JustPaste.it

জীবন পাথেয়

 

হজ্ব ও কুরবানী সম্পর্কিত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও তার সংশোধন

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রহঃ)

========================================================================

 

        ইসলামের রোকনসমূহের মধ্যে একটা হলো হজ্ব। হজ্ব তার অনন্য বৈশিষ্টের কারণে অন্যান্য রোকনের তুলনায় অনেকটা আলাদা। এবং বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। কারণ হজ্বব্রত পালনের জন্য একদিকে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ যা লাভ করা মানুষের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন নয়। অপরদিকে হজ্ব পালনের ব্যাপারেও নানা ধরনের সমস্যা ও বাধা - বিপত্তির সম্মুখীন হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়। কারণ এজন্য যেমন বেশী সম্পদ থাকা দরকার তেমন শক্তি, সাহস এবং সময় সুযোগেরও প্রয়োজন হয়।

 

        হজ্ব করার জন্য সামর্থ থাকার পর এক বছর অলসতা করে হজ্ব না করলে পরবর্তী বছর উল্লেখিত আবশ্যিক  বিষয়গুলোতে পুরোপুরি বা আংশিক বাস্তব সমস্যা সৃষ্টি হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক। এই সমস্যাগুলো অন্যান্য রোকনের মধ্যে নেই। এ কারণেই হাদীসে বলা হয়েছে, “কেউ হজ্ব করতে চাইলে যেন সে তা তাড়াতাড়ি আদায় করে নেয়“। আর এই বিশেষত্বের কারণেই সম্ভবতঃ হজ্ব জীবনে মাত্র একবার ফরয করা হয়েছে।

 

        তাছাড়া হজ্বের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বহু কাজ আঞ্জাম দিতে হয়। যা বিশেষ সময় ও বিশেষ স্থানের সাথে সম্পৃক্ত বিধায় এ দৃষ্টিকোণ থেকেও হজ্ব অন্যান্য রোকুন থেকে ব্যতিক্রম। আর এ কারণেই সাধারণ মানুষ হজ্বের আহকাম ও মাসআলা সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখে না। এর চর্চাও হয় খুব কম। কম জানার কারণে হজ্বের মধ্যে আ'মলী ক্রটি বেশী সংঘটিত হয়। আর চর্চা কম থাকার কারণে ইলমী ক্রটি আরও বেশী হয়।

 

        আ'মলী ক্রটি হলো, হজ্ব আদায় করার ব্যাপারে মানুষ বেশী অলসতার শিকার হয়। অহেতুক ঝামেলা ও কাল্পনিক সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় মানুষ হজ্ব আদায়ে অযথা বিলম্ব করে ফেলে। মনে করে যে, অমুক কাজটা থেকে অবসর হয়েই হজ্ব পালন করব। কিন্তু কাজ আর শেষ হয় না। এক কাজ শেষে হতে না হতে আরেক কাজ এসে হাজির। যা হজ্ব পালনে বাধা হয়ে দাড়ায়। এ ক্ষেত্রে তার চিন্তা করা উচিত, আমি যদি এখনই মরে যাই তাহলে আমার মিল - কারখানা, কায় - কারবার, জায়গা - জমি ও পরিবর পরিজনের কি হবে? আর সফর তো মৃত্যু থেকে বড় কিছু নয়। মৃত্যু হলে চিরদিনের জন্য সব কিছু ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। আর হজ্ব করতে গেলে ত্যাগ করতে হবে মাত্র কয়েকটি দিন। এভাবে নিজেকে বুঝিয়ে হজ্বের জন্য প্রস্তুত করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়।

 

        আর হজ্ব সম্পর্কিত ইলমী ক্রটি তো বিস্তর। এর কতিপয় হলো স্থান বিশেষের সাথে সম্পর্কিত। বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া তা আয়ত্ত করা কঠিন ব্যাপার। যারা হজ্বের বিধান সম্পর্কে সম্যক অবগত, বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং দ্বীনদারী ও নিষ্ঠার সাথে হাজীদেরকে হজ্বের যাবতীয় কার্য সম্পাদনে সাহায্যের জন্য তৎপর, এমন লোকদেরই এ সব কাজের জন্য মুআল্লিম নিয়োগ করা উচিৎ। অনেক ক্ষেত্রে মুআল্লিম নিয়োগ করা হয় নিছক আসবাবপত্র হেফাজতের জন্য। বস্তুত পার্থিব প্রয়োজন কোন না কোন উপায়ে সেরে নেয়া তেমন জটিল বিষয় নয়, দ্বীনী প্রয়োজন মেটানোর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা বেশী প্রয়োজন। আর হজ্ব করতে যাওয়ার আগে হজ্ব করে আসা অভিজ্ঞ আলিমদের সাথে পরামর্শ করা দরকার। বলা বাহুল্য যে, অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় এমন ত্রুটি ঘটে যার কারণে হজ্বই নষ্ট হয়ে যায়।

 

        আর যেহেতু হজ্বের সবধরণের মাসআলা সবসময় আলিমদেরও মনে থাকে না, সেজন্য তাদের উচিত হজ্বে যাওয়ার সময় হজ্বের মাসআলা সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য কোন কিতাব সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া এবং সুযোগমত তা অধ্যয়ন করতে থাকা। এর পরও যদি মাসআলা বুঝে না আসে তা হলে বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছে জিজ্ঞাসা করে তা জেনে নেয়া। এ বিষয়ে সংকোচ বোধ করা ঠিক নয়। আর নিজে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েই তবে অন্যকে মাসআলা বলবে। নিজের জানা না থাকলে তাকে অন্য কোন বড় আলিমের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিবে।

 

        এতো গেল সেসব ইলমী ত্রুটির কথা যা জানা না থাকার ফলে বিশেষ বিশেষ স্থানে পৌছার পর সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এমন কিছু ত্রুটিও আছে যা সফরের পূর্বে দেখা দেয়। তন্মধ্যে কতিপয় বিষয় এমন আছে যে সম্পর্কে শরীয়াতের অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও হজ্বে যাওয়ার পথে তা প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। আবার কোন বিষয়ে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তা হজ্বের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। একটু বিশ্লেষণ করলেই বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝে আসবে।

 

 

হজ্বের জন্য মদীনায় যাওয়া জরুরী নয়ঃ 

        একটি ত্রুটি হলো এই যে, অনেকে হজ্ব তখনই ফরয হয় বলে মনে করে যখন তার মদীনা মুনাওয়ারা পর্যন্ত যাওয়ার মত সামর্থ থাকে। যদি এমন হয় যে, এতটুকু পরিমাণ অর্থ আছে যদ্বারা শুধু মক্কায় গিয়ে হজ্ব করা যায়। কিন্তু মদীনা যাওয়া যায় না; তাহলে এমতাবস্থায় হজ্ব ফরজ হয় না বলে তাদের ধারণা। কিন্তু এহেন ধরণা নিতান্ত ভুল। রওযা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্য হোক, শুধু মসজিদে নববীর উদ্দেশ্যে হোক মদীনায় যাওয়া একটি পৃথক ইবাদাত । হজ্বের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই।

 

        মোট কথা, হজ্ব ফরয হওয়া মদিনা যাওয়ার সামর্থের উপর নির্ভরশীল নয়। যদি শুধু মক্কা গিয়ে হজ্ব করার সামর্থ থাকে আর মদীনা সফর করার সামর্থ না থাকে তবুও তার উপর হজ্ব ফরয হবে। এমন ব্যক্তি যদি হজ্ব না করে তাহলে সেও সেসব সতর্কবাণীর পাত্র হবে যা সরাসরি হজ্ব বর্জনকারীর উপর আরোপ করা হয়েছে। তবে যদি হজ্ব সমাপ্ত করার পর মদীনা সফর করার মত কোন সুব্যবস্থা হয়ে যায় কিংবা পায়ে হেটে যাওয়ার সাহস হয়; তাহলে সে সুযোগ গ্রহণ করা উচিত। অন্যথায় মক্কা থেকে ফিরে আসবে এবং মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা রাখবে যে, কখনো আল্লাহ তাওফীক দিলে পৃথক ভাবে মদীনা সফর করে আসব। এরূপ ব্যবস্থা হয়ে গেলে অবশ্যই প্রতিজ্ঞা পালন করবে। কিন্তু এই প্রতিজ্ঞার পর যদি জীবনে কখনো সুযোগ নাও আসে তবে এমন সফর করলে সে যে সওয়াব পেত আল্লাহ তায়ালা তার এই প্রতিজ্ঞার বিনিময়ে প্রায় তত পরিমাণ সওয়াব তাকে দান করবেন। যেমন বিভিন্ন হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, সৎ কাজের নিয়ত করলেও কাজ করার সমপরিমান সওয়াব পাওয়া যায়।

