বাংগালি জাতি ও বাংলা ভাষার প্রকৃত ইতিহাস
ফজলুল করীম যশোরী
===============================================================
(পূর্ব প্রকাশের পর)
সুতরাং পূর্বে আমরা যে হরপ্পা মহেনজোদারো সভ্যতাকে মানব জাতির আদি নিবাস এবং প্রথম কালের শ্রেষ্ঠতম সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছি তা কিছুতেই অযৌক্তিক নয়। হরপ্পা মহেনজোদারোর দ্রাবিড় সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করার পূর্বে শুধু একটি কথাই বলে রাখা প্রয়োজন, তা হল, জ্ঞান বিজ্ঞানের যতই উন্নতি হচ্ছে আধুনিক বস্তুবাদী ঐতিহাসিক ও সমাজ বিজ্ঞানীদের থিওরী ততই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তারা যে আদি যুগের মানুষকে অসভ্য বর্বর বলে উল্লেখ করে থাকে তা দিন দিন জলন্ত মিথ্যা ও পাগলের প্রলাপ বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
ইতিহাসের আলোকে দ্রাবিড় সভ্যতাঃ
-------------------------------------------------------------------
করাচীর ২০০ মাইল উত্তর পূর্বে সিন্ধু নদের তীরে অবস্থিত রয়েছে দ্রাবিড় সভ্যতার কেন্দ্রভূমি মহেনজোদারো এবং সিন্ধু উপনদীর তীরবর্তী, প্রাচীন ধারার বাম তীরে পাঞ্জাবের একটি শহরের নাম হরপ্পা। ১৯২২ সাল থেকে ৬৮ বছর যাবত অনবরত খনন কার্য চালিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ যে সব নিদর্শন আবিষ্কার করেছেন তাতে প্রমাণিত হয় যে,২৫০০ খৃষ্ট পূর্ব থেকে ১৫০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যবর্তী ১০০০ বছর ধরে বিদ্যমান এ সভ্যতা ছিল মিশরীয় ও সুমেরীয় সভ্যতার সম পর্যায়ের। প্রাপ্ত তথ্যে আরো জানা যায় যে, তাদের দৈহিক গঠন ছিল ইথিওপিয়, সোমালিয়, ইয়েমেন, দক্ষিণ আরব ও দক্ষিন ভারতের তাম্রবর্ণ বাসিন্দাদের অনুরূপ। তাদের পোষাকাদিও ছিল অত্যন্ত রুচিসম্মত, এমনকি তাদের কাজ করা পোশাক পরিধানেরও প্রমাণ পাওয়া যায়। এদু’টি শহরের নির্মাণ পদ্ধতি ও আকার আকৃতিও ছিল প্রায় একই ধরণের। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও এখনো মহেনজোদারো নগরীতে লম্বালম্বিভাবে ৩টি এবং আড়াআড়িভাবে নির্মিত ২টি সমান্তরাল সড়ক নজরে পড়ে। এ পাঁচটি সড়কের প্রত্যেকটিই ৩০ ফুট প্রশস্ত।
এ সড়কগুলোর পাশে ছিল সারিসারি দালান কোঠা। সড়ক ও গলির নিন্ন দেশে প্রবাহিত ছিল ভু-গর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালী, যা ৬০ এর দশকের পূর্বে ঢাকা শহরেও ছিল না। : মহেনজোদারোর দুর্গটি এলাকাটি ছিল নগরীর পশ্চিম প্রান্তে উত্তর-দক্ষিণে ১৫০০ ফুট ও পূর্ব পশ্চিমে ৬০০ ফুট বিস্তৃত ভূমির ওপর নির্মিত। দুর্গ এলাকার চর্তুদিক পরিবেষ্টিত ছিল। সিন্ধুনদের জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য উক্ত নগরীর বহির্দেশে বর্তমান যুগের ন্যায় পোড়া ইটের গাঁথুনি এবং সিরামিক ইট দ্বারা সজ্জিত করা হয়েছিল। বাঁধের উপর ৪০ ফুট তলদেশ থেকে নির্মিত ছিল বিশাল প্রাচীর। প্রাচীরের উপরিভাগের প্রশস্ততা ছিল ৩০ ফুট। দুর্গের অভ্যন্তরে মাটি ভরাট করে ৩০ ফুট উঁচু ভিটির ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল বিভিন্ন ধরণের সুউচ্চ প্রসাদরাজী। একটি বিশাল ভবনের অভ্যন্তরে বিদ্যমান ছিল, পোড়া ইটের গাঁথুনি বিশিষ্ট ও সিড়ি সম্বলিত একটি উন্নতমানের স্নানাগার বা সুইমিং পুল। দুর্গ এলাকা থেকে সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল নগরীর সাধারণ শস্য ভান্ডার, যাতে ছিল আধুনিক যুগের ন্যায় সাইলো গুদাম ও শস্য শুকানোর উপযোগী সুউচ্চ ভিটি। মোট কথা, আধুনিক কালের যে কোন পরিকল্পিত নগরীর মতই ছিল তার নির্মাণ বৈশিষ্ট্য। প্রত্নতাত্ত্বিকগণের সর্বশেষ ফলাফল অনুযায়ী প্রমাণিত হয় যে, উক্ত সভ্যতার ধারক বাহকরা ছিল একত্ববাদ তথা নিরাকার স্রষ্টায় বিশ্বাসী।
কেননা, খনন কার্যের ফলে মহেনজোদারোতে বিস্ময় সৃষ্টিকারী অসংখ্য নিদর্শন পাওয়া গেলেও সেখানে কোন ধর্ম মন্দির ও দেব, দেবীর মূর্তি পাওয়া যায়নি। অসংখ্য নিদর্শনের মধ্যে সেখানে মাত্র একটি ষাঁড়ের মূর্তি, নৃত্যরত একটি নারী মূর্তি এবং মানুষ ও পশুর যুগ অবয়ব বিশিষ্ট একটি প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে মাত্র। যার ফলে তৌহিদবাসী জনগোষ্ঠি অধ্যুষিত বিশাল সভ্যতার মাঝে স্বল্প সংখ্যক গো দেবতা ও পশু পুজারী সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব প্রমানকরে। হয়তঃ এই সংখ্যা লঘু পৌত্তলিকেরা কোন স্বজাতীয় বিদেশী শক্তির অদৃশ্য ইঙ্গিত ও স্থানীয় 'শিখন্ডীদের সহায়তায় সেখানে নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপ পৌত্তলিকতার বীজবপন করতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে এই উন্নত সভ্যতার ধারক বাহক জনগোষ্ঠির সমাজ জীবনে নেমে এসেছিল চরম ধ্বংস ও আকস্মিক বিপর্যয়। এরই ফলশ্রুতিতে হয়ত তাদের উপর খোদায়ী গজব হিসেবে আবর্তিত হয়েছিল বিদেশী শক্তির আগ্রাসন। উক্ত বিদেশী আগ্রসনবাদীরা এসে তাদের সভ্যতাকে করে দিয়েছিল চিরতরে নিশ্চিহ্ন। কেউ কেউ অবশ্য হরপ্পা মহেনজোদারোর সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে ধারণা করে থাকেন।
প্রত্নতাত্ত্বিকদের পরীক্ষার ফলাফল সম্পূর্ণ এর বিপরীত অর্থাৎ এ সভ্যতাদ্বয় যে এ বিদেশী হানাদারদের দ্বারা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছিল তা অনেকটা নিশ্চিত সত্য। কিন্তু কারা ছিল এই আগ্রাসনবাদী শক্তি? তাদের পরিচয় জানার জন্য ইতিহাস মন্থন না করে হানাদারদের মুখ থেকেই শোনা যাক মূল ঘটনা। তাদের দাবীমতে উপমহাদেশের আদিতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ” এ তারা স্বীকার করেছেন যে, তাদের পূর্বপুরুষ আর্যরাই নিজেদের যুদ্ধদেবতা ইন্দ্রের নেতৃত্বে সিন্ধু অববাহিকার এক শত “পুর” বা দুর্গ তথা সুরক্ষিত শহর ধ্বংস করেছিল। শহরগুলোর দু’টি ছিল সুবৃহৎ ও সুবিস্তৃত মহানগরী। শারদীয় বন্যা থেকে ছিল সুরক্ষিত। কাঁচা ও পাকা মাটি এবং পাথর ও বিভিন্ন ধাতুর আবেষ্ঠন মণ্ডিত ছিলো এই সব। এরূপ একশত “পুর” বা শহর ধ্বংস করে তাদের যুদ্ধদেবতা ‘ইন্দ্র” “পুরন্দর” উপাধিতে ভূষিত হন। সুতরাং আর্য হিন্দুরাই যে হরপ্পা মহেনজোদারো সভ্যতার ধ্বংসকারী তাদের নিজস্ব স্বীকারোক্তির পর তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। আর্যদের ধ্বংসলীলা থেকে যারা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল তারা এসে সিন্ধু পাঞ্জাবসহ অন্যান্য এলাকার স্বগোত্রীয় লোকদের সাথে বসবাস শুরু করে। আর্যদের আদি নিবাস ছিল ইরান অথবা পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলে। জাতি হিসেবে অসভ্য ও যাযাবার হলেও সুসভ্য দ্রাবিড়দের তুলনায় অস্ত্রেশস্ত্রে ছিল অনেক উন্নত। ফলে তারা একের পর এক দ্রাবিড়ীয় অঞ্চলগুলো দখল করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
তখন আমাদের এই বঙ্গদেশ যে মহাশৌর্যবীর্যের অধিকারী শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে খ্যাত ছিল ঐতিহাসিকভাবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আত্মীয়তা ও বিশ্বাসগত ঐক্যের সূত্র ধরে আর্যহানাদার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে এসব অঞ্চলের লোকেরা ব্যাপক হারে আগমন করতে থাকে আমাদের এই বঙ্গদেশে এবং কালক্রমে তারা বাংগালীদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে একই দেহে বিলীন হয়ে যায়। ফলে শাব্দিক অর্থেই তারা এক জাতিতে পরিণত হয়ে পড়ে। উক্ত সম্মিলিত জাতিই পরবর্তীতে গংগরিড়ী বা বংদ্রাবিড়ী নামে খ্যাত। বর্তমান ভারতীয় ব্রাহ্মণ্য হিন্দুরা হল আর্যদের উত্তরসূরী।তাতার, ইংরেজ ও ইয়াজুজ-মাজুজ গোষ্ঠির লোকেরাও এই আর্যদের বংশধর বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। মূলতঃ আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরা যে ভারত বর্ষে বহিরাগত উপনিবেশবাদী জনগোষ্ঠী, প্রকৃত ইতিহাসের আলোকে তা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। অবশ্য আর্য আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষে সুসভ্য দ্রাবিড়দের পাশাপাশি দু' একটি অসভ্য যাযাবর উপজাতীয় জনগোষ্ঠী পাহাড় ও অরণ্য অঞ্চলে বসবাস করতো।
আর্য আগমনে এসব বণ্য যাযাবরদের সাথে আর্যদের কৃষ্টি কালচার তথা জীবন যাত্রার মৌলিক সূত্র ধরে তাদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং পরবর্তীতে তা একাকার হয়ে বর্তমান ভারতীয় হিন্দু জনগোষ্ঠির উদ্ভব হয়। উভয় জনগোষ্ঠির কৃষ্টি কালচার ও রীতিনীতি এক হলেও নবাগত উপনিবেশবাদী আর্য ব্রাহ্মণরা স্থানীয় নিষাদ, কীরাত সহ অন্যান্য জনগোষ্ঠিকে তাদের সমান মর্যাদা দিতে কিছুতেই সম্মত ছিল না। ফলে তারা এক অভিনব পন্থায় বর্ণ প্রথার সৃষ্টি করে স্থানীয় জনগণকে চিরতরে নিজেদের দাস বানিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। এমনকি তারা বাংলাদেশের উপরও তাদের উপনিবেশ বিস্তারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা বাংগালীর শৌর্যের সামনে মথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং বাংগালী জাতি হয়ে পড়ল তাদের আজন্ম শত্রু। বাংগালীর চাল-চলন, আচার-আচরণ, ভাষা-সাহিত্য, কৃষ্টিকালচার সব কিছুই তাদের নিকট ঘৃণিত। সেই থেকে তারা বাংগালী জাতিকে দাস, দস্যু, যবন, স্রেচ্ছ, অসুর, সর্প, পক্ষী ইত্যাদি নামে ভূষিত করে হেয় প্রতিপন্ন করতে থাকে। এমনকি তাদের ধর্মগ্রন্থগুলোতেও বাংগালী জাতির নিন্দাসূচক বহু বাক্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
