সম্পাদকীয়
ইসলাম ও স্বাধীনতার পক্ষ নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে
স্বাধীনতা ও বিজয় একটি অভিন্ন অনুভব হলেও এর রূপ, পকৃতি, উদযাপন এবং উপভোগ জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায় বিশেষে ভিন্ন ও বিচিত্র। একজন মুসলমানের জন্ম, মৃত্যু, জীবন, যৌবন, কৃতিত্ব ও আনন্দ মানবিক বিচারে অমুসলিম হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইহুদী ও নাস্তিকদের মত হলেও হতে পারে, কিন্তু এসবের আচার অনুষ্ঠান উপভোগ-উদযাপন কোনক্রমেই অমুসলিমদের মত হতে পারে না। কারণ, মুসলমানের জন্মে কোন নিরপেক্ষতা নেই। নিরপেক্ষতা নেই তার বিশ্বাস ও আদর্শে। যেমন-তার মৃত্যু ও পুনরুত্থানের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা নেই কোন নিরপেক্ষতার। একজন মুসলমানের ব্যক্তিগত-পারিবারিক, সামাজিক জীবন, তার পেশা-ব্যবসায়, কর্ম-সাধনা, প্রশাসন-বিচার, দেশ ও আন্তর্জাতিক সমাজ ইত্যাদির কোন অঙ্গণেই এতটুকু অবকাশ নেই নিরপেক্ষতার। একজন মুসলমানকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্তই ইসলামের পক্ষে থাকতে হবে। আমৃত্যু তাকে পক্ষপাতিত্ব করতে হবে পাক কুরআনের। আর এ পথেই সব বিশ্ব মানবতার পতি তার অকৃত্রিম নীতিনিষ্ঠা ও অপরিসীম সহমমির্তার প্রমাণ দেয়া। ইসলামকে এজন্যই বলা হয়, বিশ্ব মানবতার ধর্ম। ইসলামের নবী (সাঃ) কে বলা হয় বিশ্ব মানবতার মুক্তির মহান দূত। রাহমাতুল্লিল আলামীন তথা বিশ্ব জাহানের রহমত।
একথা কস্মিনকালেও সত্য নয় যে, মুসলমান তার বিশ্বাসের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হতে পারে। যদি মুসলমানের পক্ষে সত্য ধর্ম তথা ইসলামের প্রশ্নে নিরপেক্ষ হওয়ার দাবী করা হয়, তবে কি মুসলমানরা আল্লাহ, আখেরাত, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, নবী-রাসূল, অদৃষ্ট এবং অদেখা জগত সম্পর্কে পূর্ণ বিশ্বাসী না হয়ে দোদুল্যমান নিরপেক্ষতায় নিমজ্জিত থাকবে? নিরপেক্ষতার বিপরীত অবস্থানকে যারা এক কথায় পক্ষপাতমূলক সংকীর্ণতা আখ্যা দিয়ে থাকেন, তাদের মতে কি সত্য, দুন্দর ও ন্যায়নীতির পক্ষাবলম্বনও সংকীণর্তা? যাদি তাই হবে, ভাহলে তো উদার (!) হতে হলে সকলকেই অন্যায়, অসত্য ও পাপ-পংকিলতার পক্ষপাতিত্বও করতে হয় সমভাবে। কিন্তু বিষয়টি তো এমন নয়। সর্বত্রই সুন্দর ও সত্যের সপক্ষ অবলম্বনকেই মানুষ ন্যায় ও সিদ্ধ বলে আখ্যা দিয়ে থাকে।
বিশ্বময় যখন প্রতি বিষয়ের ভাল-মন্দ এবং উত্তম ও অধমের আলোকেই মানুষ ব্যাপক পক্ষপাতে নিমগ্ন, তখন কেবল ধর্মের ব্যাপারে কেন এ আহবান যে, এখানে এসে সবাই নিরপেক্ষ হয়ে যাও? আল্লাহ্র পক্ষ অবলম্বন না করে, রাসূল (সাঃ) এর সপক্ষে না থেকে, পাক কুরআনের দলে না ভিড়ে, ইসলামের পূর্ণ অনুসরণ না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা! কালেমায়ে তাওহীদও পড়, শ্লোক গীত আর মন্ত্রও আওড়াও! আল্লাহর নামও উচ্চারণ কর, আবার দেব-দেবী আর ভগবান ভগবতীদের চরণেও আরতি দাও! কুরআন তিলাওয়াত শোনার পাশাপাশি গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটকের বাণীও শ্রবণ কর! নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত, তাসবীহ-তাহলীল, জিহাদ ও কুরবাণী তো করবেই, মুর্তিপূজার মন্ডপে গিয়েও সশ্রদ্ধ প্রণতি দাও! মৃতের রূহে সওয়াব রেসানীর জন্য জিয়ারত, তিলাওয়াত, দান-খয়রাত ও কাঙ্গালী ভোজ তো করছই। তাদের কবরে শান্তি পৌঁছাতে দীপশিখা, মঙ্গল প্রদীপ, স্মৃতিসৌধের বেদীমূলে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, নীরবতা পালন, প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অপর্ণিসহ যত অর্থহীন উপাচার, সবই নির্দ্বিধায় করে চলো! মুসলমান শহীদদের পরকালীন মঙ্গলের জন্য ইসলামী রীতিমাফিক কোন কাজ করা যথেষ্ট নয় বিধায় পৌত্তলিক, অগ্নি উপাসক, পারসিক বা উপজাতিদের কোন জাতীয় বিজয় ও স্বাধীনতার গৌরব গাথার স্মারকচিহ্ন