 

 

হারাম সম্পদ দ্বারা হজ্বঃ 

        আরেকটি ত্রুটি হলো এই যে, অনেক সময় এমন হয় যে, কোন ব্যক্তির কাছে হরাম সম্পদ এত পরিমাণ আছে যে, তদ্বারা হজ্ব করে আসা যায়। কিন্তু সে মনে করে যে, এ সম্পদ তো হারাম। আর হারাম সম্পদ হজ্বের কাজে ব্যয় করা তো আরো খারাপ। পক্ষান্তরে আমার কাছে হালাল সম্পদ এত পরিমাণ নেই যদ্বারা আমি হজ্ব করতে পারি। সুতরাং আমার জন্য হজ্ব ফরয নয়। আর যাকাতের বেলায়ও অনেকে এরূপ ধারণা করে বসে। মোট কথা এরা বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও না দেয় যাকাত না করে হজ্ব।

 

        এব্যাপারে শরীয়াতের বিধান হলো, হজ্ব ফরয হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত। মালিকানাধীন সম্পদ হালাল হওয়া হজ্ব (বা যাকাত) ফরয হওয়ার জন্য শর্ত নয়। এ কারণে এমন ব্যক্তির উপর হজ্ব ও যাকাত উভয়ই ফরয হিসাবে বর্তায়। তবে হারাম সম্পদ দ্বারা যে হজ্ব করা হবে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। (অর্থাৎ এর বিনিময়ের সে কোন সওয়াব পাবে না) কিন্তু ফরয আদায় হয়ে যাবে। অর্থাৎ মৃত্যুর পর এমন ব্যক্তিকে একথা জিজ্ঞাসা করা হবে না যে, তুমি কেন হজ্ব করনি? তবে একথা অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তুমি হারাম উপায়ে কেন সম্পদ উপার্জন ও সঞ্চয় করেছো? হারাম সম্পদ কেন ভোগ করছো ইত্যাদি। এব্যাপারে পই পই হিসেব তাকে দিতে হবে। মোট কথা হজ্ব আদায় হয়ে যাওয়া এক কথা আর কবুল হওয়া আরেক কথা।

 

        কিন্তু যদি কেউ হারাম সম্পদ দ্বারা হজ্ব আদায় হওয়ার সাথে সাথে কবুল হওয়াও কামনা করে আর এই হারাম সম্পদ ছাড়া অন্য কোন হালাল সম্পদ তার কাছে না থাকে, তাহলে এ পন্থা অবলম্বন করা যেতে পারে যে, কোন কাফিরের নিকট হতে কিছু টাকা ঋণ করে আলাদা করে রেখে দিবে। অতঃপর কিছুদিন পরে সেই হারাম সম্পদ দ্বারা তার ঋণ পরিশোধ করে দিবে। সরাসরি হারাম সম্পদ দ্বারা হজ্ব করার চেয়ে এই ঋণের টাকা অনেক ভালো । অন্যের থেকে সরাসরি বদল করে নেয়া আর ঋণ করে হারাম মাল দ্বারা পরে তা শোধ করা এক কথা নয়।

 

