বিসমিল্লাহ্! ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা মান লা নাবিয়্যা বা’দাহ্! আম্মা বা’দ...
মুহতারাম এক ভাই (ইসলামে ভোট হালাল কি?=https://justpaste.it/6i3vf) এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেছেন। সেখানে একজনের একটা লেখা তুলে দিয়ে ইসলামে ভোটের বিধান কি তা জানতে চেয়েছেন। স্বাভাবিকই লেখাটি মুহতারাম ভাইয়ের কাছে আপত্তিজনক মনে হচ্ছে। লেখাটি বাস্তবেও তেমনি, বরং আরোও জঘন্য।
লেখকের লেখাটি মূলত তাকী উসমানী সাহেব যা বলেছেন তারই আপডেট ভার্সন। তাকী সাহেবের লেখাটার সাথে আরোও বিভিন্ন মাত্রা-উপমাত্রা যোগ করেছেন। হাকিকত ও বাস্তবতার অস্বীকার এবং ফেরেব ও ধোঁকায় আরেকটু অগ্রগতি এনেছেন।
আসলে এসব কথা এতই সুস্পষ্ট বাতিল ও ধোঁকায় পূর্ণ যে, সামান্য দ্বীনি-বুঝ সম্বলিত প্রতিটি মুসলমানেরই তা বুঝার কথা। কিন্তু যামানার আবর্তে অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, এসব অসাড় প্রলাপেরও রদ লিখতে হয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!
লেখকের দাবি- খলিফা নির্বাচনের ব্যাপারে ইসলামে সুনির্দিষ্ট কোন ত্বরীকা নেই। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নির্ধারিত হবে: খলিফা কিভাবে নির্বাচিত হবে। এর দলীল তিনি দিয়েছেন- খুলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়া এক রকম ছিল না। একেক জন একেকভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। কাজেই বুঝা গেল- খলিফা নির্বাচনে ইসলামে নির্ধারিত কোন ত্বরীকা নেই। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে খলিফা নির্ধারিত হবে। তবে মতামত প্রদানের ত্বরীকা সময়ের পরিবর্তনে পরিবর্তিত হবে। আর মতামত প্রদানের আধুনিক পদ্ধতি হল- ভোট। কাজেই ভোট আধুনিক যামানায় খলিফা নির্বাচনের ইসলামী ত্বরীকা।
লেখক এখানে অনেকগুলো বাস্তবতাকে এড়িয়ে গিয়ে কোনমতে ধামা-চাপা দিয়ে গলার জোরে নিজের দাবি প্রমাণ করার বরং অকাট্য সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছেন। অথচ এই বাস্তবতাগুলো এড়িয়ে গিয়ে কিছুতেই খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতির দিকে যাওয়া যায় না। এই বাস্তবতাগুলোর উপর সামান্য একটু আলোকপাত এখানে আমি করছি-
• আমাদের আলোচনা প্রথমে খলিফা নির্বাচন নিয়ে হবে না, বরং আলোচনা হবে কুফরী শাসন দিয়ে শাসনকারী তাগুত ও মুরতাদ শাসকদেরকে অপসারণ নিয়ে। প্রশ্ন করি- মুরতাদদের হটানোর জন্য শরীয়ত কি ভোটে নামতে আদেশ দিয়েছে না’কি কতল ও কিতালের আদেশ দিয়েছে? মুরতাদের শাস্তি কি ভোটের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করে দেয়া, না’কি হত্যা করা? অপসারণ করে ক্ষান্ত রাখা তো পরের কথা, কোন মুরতাদকে হত্যা না করে জেলে ভরে রাখার অনুমতিটুকুও কি শরীয়ত দেয়? উত্তর যদি না হয়, তাহলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ভোটে নামবো কোন শরীয়তের আলোকে?!
• লেখক হয়তো বলবেন- ‘আমরা তাগুতদেরকে মুরতাদ মনে করি না।’ তাহলে জিজ্ঞেস করি- কি মনে করেন? অবশ্যই জঘন্য রকমের জালেম ও পাপিষ্ঠ মনে করেন? আর এরা অবশ্যই সাধারণ জালেম শাসকের মতো নয়। কারণ-
- সাধারণ জালেম শাসকরা শরীয়ত প্রত্যাখান করে কুফরী শাসনব্যবস্থা চালু করে না।
- সাধারণ জালেম শাসকরা তাগুত নয়, কিন্তু এরা তাগুত।
- সাধারণ জালেম শাসকরা কাফেরদের দ্বারা নির্বাচিত তাদেরই অনুগত দাস ও দালাল কিংবা তাদের কুফরের একনিষ্ঠ সাহায্যকারী নয়, কিন্তু এরা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
কাজেই এদের বিধান সাধারণ জালেম শাসকদের বিধান নয়। এখন লেখককে জিজ্ঞাস করি- শরীয়তের কোথায় এসব জালেম তাগুতকে অপসারণের জন্য ভোটে নামার আদেশ দিয়েছে আমাদের একটু দেখাবেন কি?
