JustPaste.it

জীবন পাথেয়

 

মহরানা সংশ্লিষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি

হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানুভী রহ.

 

 

শরীআত প্রণেতার ভাষ্যে মহরানা ওয়াজিব

            মহরানার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় ত্রুটি হল এই যে, অধিকাংশ লোক মহরানা প্রদান করার কোনো ইচ্ছাই রাখে না। হয়ত স্ত্রী তা উসুলের গরজ রাখে না, অথবা অন্য কোনো অসুবিধার কারণে স্বামী তা দেয় না। যেমন, স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হলে কিংবা মারা গেলে তার অভিভাবক বা ওয়ারিস তা আদায়ের চেষ্টা করলেও স্বামীর তা আদায়ের কোন সদিচ্ছা দেখা যায় না। এতে বুঝা যায় যে, সাধারণের দৃষ্টিতে এটার কোনো গুরুত্বই নেই। এ ব্যাপারটি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখলে এ সত্যটিই ধরা দেয়। যেমন, মহরানা ধার্য নিয়ে দর কষাকষি হলে বলে দেয়, মিয়া! মহরানা কে নেয় আর কে দেয়?

             যাক, জনসাধারণ তো সুস্পষ্টভাবেই তাদের এ ধারণাটি জানিয়ে দেয় যে, নেহাৎ নিয়মের খাতিরে নাম মাত্র একটা মহরানা ধার্য করা হয়। তার সাথে লেনদেনের কোন সম্পর্ক নেই।

            পয়লা কথা হল, এ ধারণাটিই ভুল ও বাতিল। শরীআত প্রণেতার ভাষ্যমতে মহরানা ওয়াজিব এবং তা প্রদান করা অপরিহার্য। অন্যান্য প্রদেয় অপরিহার্য ঋণের মতই এটা আদায় করা ওয়াজিব। তবে যদি স্বেচ্ছায় ক্ষমা করা হয় কিংবা মারা যাবার কারণে স্বামী ওয়ারিস হিসাবে কিছু অংশ পাওনা হয়, তা হলে সে পূর্ণ বা আংশিক দায়মুক্ত হবে। তা ছাড়া এক বিছানায় যাবার আগে তালাক হলে অর্ধেক মহরানা মাফ হবে। এ ধরনের আরও কিছু ব্যাপার ফেকাহর কিতাবে রয়েছে। যা হোক মহরানা মূলত আদায় করা ওয়াজিব ! যারা এটাকে হাল্কা বলে দাবী করে, মহরানা সংক্রান্ত বিভিন্ন ঝগড়াই তাদের সে দাবী মিথ্যা প্রমাণ করে। যেমন, তালাকপ্রাপ্তা বা খোজ-খবর বিহীন অবস্থায় ফেলে রাখা স্ত্রী প্রথমেই তার মহরানার দাবী তুলে থাকে।

            মোটকথা, এর অপরিহার্যতা ও বিচার-বিশ্লেষণ বলে দেয়, এটাকে হাল্কা ভাবা সর্ববিবেচনায় ভুল।

 

মহরানা আদায়ে অনিচ্ছুকরা ব্যভিচারী হয়ে মারা যাবে

              মহরানাকে হাল্কা ভাবা ও তা না দেয়ার নিয়ত রাখা এত বড় মারাত্মক কথা যে, হাদীস শরীফে সে ব্যাপারে কঠোর সতর্কতার উল্লেখ রয়েছে। কানযুল উম্মাল কিতাবে উল্লেখ আছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিয়ে করে ও তার জন্যে কিছু মহরানা ধার্য করে, তারপর যদি সে নিয়ত করে তা না দেয়ার কিংবা আংশিক না দেয়ার, তা হলে সে ব্যভিচারী হয়ে মারা যাবে এবং ব্যভিচারীরূপেই আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে।

            ভেবে দেখুন, এটা কত বড় কঠোর সতর্কবাণী। বিয়ের সব কিছু বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও যদি সে ব্যভিচারী বলে গন্য হয়, তা হলে যে কারণে তা হবে সেটা সংশোধন কি জরুরী নয়?