        উল্লেখ্য যে, এই পন্থা শিখিয়ে দেয়ার অর্থ এই নয় যে, আমি হারাম সম্পদ অর্জনের অনুমতি দিচ্ছি। কিংবা এই পন্থা অবলম্বন করলে হারাম অর্জনের পাপ ঘুচে যাবে বা তার পাপ মোচনের আর কোন প্রয়োজন থাকবে না। একথা আমার বলার উদ্দেশ্য কখনো নয়। হারাম সম্পদ উপার্জনের যে অপরাধ পূর্বে ছিল এই পন্থা অবলম্বন করার পরও তা পূর্ববৎ বহাল থাকবে এবং এর প্রতিকার এখনও তার প্রতি ওয়াজিব থাকবে। অর্থাৎ যাদের হক নষ্ট করে এই সম্পদ উপার্জন করা হয়েছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে। অর্জিত হারাম সম্পদের যে অংশের প্রকৃত মালিক পাওয়া না যাবে তা তার ওয়ারিশদের হাতে তুলে দিবে। আর যদি এরূপ হারাম ভাবে অর্জিত কোন সম্পদের মালিকের পরিচয় জানা না যায় তাহলে তা প্রকৃত মালিকের নামে গরীবকে দান করে দিবে। এর সাথে সাথে তার জন্য ইসতেগফারও দু’আ করবে। আর যদি তৎক্ষণাৎ প্রতিকার করা সম্ভব না হয় তাহলে সবসময় প্রতিকারের চিন্তায় থাকবে এবং যখন যতটুকু সম্ভব হয় আদায় করতে থাকবে।

 

        মোটকথা উপরোক্ত বাহানা দ্বারা হারাম - হালালের বিধানের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসবে না। এর দ্বারা উদ্দেশ্য শুধু এতটুকু বুঝিয়ে দেয়া যে, এরা যে মনে করে এমতাবস্থায় হজ্ব যাকাত ফরয হয় নয়, তাদের এ ভুল ধারণা দূরীভূত করা।

 

 

ভিক্ষা করে হজ্ব করাঃ 

        একটি ত্রুটি হলো এই যে, অনেক লোক এমন আছে যে, তাদের কাছে না আছে হজ্বের প্রয়োজনীয় আসবাব, না আছে তাদের অন্তরে অমুখাপেক্ষিতা ও তাওয়াক্কুলের হিম্মত। কিন্তু মানুষের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করে তাদেরকে পেরেশান করে হজ্ব করতে যায়। বস্তুত এভাবে ভিক্ষা করে হজ্ব করতে যাওয়া সম্পূর্ণ হারাম ।

 

 

মাহরাম ব্যতীত হজ্ব করাঃ 

        অনেক মহিলার মধ্যে এই ত্রুটি পরিলক্ষিত হয় যে, তারা স্বামী বা অন্য কোন মাহরাম পুরুষ সংগে না নিয়েই হজ্ব করতে চলে যায়। কোন কোন ইমামের মতে শর্তসাপেক্ষে এরূপ করার সুযোগ থাকলেও

 

       প্রথমতঃ সর্ব সাধারণের এই অধিকার নেই। যে, যখন যে ইমামের মত ভালো লাগে তখন তারটা গ্রহণ করবে।

 

       দ্বিতীয়তঃ যেসব মহিলারা এভাবে হজ্ব করতে যায় সাধারণতঃ তারা সেসব শর্ত সম্পর্কে নিতান্তই অজ্ঞ। এ সবকিছুর তোয়াক্কই তারা করে না। যেভাবে মনে চায় সেভাবে চলে যায়, যা কোন ইমামের মতেই জায়িয নয়।

 