• বর্তমান ভোটাভুটিকে খুলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন-প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করা নিতান্তই ফেরেব ও ধোঁকা। কারণ- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর কিংবা আবু বকর রাদি., উমর রাদি., উসমান রাদি., বা আলী রাদি. এর কারো ওফাতের পর মুসলিম বিশ্বের অবস্থা হল- খলিফার পদ খালি রয়েছে, জরুরী ভিত্তিতে একজন খলিফা নির্বাচন করতে হবে। পক্ষান্তরে বর্তমানের অবস্থা হল- কাফের ও তাগুত-মুরতাদরা মুসলিম খলিফা ও সুলতানগণকে অপসারণ করে, মুসলিমদেরকে রক্তের সাগরে ভাসিয়ে গোটা মুসলিম বিশ্ব তাদের কব্জায় নিয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায় মুসলমানদের ফরজ দায়িত্ব- এসব কাফের মুরতাদ ও তাগুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে হটানো। এরপর সামর্থ্যানুযায়ী একজন খলিফা নিয়োগ দেয়া। খলিফা সম্ভব না হলে অন্তত সুলতান নিয়োগ দেয়া। এই দ্ব্যর্থহীন সুস্পষ্ট বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আগে খলিফা নির্বাচনের স্লোগান উঠানো মূলত ফরয দায়িত্ব এড়ানোর একটা বাহানা। শুধু তাই নয়, বরং মনগড়া এই ভোটাভুটিকে শরীয়ত-নির্ধারিত দায়িত্ব আখ্যায়িত করে নিজেদের গোমরাহি ঢাকা দেয়ার অপচেষ্টা। শুধু তাই নয়, বরং গোটা উম্মাহকে এই গোমরাহিতে লিপ্ত করার অনন্ত প্রয়াস।
• দ্বিতীয়ত: লেখকের দাবি খলিফা নির্বাচনে ইসলামে নির্ধারিত কোন ত্বরীকা নেই। বাতিলপন্থীদের অনেকেই এ দাবিটি করে থাকে। এর উদ্দেশ্য- যাতে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতিকে ইসলামের নামে চালিয়ে দিতে পারে। পক্ষান্তরে তারা যদি মেনে নেয়- ইসলামে খলিফা নির্বাচনের নির্ধারিত পন্থা রয়েছে, তাহলে তাদের ধোঁকার রাজনীতি মাঠে মারা যাবে। জনগণের কাছে তারা শরীয়তবর্জনকারী নব্য-বিদআতি মতালম্বী বলে প্রসিদ্ধ হয়ে যাবে। এ জন্য তারা হাঁক-ডাক করে বেড়ায়: ইসলামে খলিফা নির্বাচনে নির্ধারিত কোন পন্থা নেই। এর পক্ষে খোঁড়া দলীল- খুলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়া একেজনের একেক রকম ছিল।
কিন্তু এই ফেরেববাদিদের কে বুঝাবে যে, খুলফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়ার দ্বারা খলিফা নির্বাচনে স্বাধীনভাবে মনগড়া যা ইচ্ছা তা-ই করার সুযোগ সৃষ্টি হয় না, বরং খলিফা নির্বাচনের প্রক্রিয়া কি হবে তা সুনির্ধারিত হয়। উম্মাহর ফুকাহায়ে কেরাম এমনই বুঝেছেন। তেরোশ বছর এভাবেই চলে আসছে। কিন্তু আজ যামানার আবর্তে এই ফেরেববাদিদের জন্ম হল, যারা এসে দাবি করছে- ইসলামে খলিফা নির্বাচনে নির্ধারিত কোন পন্থা নেই।
খুলাফায়ে রাশিদীনের নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে ফুকাহায়ে কেরাম খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি দুটির কোন একটি হবে বলে নির্ধারণ করেছেন:
এক.
