আমার দেশের চালচিত্র
১৯৭৯ সালে সংঘটিত আফগানিস্তানের নির্মম পরিণতি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে কি?
ফারুক হোসাইন খান
এক
এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ আয়তনের এ বাংলাদেশে প্রায় ১১ কোটি মুসলমানের বসবাস। এ বিপুল সংখ্যক মুসলমানের ধর্ম বিশ্বাস, আদর্শের বিরুদ্ধে রীতিমত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এক ব্যক্তি, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। নাম তার ডঃ আসগর আলী। বাংলাদেশের ইতিহাসে নবীনতম সেকুলার বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সম্প্রতি নাম লিখিয়েছেন। গত ১০ই জুন বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বেশ ঔদ্ধত্যের সাথেই তিনি সেকুলার বুদ্ধি জীবীদের দলে নিজের নাম খানা লেখাতে সমর্থ হয়েছেন।
১১ কোটি মানুষের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে মনগড়া প্রলাপ বকে এখনও বেশ বহাল তবিয়তে আছেন উক্ত বুদ্ধিজীবী সাহেব। চাকরিতে বহাল আছেন, পত্রিকায় বেশ কভারেজ পাচ্ছেন, তার লাইনের বুদ্ধিজীবী মহল অভিনন্দন জানাচ্ছেন, পত্র-পত্রিকায় তাকে নিয়ে মাতামাতি হওয়ার সুবাদে রাতারাতি তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি পাচ্ছেন, সর্বোপরি সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ কান্ড ঘটানোর পর সরকারের নীরবতা তথা নীরব সমর্থনও তিনি পেয়ে গেছেন। অতএব, তিনি তো এখন খোশ মেজাজে পরম আনন্দে মহা সুখেই থাকবেন। তার মত সুখীজন এ মুহূর্তে আর কে আছে!
আর যাদের ধর্ম বিশ্বাস, ও নবীর (সাঃ) বিরুদ্ধে যে জঘন্য উপায়ে হামলা করা হলো, এর বিরুদ্ধে গুটি কয়েক মানুষ গতানুগতিক কায়দায় বিবৃতি, প্রতিবাদ সভা ও বক্তৃতায় গদবাধা কতিপয় শব্দ, হুমকি ধামকি ছুড়ে দিয়ে নীরব হয়ে গেলেন। ডঃ আসগর আলী আরো পপুলারিটি পেল, তৌহিদী জনতার মনের ব্যথা মনেই থাকল। একসময় এ তৌহিদী জনতা হয়ত মনের ব্যথা ভুলে যাবেন আর ডঃ আসগর আলী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সভাপতি, প্রধান অতিথি, সেমিনারের প্রবন্ধকার, প্রধান আলোচক বা প্রধান বক্তার পদ অলংকৃত করে সদপে তার বুদ্ধি জাহির করে যাবেন।
ঘটনাটা ঠিক এরকম। কতিপয় সন্ত্রাসী অস্ত্রের জোরে হাজার হাজার মানুষকে জিম্মি করে রেখে তাদের সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেল। সন্ত্রাসীরা সদর্পে চলে যাওয়ার পর সর্বস্ব হারানো মানুষেরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে কতক্ষণ আক্ষেপ করে যার যার গন্তব্যে চলে গেল। অথবা কেউ কেউ একটু সাহসী হয়ে সন্ত্রাসীদের বিচারের দাবীতে একটা মিছিল করে বসল। ব্যাস ঐটুকু। এ মিছিলের উত্তাপ সন্ত্রাসীদের গায়ে একটা আচড় লাগা তো দূরের কথা ক্রাইম জগতে তাদের কুখ্যাতি আরো বাড়িয়ে দিল। জনগণের মধ্যে এদের নামে আরো আতঙ্ক বৃদ্ধি পেল। ফলে সন্ত্রাসীদের ক্রাইম ঘটানো আরো সহজতর হয়ে গেল। নিঃস্ব হয়ে যাওয়া লোকদের চোখের ওপর তাদেরই কেড়ে নেয়া ধন-সম্পদ দিয়ে বাড়ী- গাড়ির মালিক হয়ে সন্ত্রাসীরা দিব্যি আরামে দিন কাটাতে থাকল আর হাজার হাজার নিঃস্ব মানুষ শুধু আক্ষেপ করেই জীবন পার করে দিল।
সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে যেমন জনগণকে নিঃস্ব করে দেয়ার কোন অধিকার রাখে না, তাদের অপকর্মের পক্ষে রাষ্ট্র-সমাজের যেমন কোন প্রোটেকশন নেই, তদ্রপ ডঃ আলী আসগর ১১ কোটি মুসলমানের ধর্ম বিশ্বাসের ওপর যে সন্ত্রাস চালিয়েছে, তার পক্ষেও কোন বৈধতা নেই, রাষ্ট্র বা সমাজ তার এ অপকর্মের পক্ষে কোন প্রোটেকশন দেয় না। যেমন, বাংলাদেশ সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।”
৮(১ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সর্ব শক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।”
এছাড়া সংবিধান শুরু হয়েছে, 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' দিয়ে। এর প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সর্ব শক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি।
সংবিধানে ডঃ আসগরের ইসলাম বিরোধীতা বা বিদ্বেষপ্রসূত কোন মন্তব্য করার অধিকার সম্পর্কিত কোন বিধি বা অনুচ্ছেদ নেই। বরং ডঃ আসগর ১০ই জুন ইসলাম ও রাসূল (সাঃ) এর বিরুদ্ধে যা বলেছেন তা সংবিধানের মূলনীতির সুস্পষ্ট লংঘন। এটা ব্লাসফেমীর পাশাপাশি রাষ্ট্রের মূলনীতির বিরোধিতা তথা রাষ্ট্রদ্রোহী আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ সরকারের পাশাপাশি তৌহিদী জনতাও সাময়িক কতিপয় বিবৃতি দিয়েই প্রকারান্তরে নীরব থাকায় এই রাষ্ট্রদ্রোহী বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করার সুযোগ পাচ্ছেন। ১১ কোটি মুসলমানের এ দেশে খোদ রাজধানীতে বসে ডঃ আলী আসগরের এ ঔদ্ধত্য দেখে একটা হাদিস স্মরণ করতে হয়। আমাদের এ পরিণতি সম্পর্কে হয়ত ভবিষ্যত বাণী ছিল এ হাদিস, “হ্যা সেইরূপ দুর্দিনও তোমাদের ওপর দিয়ে বয়ে যাবে, যখন কুফরী শক্তি তোমাদের নির্মূল করার জন্য পরস্পরকে ডাকতে থাকবে, যেমন ক্ষুধার্থ লোকদেরকে খানার আসরে ডাকা হয়। আর কুফরী শক্তি তোমাদের বেছে বেছে পরিণত করবে মুখের গ্রাসে।
সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল। তখন কি মুসলমানরা সংখ্যায় কম হবে?
প্রিয়নবী (সাঃ) বল্লেন, না সংখ্যায় বরং তোমরা প্রচুর হবে। জল স্রোতের নিসীম ফেনার মতো বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত দেখাবে তোমাদেরকে, কিন্তু তোমাদের মাঝে শক্তি, প্রতাপ ও সংহতি বলতে কিছুই থাকবে না।” ১১ কোটি মুসলমানের বিপরীতে একজন ডঃ আসগর আলীর ধর্মদ্রোহীতা, জনগণের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত হানা এবং রাষ্ট্রদ্রোহী অপকর্ম করেও বহাল তবিয়তে থাকার পরও কি অনুভূত হয় না আমরাই মহানবীর বর্ণিত সেই জল স্রোতের নিসীম ফেনার মতো বহুদূর বিস্তৃত হতভাগা মুসলিম জাতি?