তাই আজও বাংগালী জাতি আর্যব্রহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের নিকট রয়ে গেলে অস্পৃশ্য। তাদের নিকট বাংগালী জাতির ভাষা হল ইতরের ভাষা এবং পক্ষীর মত কিচির মিচির করা দুর্বোধ্য ভাষা। এ জন্য তারা এ ভাষাকেও অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত। এমনকি বাংলা ভাষা চর্চা করাও তাদের নিকট ছিল মহাপাপ। অতএব তারা ঘোষণা দিল কেউ যদি বাংলা ভাষায় কথা বলে তাহলে তার স্থান হবে রৌরব নামক নরকে অবশ্য আধুনিক কালের আর্য হিন্দুরা ইংরেজ ব্রাহ্মণ্য চক্রান্তের ফসল ফোর্ট উইলিয়ামী অনুস্বর বিস্বর্গ মিশ্রিত ও সংস্কৃত প্রাধান্য বাংলাকে গ্রহণ করলেও মুসলিম অধ্যুষিত প্রকৃত বাংলা ভাষাকে এখনো দু’ চোখের কাটা মনে করে থাকে। শুধু হিন্দুরাই কেন তাদের পদলেহী শিখণ্ডি ও তল্পিবাহক কিছু সংখ্যক মুসলিম নামধারী তথাকথিত এদেশী সেদেশী প্রগতিশীল শ্রেণীও আজও প্রকৃত বাংলা ভাষাকে সহ্য করতে প্রস্তুত নয়। নিম্নের উদ্ধৃতিটি লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে যে, পদলেহী ছোট লোকরা মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার মানুষ ও ভাষা সম্পর্কে কত জঘন্য ধরণের মন্তব্য ও ধারণা পোষণ করে থাকে। কুখ্যাত লেখক মুরতাদ-শয়তান রুশদী তার স্যাটানিক ভার্সেস নামক উপন্যাসের ১৭১ পৃষ্ঠায় লিখেছে, “পূর্ব বাংলায় শুধু বড় বড় জলাশয়। এখানে কারা বাস করে? এই বন্য ও অসভ্য জংলীদের বংশ বৃদ্ধি খুবত ঘটে। এরা কোন কাজের নয়। পারে শুধু পাট ফলাতে আর পারে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধ, হানাহানি করতে। ধানের শীষের মধ্যে তারা বিশ্বাসঘাতকতার আবাদ করে এরা। আদি বাসী জংলীর জাত। ছোট ছোট, কালো মানুষগুলি, তাদের ভাষা উচ্চারণ যোগ্য নয়, স্বরবর্ণগুলি উদ্ভট ধ্বনিময়।” (দৈনিক সংগ্রাম, ভাষা দিবস সংখ্যা ১৩৯৬) এতো গেল সেদেশী পদলেহীর দৃষ্টান্ত।
এদেশী পদলেহীদের দুঃসাহসও কিন্তু কম নয়। এরা শতকরা ৯৫ জন লোকের ব্যবহৃত মুখের ভাষাকে উপেক্ষা করে তাদের গুরু শ্রী চন্দ্রদের সংস্কৃত প্রাধান্য বাংলাকে দেশবাসীর ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার জন্য সদা তৎপর। এমনকি এদেশের সংখ্যা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য লালিত সহজবোধ্য ভাষায় কবিতা রচনার অপরাধে তারা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও সম্প্রদায়িক বলে গালিগালাজ করতে দ্বিধা করেনি। তাদের মতে বাংগালী জাতি নাকি লম্পট। আর্য ঋষি দীর্ঘতমা ও অনাৰ্য্যবলী রাজার স্ত্রী সুদেষ্ণার অবৈধ মিলনের ফলে জন্য প্রাপ্ত জারজ সন্তানেরই বংশধর। বাংগালী জাতির জন্ম সম্পর্কে আর্য হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ পুরান ও মহাভারতে যা বর্ণনা করা হয়েছে নিম্নে তা উদ্ধৃত করা হলঃ "পূর্ব দেশে বলি নামে একজন প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন। তিনি একাধারে অজেয় সংগ্রামী, মহাধার্মিক ও প্রণ্ডিত ছিলেন।
