আমার দেশের চালচিত্র
মুরতাদদের পক্ষে ওদের নির্লজ্জ দালালী এবং
কতিপয় লেখকের কুরআন হাদীস অপব্যাখ্যার ধৃষ্টটা!!
আমাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়?
ফারুক হোসাইন খান
===================================================
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে কতিপয় কু-বুদ্ধিজীবী ধর্মদ্রোহী আইন পাশের বিরুদ্ধে ‘আদাজল’ খেয়ে দাপাদাপি, মাতামাতি করে বেড়াচ্ছে। এ আইনের বিপক্ষে উদ্ভট যুক্তির সয়লাব বইয়ে দিচ্ছে। তাদের যুক্তি তর্কের একটাই উদ্দেশ্য, এদেশে এ আইন পাশ করা যাবে না। এ আইন সাম্প্রদায়িক, খৃস্টানের কর্তৃক বর্বর যুগের প্রণীত। ইত্যাদি বে-আক্কেল ‘মার্কা’ আব্দার তুলে তারা ইসলাম ও ধর্ম চর্চার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য সমালোচনা করার ‘অধিকার’ নির্বিঘ্নে ভোগ করতে চাচ্ছে। এতার নাম নাকি মুক্ত বুদ্ধির অবাধ চর্চা। এ কুতর্কে দেশ, জাতি বা সমাজের লাভের বা উন্নতির ছিটোফোটা সম্ভাবনা নিহিত না থাকলেও তারা সকল আইন আদালতের উর্ধ্বে থেকে ধর্মের মুণ্ডপাত এবং কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত দেয়ার ‘যজ্ঞটি’ পালনে নানার বাড়ীর আব্দার জানাচ্ছে। এটা তাদের করতে না দিলে নাকি তাদের মানবাধিকার লংঘন করা হবে, তাদের প্রতি করা হবে মধ্যযুগীয় বর্বর আচরণ। এসব বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, কু-চিন্তায় পারদর্শিতা। অর্থ্যাৎ এরা কু-চিন্তা-চেতনায় এক একজন একেক রকমের বিশেষজ্ঞ। এজন্য এদের “কু-বাদী বুদ্ধিজীবী” ও বলা যেতে পারে। আমাদের গৃহপালিত বিশেষ হিংস্র প্রাণীটিকে আমরা যতই ঘৃণিত এবং নিকৃষ্ট মনে করি না কেন তার সাথে তুলনা করলে এসব পণ্ডিতদেরও মন হয় না। গৃহপালিত প্রাণিটি মনিবের বাড়ীতে চোর ঢুকলেও ঘেউ ঘেউ করে ওঠে তদ্রূপ মনিবের হিতাকাংখী কোন অপরিচিত ব্যক্তি আসলেও ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। অথ্যাৎ ভাল-মন্দ কোনটাই তার পছন্দ নয়। কিন্তু আমাদের কু-বাদী বিশেষজ্ঞরা ইসলামের স্বার্থ জড়িত কোন ভাল প্রস্তাবের কথা ইসলাম পন্থী কোন মহল থেকে ওঠলে বুঝুক আর না বুঝুক তার মধ্যে ‘কু’ অর্থ্যাৎ খারাপ আবিষ্কার করবেই। পক্ষান্তরে ইসলামের ওপর কোন আঘাত কোন মহল থেকে আসলে তাকে যেভাবেই হোক সমর্থন করবেই। অর্থ্যাৎ তারা ইসলামের কোন ভাল হলে তার বিপক্ষে আর খারাপ বা ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে তা পক্ষে। এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কু-বাদীরা ‘জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আদর্শিক মুল্যবোধ সুরক্ষা আইন’ পাশের দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বিপক্ষে আবস্থান নেয়। জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য উদ্ভট প্রচারণায় মেতে ওঠে। কু-বাদীরা চিহ্নিত পত্র পত্রিকায় এই দাবীর বিপক্ষে বিভিন্ন কায়দায়, বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীতে এত কলাম, নিবন্ধের স্রোত বইয়ে দিয়েছে যে, তিক্ষ্ণ বিবেচনা বোধের অভাব থাকলে যে কোন ব্যক্তি বিভ্রান্তির এ মহাস্রোতে তলিয়ে যেতে বাধ্য। অথচ যুক্তির কষ্ঠিপাথরে এর প্রতিটি কলাম, নিবন্ধ বালখিল্য সুলভ এবং উদ্ভট কথামালা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলাম বিদ্বেষী এই কু-বাদীদের প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করতে গেলে মিনি-মহাগ্রন্থ রচনা ছাড়া উপায় নেই। তাই সে পথ পরিহার করে দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের মূল হোতা ‘স্বাতন্ত্র্য ও নিরপেক্ষতায় সচেষ্ট’ তকমাধারী দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কতিপয় অন্যতম জধন্য ও ভিত্তিহীন প্রোপাগাণ্ডার স্বরূপ এখানে বিধৃত করা হল।
১। ধর্মদ্রোহী আইন পাশের বিপক্ষে ঐ পত্রিকা মারফত কয়েকজন আইনজীবির ভিন্ন ভিন্ন ভাবে মুল্যবান বয়ান পেয়েছি। এই আইনজীবী পালের অন্যতম হলেন তথাকথিত মৌলবাদ বিরোধী শক্তিমান ক্রসেডার প্রখ্যাত আইনব্যবসায়ী ডঃ কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যরিষ্টার সারা হোসেন। তাদের সুরে সুরে মিলিয়ে প্রবন্ধ ফেদেছেন জাদরেল বামপন্থী নেতা রাশেদ খান মেনন। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় হালুয়া রুটি উপার্জনকারী এটর্নি জেনারেল সাহেব এবং তার সহকর্মীও বিস্ময়কর ভাবে এ দলে ভিড়েছেন। তারা সবাই ধর্মদ্রোহী আইন পাশের বিরুদ্ধে ক্রসেড ঘোষণা করতে গিয়ে যা বলেছেন,তার সারমর্ম হল “এ আইন ইসলামী ভাবাদর্শ, মানবাধিকার ও সংবিধানের সম্পূর্ণ বিরোধী। এই আইন পাশ হলে দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধি পাবে। এই আইন পাশ হলে তা’ অপব্যবহার করে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার, শত্রুতা সাধন, হত্যা ও অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, মুক্ত বুদ্ধি চর্চার পথ বন্ধ হবে, ধর্মের প্রসঙ্গে কোন কথা বললেই তাকে অপব্যাখ্যা করে ধর্মদ্রোহী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া যাবে। এই আইন খৃস্ট জগতের এক অন্ধকার সময়ে প্রণীত। মধ্যযুগে খৃস্টান রাজা ও পাদ্রীরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ রাখারা জন্য এই বর্বর আইন পাশ করেছিল। সুতরাং এ দেশে এই আইন পাশ হলে মোল্লারা পাদ্রীদের ন্যায় সংখ্যালঘু এবং সমাজের প্রগতিবাদীদের ওপর নির্যাতন চালাবে অর্থ্যাৎ এই এইন সাম্প্রদাইকতা ও সমাজ শোষণের হাতিয়ার হবে। সর্বোপরি এই আইন ইহুদী খৃস্টানদের প্রণীত। তাই এ আইন প্রতিহত করতে হবে। ইত্যাদি।“ [সূত্রের জন্য দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত ২৭,২৯,১৯,৩০শে জুলাই এবং ৫.৮.৪,১৫,১৭,১৯শে আগস্ট সংখ্যাসমূহে প্রকাশিত ব্লাসফেমী সংক্রান্ত নিবন্ধ ও বিবৃতিসমূহ দেখা যেতে পারে।]
তাদের উদ্ভট যুক্তি সমূহ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ধর্মদ্রোহী আইন যদি খৃস্ট জগতে অন্ধকার সময়ে এবং বর্বরতা করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়ে থাকে তবে এই যুক্তি প্রদর্শনকারী আইনজীবী এবং বুদ্ধিজীবীরাও সেই বর্বর চরিত্রের পাদ্রীদের চেয়েও বর্বর এবং সাম্প্রদায়িক। কেননা গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে কথিত বৃটেন এবং সভ্য ইউরোপের আরও বহু দেশ এখনও এই বর্বর এবং অন্ধযুগের আইন নিজেদের সংবিধানে স্থান দিয়ে রেখেছে, বাতিল করেনি। অর্থ্যাৎ তারা এবং অন্ধযুগের আইন নিজেদের সংবিধানে স্থান দিয়ে রেখেছেন, বাতিল করেনি। অর্থ্যাৎ তারা বর্বরতাকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদেরও বর্বর প্রমাণ করছে। এই জ্ঞান-বিজ্ঞানময় আধুনিক সভ্য যুগে সব কিছু জেনে শুনেও আমাদের গুণধর আইনজীবীরা সেই বর্বরদের তৈরী আইন শাস্ত্র অধ্যায়ন করেই আইনজীবী হয়েছেন, তারা সভ্য মানুষদের প্রণয়ন করা বিদ্যা অর্জন করেননি। অতএব জেনে শুনেও যারা বর্বর বিধ্যা অর্জন করেন তারা নিশ্চয়ই আরও নিকৃষ্ট বর্বর। এই বর্বর জ্ঞানের দ্বারা আচ্ছন্ন ব্যক্তিরা যে অন্যান্য যুক্তি সমূহ ফেঁদেছেন তাও বর্বরতা থেকে মুক্ত নয়। প্রথমত, এই আইনকে মানবাধিকার ও ইসলামী ভাবাদর্শের বিপক্ষে বলা হয়েছে। এই আইন ইসলামী আদর্শের পক্ষে না বিপক্ষে তা নিবন্ধের শেষে প্রমাণ করা হবে। তবে এ আইন কিভাবে মানবাধিকার লংঘন করবে তা’ কিন্তু ওনারা বলেননি। অযৌক্তিকভাবে কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা, আল্লাহ্ ও রাসূল (ﷺ) কে কটাক্ষ করা মানবাধিকারের কোন সংজ্ঞায় পরে এতে করে জাতি ও দেশের কতখানি উন্নয়ন ঘটে তার একটা পরিসংখ্যান দিলে তারা ভালই করতেন। দ্বিতীয়তঃ ওনারা বলেছে, এই আইনের মাধ্যমে নাকি সাম্প্রদায়িকতা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার ও শত্রুতা বৃদ্ধি পাবে। উদাহরণ স্বরূপ প্রত্যেক নিবন্ধে পাকিস্তানের কতিপয় বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে বড় করে দেখানো হয়েছে। অথচ ইংল্যাণ্ডে ব্লাসফেমীর আওতায় শুধুমাত্র খৃস্টধর্ম সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। সংখ্যালঘু মুসলমান, ইহুদী বা হিন্দুদের ধর্মের আদর্শ সুরক্ষার জন্য কোন ব্যবস্থা নেই। অর্থ্যাৎ কোন সংখ্যালঘু খৃস্টধর্মের সমালোচনা করলে তাকে সাজা দেয়া যাবে অথচ কোন খৃস্টান সংখ্যালঘুদের ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করলেও তার কোন বিচার করা হবে না-আইন না থাকার অজুহাতে। ইংল্যান্ড কুখ্যাত ইসলাম বিদ্বেষী সালমান রুশদীকে আশ্রয় দিয়ে তার বিচার হওয়াকে ঠেকিয়ে রেখেছে। এটা ইংল্যাণ্ডের দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলমানদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ভাবে মানবাধিকার লংঘনের একটা দৃষ্টান্ত বটে। কিন্তু এদেশের তথাকথিত মানবাধিকারের ‘পাণ্ডাদের’ দৃষ্টি সেদিকে যায় না। এদেশের ধর্মদ্রোহী আইন পাশের দাবীদাররা একমাত্র ইসলামের ওপর আঘাত হানা হলেও শুধু ইসলাম ধর্মের আদর্শ সুরক্ষার জন্য তারা এ আইন পাশের দাবী জানাননি। তারা সকল ধর্মের সুরক্ষার জন্য নয়া আইন পাশের দাবী জানিয়েছেন। ফলে বৃটেনে যেভাবে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার লংঘিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে এ দেশে সে সুযোগ থাকার উপায় নেই। কিন্তু তার পরও কুবুদ্ধিজীবীরা এর মধ্যে ‘কূ’ আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তারা এই আইনকে আগুন নিয়ে খেলা এবং একে সচেতন মানুষ মাত্রি প্রতিহত করার নসিহত করেছেন পাকিস্তানের ব্লাসফেমী আইনের কথিত কতিপয় অপব্যবহারের ঘটনাকে মূলধন করে। তাদের রেষারেষির ফলশ্রুতিতে কতিপয় শিক্ষক কর্তৃক একজন খৃস্টান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমীর অভিযোগ আনা এবং তাকে হত্যা করা। পানির কল নিয়ে এজ খৃস্টান ও তার মুসলমান প্রতিবেশীর ঝগড়ার ফলশ্রুতিতে ব্লাসফেমীর অভিযোগ এনে খৃস্টান প্রতিবেশীকে হয়রানি করা। এক দোকানীর সাথে এক খৃস্টানের লেনদেন সংক্রান্ত ঝগড়া এবং ব্লাসফেমীর মিথ্যা অভিযোগ এনে খৃস্টানকে আদালতে হাজির করা। এছাড়াও তারা উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানের পুলিশ নাকি কথিত ধর্মান্ধদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে ব্লাসফেমীর মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়। এ ছারাও প্রভাবশালী আমলা ও রাজনীতিকরাও নাকি প্রতিপক্ষকে জব্ধ করার জন্য এ আইনের অপব্যবহার করছে। অতপর এসব ঘটনার ফিরিস্তি দিয়ে যৌথভাবে ব্যরিষ্টার সারা হোসেন ও হাসান মির্জা সাহেব ১৭ জুলাই, জনকণ্ঠে প্রকাশিত তাদের নিবন্ধের এক স্থানে বলেছেন, ‘প্রস্তাবিত আইনটি এতই অনির্দিষ্ট যে, যে কোন বক্তব্যকে পবিত্র কুরআন ও নবী (ﷺ) সম্পর্কে অবমাননাকর বলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে। অভিযোগকারীর খেয়াল খুশিকে এই আইন সহজেই প্রশ্রয় দেবে।“ তাদের এহেন অর্বাচীনের ন্যায় বক্তব্যে মনে হয়, এরা আইনজীবী দাবী করলেও আইনের ‘অ’ অক্ষরও জানেন না এবং আদালতের প্রতি কোন শ্রদ্ধাবোধও এদের নেই। প্রথমত এরা যে আইনটিকে অনির্দিষ্ট এবং অভিযোগকারীর খেয়াল খুশি মাফিক ব্যবহারের আতঙ্কে ভুগছেন সেই আইনটি কিন্তু এখনও পাশতো দূরের কথা তৈরীও করা হয়নি। এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র যুগোপযোগী একটি আইন প্রণয়নের দাবী জানানো হয়েছে মাত্র এবং যা’ এখনও বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি তাকে ‘অনির্দিষ্ট’ এবং ‘অপব্যবহারে’ দোষে দোষী করা হল কোন উদ্দেশ্যে? মাথায় কুচিন্তা ভর করলেই এমনটি হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গুণধর আইনজীবীরা আদালতের বিজ্ঞতার প্রতি ভয়ঙ্কর উক্তি করেছেন। এ আইনটি পাশ হলে নাকি প্রশ্রয় দেয়া হবে। এ আইনজীবীগণ কি মনে করেন, কোন বক্তব্য ধর্মের অবমাননাকর আর কনটা অবমাননাকর নয় আদালতের সে পার্থক্যটুকুও বোঝার মুরোদ নেই। বিচারকগণ যদি এতটুকু বিজ্ঞ না হন তবে তারা কিভাবে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ করে অপরাধীর বিচার করেন। তারা কি এতই পক্ষপাতের দোষে দোষী যে স্বাক্ষ-প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগকারীর অভিযোগ অনুযায়ী বিচার করে ফেলবেন? এই মতলববাজ আইন ব্যবসায়ীরা বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে আরও একটি চটুল মন্তব্য করেছেন যা যে কোন মানুষের কৌতুক উদ্বেগ করতে যথেষ্ট বই কি। তারা বলেছেন, “এ আইনের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা যাবে, শত্রু দমন এবং ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করা যাবে। অতএব এ আশঙ্কা দূর করার জন্য এ আইন প্রতিহত করতে হবে।” ওনারা ইসলাম বিরোধী ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কতখানি ছেলে মানুসি পারেন নি। বুঝতে পারেন নি, ওনাদের দাবী যে পুরো বিচার ব্যবস্থাকে অসার প্রমাণ করে, আইন ব্যবসাকেই একই অপরাধে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আমরা জানি, আদালতে কোন অপরাধে প্রমাণ করতে স্বাক্ষী, স্বাক্ষ-প্রমাণের দরকার হয়। মিথ্যা সাক্ষী দাড় করিয়ে এবং বিজ্ঞ উকিলের যুক্তির তোরে কোন নিরীহ ব্যক্তিকে যেমন ডাকাত প্রমাণ করা যায় আবার কুখ্যাত ডাকাতকে নির্দোষ প্রমাণ করাও সম্ভব। দেশে-বিদেশে এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। তাই বলে এর দ্বারা আইনের এই যে অপব্যবহার হচ্ছে এর জন্য কি ডাকাতীর সাজা সংক্রান্ত বিধানটি তুলে দিতে হবে না এই আইনটি প্রতিহত করার জন্য উস্কানীমূলক নিবন্ধ ফাঁদতে হবে? যে আইনটি পাশ করার দাবী হচ্ছে সেটির আলোকে বিচারকরাই বিচার করবে অন্যান্য অপরাধের ন্যায় পুলিশি তদন্ত, স্বাক্ষ্য প্রমাণের ওপর নির্ভর করেই। জনগণের নিজেদের হাতে আইন তুলে দিতে হবে বা তারা নিজেরাই যে বিচার করবে তাতো বলা হয়নি। বরং এমনটি কেউ করলে সে আইনের দৃষ্টিতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিধান করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। দু’একটি অপব্যবহারের ঘটনার আশঙ্কায় কোটি কোটি মানুষকে গুটিকতেক অপরাধীর শিকারে পরিণত করার রাস্তা খোলা রাখার জন্য সারা হোসেনরা ‘মালকোচা’ দিয়ে নেমেছেন কেন? বলি, উদ্দেশ্যটা কি?