এ প্রসঙ্গে একটি ইতিহাসের ঘটনার কথা স্মরণ করতে হয়। ঘটনাটি আজকের লাখো শহীদের রক্তস্নাত পবিত্র ভূমি আফগানিস্তানের। আফগানিস্তানে তখনও প্রত্যক্ষভাবে রাশিয়ান আগ্রাসন শুরু হয়নি। গণতান্ত্রিক সংবিধানের আওতায় গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তান শাসিত হচ্ছে। জেনারেল দাউদ তখন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আফগান প্রশাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণী পরিষদ সর্বত্র রাশিয়ান মদদপুষ্ঠ কনিষ্ঠদের দোর্দন্ড প্রতাপ, আজকের বাংলাদেশের সর্বত্র যেমন সেকুলার ও ছদ্মবেশী বামপন্থীদের দাপট বিরাজ করছে। বামপন্থী পত্র-পত্রিকা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিকরা ধুমছে ইসলামের বিরুদ্ধে কুৎসামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ তৎকালীন আফগান সংবিধানেও ধর্ম বিদ্বেষী কোন প্রচারণা চালাবার কোন বিধি ছিল না। তবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল দাউদ ছিলেন গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কমু্যনিস্টদের সমর্থক। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে রাশিয়ান মিলিয়ন মিলিয়ন রুবলের স্বেচ্ছা ঋণ ও বিভিন্ন সময়কার রাষ্ট্রীয় চুক্তির কারণে তিনি রাশিয়ান পুতুল সরকারের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। 'সাওর বিপ্লবের' কয়েক মাস আগের ঘটনা। একদিন একদল কম্যুনিষ্ট কাবুলে প্রকাশ্য রাজপথে মহিলাদের ওড়না ছিনিয়ে নিয়ে সদর্পে ঘোষণা করল, আজ থেকে আফগানিস্তানের মাটি হতে পর্দা চিরতরে উৎখাত করা হলো। আজ থেকে আফগান নারী সমাজ পর্দার বেড়াজাল থেকে মুক্ত।
হতবাক হয়ে গেল কাবুলের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। কাবুলের রাজপথে তারা মিছিল করল বটে, কিন্তু তাতে কোন ফল হলো না। কেননা, জেনারেল দাউদের পাঁচ বছরের শাসনামলে ইসলামদ্রোহী প্রচারণার বিরুদ্ধে আফগান ওলামা সমাজ কার্যকর কোন ভূমিকা না নিয়ে নির্লিপ্ত ছিল। মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকাহগুলো স্বাভাবিক গতিতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আলেম-ওলামা, মুয়াল্লিম সাহেবানও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। সমগ্র দেশের জনগণ কাবুলে দাউদ সরকারের অন্তরালে কী ঘটছে সে সম্পর্কে বেখবর। কাবুলে ‘পর্দা’ নিয়ে কমুনিষ্টদের স্পর্ধিত ঘটনার কথাও তারা জানতে পেল না। এ ঘটনার অল্প কয়েক দিন পরেই ঘটল কমুনিষ্টদের সাওর বিপ্লব। আল্লাহর গজবের মতো তারাকী, আমিন ও বারকাক কারমালের বাহিনী আফগান সাধারণ জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। তবে সবচেয়ে বর্বর ও নৃশংস দমন অভিযান চালানো হলো জাতির প্রয়োজনের সময়ও যারা নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছিল সেই আলিম সমাজের ওপর। একমাত্র হেরাতেই আলিমদের এক গণ জমায়েতের ওপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে ২০ হাজার আলিমকে হত্যা করা হয়েছিল। আজও হেরাত নগরীর উপকন্ঠের চারটি বিশাল গণ-কবর সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
আমরা জানি না, ডঃ আসগর আলীরা কাবুলের সেইসব কমু্যনিষ্টদের মতো যেভাবে ইসলাম ও রাসূল (সাঃ) এর বিরুদ্ধে নির্ভীক চিত্তে কুৎসা ও বিদ্বেষ প্রসূত প্রচারণা চালানোর অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করছে, এর পরিণতিতে ১৯৭৯ সালের আফগানিস্তানের ভাগ্য আমাদের জন্যও অপেক্ষা করছে কিনা।
দুই
