হিন্দু ধর্মের স্বরূপ সন্ধানে
শামস নবীদ ওসমানী
==================================================
অনেক হিন্দু – সুধী ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে যারা আগ্রহ রাখে, যারা ইসলামের প্রতি সামান্য অনুরক্ত তাদরকে কখনও অভিযোগের সুরে বলতে শুনা যায়, কুরআনের মধ্যে বহু জাতি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু দুঃখের বিষয়, সুপ্রাচীন হিন্দু জাতি সম্বন্ধে একটি কথাও সমগ্র কুরআনের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই সকল সুধীদের অভিযোগের জবাব দিতে আমরা যখন গলদঘর্ম হই তখন এক বারও আমাদের খেয়ালে এ কথা আসে না যে, আমার মনের কোণে পবিত্র কুরআনের প্রতি তাদের মতো এমন কোনো অভিযোগ উঁকিঝুকি মারছে না তো!
শ্রী গঙ্গা প্রসাদ উপাধ্যায় নিজ বিদ্যার জোরে মূল আরবীতে পবিত্র কুরআন অধ্যায়ন করে তা থেকে লব্ধ জ্ঞানের আলোকে উর্দূ ভাষায় ‘মাসাবীহুল ইসলাম’ নামে যে গ্রন্থটি রচনা করেছেন তার থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করা হচ্ছেঃ
“পবিত্র কুরআনের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে যে, খোদা তাআ’লা যুগে যুগে মানবজাতির হেদায়েতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাতিতে বিভিন্ন নবী প্রেরণ করেছেন। বহু জাতি ও গোষ্ঠির কথা পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত হলেও দু-একটি বাদে কারও সম্বন্ধে বিস্তারিত কোনো আলোচনা পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু সব চেয়ে মজার কথা হলো, পৃথিবীর যে সকল জাতির ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন, যেমন হিন্দুস্তানী ও চীনা সম্বন্ধে একটি কথাও বলা হয় নি—কোথাও কোনো ইঙ্গিতও এদের প্রতি করা হয় নি। তাই এই গায়েবী গ্রন্থখানা যাকে কালামে মাজীদ নামে অবিহিত করা হয় এর সাথে মানুষ ও তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের কী সম্পর্ক আছে?”
উপরিউক্ত অভিযোগের প্রসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে, এই কুরআন বা কালামে ইলাহীর প্রথম শ্রোতা ছিলেন আরবগণ! এ কথাও পরীক্ষিত ও স্বীকৃত যে, এই পবিত্র গ্রন্থখানা কেবল চৌদ্দশত বছরের পুরাতন কোনো গ্রন্থ নয় এবং শুধু তৎকালীন পরিস্থিতি ও সমস্যা নিয়েই আলোচনা করেনি বরং বর্তমান বিশ্ব ও এই সময়ের সমাধানও এতে বিধৃত হয়েছে। তাই উপরোক্ত অভিযোগ কি করে আমরা স্বীকার করতে পারি যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম যে সব জাতি তাদের সম্বন্ধে কুরআনের কোথাও কোনভাবে আলোচনা করা হয়নি? আমি মনে করি, মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান কুরআনের প্রতি এমন অভিযোগ করা শুধু অন্যায়ই নয় বরং বালখেল্যও বটে। আমরা কি কখনো হিন্দু জাতির নাম ও পরিচয় কুরআনে সন্ধান করেছি? আমলে আমরা কখনো কুরআনের পাতায় সন্ধানী দৃষ্টিতে হিন্দুদেরকে সন্ধান করিনি। শুধু আমরা কেন কখনো কেউ করেনি। যা দুঃখ জনক বৈ কি?
এবার লক্ষ্য করুন , কুরআনের মধ্যে খাসা হিন্দু শব্দটি পাওয়া যায় না ঠিকই কিন্তু ঈসায়ী বা খৃষ্টান নামটি পাওয়া যায় কি? ঈসায়ী নামটিও কুরআনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। তবে কুরআনে ঈসায়ীদের বেলায় নাসারা শব্দ ব্যবরূত হয়েছে। যদিও পৃথিবীর কোন খৃষ্টান বা ঈসায়ী এখন নিজেদেরকে নাসারা বলে পরিচয় দেয়না । অথচ সকলের জানা আছে যে, কুরআনের ওই সকল লোকদেরকেই নাসারা বলা হয়েছে যাদেরকে আমরা খৃষ্টান বা ঈসায়ী বলি। তাই বিচিত্র কি যে, যে জাতিটি আজ নিজেদেরকে হিন্দু বলে পরিচয় দেয় কুরআনে তাদেরকে অন্য কোন নামে সম্বোধন করা হয়েছে?