       তৃতীয়তঃ আগের দিনে ফেতনার আশংকা কম থাকার দরুণ মহিলারা নিরাপদে চলাফেরা করতে পারত। কিন্তু এখন ফেতনা ও নিরাপত্তাহীনতা আশংকা জনক পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে। মহিলাদের দেখলেই দুষ্ট প্রকৃতির পুরুষদের কুপ্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তদুপরি বর্তমান মানুষের মধ্যে সাহায্য ও সহানুভূতির মানসিকতা কম থাকার কারণে অন্য মহিলাদের সঙ্গে হজ্ব করতে গেলেও ঘটনাক্রমে রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে নিজের কাজ রেখে রোগীর সেবা করার মত মহিলা খুব কমই পাওয়া যায়। প্রত্যেকেই নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। অতএব বাধ্য হয়ে পুরুষদেরকে তাদের সহযোগিতা করতে হয়। উপর থেকে নীচে নামার সময় বা নিচে থেকে উপরে উঠার সময় বেগানা পুরুষদেরকেই তাদের হাত ধরতে হয়, কোমর ধরতে হয়। এমতাবস্থায় ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকা উভয়ের জন্য দুষ্কর হয়ে দাড়ায়। বিশেষতঃ এসব ক্ষেত্রে অন্তর ও চোখের ফেতনা থেকে বাঁচাতো সম্ভবই নয়। সুতরাং এমন হজ্বের। মূল্য কি? এ ধরণের মহিলাকে যখন শরীয়াত হজ্বের আদেশ দেয়ার পরিবর্তে নিষেধ করেছে, তখন খামাখা বিপদের ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন টা কি? তাই কোন মহিলার যদি হজ্ব করার সংগতি থাকে কিন্তু সাথে যাওয়ার জন্য কোন মাহরাম পুরুষ না থাকে কিংবা থাকা সত্ত্বেও সে সঙ্গে যেতে চায় বা রাজী না হয় এমতাবস্থায় তার হজ্ব ওয়াজিব হবে কি হবে না, এ ব্যাপারে ইমামদের মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেছেন, হজ্ব ওয়াজিব হবে আর কেউ বলেছেন, হবে না। প্রথম মত অনুযায়ী মৃত্যুর সময় তার ওপর বদলী হজ্বের অসিয়াত করে যাওয়া ওয়াজিব। আর দ্বিতীয় মত অনুযায়ী ওসিয়ত করাও ওয়াজিব নয়। তবে সাবধানতার খাতিরে অসিয়াত করে যাওয়াই ভালো। যদি এই আশংকাও থাকে যে, অসিয়াত করে গেলেও হজ্ব পালন করা হবে না, ফলে তা তো আমারই দায়িত্বে ওয়াজিব রয়ে গেল। এর জবাব হলো, না কেউ আসিয়াতের পর তার হজ্ব আদায় করা না হলে অসিয়াত কারী গুনাহগার হরে না। কারণ তার দায়িত্ব হলো শুধু অসিয়াত করা। যা সে পালন করেছে। এখন তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব ওয়ারিশদের। সামর্থ থাকা সত্ত্বেও তারা তা না করলে তজ্জন্য তাদেরই জবাবদিহি করতে হবে।

 

        অনেকে হজ্ব করতে যায়। কিন্তু যাতায়াত পথে ফরয নামায আদায় করে না। অর্থাৎএক ফরয আদায় করতে গিয়ে অনেকগুলি ফরয বরবাদ করে ফেলে। বিশেষতঃ হজ্ব যদি নফল হয় তাহলে তো বিষয়টা আরও মারাত্মক হয়ে দাড়ায়। এমন ব্যক্তির জন্য হজ্ব করাই জায়িয নয়।

 

        আরো একটি জঘন্যতম ক্রটি হলো এই যে, অনেক লোক হজ্ব থেকে ফিরে এসে হজ্বের কষ্ট ও সমস্যাবলীর কথা এমন কঠিন বচনে বর্ণনা করে যা শুনে শ্রোতারা হজ্বে যাওয়ার ব্যাপারে ভীত হয়, উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের লোকদেরকে আল্লাহর পথে ‘বাধাদানকারী’ আখ্যা দিতে কোন দোষ আছে কি? আর সাথে সাথে যদি তার বলা সব কাহিনী অবাস্তব হয় তা তো আরো জঘন্যতম অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এসব কথার জবাবে তাদেরকে শুধু এতটুকু বলা যায়ঃ

 

         “তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে বে খবর নন।”

 

        মনে রাখতে হবে যে, বাস্তবে যদি হজ্ব করতে গিয়ে বিশেষ কোন কষ্ট ভোগ করতেওহয় তবুও এ কথা বুঝতে হবে যে, এ সফর হলো সেই মহান প্রেমাস্পদের দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য একান্ত প্রেমের সফর। তাই এই প্রেম সফরে থাকবে কাঁটা ও পুষ্প এবং কাক - চিল ও বুলবুল । এটাই স্বাভাবিক।

 

 

কুরবানী সম্পর্কিত ত্রুটিসমূহ এবং তাঁর সংশোধনঃ 

        কুরবানীর ব্যাপারে একটি ক্রটি হলো এই যে, অনেক লোক ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও কুরবানী করে না। কোন কোন খান্দান তো এমনও আছে যে, তাদের কয়েক পুরুষ পর্যন্ত কখনও কেউ কুরবানী করেনি। আজো পাড়া গায়ের অনেকে কুরবানী কি জিনিস তা-ই জানে না। অনেকে আবার অলসতা ও বেপরোয়াযীর কারণে কোরবানী করে না। আবার অনেকে করে না কার্পণ্যের কারণে।