১০ই জুন ডঃ আসগর আলী শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সঙ্গে সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সাথে মত বিনিময় সভায় যা বলেন তাহলো, 'ধর্ম হচ্ছে ব্যক্তিগত জ্ঞান। ধর্ম শিক্ষা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক হওয়া উচিত। পাবলিক এডুকেশনের শিক্ষা পাবলিক হওয়া উচিত। যারা ধর্ম শিক্ষা করে তারা প্রকৃতি জানে, গণিত জানে না। ধর্ম শিক্ষার নামে যারা নৈতিকতা শিক্ষা করে বলে দাবী করে, তারাই স্বাধীনতার বিরোধিতা করছে।.....আরব দেশে মোহাম্মদের নাম দিলেই সারা বিশ্ব তাকে সন্ত্রাসী মনে করে।.....ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজন নেই। মানুষের ধর্ম সত্য অনুসন্ধান করা, সেই সত্য অনুসন্ধান করতে হবে।'
ডঃ আসগর আলী তার দীর্ঘ বক্তৃতায় যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা আর বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয় না। ১৯৭২ সালে কুদরতি খুদা এ দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা জন্য প্রতিবেশী দেশ সফর করে এক সেকুলার শিক্ষা নীতির সুপারিশ করেন। ১৯৯৭ সালে কুদরতি খুদার সে মিশন সফল করার দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন ডঃ আসগর আলীরা। তবে ডঃ আসগর আলীরা যে, কোন সুতোর টানে এমন খেমটা নাচন নাচছে তা একটু পর্যালোচনার দাবী রাখে।
গত ২৪ শে জুন বাজেটের সাধারণ আলোচনায় বিরোধী দলের একজন সদস্য ডাঃ আসগর আলীর এহেন রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোকপাত করেন এবং কুদরতি খুদার প্রণীত শিক্ষা নীতির সংবিধান পরিপন্থী বিষয় উল্লেখ করে তা বাস্তবায়নে বিরত থাকতে সরকারকে আহবান জানান। জবাবে সরকারী দলের টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত একজন অন্যতম সদস্য মাদ্রাসা শিক্ষার প্রচন্ড বিরোধিতা করেন। তিনি প্রশ্ন রাখেন বিশ্বের কোথায় মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এ ছাড়া কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাকে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ড বলে আখ্যায়িত করেন।
একটি ইতিহাস সচেতন দাবীদার দলের সদস্য হয়েও ইতিহাস সম্পর্কে এ অজ্ঞতা এবং তা জাতীয় সংসদের মতো স্থানে প্রকাশ করা সত্যিই পীড়াদায়ক। সংসদ সদস্য সেদিন তার বক্তব্যে বলেছেন যে, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রগতিশীল এবং ইংরেজরা বিভেদ সৃষ্টির জন্যই আলীগড়ের বিপরীতে আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা করে। এ আলীয়া মাদ্রাসা ছিল প্রতিক্রিয়াশীলতার ধারক। অথচ আলীয়া মাদ্রাসা ও আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমির ইতিহাস ছিল এর ঠিক উল্টোটা, যা ইতিহাস সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, উক্ত সংসদ সদস্য ইতিহাসকে যেন রূপকথার গল্প মনে করেছেন। যেমন খুশি তেমন রূপ দিয়ে বর্ণনা করা যায়। আলীয়া মাদ্রাসা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন কিন্তু আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতার জন্মও হয়নি। ১৭৮২ সালে কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপন হয়। আর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদের জন্ম হয় ১৮১৭ সালে। ১৮৭৫ সালে তিনি আলীগড় বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাথমিক ভিত্তি স্বরূপ একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তার মৃত্যুর (১৮৯৪) অনেক পরে ১৯২০ সালে আলীগড় পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। অতএব দেখা যাচ্ছে, দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার মধ্যে পার্থক্য হলো (১৭৮২-১৮৭৫) ৯৩ বছর। এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বলা হলো, প্রগতিশীল আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়কে বাধাগ্রস্থ বা বিভেদ সৃষ্টির জন্য আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একেই বলে ইতিহাস বিকৃতি। ইতিহাসে দেখা যায়, আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষা পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন করতে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, ইংরেজ তোষণের পুরুস্কার স্বরূপ “স্যার” উপাধী প্রাপ্ত সৈয়দ আহমদ আলীগড় বিশ্ববিদ্যায়ের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