            হাদীসের বিশ্লেষণ থেকে বিয়ে ও ব্যভিচারের ভেতর পার্থক্য সৃষ্টিকারী ব্যাপারগুলো হল, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে গার্ডিয়ানের উপস্থিতিতে দু’জন সাক্ষী ও মহরানা। সাক্ষীর ব্যাপারে বিশ্লেষণ রয়েছে। (কানযুল উম্মাল অষ্টম খণ্ড, ২৪৫, ২৪৬, ২৪৭ ২৪৮, ২৪৯, ২৯৬, ২৯৭ পৃষ্ঠা)।

 

মহরানা অনাদায়কারী চোর খেয়ানতকারী

            এ হাদীসের আরও একটি অংশ রয়ে গেছে। তা হল এই, কেউ যদি কোন জিনিস ক্রয় করে তার দাম দেয়ার নিয়ত না রাখে কিংবা কারো থেকে কিছু কর্জ নিয়ে তা আদায় করতে ইচ্ছুক না হয়, সে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন খেয়ানতকারী ও চোর বলে বিবেচিত হবে। তাই এটা স্পষ্ট যে, মহরানা অবশ্য প্রদেয় একটি ঋণ। সে ক্ষেত্রে যদি কেউ তা আদায়ের ইচ্ছা না রাখে, তা হলে সেও খেয়ানতকারী ও চোর সাব্যস্ত হবে। ফলে তার ওপর দুটো অপরাধ চাপবে। হাদীসের পয়লা অংশের ভিত্তিতে সে ব্যভিচারী ও দ্বিতীয় অংশের ভিত্তিতে খেয়ানতকারী ও চোর। কারণ, আর্থিক পাওনা নষ্ট করা খেয়ানতকারী ও চোরের কাজ!

            একটি অপরাধের শাস্তি এড়াবার জন্য আমি আগে বলেছিলাম যে, এরপরেও কি এটা উপেক্ষা করা যেতে পারে? এক্ষণে তো দু’ অপরাধের শাস্তি প্রমাণিত হল। এখন তো আরও জোরের সাথে বলা যাবে যে, এরপরও কি মহরানা উপেক্ষা করার ত্রুটি প্রতিকারের দাবী রাখে না?

 

ক্ষমতার বাইরে মহরানা ধার্য করা ঠিক নয়

             তাই মহরানা সংশ্লিষ্ট উক্ত মারাত্মক ত্রুটির প্রতিকার অপরিহার্য। তা হল, মহরানা প্রদান করার দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা। কিন্তু অভিজ্ঞতা ও বিবেক বলে, ইচ্ছার এ দৃঢ়তা তখনই হতে পারে, যখন তা প্রদান করা সাধ্যাতীত না হয়। যদি তা সাধ্যাতীত হয় তখন তা আদায়ের ইচ্ছাটা অসার কল্পনা হয়ে দাড়ায়। যে ব্যক্তির সোয়াশ' টাকা দেয়ার ক্ষমতা নেই, তার যদি সোয়া লাখ টাকা মহরানা ধার্য করা হয় কিংবা পাঁচ কি দশ হাজারও নেই, তার যদি সোয়া লাখ টাকা মহরানা ধার্য করা হয় কিংবা পাঁচ কি দশ হাজারও ধরা হয়, তা হলে স্বভাবতই সে আদায়ের ইচ্ছা পোষণ করবে না। অথচ এ কারণে সে পূর্বোক্ত শাস্তির শিকার হবে। তাই মহরানা ধার্যের সময়ে তা ক্ষমতানুসারে ধার্য না করে উপায় নেই। যেহেতু অধিকাংশ লোকই কম মহরানা দেবার ক্ষমতা রাখে, তাই কম মহরানাই ধার্য হওয়া চাই। হাদীসে বেশী ধার্যের নিন্দা ও কম মহরানা ধার্যের প্রশংসা এসেছে। হযরত ওমর (রাঃ) এক খুতবায় বলেন, বেশী মহরানা ধার্য করো না। যদি তা পার্থিব সম্মানের কিংবা আল্লাহর কাছে তাকওয়ার কাজ বলে বিবেচিত হত, তা হলে রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা অর্জনের বেশী উপযোগী ছিলেন। কিন্তু রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোনো স্ত্রী বা কন্যার মহরানা ১২ উকিয়ার বেশী ছিল না। এক উকিয়া চল্লিশ দেরহাম সমান। এক দেরহাম আমাদের সোয়া চার আনা।  হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, নারীর মহত্ত্বের এটাও একটা দিক যে, তার মহরানা কম ও সহজে আদায়যোগ্য।