(২) উক্ত পত্রিকার মাধ্যমে ধর্মদ্রোহী আইনের বিরুদ্ধে যারা কলমবাজী করেছেন তাদের মধ্যে আলেম খেতাবধারী ‘ত্রি-রত্ন’ও সামিল হয়েছেন। এরা কুরাআনের আয়াত, হাদীস উল্লেখ করে তাদের মতলবী যুক্তি পাকা করতেও কম কোশেশ করেননি। পূর্বে উল্লেখিত জনকণ্ঠের সংখ্যাসমূহে মাওলানা আব্দুল আউয়াল, সাদ উল্লাহ ও হাফেজ জিয়াউল হাসান জিয়া প্রমুখের রচিত নিবন্ধ সমূহ পড়লে মনে হয়, ওনারাই যেন ইসলামের বিধি-বিধানের যুগশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার। যারা ধর্মের আদর্শ সুরক্ষার জন্য আইন পাশের দাবী করছেন তারা ওনাদের জ্ঞানের তুলনায় নস্যি। তারা আজীবন কুরআন, হাদীস চর্চা করে এখন কুরআন হাদীসের অপব্যাখ্যা করছে আর উনাদের ব্যাখ্যাই সর্বজনগ্রাহ্য। এই যুগশ্রেষ্ঠ (!) ব্যাখ্যাকার মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেব ২৭শে জুলাই ‘ব্লাসফেমী খৃস্ট ধর্মযাজকদের ইসলাম বিরোধী আইন’ শিরোণামে এক বিশাল নিবন্ধের জন্ম দিয়েছেন। সাদ উল্লাহ সাহেবও ‘ইসলাম ও আমরা’ শিরোণামে প্রতি শুক্রবার মাওলানা সাহেবের সুর প্রতিধ্বনি করছেন সিরিজ নিবন্ধে। ইনিয়ে বিনিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধের মাধ্যমে এরা বলতে চেয়েছেন যে, ব্লাসফেমী আইন ইহুদী-খৃস্টানদের প্রণীত, এটা ইসলাম বিরোধী। এই আইন প্রণয়ণের দাবি করে তথাকথিত ফতোয়াবাজরা ইহুদি-খৃস্টানদের অনুসরণ করছে। অতঃপর তাদের যুক্তিকে মজবুত করতে অবতারণা করছে একটি হাদীসঃ “শেষ যুগে আমার উম্মতের লোকেরা ইহুদী-খৃস্টানদের অনুসরণ করবে।“ মাওলানা সাহেবের মাথায়ও যদি কু-চিন্তা প্রশ্রয় নিতে না পারত তবে তিনিও জানতেন, তিনি যে সাম্প্রদায়িকতা মনে লালন করেন তার কোন স্থান ইসলামে নেই। ইসলাম ইসলাম মুসলমানদেরকে অমুসলিমিদেরও কোন ভাল কাজকে গ্রহণ করতে বারণ করেনা। বাঁধা দেয় না। তা ছাড়া ব্লাসফেমী শব্দটাকে আমাদের দেশে ধর্মীয় আদর্শ সুরক্ষার উপযোগী আইন প্রণয়নের দাবী জানাতে ‘রূপক’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। যেহেতু ইংল্যাণ্ডে এ ধরণের আইন চালু আছে, উদাহরণ হিসেবে অনুরূপ আইন আমাদের দেশেও প্রণয়নের দাবী করা হয়েছে মাত্র, ইংল্যাণ্ডের ব্লাসফেমী আইনকে হুবহু গ্রহণ করার দাবী করা হয়নি। তাছাড়া এদেশের সকল ধর্মের আদর্শ সুরক্ষার জন্য ইংল্যাণ্ডের প্রণীত একমাত্র খৃস্টান ধর্মের আদর্শ সুরক্ষার ব্লাসফেমী আইন এদেশে চালু করার মত মুর্খের ন্যায় দাবি নিশ্চয় কেউ করেনি। কিন্তু তা জেনে শুনেও আউয়াল সাহেবরা এর মধ্যে ‘অনুসরণ করার’ মতলব আবিষ্কার করে ফেলেছেন। খুঁজে পেয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার রসদ। বেশ তো ব্লাসফেমী আইন ইহুদী, খৃস্টানদের মস্তিস্ক প্রসূত বলে এর অনুরূপ কোন আইন প্রণয়নও ইসলাম বিরোধী বলে আউয়াল সাহেবদের ন্যায় মহা ইসলাম দরদীরা যে বুঝতে পেরেছেন এজন্য তারা বাহবা পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু ৯০% মুসলমানদের দেশের সংবিধানখানা যে প্রো-বৃটিশ সংবিধান, এ দেশের বিচার ব্যবস্থা যে ইহুদী-খৃস্টান ইংরেজদের প্রণীত আইন অনুযায়ী চলছে সে খবর কি আউয়াল সাহেবরা রাখেন? রাখলে ইসলামের এতবড় অবমাননা সহ্য করছেন কিভাবে? ইহুদী খৃস্টানদের এসব জঞ্জাল সরিয়ে সবকিছু ইসলামী করণের জন্য হুঙ্কার ছাড়ছেন না কেন? আমাদের মত ইসলাম দরদীদের খৃস্টান আইনে শাসিত হওয়া কি শোভা পায়? তাও কিনা নীরবে মেনে নিচ্ছেন! ছিঃ মোনাফেকী হয়ে যাচ্ছে না! আসুন আজ থেকে খৃস্টান ইহুদীদের উদ্ভাবিত আইন শাস্ত্র, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সবকিছু পরিত্যাগ করুন, জাতিকে পরিত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করতে আন্দলন গড়েতুলুন। আমরা জানি, মানুষের ক্রোধে উন্মাদ হলে সাধারণ বিবেচনা বোধটুকুও হারিয়ে ফেলে, তখন সে প্রলাপ বকে। ধর্মদ্রোহী আইনের দাবীদারদের বিরুদ্ধে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে কতিপয় ‘মাওলানা’ ও ‘হাফেজ’ খেতাবধারীরা তার কিছুটা প্রমাণ রেখেছেন বটে। তারা নিবন্ধের বিভিন্ন স্থানে দেশের গণ্যমান্য আলেম ও পীর মাশায়েখদের ক্ষমতালোভী এবং এই আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ্র হুশিয়ারী সংক্রান্ত আয়াতও উদ্ধৃত করেছেন। বলি, আলেমরা ক্ষমতালোভী হলো কোন যুক্তিতে, তারা কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে কোন আন্দোলন করছে তারা কি রাজনৈতিক অবস্থাকে ঘোলাটে করার জন্য সংসদ অচল করে রেখেছে? যখন দেশে ঘন ঘন হরতাল ডেকে জনজীবনে দুর্ভোগ ডেকে আনা হয়, ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অচল করে দেয়া হয় তখন এসুব সমাজপ্রেমীগণ কোথায় লুকিয়ে থাকেন? কেন তখন আল্লাহ্র হুশিয়ারী বাণী তাদের উদ্দেশ্যে বর্ষণ করেন না?
আউয়াল সাহেবরা কুরআন হাদীস এবং রাসূল (ﷺ)-এর জীবনীতিহাস নিয়েও ‘জঘন্য’ একপেশে মন্তব্য করেছেন। ‘হাফেজ’ এবং ‘মাওলানার’ দাবীদার হয়েও তারা কুরআন, হাদীস নিয়ে যে ঘৃণ্য খেলা খেলছেন তাতে মনে হয়, কুরান-হাদীসের অপব্যাখ্যা এবং কু-যুক্তিকে পাকাপোক্ত করতে কুরআনের আয়াত এবং হাদীস ব্যবহারের বিদ্যাটি তারা দক্ষতার সাথে রপ্ত করতে পেরেছেন বএই তাদের সমমনা লোকেরা সংশ্লিষ্ট বিদ্যায় তাদের ‘মাওলানা’ ও ‘হাফেজ’ আখ্যা দিয়েছেন। তারা ধর্মদ্রোহীদের কোন শাস্তির বিধান কুরআন হাদীসে নেই বা রাসূল (ﷺ)-এর যুগেও এমন কোন ঘটনা ঘটেনি এটা প্রমাণ করতে গিয়েও আশ্রয় নিয়েছেন প্রতারণার ও ইতিহাস বিকৃতির। মুরতাদের শাস্তি আল্লাহ্ দেবেন, মানুষ তাদের বিচার করতে পারবে না। অর্থ্যাৎ মুরতাদকে জাগতিক কোন শাস্তি দেয়া যাবে না তা প্রমাণ করতে গিয়ে আব্দুল আউয়াল সাহেবরা যে কয়টি আয়াত উল্লেখ করেছেন তা’ অপ্রাসঙ্গিক এবং স্বভাবগতভাবে চরম অপব্যাখ্যার সামিল। যে আয়াতে কাফিরদের সতর্ক করে তাদের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ্র হুশিয়ারী রয়েছে তাকে ব্যবহার করেছেন মুরতাদের প্রসঙ্গে। আবার যে আয়াত মোনাফেকদের সতর্ক করে নাজিল হয়েছে তা ব্যবহার করেছেন মুরতাদদের প্রসঙ্গে। যেমন ধরা যাক। দৈনিক জনকণ্ঠে প্রাকাশিত মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেবের “মুরতাদদের শাস্তির নামে একাত্তরের বদলা নেয়ার পায়তারা” শিরোণামের প্রবন্ধটির কথা। [পত্রিকা কাটিংয়ের সময় ভুলবশত নিবন্ধ প্রকাশের তারিখ সংরক্ষণ করা হয়নি। সম্ভবত জুন মাসের শেষে অথবা জুলাইর প্রতমার্ধে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।] নিবন্ধে এ প্রসঙ্গে ৪টি আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে। এই লেখকেরই ২৭শে জুলাই-র আর এক নিবন্ধে উল্লেখিত আয়াতের ৩টি এবং নতুন দুটি আয়াতের উল্লেখ রয়েছে। আয়াতগুলি হল ২:২৫৬/ ১৮:২৯ / ১৬:২৯ / ৪:১৪০ / ৪:১৩৭ / ৬:১০৮। এই প্রত্যেকটি আয়াতের সুনিপুন ভাবে অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। আমরা এখানে দু’টি নমুনা ধরছি। মাওলানা সাহেব প্রথম প্রবন্ধে সূরা নিসার ১৩৭ নং আয়াত, “যারা বিশ্বাস করে ও পরে সত্য প্রত্যাখ্যান করে অতঃপর তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ্ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোন পথও দেখাবেন না” উল্লেখ করেছেন। আয়াতের ভুমিকায় তিনি বলেছেন, “বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মগ্রহণ এবং বর্জনের ব্যাপার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এ ব্যাপার কোন প্রকার জোর জবরদস্তি নেই এবং জাগতিক শাস্তি ইসলাম অনুমোদন করে না, “পরে আয়াতের ব্যাখ্যা করে তিনি বলেছেন, “কেউ একবার ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন অস্বীকার করলেই মুরতাদ হয়ে যায়। মুরতাদের জাগতিক শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হলে পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতে একাধিকবার ধর্মগ্রহণ-বর্জনের যে অধিকার বা স্বাধীনতা আল্লাহ্ মানুষকে দিয়েছেন তা’ ক্ষুণ্ন হবে। ফতোয়াবাজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে মুরতাদদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কুরআন বিরোধী দাবী কোন মুসলমানই মেনে নিতে পারে না।“ মাওলানা সাহেব এ অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মুরতাদদের ধর্মদ্রোহী আচরণ করার অবাধ লাইসেন্স দেয়ারই ব্যর্থ কসরত করেছেন। আসল ঘটনা কিন্তু তা’ নয়। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে আয়াতটি অভিশপ্ত ইহুদীদের সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে। প্রথমে তারা মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান এনে তারপর সত্য প্রত্যাখ্যান করে গো-পূজা করে কাফের হয়। অতঃপর তওবা করে আবার ঈমান আনে। পুণরায় হযরত ঈসা (আঃ)-কে অস্বীকার করে কুফরের চরম সীমায় উপনীত হয়। আয়াতের শেষে এই অভিশপ্ত ইহুদীদের ‘চরম কুফরের সীমায় পৌঁছার দরুন’ তাদের আর কখনও ক্ষমা বা সুপথ না দেখানোর আল্লাহ্র ওয়াদা ব্যক্ত হয়েছে। তা’ ছাড়া মাওলানা সাহেব তার ব্যাখ্যায় “উপরোক্ত আয়াতে একাধিকবার ধর্ম গ্রহণ বর্জনের যে অধিকার বা স্বাধীনতা আল্লাহ্ মানুষকে দিয়েছেন” বলে আবিষ্কার করেছেন তাও তার বিকৃত চিন্তা চেতনার ফসল। এ আয়াতের মাধ্যমে মুরতাদদের বার বার ধর্ম গ্রহণের বা বর্জনের কোন অধিকার দেয়া হয়নি। বরং এর মাধ্যমে আল্লাহ্ রাসূল (ﷺ)-কে ইহুদীদেরকে তাদের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে বলেছেন। তিনি যদি এর পরের আয়াতটির প্রতি দৃষ্টি দিতেন তবে এ অপব্যাখ্যা করার দুঃসাহস হয়ত কিছুটা কম হত। পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, “সেসব মুনাফিকদের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন যে, তাদের রয়েছে বেদনাদায়ক আযাব।“
