JustPaste.it

গল্প নয়
একটি কবিতার কথা
রুবাইয়াত আল ইমাম


     হে জ্ঞানী ব্যক্তি! আল্লাহর কসম করে বলছি, তুমি যদি আমার অশ্বটির চার পা যখন মাটিতে গেড়ে যাচ্ছিল তা উপস্থিত থেকে দেখতে তাহলে নির্ঘাত জেনে ফেলতে এবং মোটেই দ্বিধা করতে না যে, মুহাম্মাদ সপ্রমানিত আল্লাহর রাসুল। এমতাবস্থায় তার মোকাবেলায় কে আসতে পারে? তোমার কর্তব্য হলো, লোকজনকে তার পক্ষ নিয়ে, তার ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকা।কেননা আমি দেখতে পাচ্ছি, তার বিষয়টির লক্ষ্য সমূহ বাস্তব আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। এটা এমন ব্যাপার যা সকলেই চাচ্ছে। এটা এমন বিষয় যার সাথে সকলেই আপোস করতে চায়। 


আবুল হাকাম, আল্লার কসম
বলো, তুমিই বলো, একটু ভেবে
আমার দূরন্ত তাজীর পা
মরুর বুকে যখন যাচ্ছে দেবে
হাজির থেকে যদি দেখতে
নির্ঘাত ফেলতে জেনে
মুহম্মাদ, সপ্রমানিত আল্লার রাসুল
তুমিও দ্বিধাহীন নিতে মেনে।
কে আসে তার মোকাবেলায়
আছে এমন দুর্মতি কার?
উচিত তোমারও, ক্ষতি নয়,
পূর্ণ শক্তি নিয়ে দাঁড়াও পাশে তার।
সবই দেখতে পাচ্ছি আমি
দিনের আলোর মতো
আর আকাশের নীলে
পেজা পেজা তুলোর মতন
যাচ্ছে সকলেই সত্যের মিছিলে।
মোহাম্মদ উপ্ত লক্ষ্য বস্তু সকলি
এমনি এক বিষয়
যার সাথে চায় আপোস বিশ্ব
বিজয় তার সুনিশ্চয়।