              অপর এক হাদীসে আছে, উত্তম মহর হল স্বল্প ও সহজ মহর। (কানযুল উম্মাল, ২৪ পৃঃ) অপর এক হাদীসে আছে, মহরানা ধার্য সহজ কর। (কানযুল উম্মাল, ২৪৯ পৃঃ)

 

নিজ সাহসের বাইরে মহরানা স্বীকার করা নিষিদ্ধ

             মোটকথা, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর থেকে প্রাপ্ত মারফু ও মাওকুফ বর্ণনা, শরীআতের মূলনীতির আলোকে ক্ষমতার বাইরে বোঝা ধারণ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন হাদীসে আছেঃ রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, কোন মুমিনের জন্যে শোভন নয় যে, সে নিজকে লাঞ্ছিত করবে। আরয করা হল, হে আল্লাহর রসূল! কিভাবে নিজকে লাঞ্ছিত করা হবে? তিনি বললেন, এমন বিপদ সে মাথায় নেয় যা বহন করার ক্ষমতা তার নেই।

 

ন্যূনতম মহরানা দশ দেরহাম

             এখন কথা থেকে যায় যে, মহরানার ন্যূনতার কি কোন সীমা আছে? ইমাম আবু হানীফা (রাঃ) এর নিকট ন্যূনতম মহরানার পরিমাণ হল দশ দেরহাম। মানে, এর চেয়ে কম মহরানায় বিয়ে জায়েয হবে না। যদি কম ধার্য করা হয়, তথাপি দশ দিরহাম আদায় করা ওয়াজিব হবে। হযরত জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, দশ দেরহামের কমে কোনো মহরানা নেই। হযরত আলী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, নারীর লজ্জাস্থান বৈধ হবার নূন্যতম মহরানা হল দশ দিরহাম! হযরত আলী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত আছে, দশ দেরহামের কম কোনো মহরানা নেই।

 

মহরানা অধিক ধার্যের পার্থিব ক্ষতির দিক

             এর আগে অতিরিক্ত মহরানা ধার্যের দ্বীনী ক্ষতির দিক বলে এসেছি। বলেছি, এটা সুন্নতের খেলাপ কাজ। তা ছাড়া তার ফলে মহরানা না দেয়ার মনোভাব সৃষ্টি হয়। ফলে তা আদায় করা হয় না। পরিণামে তার তুলনা হয় ব্যভিচারীর পাপের সাথে। এ ছাড়া তাতে পার্থিব ক্ষতিরও কয়েকটি দিক রয়েছে, লক্ষ্য করলেই তা নজরে পড়ে। যেমন, কোথাও স্বামী-স্ত্রীর মিল হয় না। তাই স্ত্রীর হক আদায় করা হয় না। অথচ তালাকও দেয় না এই কারণে যে, মহরানার পরিমাণ বেশী। ভাবে, তালাক দিলে মহরানা নিয়ে জ্বালাতন করবে। ফলে দেখা যায়, অধিক মহরানা নারীর জন্যে কল্যাণের বদলে অকল্যাণ বয়ে আনে। কোনো কোনো জ্ঞানী-গুণী মনে করেন যে, বেশী মহরানা হলে তালাক দিতে পারবে না। কিন্তু এটা ভাবেন না যে, ছেড়ে দিতে না পারাটা সব ক্ষেত্রে কল্যাণ আনে না। যেমন, উপরোক্ত ক্ষেত্রে ছাড়তে না পারাতেই তো অকল্যাণ দেখা দিয়েছে। যেমন, কোথাও স্বামী তালাক দেয়ায় বা সে মারা যাওয়ায় স্বামী কিংবা তার ওয়ারিস লাখ টাকার মহরানা আদায় করতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে পথের ভিখারী হল। এভাবে সাধ্যাতীত মহরানা দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিক থেকেই ক্ষতিকর হয়।