সজাতির বংশজাত বৃদ্ধ ও অন্ধ ঋষি দীর্ঘতমার বিপদকালে তিনি তাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং স্বীয় স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করার জন্য এই অন্ধ ঋষিকে অনুরোধ করেন। দীর্ঘতমা ঋষি নিজ আশ্রয় দাতা বলিরাজার অনুরোধে রানী সুদেষ্ণার সাথে সঙ্গম করে। ফলে রাণীর গর্ভে পাঁচটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। তাদের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বংগ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুক্ষ। এই পাঁচটি পুত্রের বংশ থেকে এক একটি দেশ ও জনগোষ্ঠির উদ্ভব ঘটে এবং তাদের নামেই নামরাখা হয় ঐ দেশ ও জনগোষ্ঠির। সুতরাং বাংগালী জাতি হল দীর্ঘতমা ঋষির জারজ সন্তান বঙ্গেরই বংশধর। অতএব তাদের দৃষ্টিতে বাংগালী জাতি যে অস্পৃশ্য ও ঘৃণিত তা বলাই বাহুল্য। হায়রে বাঙ্গালী তোমরা কি সত্যই কলঙ্কিত? তোমরা কি তাহলে পরিত্যক্ত লম্পট আর্যঋষি দীর্ঘতমার জারজ সন্তানের উত্তরসূরী? মুলতঃ এ ঘটনার কোনই ভিত্তি নেই। এটা, যে প্রতিহিংসা পরায়ন বর্বর আর্যব্রাহ্মণ্য কুচক্রী মহলের মিথ্যা, বানোয়াট, গাজাখোরী উদ্দেশ্য প্রণোদিত কাল্পনিক উপাখ্যান বৈ আর কিছু নয় এ কথা বুঝতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না। ইতিপূর্বে আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, বাংগালী জাতির মূল উৎপত্তির সাথে আরবজাতির সম্পর্ক ছিল। ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তেমনি পরবর্তীতেও আবহমান কাল থেকে সে সম্পর্ক হতে থাকে আরো সুদৃঢ় ও গভীরতর। ব্যবসা। বাণিজ্য থেকে নিয়ে রাজনৈতিক সমাজিক ধর্মীয় এবং সাহিত্য সংস্কৃতি, তাহজীব তমাদুন ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বাংগালীদের সাথে আরবীদের জাতীয় পরিচিতিতে শুধু মাত্র শাব্দিক পার্থক্য ব্যতীত অন্য কোন ভিন্নতা ছিল বলে ঐতিহাসিকভাবে বিশ্বাস করা যায় না।
প্রচলিত ইতিহাসে আরবদের এদেশে আগমন ইসলাম পরবর্তী ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হলেও মূলতঃ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আরবদের বাংলায় আগমন বসবাসের ঘটনা সম্পর্কে ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে। খৃষ্ট পূঃ ৫/৬ হাজার বছর পূর্ব থেকে আরবগণ জাহাজ একথা যোগে চাটগাঁও বন্দর হয়ে বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। এমন কি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফলে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে সীতাকুণ্ড ও কামরূপে প্রাপ্ত প্রস্তর যুগের নিদর্শনাবলী থেকে ৮/১০ হাজার বছর পূর্বেই আরব জাতির বাংলাদেশের আগমন ও বসতি স্থাপনের ঘটনা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট। ১৮৮৬ বুদাপায়া কর্তৃক সীতাকুণ্ডে ভস্মীভূত কাষ্ঠ নির্মিত একটি তরবারী আবিষ্কৃত হয়েছে যা প্রত্নতাত্ত্বিক পরীক্ষায় ৮/১০ হাজার বছর পূর্বেকার বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং এই তরবারী যে একমাত্র আরব জনগোষ্ঠির নিদর্শন তা ঐতিহাসিকভাবে সন্দেহাতীত।