তৈরী কর, সূর্যকে দেবতা জ্ঞানে তার বন্দনাকারী, আগ্নিকে দেবতা জ্ঞানে আগ্নিশিখার উপাসক এবং আগুনকে চিরঞ্জীব ও শক্তির উৎস জ্ঞানে শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তনের প্রজ্জ্বালক প্রাচীন পারসিক মাজুসী আর্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় রীতি-নীতির অনুসরণে! তাহলেই কেবল মুসলমানরা মুসলমান হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে। বিশ্বের সকল বিকৃত ধর্মাচারী আধুনিকতাবাদী জাতি গোষ্ঠীর ন্যায় তোমরাও মুক্ত-স্বাধীন অবাধ জীবনলাভে ধন্য হবে। যে জীবনের কোন ভবিষ্যৎ ভাবনা নেই। যে জীবনকে হযরত নবী করীম (সাঃ) অবিশ্বাসী কাফিরদের জন্য বেহেশতের জীবন বলে উল্লেখ করেছেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘আদ-দুনিয়া সিজনুল মুমিন ও জান্নাতুন লিল কাফির।’ এ পৃথিবী মুসলমানের জন্য বিধি-নিষেধে ভরপুর এক কারাগার বিশেষ আর কাফির অবিশ্বাসীর জন্য এ জগতই হলো স্বর্গ। জীবন এখানে একটাই। যত পার একে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ কর।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও বস্তুবাদের আবেদন এমন হলেও আল্লাহর অশেষ কৃপা ও করুণায় বাংলাদেশের ১১ কোটি মুসলমান এ ধরনের জীবন চায় না। তারা দু'দিনের এ পার্থিব জীবনে দ্বিন-ঈমান, আকীদা-বিশ্বাস আর কার্যক্রম সমর্থন করতে রাজি নয়। ইহজীবন সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা কিংবা প্রাপ্তি-বঞ্চনা যেভাবেই কাটে কাটুক, পারলৌকিক জীবন তারা বরবাদ করতে একেবারেই প্রস্তুত নয়। ঈমান ও স্বাধীনতা তাদের কাছে প্রাণের চেয়েও দামী। যে স্বাধীনতাকে তারা জীবনের চেয়েও বেশী মূল্যবান বলে মনে করে, সে স্বাধীনতার অর্থ কেবল এক খন্ড মাটি নয়। এ হল ঈমান, ইসলাম, দ্বীন-ধর্ম, আমল-আখলাক, মান-ইজ্জত নিয়ে বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকা, আর্থ-সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য-শিল্পকলা ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে স্বকীয় ভাবধারায় উজ্জীবিত হওয়া। ইসলাম, ঈমান, বোধ-বিশ্বাসসহ প্রতিটি স্বকীয় বিষয়ে বিপুল ছাড় দিয়ে, শয়তানের প্ররোচনায় খন্ডকালীন মুসলমান আর খন্ডকালীন কাফের ও মুশরিক হয়ে, আধা স্বাধীন আর আধা পরাধীন হয়ে থাকার এমন অধঃপতিত দাসোচিত জীবন এদেশের আজন্ম মুক্তি পাগল জনতা কিছুতেই মেনে নেবে না। এমন জগাখিচুড়ি মার্কা নিরপেক্ষতাও যেমন মানতে প্রস্তত নয় এদেশের স্বচ্ছ বিশ্বাস ও চেতনার মানুষেরা। এ পত্যয় তাদের ইসলাম দিয়েছে। এ হিম্মত তাদের আল্লাহ দিয়েছেন। এ শক্তি তাদের দিয়েছে তাদেরই গৌরবোজ্জ্বল অতীত।
একজন মুসলমানের জীবন থেকে মরণ পর্যন্ত তার গোটা জীবনের নিয়ন্তা একমাত্র ইসলাম। ইসলামের ভিতরে তার কোন সীমাতিক্রম বা বিচ্যুতি হওয়া অসম্ভব নয়। এজন্য তার সামনে খোলা রয়েছে অনুতাপ, অনুশোচনা, ত্রুটি স্বীকার ও তওবার দুয়ার। কিন্তু মুসলমানের পক্ষে এমন কোন কাজ কখনোই শোভনীয় নয়, যা তাকে ইসলামের বৃত্ত থেকে বের করে দেয়। আর এমন ঘৃণিত কাজ এ পৃথিবীতে একটিই আছে, যাকে আমরা শিরক বলে থাকি। পাক কুরআনে ঘোষণা এসেছে, “আল্লাহ শিরকের অপরাধ কখনোই ক্ষমা করবেন না, এছাড়া অন্য যেকোন অপরাধ যাকে ইচ্ছা আল্লাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন।” অতএব, বাংলাদেশের মুসলমানদের দল-মত নির্বিশেষে শিরক থেকে অবশ্যই বাঁচতে হবে। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংঘটিত ও আয়োজিত ছোট-বড় প্রতিটি শিরক থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকতে হবে। অগ্নিপূজা, প্রতিমা পূজাসহ সকল প্রকার শিরক ও পৌত্তলিক সংস্কৃতি থেকে রক্ষা করতে হবে নিজেদের স্বাধীন-সার্বভৌম আবাসকে, যে মাটির গর্ভে ঘুমিয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ শহীদ দেশপ্রেমিক যোদ্ধা, হাজার হাজার ওলী-দরবেশ, পীর-আওলিয়া।