            অধিক মহরানার এ ক্ষতিগুলো তো তখনই দেখা দেয়, যখন তা আদায়ের ইচ্ছা না থাকে। যদি পুরুষের ওপর খোদাভীরুতা প্রাধান্য বিস্তার করে আর বান্দার হক থেকে যদি সে মুক্ত হতে চায় ও আদায়ের ইচ্ছা পোষণ করে, তখন আবার এ বিপদ দেখা দেয় যে, সেই বিরাট অংক আদায় করতে গিয়ে তাকে হাজারো দুঃখ-দৈন্যের সম্মুখীন হয়ে ওষ্ঠাগত প্রাণ থাকতে হয়। সর্বস্ব হারিয়ে ঘানি টানতে হয়। ফলে স্ত্রীর প্রতি তার মহব্বতের বদলে বিরক্তি, ঘৃণা, এমনকি শত্রুতা দেখা দেয়। পরিণামে বিয়ের উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যায়! মহরানার কারণে বিয়ের মিল-মহব্বতের উদ্দেশ্যটা উল্টে গিয়ে অমিল ও শত্রুতায় রূপান্তরিত হয়। যার পরিণতি খারাপ, সে বস্তুত খারাপ না হয়ে পারে না। নিম্ন হাদীস তা-ই বলেঃ

             ‘মহরানা সহজ (কম) কর! কারণ, পুরুষকে নারীর বেশী মহরানা দিতে হলে অবশেষে তার প্রতি শত্রুতাই অবশিষ্ট থাকে।’ (কানযুল উম্মাল, অষ্টম খণ্ড ২৪৯ পৃষ্ঠা)

            আল্লাহ তা'আলাও দায়মুক্ত হবার দুটো পথই বলেছেনঃ

            “হয় সেই স্ত্রীরা তাদের (অর্ধেক মহরানা) মাফ করে দেবে, অথবা তার বিয়ের অভিভাবক বা ভাংগা গড়ার অধিকারী মাফ করবে।” (বাকারাঃ ২৩৭)।

            এর সাথে সাথেই দ্বিতীয় পথের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে। যেমনঃ

              “আর তোমাদের মাফ করে দেয়াটা বেশী পরহেযগারীর পরিচায়ক।”

            সেই সংগে পয়লা পথের নির্দোষ হওয়া সম্পর্কেও বলে দিলেনঃ “আর পরস্পর এহসান করার ব্যাপারে উদাসীন হয়ো না।”

               সব আলোচনার সারকথা হল এই যে, পয়লা উপায়টি নির্দোষ হলেও অপছন্দনীয়। এ কারণে যে, তাতে হীনমন্যতা জড়িত। তা হলে দেখুন, বেশী মহরানা চারিত্রিক দুর্বলতারও কারণ হয়ে দাড়ায়। সেটা কখনও কাম্য বিবেচিত হয়না। এটাও ততক্ষণ নির্দোষ যতক্ষণ মাফ নেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ পাকের এ নির্দেশ মেনে চলা হবেঃ

      “অতঃপর যদি তারা তোমাদেরকে মহরানা থেকে খুশী হয়ে কিছু মাফ করে দেয় ....”(নিসা: ৪}

            অর্থাৎ- সে মাফ করাটা হতে হবে তাদের খুশী সহকারে। তা না হয়ে যদি পৌরুষত্বের মর্যাদার সাথে সাথে খোদাভীতিও বিদায় নেয়, তা হলে তো সে যে কোনো পথে নামমাত্র মাফের স্বীকৃতির প্রয়াস পাবে। কখনও ধোকার আশ্রয় নেবে, কখনও ভয়-ভীতি দেখিয়ে কাজ হাসিল করবে, কখনও জোর-জবরদস্তি করে স্বীকৃতি আদায় করবে। মনে রাখবে, এরূপ মাফ করানো খোদার দরবারে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। ফলে আল্লাহর কাছে তার দায়মুক্তি হবে না। যদি তার আত্মমর্যাদাবোধ ও খোদাভীতি দুটোই থাকত, কিন্তু ক্ষমতা না থাকত, তা হলে তো তার জন্য মহাবিপদ হত। জীবনভর তাকে সে বোঝার গ্লানি বয়ে চলতে হত। অহরহ দুশ্চিন্তায় ডুবে থাকত যে, কি করে এ বোঝা থেকে সে অব্যাহতি পাবে।