আর্য ধর্ম গ্রন্থ এবং আর্য প্রভাবিত ইতহাসে দেখা যায়, ত্রিপুরা বা ‘তিন পুরীতে প্রথমে দৈত্যগণ বাস করত। এই তিন পুরী হল কমিলা, চট্টলা ও রাশানহ। ঐতিহাসিক কর্ণেল জেরেমীর বর্ণনা মতে এই তিন এলাকা ত্রিপুরা বলে প্রসিদ্ধ ছিল এবং এই তিন এলাকা ছিল আরব অধ্যুষিত। আরবের বিশালকায় শৌর্য বীর্যের অধিকারী রণনিপুন মানুষগুলি পার্শ্ববর্তী পার্বত্য এলাকার ক্ষুদ্রকায় অধিবাসীদের নিকট দৈত্য বলেই পরিচিত ছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলাম পূর্ব যুগে আরবরা ছাড়া আর কোন জাতিই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলা ভারতের বুকে বাণিজ্য করতেন ।
মূলতঃ গোষ্ঠিগত সম্পর্কের সূত্রে অনিবার্য কারণেই বাংলাদেশে আগমনের সামুদ্রিক পথ জানা থাকা তাদের জন্য অতি স্বাভাবিক ছিল এবং ব্যবসায়িক স্বার্থে অন্য কোন জাতির নিকট তারা সামুদ্রিক যোগাযোগ পথের সন্ধান দিত না। এজন্য দেখা যায়, বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ও দার্শনিকদের নিকট এ বাংলা ভারতের অস্তিত্ব ছিল সম্পূর্ণরূপে অনবহিত। তাইতো প্লেটো তার লেখার কোথাও ভারত কিংবা ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে কোন আলোচনা করেননি এবং ইতিহাসের জনক বলে কথিত হিরোডটাস তার ইতিহাস গ্রন্থে বাংলা-ভারত বর্ষের কোন বর্ণনা দিতে পারেননি। অথচ ভারতীয় প্রাচীন ধর্ম ও ইতিহাস গ্রন্থ সমূহে যেমন আরবজাতি সম্পর্কিত আলোচনায় ভরপুর রয়েছে তেমনি প্রাচীন আরব্য ঐতিহাসিক উপাদান সমূহে বাংলা ভারত সম্পর্কিত প্রচুর তত্ববিদ্যমান রয়েছে।
স্যার উইলিয়া জোনস তাঁর Discourse on the Arabia নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ভারতবর্ষে কতকগুলা বিশেষ নামের সাথে আরবী নামের সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন আরাবিয়ান নামক নদী আরাইস বা আরবিস নামক জাতি। এবং অপর শব্দ বাণিজ্য কেন্দ্র সাবাইয়ার অনুকরণে সারা আরব ভূগোলবিদগণের সাফারাত অনুকরণে সুপরো বা সুপারা ইত্যাদি। এছাড়া ঢাকার অদূরে সাভার অঞ্চলটিও আরবদের দেয়া নাম বলে জানা যায়। এই সাভারেই প্রাচীনকাল থেকে সুম্বা মসলিন বস্ত্র প্রস্তুত হত এবং এখান থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানী হত। মুসলিম অভিযানের পূর্ব থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরব্য মুসলিম জনবসতি গড়ে উঠে। সওদাগরেরা ব্যাপক হারে সমুদ্র পথে বাংলা ভারত ও চীন দেশে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড জোরদার করে। আরবরা যে দেশে যেতো সে দেশেই স্থায়ীভাবে বসবাসের মাধ্যমে সে দেশের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। ডাঃ রবার্টসন বলেন, এসময় এতদাঞ্চলের বড় সকল বন্দরের অধিবাসীরা আরবী ভাষা বলতে ও বুঝতে পারতো।
তিনি আরো বলেন, ক্যান্টন শহরে আরবরা এত অধিক ছিল যে, তাদের অনুরোধে চীন সম্রাট তাদের মধ্য হতে একজন কাজী বা বিচারক নিযুক্ত করে দেন। এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হল, যদি এসব অঞ্চলে পূর্ব থেকেই আরব বংশোদ্ভূত লোকদের বসবাস না থাকতো তাহলে নবাগত আরবগণ এদেশে এসে এত সহজে জনগণের সাথে মিশতে সক্ষম হতো না। উপরোক্ত আলোচনায়। একথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হলো যে, বাংগালী জাতি প্রকৃত পক্ষে আরব জাতিরই উত্তরসূরী। অন্য কথায় আরব জাতিই হলো বাংগালী জাতির পূর্বপুরুষ।