এই কাল্পনিক অজুহাত ও ইতিহাস বিকৃতির কারণেই হয়ত আসগর আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। ধর্মবর্জিত কুদরতি খুদার শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়ার এটাই সম্ভবত অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।
ইংরেজরা উপমহাদেশের ক্ষমতা দখল করে প্রথম যে কাজটি করেছিল, তা হলো মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন থেকে ইসলামী চেতনাকে মুছে ফেলা। এ জন্য তারা সকল ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও প্রচলিত মাদ্রাসাগুলোকে ধ্বংস করে। আরবী, ফার্সির স্থলে ইংরেজীকে সরকারী ভাষা গণ্য করে প্রশাসন থেকে সকল ফারসী, আরবী পড়ুয়া মুসলমানকে চাকরীচ্যুত করা হয়। একমাত্র তৎকালীন বৃহত্তর বাংলায়ই ৮০ হাজার মাদ্রাসাকে ধ্বংস করা হয়। বিখ্যাত জার্মান প্রাচ্য- বিশারদ ম্যাক্সমূলার গত শতাব্দীতে প্রকাশ করেন যে, বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর আগে ৮০ হাজার মাদ্রাসা ছিল। ইংরেজদের এ পরিকল্পিত শিক্ষা আগ্রাসনে পশ্চাদপদ মুসলিম সমাজে পৃথক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে ওঠে। গণ-আন্দোলনের ফলে কলিকাতায় আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অত্র অঞ্চলের মুসলমানদের ইসলাম সম্পর্কে জানার কেন্দ্র বিন্দু ছিল এ মাদ্রাসা। পরবর্তিতে এ মাদ্রাসা বিস্তৃত হয়ে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ১৮৬০ খৃঃ দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা ও এর অনুসৃত শিক্ষা পদ্ধতিতে সমগ্র উপমহাদেশে মাদ্রাসা গড়ে উঠে দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে রাখে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা আলিমগণের মাধ্যমেই মুসলিম জাতির ধর্মীয় পরিচয়, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইসলামী চেতনা অটুট থাকে। মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছে ফেলার ইংরেজ ও তাদের পদলেহী ব্রাক্ষণ্য চক্রান্তের পথে এরাই ছিলেন প্রধান বাধা। মুসলমানদের অন্ধকার যুগে ঠেলে দেয়ার তৎকালীন ভয়াবহ চক্রান্তের বিরুদ্ধে এরাই সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের গৌরবজনক ভূমিকার করণে আজও আমরা গর্বের সাথে মুসলিম পরিচয় দিতে পারছি, আমাদের পিতৃ পরিচয়, জন্মলাভ সকল পঙ্কিলতা মুক্ত। (বর্তমানেও বাংলাদেশে যারা ইসলামী শরিয়ত সম্মত পন্থায় বিয়ের জন্য সরকারীভাবে কাজী নিযুক্ত হন তারা আলীয়া মাদ্রাসার সার্টিফিকেটধারী) যাদের কল্যাণে মুসলিম নাম, মুসলিম পরিচয় ও সর্বোপরি একটি মুসলিম দেশের সংসদ সদস্য হওয়ার সুযোগ ঘটেছে, তাদেরকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে আখ্যা দেয়া ইতিহাস সচেতনতাই বটে!
ইংরেজরাও মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করে ইংরেজী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার সময় আধুনিক শিক্ষা ও প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা বুঝিয়েছিল। আজকের আসগর আলী ও তাদের নেপথ্য সমর্থকরাও মাদ্রাসা শিক্ষাকে বন্ধ করে দেয়ার যুক্তি স্বরূপ আধুনিক ও প্রগতিশীল শিক্ষা নীতি প্রবর্তন করার কথা বলেছেন। তারা মোহাম্মদ নামের সাথে সন্ত্রাসের গন্ধ শুকে বেড়াচ্ছেন, ধর্ম শিক্ষাকে প্রগতি পরিপন্থী বলে চিৎকার করছেন। ধর্ম শিক্ষার নামে যারা নৈতিকতা শিক্ষা করছে তারা নাকি মানুষ হত্যা করে। তাই ধর্ম শিক্ষাকে বাদ দিয়ে প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার দাবীতে আসগর আলীদের এত লম্ফ-ঝম্ফ।
