত। কলিকাতা, ১৮৫৮ , পৃঃ ১৫০। “সেই নতুন গণনা (বাংলা সন) বঙ্গদেশে অদ্যাপি চলিত আছে, অর্থাৎ খ্রীস্টীয় ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল তারিখে বাঙ্গালী সন - নামক গণনানুসারে ৯৬৩ সালের আরম্ভ হয়। অতএব সনের এবং খ্রীস্টীয় সালের মধ্যে নিরন্তন ৫৯৩ বৎসর ও তিন মাস ও এগার দিন ব্যবধান আছে।”

 

        ১০ নক্ষত্র চেনা, জগদানন্দ রায়, পৃষ্ঠা ৭৩।

 

═──────────────═