দেশে দেশে ইসলাম
নবী রাসূলগণের পুণ্য স্মৃতি বিজড়িত ফিলিস্তিনঃ সেদিন থেকে আজ
– নাসীম আরাফাত
=================================================
আবহমান কাল থেকে পূর্ণময়, প্রাচুর্যে ভরা ভূমধ্য সাগরের পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলটি ফিলিস্তিন নামে পরিচিত। ফিলিস্তিনের ধুলিবালি জানা-অজানা হাজারো নবী রাসুলের পদধূলিতে চির গর্বিত, চির উন্নত, অতি পবিত্র। ইউনানী ভাষায় ফিলিস্তিনকে প্যালেষ্টাইন (Palaistna) বলা হয়। আর হিব্রু ভাষায় বলা হয় পেলেষ্টহেট (Pleshet)। যার অর্থ ফিলিস্তিনীদের আবাস ভূমি। প্রাচীন কালে এখানে ইয়াহুদীয়া (Judaca) এবং সামেরীয়া (samaria) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইতিহাসের ধাপে ধাপে ফিলিস্তিনের রাজ্য সীমানা বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। মিশরের পূর্ব দক্ষিন সামুদ্রীক উপকূলীয় এলাকা ফিলিস্তিন (Philistia) নামে পরিচিত ছিলাে। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমক শাসিত ফিলিস্তিনের দক্ষিণাঞ্চলকে syria palestina বলা হতো। কালের বিবর্তনে বহু জাতি ফিলিস্তিনের নিকট পূর্বাঞ্চল (Near East) শাসন করেছে। মিসর, আসরীয়, ব্যাবিলন, পারস্য, রুম, ইউনান এবং বাইজাইনটাইনের সম্রাটরা বিভিন্ন সময়ে এ অঞ্চল শাসন করে। প্রাচীন কাল থেকে এ এলাকা নবী রাসূলের পূর্ণ ভূমি নামে পরিচিত।
প্রাচীন ইতিহাসঃ ফিলিস্তিনে মানব বসতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে আরব উপদ্বীপ থেকে কানানা গোত্র এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। তাদের গড়ে তোলা জনপদ কেনান নামে পরিচিতি লাভ করে। খৃষ্টপূর্ব ২,০০০ অব্দে ক্রীট থেকে ফিলিস্তাইন নামক এক গোত্র এখানে এসে গড়ে তোলে ফিলিস্তিয়া নামক জনপদ। ঠিক এই সময়ে ভূমধ্য সাগরের তীরবর্তি এলাকাগুলােতে লােহিত সাগরের উপকূলবর্তী থেকে আর একটি গোত্র এসে বসতি স্থাপন করে। এই এলাকাটি ফিনসিয়া নামে খ্যাতি লাভ করে। আরো পরে কানান, ফিলিস্তিয়া এবং ফিনসিয়া মিলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং উরুসালেম প্রধান শহরের মর্যাদা লাভ করে। উর অধিপতি নমরুদের হাতে নিগৃহীত হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ফিলিস্তিনে এসে তাওহীদের দাওয়াত প্রদানের কাজ শুরু করেন। তাঁর অন্যতম পুত্র ইসহাক (আঃ) এবং পৌত্র ইয়াকুব (আঃ) -এর কর্মক্ষেত্র ছিল এই ফিলিস্তিন। বহুকাল ধরে এ ভূখণ্ড তাওহীদবাদীদের দখলে থাকে। মিশরের ফেরাউন আহমোসের আমলে ফিলিস্তিনে মিশরী আগ্রাসন শুরু হয় এবং তাতমোসের শাসনকাল পর্যন্ত ফিলিস্তিন মিশরের অধীনে থকে। খৃষ্টপূর্ব ১৩৭৫ অব্দে মিশরের অধিপতি হন ফেরাউন আখনাতন। তার সময়ই ইউসুফ (আঃ) মিশরের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করেন। আখনাতন ছিলেন তাওহীদবাদী এবং উদারচেতা। তিনি বিজিত এলাকার প্রতি উদারনীতি গ্রহণ করেন। এই সুযোগে ফিলিস্তিন মিশর থেকে স্বাধীন হয়ে যায়। কিন্তু ফিরাউন রামোসিসের আমলে পূণরায় ফিলিস্তিনে মিশরী দখলদারিত্ব কায়েম হয়। এই রামোসিসের সময় মূসা (আঃ) মিশরে আবির্ভূত হন। ফিরাউন মিন ফাতাহর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি বনী ইয়াকুবকে নিয়ে লােহিত সাগরে পাড়ি দিয়ে ফিলিস্তিনে পৌছান। তাঁর পিছু ধাওয়া করে এসে মিন ফাতাহ সদলবলে নীল নদে ডুবে মরে।