কুরআনের মধ্যে এমন বহু জাতির নাম এসেছে যাদের সঠিক পরিচয় আজও নির্দ্ধারিত করা যায় নি। যেমন ‘আসহাবুররুস’ ও ‘কওমুত্তুবাআ’ তবে কুরআনের বহু স্থানে মুমিন, ইয়াহুদী, নাসারাদের পাশাপাশি সাবিঈনদেরকে এমন ঘনিষ্ঠ সংযুক্তির সাথে উল্লেখ করা হয়েছে যাতে মনে হয় , এরা তৎকালীন বিশ্বের সেরা জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে কোন একটি হবে।
উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
“নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে এবং ইয়াহুদী খৃষ্টান ও সাবিঈনদের মধ্যে যারা আল্লাহর ওপর ও শেষ দিবসে বিশ্বাস রাখে এবং সৎকাজ করে তাদের জন্য প্রতিপালকের নিকট পুরষ্কার রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” – বাকারাঃ ৬২তম আয়াত
উপরোল্লিখিত আয়াতে সাবিঈনদেরকে মুমিন, ইয়াহুদী ও ঈসায়ীদের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে স্থান দেয়া হয়েছে। কেবল এই একটি আয়াতেই নয় বরং কুরআনের যে যে স্থানে সাবিঈনদের নাম উল্লেখিত হয়েছে সেখানে তৎকালীন বিশ্বের বড় বড় জাতির কথা আবশ্যকীয়রূপে দেখা যাচ্ছে । অথচ এই বৃহৎ ও কুরআনের মধ্যে গুরুত্বের সাথে উল্লেখিত জাতিটির স্বরূপ উদঘাটনে এ পর্যন্ত আমরা সফল হতে পারিনি। এদের অস্তিস্তও আমরা অস্বীকার করতে পারিনি? তবে একটু আন্তরিকতার সাথে গভীরভাবে ভাবলে অতি সহজেই যে, এদের স্বরূপ উদঘাটনের সূত্র পেয়ে যাব তা হলফ করে বলতে পারি। এবার আমরা সেদিকেই অগ্রসর হচ্ছি।
অতএব দেখা যাক বর্তমান বিশ্বের মুসলমান , খৃষ্টান ও ইয়াহুদীর মত সমপর্যায়ের বৃহৎ কোন জাতি আছে কি নেই। যদি থাকে তবে সাবিঈনরা যে আজও একটি সুবৃহৎ জাতি তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। এ কথার ব্যাখ্যায় পরে আসছি। এ ছাড়াও অন্য একটি সূত্র ধরে আমরা এদের সন্ধানে পা বাড়াব।
শরীয়াত ওয়ালা যত নবীর আলোচনা পবিত্র কুরআনে এসেছে বিশেষভাবে একাধিকবার যাদের নাম উল্লেখিত হয়েছে তারা হলেনঃ হযরত নূহ আঃ, হযরত ইব্রাহীম আঃ, হযরত মূসা আঃ, হযরত ঈসা আঃ, এবং সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। যথা পবিত্র কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেনঃ “আমি নবীদের নিকট থেকে , তোমার নিকট থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও মারিয়াম তনয় ঈসার নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম – গ্রহণ করেছিলাম বড় অঙ্গীকার।” – আহযাবঃ ৭ম আয়াত।
“আমি তোমাদের জন্য দ্বীন নির্ধারিত করেছি যার নির্দেশ হূহকে দিয়েছিলাম-যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমাকে- যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম মূসা ও ঈসাকে এ বলে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে মতভেদ কর না।” – শুরাঃ ১৩তম আয়াত।
আমরা লক্ষ্য করেছি , কুরআনের মধ্যে যত বড় বড় জাতির নাম পাশাপাশি একসঙ্গে এসেছে তারা হলো মুসলমান, খৃষ্টান,ইয়াহুদী ও সাবিঈন। আর পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে সমমর্যাদার সাথে পাশাপাশি যে সকল নবীর নাম উল্লেখিত হয়েছে তারা হলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ঈসা আঃ, মূসা আঃ, ও নূহ আঃ প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মুসলমানরা হলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত। খৃষ্টানরা এখনও ঈসা আঃ কে তাদের নবী হিসেবে মনে করে, ইয়াহুদীরা অনুসরণ করে মূসা আঃ কে। বাকি থাকে সাবেঈন সম্প্রদায়।যাদের বিস্তারিত ও সঠিক পরিচয় দানে ইতিহাস নিরব। তাই বলে কি আমরাও নিরব থাকবো। কোনদিন কি উদ্ধার করা হবে না এদের পরিচয়? তাই এদের সঠিক পরিচয় আবিষ্কার করার জন্যই আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
সুপ্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, পরিভাষাগতভাবে হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর উম্মাতকে মু’মিন বলা হয়, হযরত ঈসা (আঃ) এর অনুসারীদেরকে খৃষ্টান বলা হয় এবং হযরত মূসা (আঃ) এর কথিত অনুসারীদেরকে ইয়াহুদী বলা হয়। এবার আপনারাই বলুন, যে নূহ (আঃ)- কে কুরআনের প্রায় সব জায়গায় এই সকল নবীদের পাশাপাশি সমমর্যাদার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে তার উম্মাত কে কী বলা হয়? কে দিবেন এর উত্তর! তবে কি আমরা বলতে বাধ্য নয় যে, হযরত নূহ (আঃ) – এর অনুসারীদেরকেই সাবিঈন বলা হয়? [চলবে]
অনুবাদঃ মনযূর আহমাদ