মাওলানা সাহেব ২৭শে জুলাইর নিবন্ধের একস্থানে মন্তব্য করেছেন, “যারা ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ কিংবা আল্লাহ্র শাস্তি দেবেন। ইহজগতে এই অপরাধের বিচার করার অধিকার আল্লাহ্ কোন মানুষকে দেননি।“ এর পর উল্লেখিত হয়েছে সূরা নিসার ১৪০ আয়াত, “যখন তোমরা শুনবে আল্লাহ্র কোন আয়াতকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে আয়াতকে অস্বীকার করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে বিদ্রুপ করা হচ্ছে তখন তোমরা এদের সঙ্গ পরিত্যাগ কর, যতক্ষণ না তারা এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে ফিরে না আসে। অন্যথায় তোমরাও তাদের দলের বলে গণ্য হবে। আল্লাহ্ মুনাফেক ও সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের দোজখে একত্র করবেন।“ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, “যারা ধর্মের নিন্দা বা আল্লাহ্র আয়াত নিয়ে বিদ্রুপ করে তাদের সাথে মেলামেশা ছেড়ে দিতে হবে। তবে সেটা সব সময়ের জন্য নয়, শুধু নিন্দা বা বিদ্রুপকালীন সময়ের জন্য। এই সাময়িক মেলামেশা বন্ধ রাখাটাই উক্ত নিন্দাকারীর ও বিদ্রুপকারীর ইহজাগতিক শাস্তি। সেটাও আল্লাহ্ নির্ধারণ করে দিয়েছেন পরকালে তার শাস্তি হচ্ছে নরকবাস।“
এই আয়াতের আলোকে তিনি “শুধু নিন্দা বিদ্রুপকালীন সময়ে” সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বা মুরতাদের সাথে মেলামেশা বন্ধ রাখার একমাত্র ইহজাগতিক শাস্তির যে ফতোয়া ঘোষণা করেছেন এটাও তার একান্ত মনগড়া কথা। কেননা এই আয়াতটি নাজিল হওয়ার পটভূমি এবং মুল উদ্দেশ্যের সাথে মুরতাদ বা তাদের শাস্তির বিধানের কোনই সম্পর্ক নেই। অভিজ্ঞ তাফসিরকারগণের মতে, এ আয়াতে ইতিপূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ সূরা আনআমের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে সূরায় মুসলমানদের কাফের ও বদকারদের ধারে কাছেও বসতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তিতে সে নিষেধ অমান্য করে কতিপয় মুসলিম নামধারী মুনাফিক মক্কার কুরাইশদের বড় বড় কাফের নেতাদের ইজ্জত সম্মানের মালিক মোখতার মনে করে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল (ﷺ)-এর মদীনা জীবনে আল্লাহ্ মুনাফিক ও মুসলমানদের সতর্ক করে কোন পরিস্থিতিতে কাফিরদের সাথে মেলামেশা বৈধ হবে তার নয়া রূপরেখা স্বরূপ এ আয়াত নাজিল করেন। এ আয়াত মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে এই বলে যে, কাফিরদের যে মজলিসে ইসলাম ধর্ম বা আল্লাহ্র কোন আয়াত নিয়ে বিদ্রুপ করা হয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এমন গর্হিত কাজ চলতে থাকে ততক্ষণ তাদের মজলিশে বসা বা যোগদান করা হারাম। যদি কেউ হৃষ্টচিত্তে সে মজলিশে উপস্থিত থাকে বা তাদের কুফরী কাজ পছন্দ করে তবে সেও কাফিরদের সমতুল্য বলে গণ্য হবে। অর্থ্যাৎ সে কাফিরদের সমান গনাহগার হবে এবং আয়াতের শেষের অংশে বলা হয়েছে, জাহান্নামে কাফিরদের সাথেই তাদের একত্রিত করা হবে।‘ আয়াতের শেষের অংশে আরবী শব্দ ‘মুনাফিকিনা’ এবং ‘কাফিরিনা’ ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ মাওলানা সাহেব তার অনুবাদে ‘মোনাফেক’ এবং ‘সত্য প্রত্যাখ্যানকারী’ উল্লেখ করে মোনাফেকদের সাথে মুরতাদদের জাহান্নামে একত্রিত করার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অথচ আয়াতে ‘কাফির’ শব্দ ব্যবহার করে জাহান্নামে মক্কার কুরাইশ কাফেরদের নেতাদের (যারা কখনই ইসলাম গ্রহণ করেনি, যাদের বেলায় মুরতাদ হওয়া প্রশ্নই অবান্তর) ন্যায় কাফেরদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী আল্লাহ্র হুকুম অমান্য করে মুনাফিক হিসেবে গণ্য মুখোশধারী মুসলমানদের একত্রে শান্তি দেয়ার সতর্কবাণী উল্লেখিত হয়েছে। অথচ, তিনি এ স্পষ্ট আয়াতটিকে অপব্যবহার করলেন মুরতাদের রক্ষা কব্জ হিসেবে। এমনি করে তিনি উল্লেখিত সবক’টি আয়াতের অপব্যাখ্যা করেছেন মুরতাদদের রক্ষা কবজ হিসেবে। এর পরই তিনি বিশিষ্ট সাহাবীগণের দ্বারা বর্ণিত মুরতাদের শাস্তি সম্পর্কিত সকল হাফদীস অস্বীকার করার ধৃষ্টটা দেখান। তিনি স্বপক্ষে যুক্তি দেখান যে, এগুলি উহুদীদের দ্বারা রচিত জাল হাদীস এবং কুরআনের মুল নীতির সাথে সম্পর্কহীন এবং বিরোধী। অথচ মুরতাদের শাস্তি সম্পর্কে প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) বলেছেন যে, “যে ধর্মত্যাগ করে তাকে হত্যা কর অথবা তার শিরোচ্ছেদ কর।