খৃস্ট পুর্বে ৯৭০ অব্দে বনী ইয়াকুব জেরুজালম পুনরায় দখল করে নেয়। তালুত এর শাসনামলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজা জুলিয়েত ফিলিস্তিন আক্রমণ করলে তালূত তার বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করেন। যুদ্ধে কিশোের দাউদের (আঃ) হাতে জালুত বা জুলিয়েত মারা গেলে ফিলিস্তিন বাহিনী বিজয় লাভ করে। তালুতের পর তার জামাতা দাউদ (আঃ) ফিলিস্তিনের শাসক হন। তারপর তার উত্তরাধিকারী হন সুলায়মান (আঃ)! এ সময় ফিলিস্তিন ছিলাে পৃথিবীর শীর্ষতম উন্নত দেশ। খৃষ্টপূর্ব অব্দে গ্রীক বীর আলেকজাণ্ডার ফিলিস্তিন দখল করলে বহুদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিন গ্রীকদের দখলে থাকে। এরপর কিছুকাল ফিলিস্তিন স্বাধীন থাকার পর খৃষ্টপূর্ব ৬৪ অব্দে রোম সম্রাট পম্পি জেরুজালেম দখল করেন। রোম সম্রাট টাইবেরিয়াসের শাসনামলে হযরত ঈসা (আঃ) জেরুজালেমের তিন মাইল দক্ষিণে ‘ বাইতুল লাহাম ’ নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ইহুদী ধর্মের বিকৃতি দূর করার উদ্যোগ নিলে আল্লাহদ্রোহী ইহুদীরা তাকে বন্দী করে রোমান গভর্নর পটিয়াস পাইলাতের হাতে তুলে দেন। জেরুজালেমের শহরের বাইরে ক্যালভারী পাহাড়ে তাকে শূলিবিদ্ধ করে হত্যার আয়োজন করা হয়। এই মুহূর্তে আল্লাহ তাঁকে নিজ কুদরতে উর্ধ্বাকাশে তুলে নেন।
রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াসের শাসনামল পর্যন্ত ফিলিস্তিন রোমানদের দখলে ছিল। ৬৩৬ সালে মুসলিম সেনানায়ক খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ও আবু ওবায়দা (রাঃ) ফিলিস্তিন বিজয় করেন। ইসলামের ইতিহাসঃ হযরত উমর (রা) -এর খিলাফত কালে ১৬ বা ১৭ হিজরীতে বাইতুল মুকাদ্দাস বিজিত হয়। এরপর গোটা ফিলিস্তিন এলাকা মুসলমানদের দখলে চলে আসে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপি অপসংস্কৃতির মিথ্যা আকীদা বিশ্বাসের চির অবসান ঘটিয়ে সেখানে এক স্বর্গীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়। ফলে সুপ্রাচীন মনিব-দাস প্রথার দর্প চূর্ণ হয় এবং সকল মানুষ এক আল্লাহর দাস হয়ে যায়। তাঁর সময় শান্তি স্নিগ্ধ সমিরণ নেচে ফিরতে থাকে ফিলিস্তিনের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত।
হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ)-এর আমলে এসকন্দরীয়ান শহর বিজয়ের পর ফিলিস্তিনে মুসলমানদের অবস্থান দৃঢ় হয়। মুসলমান শাসকরা তাকে এক স্বতন্ত্র প্রদেশে ভাগ করে ফিলিস্তিনকে সীমান্ত সেনাপ্রদেশ হিসাবে অভিহিত করে। কায়সারিয়ার পরিবর্তে লাদকে প্রদেশিক শাসন কেন্দ্র নির্বাচিত করা হয়। এর আরো পর রামলাকে প্রাদেশিক কেন্দ্রীয় শহরে পরিণত করা হয়। সূলাইমান ইবনে আব্দুল মালেক ফিলিস্তিনের শাসক নিযুক্ত হলে রামলা ও লাদ এ উভয় শহরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। ৭৫০ হিজরীতে উমাইয়া খিলাফতের অবসান ঘটলে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন আব্বাসীয়দের করতলগত হয়ে যায়। নবম শতাব্দীতে আব্বাসীয়দের পতন ঘটলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয় এবং মিশরের শাসক তুলনী রুম ফিলিস্তিনসহ এক বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র কায়েম করে। এই রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতার সুযোগে ইসলামী বিশ্বে এক বিচ্ছিন্নবাদী ভ্রষ্ট চত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে, যাদের ধ্বংসাত্বক কার্যকলাপে মুসলিম জাতির মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। আব্বাসীয়রা পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ফিলিস্তিন ছিনিয়ে আনলেও তা আর বেশীদিন দখলে রাখতে পারেনি। ৯৬৯ হিজরীতে মিশরে ফাতেমীয়দের উত্থান ঘটে। তারা প্রভূত শক্তি সঞ্চয় করে মাত্র দশ বৎসরে ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নেয়।