 

        এখন এই না করার কারণ যদি অজ্ঞতা হয় তাহলে তার সংশোধনের পন্থা হলো কুরবানীর গুরুত্ব অপরিহার্যতা এবং না করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত হওয়া । যেমন ইবনে মাজার একটি হাদীসে রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ

 

        “সংগতি থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করল, সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে কাছেও না আসে।”

 

       বিশেষতঃ বক্তা, খতীব ও আলিমদের দায়িত্ব হলো পল্লী এলাকার লোকদেরকে এসব ব্যাপারে যথাযথভাবে অবহিত করা।

 

        আর যদি কুরবানী না করার কারণ হয় বেপরোয়ারী তাহলে তাদের ভেবে দেখা দরকার যে, দুনিয়ার কোন হীন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যদিও তা অত্যাবশ্যক না হয় এবং ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা না পাওয়ার জন্য যদিও নিশ্চিত না হয় তবুও মানুষ সেজন্য কত টাকাই না ব্যয় করে। তদুপরি তা ধ্বংসশীল ও ক্ষয়িষ্ণু। তাহলে আখেরাতের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যার উপর আর কোন স্বার্থ নেই এবং আযাব থেকে বাঁচার জন্য যার থেকে বড় আর কোন পথ নেই। তাই সে কাজে অলসতা করা উচিত কি? যার ফলাফলের ব্যাপারে অনিশ্চয়তার লেশমাত্র নেই। অতএব বলুন, সংগতি থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করা কত বড় অন্যায়, কত বড় বোকামী।

 

        আর যদি কুরবানী না করার কারণ হয় কৃপণতা তাহলে তার সংশোধনের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে কুরবানী করার উপকারিতা ও না করার ক্ষতি - যা এই মাত্র উল্লেখিত হলো সে তা স্মরণ করবে। এর সাথে সাথে ধীরে ধীরে কার্পণ্য দূর করার চেষ্টা করবে। বিভিন্ন কিতাবে এর পন্থা বর্ণিত হয়েছে।

 

 

কুরবানী করা ইবাদাত হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণঃ 

        অনেক লোক এর চেয়ে আরেকটু অগ্রসর হয়ে এই কারণে কুরবানী করে না যে, কুরবানী ইদাবাত হওয়ার ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নয় সন্দিহান। তারা মনে করে, কুরবানীর নামে পশু যবাহ করা জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা ছাড়া কিছুই নয়। এদের সংশোধনের পথ হলো তারা বিজ্ঞ আলিমের কাছে নিজের সন্দেহের কথা খোলাখোলী ব্যক্ত করে সন্দেহ দূর করে নেবে। সংক্ষেপে শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, ইবাদতের মূলকথা হলো আল্লাহর আদেশ পালন করা। আর কুরবানী করা আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট কাজ বলে প্রমাণিত হওয়ার পর তা ইবাদত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

 

        কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, আল্লাহর এই বিধানের হিকমতি ও তাৎপর্য কি? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেক কিছু বলা যায়। কিন্তু সঠিক উত্তর হলো, এধরনের প্রশ্ন করার অধিকার কারও নেই। কারণ, আমরা আইন প্রণেতা নই যে, এর কারণ ও গূঢ়তত্ত্ব আমাদের জানা থাকতে হবে। আমরা তো আইনের বাহক ও বর্ণনাকারী মাত্র। আইন প্রণয়ণকারীর সামনে যেদিন আপনাদের দাড় করানো হবে যদি সাহস হয় সেদিন একথা জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবেন। হয়ত মৌখিকভাবে বা শাস্তির মাধ্যমে সেদিনই এর যথার্থ উত্তর পাবেন। উকিল, মেজিষ্ট্রেড রা জজের নিকট আইনের কারণ জানতে চাওয়া চরম বোকামী নয় কি? কেউ তাদেরকে আইনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাকে এই জবাব দেয়ার অধিকার তাদের আছে যে, আমরা তা বলতে পারব না, তুমি আইন প্রণয়ণকারীকে এর কারণ জিজ্ঞাসা কর। এর কারণ বর্ণনা করা আমাদের দায়িত্ব নয়। অতএব এ ধরণের প্রশ্নের উত্তরে আলিমগণ কেন এ ধরণের উত্তর দিতে পারবেন না? আলিমগণ যদি এরূপ ইতিবাচক উত্তর ভালো মনে করেন তবে কেন তারা এর নেতিবাচক উত্তর দিতে গলদঘর্ম হন?