              তাই ভেবে দেখুন, মহরানা বেশী ধার্য করার কত কুফল দেখা দেয়। যদি স্বামী তা দেবার পাক্কা এরাদা রাখে এবং সারাজীবন কিছু কিছু দিতে থেকে অসম্পূর্ণ রেখে মারা যায়, তা হলে হয়ত আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন না। কিন্তু বেচারার পার্থিব জীবন তিক্ত হয়ে গেল! স্বামীর জীবনই যদি তিক্ত হয়, তা হলে স্ত্রীর জীবন কি আর মধুর হতে পারে? মোটকথা, এতে সব দিক থেকে শুধু ক্ষতিই ক্ষতি।

 

বেশী মহরানার কল্যাণকারিতা কল্পনা মাত্র

               যদি কারো এরূপ খেয়াল হয় যে, ক্ষতির দিক কম লাভের দিকটা বেশী। যেমন মহরানা কম হলে স্বামী তার পরোয়াই করে না। তাই এক বউ ছেড়ে আরেক বউ আনে। সে ক্ষেত্রে বেশী মহরানা একটা বাধা হয়ে দাড়ায়।

             তার জবাব এই যে, পয়লা কথা হচ্ছে, আমি কম মহরানা বলতে অত্যন্ত কম মহরানার কথা বলিনি। আমার বলার লক্ষ্য হচ্ছে যে, এত বেশী যেন না হয় যা স্বামীর দুনিয়া ও আখেরাত দুটোই বরবাদ করার কারণ হয়ে দাড়ায়। যদি সে আদায় করার ইচ্ছা না রাখে, তা হলে দ্বীন বরবাদ হবে। যদি আদায় করতে সে চেষ্টা করে তো দুনিয়া বরবাদ হবে। তেমনি যদি তা অনাদায়ের কলাকৌশল চালায়, তাতে দুটো বরবাদ হবে। কথা হল মহরানা ধার্যে ইনসাফ থাকতে হবে। ফলে সার্বিক কল্যাণ সুরক্ষিত হবে।

             দ্বিতীয়ত, যার ভেতর খোদাভীতি নেই, তাকে কোন কাজে কোন কিছু দিয়ে ঠেকানো যায় না। এরূপ বহু ঘটনা কি আমরা দেখি না যে, বিরাট বিরাট অংকের দেনমহরের দায় ঘাড়ে নিয়েও স্ত্রীর কোন হকই আদায় করছে না? আর সেই অবস্থায় তার নজর বৈধ কি অবৈধ পথে অন্য দিকে নিবদ্ধ রয়েছে? এরূপ জালেমকে তো কোন কিছু দিয়ে আটকানো যায় না। হয় সে এত প্রতিপত্তি রাখে যে, তাকে কিছু বলা যায় না। অথবা সে নিঃস্ব যে, তার থেকে আদায়ের উপায় নেই। শুধু জেলে ঢুকানো যায়, জামাইকে জেলে ঢুকিয়ে মেয়েকে কোন আরামটা দেয়া যায়?

 

বেশী মহর ধার্য করা নিছক সামাজিক রীতির অনুসরণ মাত্র

             কিছু লোক এ জন্যে বেশী মহরানা ধার্য করে যে, কম মহরানায় ইজ্জত কমে আর বেশী মহরানায় ইজ্জত বাড়ে। এর পয়লা জবাব হচ্ছে, ইনসাফ ভিত্তিক মহরানায় ইজ্জত কমে না। দ্বিতীয়ত, যাতে ক্ষতি অনেক বেশী তাতে ইজ্জত বাড়ানোর নগণ্য একটা অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। তৃতীয়ত, গৌরব প্রকাশই যদি উদ্দেশ্য হয়, তা হলে যত বেশী বাড়াবে তত ইজ্জত বাড়বে। তাই আমার ওস্তাদ বলেন, অল্প বাড়িয়ে ক্ষ্যান্ত হলে চলবে কেন? আদায়ের যখন ইচ্ছা নেই তো সাত রাজ্যের ধন মহরানা ধার্য করা উচিত। এমনকি তারও কয়েক গুণ বেশী ধার্য করতেই বা বাধা কি? দেয়ার যখন মতলব নেই, শুধু নাম ফাটানোর মহরানা, তখন ভালভাবেই খ্যাতিলাভের চেষ্টা করা উচিত।