“ এ হাদীসটি প্রধান প্রধান সকল হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ আছে। যেমন, বুখারী বুর্তাদ্দীন অধ্যায়, আবূ দাউদ, হুদদ পধ্যায়, নাসাই, তাহরী মুদদাম অধ্যায়, মুয়াত্তা ইমাম মালিক আকদিয়্যা হাদীস-১৫, তিরমিজী, হুদুদ অধ্যায়। এই ভণ্ড মাওলানা এখানে ক্ষান্ত না দিয়ে ইসলামের ইতিহাসেও বিকৃতি ঘটিয়েছেন। নিবন্ধের শেষে কতিপয় ঘটনার বিকৃত উপস্থাপনা করে তিনি বলেতে চেয়েছেন যে, রাসূল (ﷺ)-এর জীবনে মুরতাদদের শাস্তি প্রদানের কোন প্রমাণ নেই। তিনি বয়ান করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে আবি সারাহ নামে এক অহি লেখক মুরতাদ হয়ে গেলে মহানবী (ﷺ) তাকে কোন শাস্তি দেননি এবং মুসাইলামা কাজ্জাব মিথ্যা নবীর দাবী করে মুরতাদ হয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেননি। কতিপয় বখাটে আলেমের কাছে প্রমাণ না থাকলে কি হবে, ইসলামের ইতিহাসতো আর বিলীন হয়ে যায়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে আবি সারাহ নামক অহি লেখক মুরতাদ হয়ে অজ্ঞাত স্থানে পালিয়ে গিয়েছিল আর মুসাইলামা কাজ্জাব মিথ্যা নবুয়তের দাবী করেন রাসূল (ﷺ)-এর শেষ জীবনে। তাই সরাসরি তার পক্ষে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বেই তিনি ওফাত পান। প্রথম খলীফা আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) খলীফা নির্বাচিত হয়েই সর্ব প্রথম কাজ্জাবসহ মিথ্যা নবীর দাবীদার এবং যাকাত অস্বীকারকারী সকলকে মুরতাদ আখ্যা দিয়ে জিহাদ ঘোষণা করে তাদের নির্মূল করেন। রাসূল (ﷺ) মক্কা বিজয়ের পর বড় বড় কাফের নেতাদের ক্ষমা করে দিলেও ৪ ব্যক্তিকে ক্ষমা না করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন খাতাল ছিলেন মুরতাদ হওয়ার অপরাধে অপরাধী। সে এর পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং একজন মুসলমান খাদেমকে হত্যা করে মুরতাদ হয়ে যায়। বুখারী শরীফ এবং আবু দাউদ শরীফেও ঘটনাটি উল্লেখ আছে। এছাড়া আয়েশা সিদ্দিকা (রাঃ) হতে দু’টি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যে (১) ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের বাহ্যত পরাজয় ঘটলে জৈনকা হতভাগা নারী নিজেকে মুরতাদ ঘোষণা দেয়। মহানবী (ﷺ) এ সংবাদ শুনে সাহাবীদের নির্দেশ দেন, “তোমরা উক্ত ধর্মত্যাগী মহিলাকে ইসলাম ধর্মে ফিরে আসার আহবান জানাও। যদি সে তোমাদের আহবান প্রত্যাখ্যা করে তবে তাকে হত্যা কর।“
(২) উম্মে রুম্মান নামে এ মহিলা নিজেকে মুরতাদ বলে ঘোষণা দেয়। মহানবী সাহাবীদের তাকে ইসলামে ফিরে আসার আহবান জানানোর নির্দেশ দেন। ঐ মহিলা তা প্রত্যাখ্যান করলে রাসূল (ﷺ) তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের নির্দেশ দেন।“
এছাড়াও ইতিহাসের পাতায় খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে বহু মুরতাদের শাস্তির কথা বিধৃত রয়েছে। মুরতাদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে প্রসিদ্ধ চার ইমামের সকলেই মতামত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন বলে কোন প্রমাণ নেই। এ ছাড়া মুরতাদদের মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ্র যে সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে যা’ আব্দুল আউয়াল সাহেবরা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তা’ হলঃ
(১) “যারা আল্লাহ্ ও তার রাসূলের সাথে সংগ্রামে লিপ্ত আর ভু-পৃষ্ঠে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের সাজা এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে।……… [সূরা মায়েদা, ৩৩ আয়াত]”
হিজরী ষষ্ঠ বর্ষে ‘ওয়াইনা’ গোত্রের কতিপয় লোক রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে হাজির হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণের পর মুরতাদ হয়ে গেলে তাদের শাস্তির বিধান স্বরূপ উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। অধীকাংশ তাফসীর ও হাদীস গ্রন্থে তাদের মুরতাদ হওয়ার বিস্তারিত বিবরণসহ রাসূল (ﷺ)-ও এ ঘটনা তার বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থে ‘মুরতাদের আহকাম’ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিখ্যাত সাহাবী হযরত সাইদ বিন জুবায়ের (রাঃ)-এর মতামত পেশ করেন যে, আয়াতে উল্লেখিত ‘মহারাবা’ বা আল্লাহ্র সাথে সংগ্রাম করার অর্থ হল কাফির বা মুরতাদ হওয়া।