 

        অনুরূপভাবে সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার সন্দেহের জবাব হলো, কোন সম্পদ তখনই বিনষ্ট হয় যখন তাদ্বারা কোন উপকার না হয়। অথচ কুরবানী একটি অতি উপকারী বিষয় কুরবানী করলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এটা এমন এক উপকার যার মোকাবিলায় দুনিয়ার সবই তুচ্ছ। সুতরাং কুরবানী করার দ্বারা সম্পদ নষ্ট হলো কিভাবে ?

 

 

সস্তা দামের পশু দ্বারা কুরবানী করাঃ 

        একটি ক্রটি হলো এই যে, অনেক সামর্থবান ব্যক্তি, কুরবানী করে ঠিকই কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করে যাতে সস্তা মূল্যে পশু খরিদ করা যায় - যদিও পশুর মধ্যে কোন দোষ থাকে। এর কারণ দুটি,

 

       প্রথমতঃ কৃপণতা - যার প্রতিকারের পন্থা উপরে বলা হয়েছে।

 

       দ্বিতীয়তঃ তাদের ধারণা যে, পশু বেশী মূল্যবান হলে কিংবা বেশী উত্তম হলে তাতে সাওয়াব বৃদ্ধি পায় না বরং মূল্য কম হোক আর বেশী হোক সর্বাবস্থায় সওয়াবের পরিমাণ সমান। সুতরাং অযথা টাকা বেশী। ব্যয় করে লাভ কি? দায়িত্ব মুক্ত হলেই তো হলো।

 

         বস্তুত এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পশু যত উন্নত মানের এবং বেশী মূল্যবান হবে। সওয়াবও তত বেশী হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ

 

        “যতক্ষন পর্যন্ত তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু ব্যয় না করবে ততক্ষন পর্যন্ত তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে না।”

 

        এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেন, “কুরবানীর পশুগুলিকে তোমরা মোটা তাজা করে নিও!”

 

        পক্ষান্তরে এই যে ধারণা, বেশী টাকা খরচ করে কি হবে, দায়িত্ব মুক্ত হলেই তো হলো, এর জবাবে আমরা বলব, এই মানসিকতা সে ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে জবাবদিহি থেকে রক্ষা পাওয়াই এক মাত্র উদ্দেশ্য। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সাথে না আছে তার বিশেষ কোন সম্পর্ক না আছে সুসম্পর্ক গড়ার সদিচ্ছা। কিন্তু আল্লাহর সাথে যে মানুষের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে বা সম্পর্ক গড়া কাম্য তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে কি?

 

 

বান্দার হক পরিত্যাগ করে কুরবানী করাঃ 

         আরেকটি ত্রুটি হলো এই যে, অনেক লোক নিতান্তই নিঃস্ব কিংবা সঞ্চিত সম্পদের চেয়ে তার ঋণ বেশী বা অন্য কোন হক্কুল ইবাদাত যা আদায় করা তার সর্বাগ্রে ওয়াজিব । কিন্তু এরা এসব হক সমূহকে উপেক্ষা করে নিছক গৌরব কিংবা পূর্বের ধারা বজায় রাখার জন্য কুরবানী করে থাকে। টাকা হাতে না থাকলে ঋণ করে। এভাবে তারা দু’টি অন্যায়ে লিপ্ত হয়। প্রথমতঃ বান্দার হক নষ্ট করা, দ্বিতীয়ত অহংকার প্রদর্শন। মনে রাখতে হবে যে, লাভজনক কাজ তখনই কাম্য যখন তাতে কোন ক্ষতি থাকবে না।

 

 অনুবাদঃ ম . আ . মাহদী

 

 

═──────────────═