এরপরই ফিলিস্তিনকে নিয়ে শুরু হয় ক্রুসেড যুদ্ধ। ১০৯৯ সালে ইউরোপীয়ান ক্রুসেডাররা ফাতেমীয়দের থেকে ফিলিস্তিনকে ছিনিয়ে নেয়। বাইতুল মুকাদ্দাস খৃষ্টানদের হাতে চলে যায়। খৃষ্টানরা ফিলিস্তিন শাসন করতে থাকে এবং মুসলমানদের ওপর চলতে থাক নির্যাতনের স্টীম রোলার। এই সময় মুসলিম বীর সেনানী সুলতান সালাউদ্দি আইয়ুবীর আবির্ভাব ঘটে। তার নেতৃত্বে ১১৭৪ সালের ৪ ঠা জুলাই হাত্তিনের লােমহর্ষক রক্তাক্ত যুদ্ধে খৃষ্টানদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্ত হয় খৃষ্টানদের বাহু থেকে। দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ধরে ফিলিস্তিনে আইয়ুবীদের ও অন্যান্য মুসলমান শাসকদের শাসন চলে। ১৫১৬ সালে প্রথম সালীমের শাসনামলে তা উসমানী খিলাফতের অধীনে চলে যায়। তুর্কী উসমানী ফিলাফতের প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লে ইউরোপীয় পদলেহী কিছু গাদ্দারের সহায়তায় জেরুজালেমে কয়েকটি কনসুলেট স্থাপিত ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানের অধিকাংশ ইয়াহুদী বসতি স্থাপন কারীরা ইয়াহুদী কলােনী স্থাপনের ছত্রছায়ায় বিশাল অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলে। ১৮৯৬ সালে থিয়ার্ড হার্জেল Perjudenstat নামক এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে স্বাধীন ইয়াহুদী রাষ্ট্রের বাস্তব পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অফ ন্যাশনের চুক্তির সুবাদে ফিলিস্তিন বৃটেনের করতলগত হয়ে পড়ে। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে বৃটেন ফিলিস্তিনে এক ইয়াহুদী রাষ্ট্র কায়েমের পথ উন্মুক্ত করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ ই মে ইসরাঈল রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। অথচ ১৯৪৭ সালে ২৯ শে নভেম্বর জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে দু’টি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছিলো যে, সেখানে ইয়াহুদী ও মুসলমানরা পৃথক পৃথক রাষ্ট্র কায়েম করবে। কিন্তু ইয়াহুদীরা এককভাবে, বেশী বলে ইসরাইলী রাষ্ট্রের ঘোষণা করে ৫০ শতাংশেরও বেশী এলাকা দখল করে নেয়।
ইসরাইল রাষ্ট্র কায়েমের পর মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চলতে থাকে। নির্যাতিত, নিপীড়িত মুসলমানরা মাথা গোজার ঠাই না পেয়ে পার্শ্ববর্তী মুসলিম রাষ্ট্রগুলােতে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। শুধুমাত্র ১৯৪৯ সালেই ৭২৬০০০ ফিলিস্তিনি মাতৃভূমি ছেড়ে অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলােতে আশ্রয় নেয়। ১৯৫০ সালে যদিও জর্দান তার জর্দান নদীর পশ্চিম তীর দখল করে নেয়, কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরাইল তা আবার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণাঃ ১৯৮৮ সালে বাদশাহ হোসেন হৃত পশ্চিম তীর থেকে তাঁর দাবী তুলে নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কায়েমে পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ৭ ই আগষ্ট নির্বাসিত ফিলিস্তিন সরকারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পূর্ণ সহায়তার কথা ঘোষণা করেন। ১৯৮৮ সালের ১৫ ই নভেম্বর আলজেরিয়ায় ফিলিস্তিন প্রবাসী জাতীয় কাউন্সিলের বৈঠকে স্বাধীন ফিলিস্তিন সরকার গঠন করা হয়, যা মুসলিম বিশ্বের সহায়তা ও সমর্থনে শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের পথ উন্মুক্ত হতে থাকে। সারা বিশ্ব মুসলিমের আশা ছিলাে, মুসলমানরা আবার তাদের প্রথম কেবলা ফিরে পাবে। মুসলিম বিশ্বে আবার জন্ম নিবে আরেক গাজী সালাউদ্দীন। ফিলিস্তিনের জনগণ যখন রক্তের নদী বইয়ে বন্দুর পথ অতিক্রম করে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য ছিনিয়ে আনতে অগ্রসর হচ্ছিলাে, যখন বাইতুল মুকাদ্দাসে নামায আদায়ের তীব্র আশা আকাংখায় বুক ফুলে উঠছিলাে তাদের ঠিক তখনই গাদ্দারের প্রেতাত্মারা আবির্ভূত হয়ে শান্তি চুক্তি নামে চির দাসত্বের চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এ বছরের ১৩ ই সেপ্টেম্বর।
*****