              আসল কথা হচ্ছে, এ সব হল সামাজিক কুসংস্কার। এতে মূলত কোন কল্যাণই নেই। অথচ বহু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তাই এ প্রথা বর্জন যে অপরিহার্য, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই বলছি, কুসংস্কার ছাড় এবং বিবেক- বুদ্ধি ও শরীআতের পথ ধর।

             অবশ্য যদি পারিবারিক প্রচলিত মহরের সমমহর ধার্যের প্রশ্ন আসে এবং তার কম ধার্য করা ওলীর জন্যে বৈধ না হয়-যা ফেকাহর কিতাবে বিশ্লেষিত হয়েছে- তখন সবাই মিলে মহরের প্রচলিত মানের পরিবর্তন ঘটাবে। ফলে স্বভাবতই তার পরিমাণ কম হলেও মহরে মেছাল আদায় হবে। এ পথটি এমন কোন জটিল ব্যাপার নয়, যার ওপর কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে।

 

স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর মহরানার দায়ে স্থাবর- অস্থাবর সব সম্পদ কজা করা শরীআতসম্মত নয়

             মহরের ব্যাপারে আরেকটি ত্রুটি এই যে, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী তার মহরানার দায়ে স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ হস্তগত করে মনকে বুঝায় যে, সে তার পাওনা আদায় করল। হোক তা মহরানার মূল্যের কয়েক গুণ বেশী। তাই জানা দরকার যে, যেহেতু এ সব বস্তু মহরানার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই মহরানায় শামিল করা জায়েয নয়। সে জন্যে বিচারকের রায়ের প্রয়োজন হবে। তা ছাড়া অন্যান্য ওয়ারিসের রাজী হওয়ার প্রশ্নও জড়িত। তা-ও আবার তাদের কেউ নাবালেগ থাকলে তার অংশ বাদ দিয়ে কথা হবে। তারপরও কথা থাকে যে, সম্পদ মহরানার চেয়ে এ পরিমাণ বেশী হতে পারবে না, যেটাকে মূল্য নির্ধারকরা সবাই বেশী বলে মনে করবে। তবে যদি বিচারকের আশ্রয় নেয়ার উপায় না থাকে কিংবা ওয়ারিস তার হক দিতে না চায়, তা হলে তার ক্ষমতা থাকলে সে ততটুকুই মহরানা হিসাবে নিতে পারবে, যার মূল্য মহরানার মূল্যের সমান হয়। মূলতঃ এটা বিশ্লেষণসাপেক্ষ খুঁটিনাটি মাসআলা। ভিন্ন বস্তু থেকে কিভাবে মহরানা নেয়া যাবে, তার সবিস্তার আলোচনা ফেকাহর কিতাবে রয়েছে।

 

স্ত্রী নিজ মৃত্যুশয্যায় মহরানা মাফ করতে পারে না

            মহরানার ক্ষেত্রে আরেকটি ত্রুটি এই যে, অধিকাংশ স্ত্রী মৃত্যুশয্যায় থেকে স্বামীর মহরানা মাফ করে দেয়। এ ক্ষেত্রে জানা দরকার যে, এ মাফ তার ওয়ারিসের জন্যে ওসিয়তের একটি রূপ বৈ নয়। অন্যান্য ওয়ারিসের সম্মতি ছাড়া এ ওসিয়ত জায়েয নয়। তাই সে মাফ দ্বারা মহরানা মাফ হবে না। অবশ্য স্বামী ওয়ারিস সূত্রে স্ত্রীর যে অংশ পাবে, সেটুকু মাফ হবে। অবশিষ্ট অংশ আদায় করা তার জন্যে ওয়াজিব। সেটা স্ত্রীর অন্যান্য ওয়ারিস পাবে। তবে যদি সব ওয়ারিস সেই মাফ করাটাকে মেনে নেয়, তা হলে পুরোটাই মাফ হয়ে যাবে। যদি কেউ আপত্তি তোলে কিংবা কেউ নাবালেগ থাকে, তা হলে সে অংশটি মাফ হবে না।

 