الأختيار তথা উম্মাহর আহলে হল ওয়াল আকদ যারা আছেন, তারা উপযুক্ত একজন ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে নির্ধারণ করবেন। যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর মদীনার আহলে হল ওয়াল আকদ সাহাবায়ে কেরাম হযরত আবু বকর রাদি. কে নির্বাচন করেছেন। তেমনই উসমান রাদি. এর শাহাদাতের পর আলী রাদি. কে নির্বাচন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, খলিফা নির্বাচনের অধিকার কেবল উম্মাহর আহলে হল ওয়াল আকদ ব্যক্তিগণই রাখেন। সাধারণ জনগণ এই অধিকার রাখে না। হযরত উসমান রাদি. এর শাহাদাতের পর লোকজন আলী রাদি. এর হাতে বাইয়াতের জন্য আসে। তখন তিনি বলেন-
“তোমাদের এই অধিকার নেই। এটা তো আহলে শূরা এবং বদরী সাহাবীদের দায়িত্ব। আহলে শূরা এবং বদরী সাহাবীরা যাকে নির্বাচন করবে, তিনিই খলিফা হবেন। তাই আমরা সমবেত হয়ে এ ব্যাপারে চিন্তা-ফিকির করবো। তিনি বাইয়াত নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। ফলে তারা চলে গেল।” [‘আল-ইমামাতু ওয়াস-সিয়াসাহ্’ লি-ইবনি কুতাইবা (মৃত্যু: ২৭৬হি.): ১/৯৯]
দুই.
الاستخلاف তথা পূর্ববর্তী খলিফা, তার পরে কে খলিফা হবেন তার প্রস্তাব করে যাওয়া। যেমন- আবু বকর রাদি. তাঁর পর উমর রাদি. এর প্রস্তাব করে গিয়েছিলেন, উমর রাদি. তাঁর পর ছয় জনের মধ্য থেকে এক জনকে খলিফা নির্বাচন করার প্রস্তাব করে গিয়েছিলেন। তবে এ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী খলিফার এ প্রস্তাবের দ্বারাই প্রস্তাবিত ব্যক্তি খলিফা হয়ে যাবেন না, বরং উম্মাহর আহলে হল ওয়াল আকদ ব্যক্তিগণ যদি তার প্রস্তাবকে কবুল করে নিয়ে প্রস্তাবিত ব্যক্তির হাতে খেলাফতের বাইয়াত দেন, তাহলেই কেবল তিনি খলিফা হবেন, অন্যথায় নয়।
ফুকাহায়ে কেরাম এই দুই পদ্ধতির কথাই বলে গেছেন। তৃতীয় কোন পন্থার কথা বলে যাননি।
সাথে সাথে তার সুস্পষ্ট বলে গেছেন, খলিফা নির্বাচনের অধিকার শুধু আহলে হল ওয়াল আকদ যারা থাকবেন, তাদেরই রয়েছে। অন্য কারো তাতে কোন অধিকার নেই। সাথে সাথে তাঁরা এও বলে গেছেন, কয়েক প্রকার ব্যক্তি খলিফা নির্বাচনের অধিকার রাখে না-
১. কাফের, চাই হারবী হোক কি যিম্মি হোক।
২. ফাসেক মুসলমান।
৩. সাধারণ দ্বীনদার মুসলমান, যারা খলিফা নির্বাচনের জন্য পর্যাপ্ত শরয়ী ও জাগতিক ইলম, হিকমত ও অভিজ্ঞতা রাখে না।
৪. মহিলা।
৫. নাবালেগ।
শরীয়ত যেখানে সাধারণ মুআমালাতেও এদের রায় গ্রহণ করে না, সেখানে খলিফা নির্বাচন, যা গোটা উম্মাহর সাথে জড়িত- সেখানে কিভাবে এদের রায় গ্রহণ করবে??
কিন্তু তেরোশ বছর পর আজ নব্য বিদআতি গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে, যারা দাবি করছে, ইসলামে খলিফা নির্বাচনের নির্ধারিত কোন পন্থা নেই। মুসলিম-কাফের, নাস্তিক-মুরতাদ, যিন্দিক-মুলহেদ, আদেল-ফাসেক, মহিলা-পুরুষ, বালেগ-নাবালেগ সকলকেই তারা খলিফা নির্বাচনের অধিকার দিয়ে দিয়েছে। আবার দাবি করছে- এটাই নাকি আধুনিক যামানায় ইসলামী ত্বরীকা। লা’নত এই ত্বরীকার উপর যা কুরআন-সুন্নাহ বিবর্জিত, লা’নত এই ত্বরীকার উপর যা সালাফে সালেহীনের পরিপন্থী, লা’নত এই ত্বরীকার উপর যা ঈমান-কুফর, মুসলিম-অমুসলিম, ফাসেক ফুজ্জার সকলকে বরারব বানিয়ে ফেলেছে। কসম আল্লাহর! কিছুতেই এই ত্বরীকা ইসলামী ত্বরীকা হতে পারে না। আল্লাহ যদি কাউকে অন্ধ না বানিয়ে দেন, তাহলে অবশ্যই তা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সহীহ ইলম দান করুন। ফিরাসত, বাসীরত ও অন্তর্দৃষ্টি দান কর। সব রকরেম ফিতনা ও গোমরাহি থেকে হিফাজত কর। আমীন!