(২) “অতপর তোমাদের কি হল যে, মনাফিকদের সম্পর্কে তোমরা দু’দল হয়ে গেলে……। অতএব তাদের মধ্য থেকে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহ্র পথে হিজরত করে আসে। অতপর তারা যদি বিমুখ হয়ে যায় তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও হত্যা কর। তাদের মধ্যে কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করও না এবং সাহায্যকারী বানিয়ো না। [সূরা নিসা, ৮৮-৮৯ আয়াত]”
মুজাহিদ (রাহঃ) থেকে আব্দুল্লাহ ইবনে হুমাইদ (রাহঃ) বর্ণনা করে যে, একবার কতিপয় মুশরেক মক্কা থেকে মদিনায় আগমন করে এবং প্রকাশ করে যে, তারা মুসলমান, হিজরত করে এসেছে। কিছুদিন পর তারা মুরতাদ হয়ে যায় এবং পণ্য দেওব্য আনার অজুহাতে পুনরায় মক্কায় ফিরে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেনি। সেদের সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ বলল, এরা কাফের আবার জেউ বলল মু’মিন। এ প্রক্ষাপটে অবতীর্ণ প্রথম আয়াতে এদের পথভ্রষ্ট এবং কাফির বর্ণনা করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় আয়াতে এরা ইসলামের পথে ফিরে না এলে এবং তাদের সাথে কোন সন্ধিচুক্তি না থাকলে তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করা এবং গ্রেফতার ও হত্যা করার বিধান দেয়া হয়েছে। [রূহুল মা’আনী]
এদেশের শতকরা ৯০% মানুষ মুসলমান। কিন্তু আমরা এ লজ্জা লুকাবো কোথায়? মাওলানা আকরাম খাঁর কাছে সাংবাদিকতার সবক নিয়ে এবং মাওলানা ভাষানীর কাছ থেকে রাজনৈতিক জ্ঞান আহরণ করে এদেশের গুটি কতেক বাম-চিন্তার সাংবাদিক ও রাজনৈতিক শতকরা ৯০ জন মানুষের ‘বিবেক’ আলিম সমাজের বিরুদ্ধে বিষাক্ত ছোবল হেনে যাচ্ছে। তাদেরকে ফতোয়াবাজ, সাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতা বিরোধী, দেশেদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে। মানবতার এই গুটিকতেক শত্রু যখন আমাদেরই মাঝে সদম্ভে অবস্থান করে আমাদের ধর্ম, নাগরিক স্বাধীনতা, রাজনীতিক করার অধিকার, বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জঘণ্য উক্তি করে,আমাদের অধিকারসমূহ ‘নিষিদ্ধ’ করার জন্য চিতকার জুড়ে দেয়ার দুঃসাহস দেখায়, তখন আমাদের এ ব্যররথতার জন্য আমরা কিভাবে রাসূলের (ﷺ) এর উত্তরসূরী হিসেবে পরিচয় দিতে পারি? রাসূল (ﷺ) এর জীবন ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস কি বলে? ইসলামের স্বার্থ রক্ষা, সত্যের বানীকে সমুন্নত রাখার জন্য যত অচলায়নতই বাঁধা হয়ে দাড়াক তাকে ভাংতে হবে, ডিঙ্গিয়ে যেতেই হবে। ইসলামের পতাকাকে উড্ডীন রাখতে হলে, যা ইসলামের অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করে দেয় ‘নিয়মতান্ত্রিকতার’ নামে তার সাথেও আপোষ করার কোন নজীর নেই। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করার দুটি পর্যায় রয়েছে। মুখের বা কলমের, অন্যটি তলোয়ারের। দুর্বল হলেই কেবল অন্যায়কে ঘৃণা করে নীরব থাকতে বলা হয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, শহীদের রক্তই কেবল বিজয়ের রাজপথ দেখিয়ে দিতে পারে, আর সবল হয়েও বিকল্প পন্থা বেছে নেয়া কাপুরুষতাও বটে। আমাদের আরও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের উদাসীনতা বা অহেতুক অসহায়ত্ব প্রদর্শনের জন্য এ দেশে ইসলামের বিরুদ্ধে যতখানি আঘাত হানা হয়েছে, মুসলমান বলে আমাদের মর্যাদায় যতখানী কলঙ্ক লেপন করা হয়েছে তা’ মোচন করতে নতুন করে কোন নবী, রাসূল ওহী বা দূত আসবেন না। আমাদের ভাগ্য আমাদেরই পাল্টাতে হবে। আমাদেরই ইসলামের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন ভবিষ্যত রচনায় তৎপর হতে হবে। ইতিহাসের অমূল্য শিক্ষা হল, সমাজে সর্বদা ভাল মানুষের সংখ্যা কমই থাকে এবং সেই ভাল মানুষেরা যখন নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে তখন জঘন্য চরিত্রের মানুষেরাই সমাজ ও রাষ্ট্রের মালিক মোখতার বনে যায়। তখন সাধারণ মানুষের চেয়েও সেই অল্প সংখ্যক ভাল মানুষের দুর্ভোগের পরিমাণও হয় অনেক বেশী। আমরা কি সেই পরিণতি থেকে খুব একটা দূরে আছি? এভাবে লাশের মত বেঁচে থাকার স্বার্থকতা কি?
***********************************************