স্বামীর মরণকালে স্ত্রী মহরানা মাফ করা ঠিক নয়

             এ ক্ষেত্রে আরেকটি ত্রুটি এই যে, স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী তার মহরানা মাফ করে দেয়। সেক্ষেত্রে খোলাসা কথা হল এই যে, যদি স্ত্রী সরল অন্তরে মাফ করে দেয় তা হলে মাফ হবে, কিন্তু তাকে যদি ধর-পাকড় করে বলে- কয়ে চাপ দিয়ে মাফ করানো হয়, তা হলে মাফ হবে না। সে সময়ে তার ওপর এভাবে জোর- জবরদস্তি করা ঠিক নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাফ না করাতেই মংগল। যেমন, স্বামীর মীরাস যা পেয়েছে তাতে তার ভরণ-পোষণ চলে না। অথচ অন্যান্য ওয়ারিছরাও তাকে কোন কন্সেশন দিতে রাজী নয়। এরূপ অবস্থায় তাকে মহরানা মাফের জন্যে উৎসাহ না দিয়ে বরং তা মাফ না করার পরামর্শ দেয়া উচিত।

 

মৃত স্ত্রী সন্তানের অংশ খরচ করা স্বামীর জন্যে হারাম

              মহরানার ক্ষেত্রে আরেকটি ক্রটি এই যে, মৃত স্ত্রীর যদি পিতা-মাতা ও ভাই-বোন ইত্যাদি ওয়ারিস হয়, তা হলে স্বামী তাদের অংশ দাবী করে দিয়ে দেয়। কিন্তু যেহেতু স্ত্রীর সন্তানরা দাবী করতে পারে না, তাই তাদের অংশ সে আদায় করে না। এ কাজটি সরাসরি জুলুম ও খেয়ানত। তাদের প্রাপ্য তার কাছে আমানতস্বরপ। তাই তা সন্তানদের নামে জমা রাখা চাই। তা শুধু তাদেরই কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। তা না করে নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করা হারাম হবে। সন্তানরা তাদের মায়ের যে মীরাস পেয়েছে পিতার জন্যে তা হেফাযত করা ফরয। তা থেকে ভিন্ন খাতে খরচ করা হারাম।

 

নাবালেগার মহরানা মাফ করা শরীয়াতসম্মত নয়

             এক্ষেত্রে আরেকটি ক্রটি এই যে, কিছু লোক এমনি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিংবা তালাক দেবার প্রাক্কালে নাবালেগা স্ত্রী থেকে মহরানা মাফ করিয়ে নেয়। এ মাফ শরীয়াতে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অপ্রাপ্ত বয়স্কের দান-হেবা সবই বাতিল। কোথাও তার চেয়ে মারাত্মক ব্যাপার এই দেখা যায় যে, নাবালেগার অভিভাবক তার স্বামী থেকে তালাকনামা নেয়ার জন্যে মহরানা মাফ করে থাকে। এক্ষেত্রে স্বামী যদি তালাক দেয়, তা হলে তালাক হয়ে যাবে বটে, কিন্তু মহরানা মাফ হবে না।

 

স্ত্রীদের মহরানা দাবী করায় কোন দোষ নেই

            এক্ষেত্রে একটি জ্ঞানগত ত্রুটি এই যে, নারীরা ভাবে, আমরা যদি স্বামী থেকে মহরানা নিয়ে নেই, তা হলে স্বামীর কাছে আমাদের আর কোনো পাওনা থাকে না। অর্থাৎ তাদের খাওয়া-পরা ও থাকার ব্যাপারে স্বামীদের আর কোন দায়-দায়িত্ব থাকবে না। এরূপ ধারণা একান্তই অমূলক। প্রত্যেকটি অধিকার ও পাওনা স্বতন্ত্র। একটির ওপর আরেকটি নির্ভরশীল নয়। তাই মহরানার পাওনা আদায়ের ফলে অন্য পাওনা বাতিল হয় না। যদি সেই ভুল ধারণায় কোন কোন স্ত্রী মহরানার টাকা নিতে রাজী না হয় আর তা মাফও না করে, তখন তার স্বামী তা না দিতে পারলে স্বস্তি বোধ করে না, তার জন্যে বিপদ হয়ে যায়। সে-ও অজ্ঞতার কারণে ভাবতে থাকে, এখন আর মহরানার দাবী থেকে মুক্তি পাবার কি উপায় রয়েছে? তাই তাদের অবগতির জন্যে মাসআলা বলে দেয়া হচ্ছে। তা হল এই যে, সেরূপ অবস্থায় স্বামী যদি স্ত্রীর মহরানার টাকা পুরোপুরি এনে স্ত্রীর সামনে রেখে দেয় ও স্ত্রীকে বলে দেয় যে, তোমার মহরানার টাকা নাও এবং তারপর সে সেখান থেকে চলে আসে, তা হলে স্ত্রী সে টাকা নিক বা না নিক, মহরানা আদায় হয়ে যাবে। যদি সে টাকা সেখান থেকে অন্য কেউ  নেয়, তা হলে স্ত্রীর টাকাই যাবে। তবে যদি তা না নেয়ার কারণে স্বামী ফেরত নেয়, তা হলে তা স্বামীর কাছে আমানত হিসাবে থাকবে এবং স্বামী সে টাকার মালিক হবে।

