সম্পাদকীয়
ইসলামের অনুসারী হতে চাইলে কুফরী সংস্কৃতি ছাড়তে হবে। যে ব্যক্তি ইসলামকে নিজের দ্বীন বা ধর্ম বিশ্বাস বলে মেনে নিয়েছে, তার জীবনের কোন কাজ যদি ইসলাম বিবর্জিত পন্থায় হয়, তাহলে সে একজন অপরাধী। ইসলামের প্রতি আনুগত্য দেশপ্রেমের পরীক্ষার মতো। এতে শতকরা একশ পেলেই কেবল পাস করা যায়। পূর্ণমানের কমে এখানে কোন নম্বরই গ্রহণযোগ্য নয়। যে ব্যক্তি ইসলামের কার্যক্রম তথা প্রায়োগিক অনুশাসন পালন করেনা সে অপরাধীর ন্যায় জীবন যাপন করে। তার পরকালীন জিন্দেগীও কাটবে অপরাধীর মতো।
কিন্তু প্রয়োগিক বা ব্যবহারিক দিক ছাড়া ইসলামের বিশ্বাস ও আকীদাগত কোন বিধান না মানলে, এতে দ্বিধা সংশয় পোষন করলে মানুষ আর মুসলমান থাকেনা। সে হয় ধর্মত্যাগী মুরতাদ। ইসলামী অনুশাসনে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
আকীদা-বিশ্বাস বলতে আমরা কি বুঝবো? আকীদা বলতে প্রথমেই বুঝতে হবে তাওহীদ, আল্লাহর একত্ববাদ। যে বা যারা আল্লাহকে এক অদ্বিতীয় ও লা-শারীক মানে না তারা মুশরিক। আকীদা বলতে আরো বুঝায়, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়তে বিশ্বাস করা। আসমানী গ্রন্থে বিশ্বাস, ফেরেশতাকুলের প্রতি বিশ্বাস, পরকালের পুনরুত্থান ও বিচারের প্রতি বিশ্বাস, পাপ-পুণ্যের প্রতি, এ দু'য়ের প্রতিদান এবং জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি। এ সব বিষয়ে বিশ্বাস থাকতে হবে সন্দেহাতীত, সুদৃঢ় এবং অকম্প-স্থির। তাহলেই একজন মানুষ হবে মুসলমান।
মুসলমানের জীবনে এ প্রতিশ্রুতিও থাকতে হবে যে, ইসলামকে বেছে নেয়ার পর জীবন যাপনের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে আমার আর ব্যক্তিগত কোন মতামত বা পছন্দ-অপছন্দের অবকাশ নেই। আমি আমার জীবন-মরণ, পেশা-নেশা, কর্ম সাধনা তথা সার্বিক জীবনে আল্লাহ ও রাসূলের বিধানকেই সর্বান্তকরণে মেনে নিলাম। এ অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যে যত আন্তরিক ও বাস্তবানুগ, সে ততই নিষ্ঠাবান মুসলমান। আর যে যত ফাঁকিবাজ, সে তত ভন্ড বা দাম্ভিক। আর এ বিশ্বাসভঙ্গ যদি মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দেখা দেয়, তাহলে সেটা হবে কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
আজকে আমাদের সমাজ এ বিপর্যয়ের করুণ শিকার। কাজে-কর্মে তো আমরা হর হামেশাই ইসলামের বিরোধিতা করে চলেছিই; কথা-বার্থা, ধারণা-বিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত-সংকপ্লেও আমরা প্রতিনিয়ত ইসলামী আদর্শকে লাঞ্ছিত করছি। এর পরেও কি আমরা সত্যিকার অর্থে মুসলমান বলে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারবো?
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা মানবজাতির বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা সৃষ্টির যে ক'টি মৌলিক উপাদান বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে অতীত ঐতিহ্য একটি উপাদান।
মানুষ অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহকে অস্বীকার করে। কেউ করে জ্ঞানের স্বল্পতার জন্যে, আর কেউ কেউ দম্ভ অহংকার ইত্যাদির কারণে। অবিশ্বাসীদের মধ্যে একটি বড় শ্রেণী রয়েছে, যারা, অতীত ঐতিহ্য, দেশজ সংস্কৃতি, ইত্যাদি নামে কুফর ও অন্ধত্বকে বৈধতা দিতে চেষ্টা করে থাকে। পাক কুরআনে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন, যারা কুফরী করে তাদের সপক্ষে কোন ঐশী প্রত্যোদেশ বা প্রমাণ না থাকলেও ওরা যুক্তি দেখায় যে, "ওয়াজাদনা আবাআনা কাজালিকা ইয়াফআলুন”, অর্থাৎ বাপ-দাদাদের আমল থেকেই এই আমাদের সংস্কৃতি। আল্লাহ পাক পাশাপাশিই বলে দিয়েছেন যে, “ওদের বাপদাদারাই ছিল পুরাকালের গুমরাহীতে নিমজ্জিত”।
একালে ইসলাম অনুসারীর ব্যাক্তিগত জীবনে যেমন কুফরী করার সুযোগ নেই, তেমনি তার জীবনের আর্থ-সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি কোন ক্ষেত্রেই ইসলামী অনুশাসনকে ত্যাগ করে দেশজ আঞ্চলিক বা আধুনিক সংস্কৃতি গ্রহণেরও কোনও সুযোগ নেই। যদি তিনি সত্যিকার অর্থেই আল্লাহকে ভয় করেন, আখেরাতে বিশ্বাসী হন; পূর্ণাঙ্গ মুসলমান রূপে যদি তার জীবন যাপনে কোন আপত্তি না থাকে।