আসগর আলীদের তথাকথিত প্রগতিশীল শিক্ষার স্বরূপ কি? দেশের উদাহরণ না-ই বা দিলাম, আধুনিক সভ্যতার দাবীদার ধর্মহীন আধুনিক শিক্ষিত পাশ্চাত্যের প্রতি নজর দিলেই যথেষ্ট। হিটলার, মুসোলিনি, মধ্য প্রাচ্যের কুখ্যাত ইহুদী ঘাতকরা তথাকথিত প্রগতিপন্থী শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। ইংরেজরা আমাদের আধুনিক বানানোর জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছিল, সেই একই শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও ইংল্যান্ডে বর্তমান। ইংল্যান্ডের স্কুল পড়ুয়া ১৪ বছরের বালিকাদের মধ্যে কুমারী মেয়ে পাওয়া এখন দুর্লভ ব্যাপার। খোদ বৃটিশদের জরিপ থেকে এ তথ্য উৎঘাটিত হচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় ধর্ষণ, খুন, কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন, কথায় কথায় তালাক প্রদান, সমকামীতা, ফ্রি সেক্সের ফলে এইডসে আক্রান্ত হওয়া প্রভৃতি বীভৎস অপরাধের কথা কে না জানে। অথচ আলী আসগরদের মতো তারাও তো নিজেদের সভ্য প্রগতিপন্থী ভাবেন। সভ্য- বৃটেনের সংবিধানে একটি আইন আছে, যার ফলে স্ত্রীর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হলে স্ত্রীর মাকে বিবাহ করা যায়। হয়ত একসময় বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া স্ত্রীর অনত্র গর্ভজাত সন্তানকে বিবাহ করার বৈধতাও পাশ করে নেবে পার্লামেন্টে। আরেক সভ্য দেশ আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় আসার আগে সমকামিতাকে বৈধ করার প্রতিশ্রুতিকে জনমত গঠন করতে ব্যবহার করেছিলেন।
আফগানিস্তানে কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আগে রাশিয়া আফগানিদের আধুনিক বানাবার এক মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিল। রুশরা হাজার হাজার আফগান ছাত্রদের রাশিয়ায় বিনা খরচে পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেয়। প্রগতিশীল সেসব আফগানদেরই একটি ঘটনা। গ্রামের এক আলেম ব্যক্তির ছেলে রাশিয়া থেকে পড়াশুনা শেষে দেশে ফিরে এসেছে। পিতা পুত্রকে বল্লেন, এবার বিয়ে কর। আমাদের খান্দানের যে মেয়েটি তোমার পছন্দ হবে সেটির সাথে তোমার বিবাহ করাব। পুত্র তার আপন বোনের কাঁধে হাত রেখে বল্লো, 'এই মেয়েটি আমার পছন্দ। একে আমি বিয়ে করব।'মস্কো থেকে মগজ ধোলাই হয়ে আসা পুত্রের কথা শুনে পিতার মাথায় যেন বাজ পড়ল। তখনি সে খঞ্জর চালিয়ে নাস্তিক ছেলেকে খুন করে ফেলে। এ হলো ডঃ আলী আসগরদের ধর্ম বর্জিত প্রগতিপন্থী শিক্ষার সুফলের কিঞ্চিৎ নমুনা। আলী আসগররা আমাদেরও সে পথে টেনে নিয়ে যেতে চায়। মুসলিম বিশ্বের শত কোটি মুসলমান এখনও এইডসের অভিশাপ থেকে মুক্ত আছে। মুসলিম নারীরা এখনও জীবনের চেয়ে ইজ্জত- সতীত্বকে বেশী মূল্যবান মনে করে। তারা এখনও পাশ্চাত্যের নারীদের মতো ভোগ্য পণ্য ও গণ-পতিতা হওয়াকে মানবাধিকার ভাবতে ঘৃণা করে, এটা ডঃ আসগর আলী গংদের সহ্য হচ্ছে না। সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা আবার জাগতে শুরু করেছে, তারা আবার ইসলামী চেতনা, সংস্কৃতি, স্বাতন্ত্র নিয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে শিখছে, তারা সকল আগ্রাসন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে দৃঢ় প্রত্যয়ী, এটা আসগর আলীদের বুকে শেল হয়ে বিধছে, তাদের মনে বড়ো দহনের সৃষ্টি হচ্ছে, তাই সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষবাষ্প।
আমরা কি এ বিষবাষ্পে আক্রান্ত হতেই থাকব না খুঁজব কোন মুক্তির পথ?