 

মহরানার দেনা যাকাতের পথে বাধা নয়

             আরেকটি জ্ঞানগত ত্রুটি এই যে, কিছু লোক মহরানার দেনাকে যাকাত ওয়াজিব না হওয়ার কারণ হিসাবে দেখায়। ভাবে, এত টাকা ঋণী থাকায় তার জন্যে যাকাত ওয়াজিব নয়। যদিও এ মাসআলাটিতে মতভেদ রয়েছে, তথাপি সঠিক কথা হল, তা আদৌ যাকাতের পথে অন্তরায় নয়। পরিপূর্ণ মহর জিম্মায় থাকলেও তার যাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করা ওয়াজিব। তারপর যারা মহরানা আদায়ের নিয়তই রাখে না তাদের ক্ষেত্রে তো বাধা হবার প্রশ্নই ওঠে না। আদায়ে ইচ্ছুকদেরই যেখানে বাধা হচ্ছে না, সেখানে অনিচ্ছুকদের বাধার ভাবনাই নিরর্থক।

 

অনাদায়ী মহরানার যাকাত নেই

               এক্ষেত্রে আরেকটি জ্ঞানগত ত্রুটি রয়েছে, যা জনসাধারণ তো দূরের কথা বিশেষ ব্যক্তিরাও খেয়াল করেনা। তা এই যে, ব্যবসার মালামালে লগ্নি করা টাকা যা কর্জ হয়ে অপরের জিম্মায় রয়েছে, তাতে যেভাবে যাকাত ফরয হয়, তেমনি স্ত্রীর যে মহরানা স্বামীর জিম্মায় রয়েছে, তাতে যাকাত ফরয হবে না? এ নিয়ে কেউ কখনও কোন প্রশ্ন তুলছে না। অথচ এটাও তো এক ধরনের কর্জ। অবশ্য বিশেষ লোকদের ভেতর এখন এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাদের ভেতর যাদের ভালভাবে ব্যাপারটা জানা নেই, তারা তো ব্যবসায়ের কর্জের ওপর কেয়াস করে যাকাত ফরয ভেবে বসেছে। তারপর খেয়ালে এসেছে যে, এর ফলে তো সব মহরানাই শেষ হয়ে যাবে। তাই তারা একটি ভাল বুদ্ধি বের করেছে যে, তারা মহরানার টাকা তামার পাতে রূপান্তরিত করে নেয়, যার যাকাত দিতে হয় না। আমাদের গাও-গেরামে এ প্রচলনের এটাই মূলতত্ত্ব। আমি আমার ওস্তাদ মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকূব সাহেব থেকে এরূপ শুনেছি।

           তবে যারা অনুসন্ধ্যানী তারা ফেকাহর কিতাবের শরণাপন্ন হয়েছে। ফলে এটা জানা গেছে যে, কর্জ বা ব্যবসায়ের লগ্নি হল মজবুত কর্জ আর মহরানা আদায় হয়ে যতক্ষণ যাকাতের নির্ধারিত সময় পার না হয়, ততক্ষণ তাতে যাকাত ফরয হয় না। (দুররুল মুখতার)

             শেষ দুই মাসআলার সারকথা হল এই যে, মহরানার কর্জ যেমন স্বামীর যাকাত আদায়ের পথে বাধা হয় না, তেমনি তা আদায় না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর উপর যাকাত ফরয হয় না।(সংকলিত)