আমাদের সমাজে এ ধরনের বিক্ষিপ্ত অবস্থা ব্যাপক আকারে বিরাজ করছে। ইসলামকে নামমাত্র গ্রহণ করে এর বিপরীত জীবনাচার চর্চা যেন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। নামায, রোযা, হজ্ব ও কোরবানীর মাধ্যমে আমাদের সমাজের লোকেরা কার্যত নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করলেও তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আয়-উপার্জন ও সমাজ রাষ্ট্রের অপরাপর কার্যক্রম পরিচালিত হয় ধর্মহীন রীতি-নীতিতে। যার পরিণামে তাদের আনুষ্ঠানিক ইবাদত বন্দেগীও অর্থহীন হয়ে পড়ে। ইসলামের সমাজ সংস্কৃতি ও সাধারণ জীবনাচার সম্পর্কে একটি যুগান্তকারী ও চিরন্তন ফরমান প্রিয়নবী (সঃ) জারি করেছেন যে, “মান তাশাব্বহা বি কাউমিন ফাহুয়া মিনহুম” অর্থাৎ যে ব্যক্তি যে জাতি বা সম্প্রদায়ের মতো চলবে, পরিণামে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে। ইসলামী উম্মাহর সংস্কৃতিক স্বকীয়তা নির্ধারণে এ হাদীসখানাই যথেষ্ট।
কিন্তু শতকরা ৯০ জন মুসলমানের এ দেশের মুসলিম শাসকগণ প্রিয়নবী (সঃ)-এর এ মহান বাণী কিংবা মহত্তম আদর্শের প্রতি সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখছেন বলে মনে হয়না। তারা ঈমান পোষন করছেন, ইসলামী নাম ও পরিচিতি বহন করছেন, নামায বন্দেগী করছেন ঠিকই। কিন্তু ইসলাম বিরোধী বিধি-বিধান রহিত করছেন না। ইসলামের চিরশত্রু নানা জাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধন দিনদিন কেবল মজবুতই করে চলেছেন। বিচার ও শাসন ব্যবস্থা চালাচ্ছেন ইহুদী-খৃস্টানদের রীতিতে। শিক্ষা সংস্কৃতির ও জীবনাচারে অনুসৃত হচ্ছে শিরক পন্থী জাহেলী পন্থা কিংবা নাস্তিক্যবাদী অন্ধকার নীতি। এধরনের অবস্থা কি কাম্য? এ ভাবে কি একটি দেশ বা জাতি কোনদিন মুক্তি পেতে পারে? দ্বৈত মনোভঙ্গি কি দিতে পারে কোন নেতৃত্বকে কাংক্ষিত অর্জনের ঠিকানা?
অত্যন্ত দুঃখ নিয়েই বলতে হয়, শরীয়ত নিষিদ্ধ গান-বাজনা নত্য-নাট্য ও ললিতকলার উৎকর্ষের লক্ষ্যে এ সমস্যা নিমগ্ন জাতিকে যেভাবে বিনোদনমুখি, বিলাসী ও ভোগী করে তোলা হচ্ছে, তার অশুভ পরিণাম হয়ত বেশী দূরে নয়। সরকারী অনুষ্ঠানে ভিন্ন ধর্মের আরাধনা শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকলাপকে যে ভাবে রাষ্ট্রীয় পনার রূপ দেয়া হচ্ছে, তা কিন্তু মুসলিম জাতির প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা রূপে চিহ্নিত হবে। মন্দিরা বাজিয়ে মঙ্গল প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধূনির ধূয়া দিয়ে আর শংখ উলু ধ্বনি দিয়ে অগ্নি দেবতার আশীর্বাদ কামনার প্রচ্ছন্ন ইচ্ছায় অনিবার্ন দীপশিখা প্রজ্জ্বলন ইত্যাকার শির্কী মজুসী ধর্মজাত প্রথার প্রচলন কোনক্রমেই মুসলমানের পক্ষে শোভনীয় নয়। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে তা কেউ করলে জাতিকে যত না উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা পোহাতে হয়, গণপ্রতিনিধি সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান এবং শাসক কর্তৃত্বের প্রতিনিধি পুরুষ যখন কোন অমুসলিম সংস্কৃতিকে কোন খোড়া যুক্তি বা রিপু তাড়িত ব্যাখ্যার বলে জাতির বুকে গেড়ে দিতে চান, তখন তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি আশংকিত হতে হয় জাতিকে। কেবল বাংলাদেশের মুসলিম জনসাধারণ পর্থিব যে কোন দুঃখ-কষ্ট, ব্যাথা-বেদনা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বিনিময়েও নিজেদের ঈমান-আকীদা, দ্বীন-ধর্ম, আল্লাহ -রাসূল, আমল-আখলাক ও আখেরাতকে আকড়ে ধরে রাখতে বদ্ধ পরিকর। তারা কাফের-মুশরিক, বিধর্মী বা নাস্তিক হয়ে কবরে যেতে রাজি হয়। সুতরাং আমাদের আবেদন থাকবে এই যে, এ জাতির ভাগ্য নিয়ে যারা নড়াচড়া করেন, তারা যেন তা পূর্ণ মুসলমানিত্ব বজায় রেখেই করেন।