      এই কবিতাটি যখন সুরাকা রচনা করেন তখনো তিনি কাফির।মুসলমান হন নি। আল্লাহ ও তার রাসুলকে স্বীকার করেন নি। তখনো তিনি মহানবীর জীবন শত্ৰু।জানী দুশমন।
      সুরাকার এ কবিতা থেকে মনে হয়, সচেতন কাফিররাও জানতো, মুহাম্মাদ (স) আল্লাহর প্রেরিত নবী ও রাসুল। মহানবীর দাওয়াত সাধারণ মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা মহানবীর সাথে যুক্ত হতে চাইছিলো। ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
      কিন্তু বাঁধ সাধলো স্বার্থান্বেষী মহল। কায়েমী স্বার্থবাদীরা বাধার প্রাচীর গড়ে তুলতে শুরু করলো। সংঘাত বাঁধালো বিভ্রান্ত সমাজপতি তথা গোপনত্রপতিগণ । ফলে রক্তপাত হলো। অনেক তাজা প্রান শহীদ হলো।
     কবিতাটি লেখার পেছনে একটি ঘটনা আছে। চমৎকার ঘটনা।
    সুরাকা! পুরো নাম সুরাকা ইবনে মালিক। সুরাকা নামেই বেশি পরিচিত। পেশায় ডাকাত। আরবের নাম করা ডাকাত। এক নামে সবাই চেনে। ভয় করে জমের মতো।
    আরবের গোত্রপতিরা অস্থির। কি করে সম্ভব!ভেবে পাচ্ছেনা কেউ। এতোগুলো মানুষকে ফাঁকি দিয়ে গেলো কি ভাবে মুহাম্মাদ! আর এক রাতেই বা কতদূর যেতে পারে? মাঝ পথেই, ভোজবাজীর মতো হাওয়া হয়ে গেলো কেমন করে?
     ঘোষণা করা হলো, মুহাম্মাদ কে যে হত্যা করতে পারবে তাকে দেয়া হবে একশত উট পুরষ্কার। লোভনীয় পুরস্কারই বটে।
    সুরাকার মনেও লোভ ঝলসে উঠলো শোনামাত্র। নাহ! এ সুযোগ ছাড়া যায় না। ছুটলো সুরাকা। ধূলো উড়িয়ে উল্কা ছুটছে ঘোড়া। যে করেই হোক ধরতে হবেই।
      একে একে তিন দিন চলে গেলো। কোথাও কোন চিহ্ন নেই। অলি-গলি, পাহাড়-পর্বত-প্রতিটি গুহা পর্যন্ত দেখা হলো খুঁটে খুঁটে। তবুও পাওয়া গেলো না। বাতাসে মিশে গেলো নাকি লোকটা। তবুও আশা ছাড়লো না সুরাকা। তায় তায় রইলো। এদিক ওদিক চোখ রাখলো। হঠাৎ দেখা গেলো একটি কাফেলা। দূরে এক চিলতে ধূলোর রেখা আকাশে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে। আসতে আসতে দৃষ্টি সীমায় স্পষ্ট হয়ে উঠলো কাফেলা। ছোট্ট কাফেলা। মাত্র দুজনের। দু'টি ঘোড়া। মরু মক্কার মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে মদিনার দিকে। মদিনা মানে ইয়াসরাব। ইসলাম পূর্ব যুগে মদিনার নাম ছিল ইয়াসরিব।
     ঘোড়া ছুটালো সুরাকা। লক্ষ্য কাফেলা। হ্যাঁ, পাওয়া গেছে এবার। এটাই তো মুহাম্মদ! বিড়বিড় করে সুরাকা। সাথে কে, আবু বকরের মতো মনে হয় না? সে তো অনেক আগেই মুসলমান হয়ে গেছে।
      আর ওটা কে? “পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? হবে হয়তো কোন লোক অতো ভেবে কাজ কি?
      আরবরা বরাবরই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে কুসংস্কারের হাওয়া সুরাকার চিন্তার শ্রোতে দোলা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। সুরাকার মনে দ্বন্দ্ব উঁকি মারে, সে কি পারবে? পারবে কি আরুধ্য কাজ শেষ করতে?
      ভালো মন্দ যাচাই করার জন্য সে তীর বের করলো। দেখা গেলো, “তাঁর ক্ষতি করা যাবে না" বানী অংকিত তীর বের হলো। এক বার, দুই বার, তিন বার একই বানী খচিত তীর বের হলো। মনটা টলে উঠলো তার। ফিরে যাবে? কিন্তু পুরস্কার! এক শত উট। আবার আটকে গেলো মন লোভের জালে। লোভ তাকে তাড়িয়ে নিলো সামনে। চোখে ভাসতে থাকল এক শত উটের মুখ। কিন্তু মন থেকে দূর হলো না সন্দেহ। আবার তীর বের করলো। নাহ, ওই আগের বানী-অঙ্কিত তীর উঠে এলো। না, তবুও থামলো না সে। ঘোড়ার গতি বেড়ে গেলো।
      এবার ঘটলো অন্য বিপত্তি। হোঁচট খেলো ঘোড়া। এক বার। দুই বার। তিন বার। আমলে নিলো না সে। ছুটলো। ছুটতে থাকলো।
    কিছুদুর এগোলো সে। তারপর! তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলো, সে আর ঘোড়ার পিঠে নেই। তপ্ত বালুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে।
     তখনো তার বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। কেমন একটা ঘোর লেগে আছে। চোখে। উঠে এলো ঘোড়ার কাছে। কিন্তু একি? বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেলো তার দুচোখ। যেন ঠিকরে বেড়িয়ে আসবে। সে দেখলো তার ঘোড়ার সামনের দু’পা মরুর তপ্ত বালুর ভেতরে দেবে গেছে। তাই সে ছিটকে পড়েছিলো দূরে।
     “এতোক্ষণে বুঝিলা আরিন্দম”। বুঝলো সুরাকাও। আর ধরা যাবে না। তাঁকে যে আল্লাহই হেফাযতে রাখেন।
      ঠিক এমনি সময়, হঠাৎ করেই উঠলো মরুঝড়। সাইমুম। বালুর একটি আবরণ আড়াল করে ফেললো মহানবীকে। ভয় পেয়ে গেলো সুরাকা। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লো সে। ভয়ে নীল হয়ে গেলো চোখ-মুখ। বুক শুকিয়ে যেতে লাগলো। কি দিয়ে কি হয়ে গেলো বুঝতে পারলো না। ধাতস্ত হতে সময় লাগলো।
      এক সময় নিজেই আবিস্কার করলো, নিজের দেহ-মন-মস্তিস্ক কোনটাই আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই। তার কোন কথাই শুনছে না ওগুলো। তার মুখ তার অজান্তেই মহা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে মহানবীকে অনুনয় বিনয় করে ডাকতে লাগলো। প্রতিজ্ঞা করে বললো, সে তাঁদের কোনই ক্ষতি করবে না, সে বাঁচতে চায়। কাজেই তাকে যেনো একটি আমান নামা দেয়া হয়। যাতে করে সে নিরাপদে থাকতে পারে।
    আমান নামা হলো এক ধরণের ত্রান পত্র। একে নিরাপত্তার পত্র বা সেফ লেটার বলা যেতে পারে। এটি সাধারনত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
       মহানবীর নির্দেশে হযরত আবুবকর তাকে আমান দিলেন। সে মহানবীর ত্রাণ পত্র নিয়ে ফিরে গেলো। দয়ার নবী, মহানবী সুরাকার কাতর মিনতি ফেলতে পারলেন না। তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারলেন না ।মহানবী তাকে ক্ষমা করলেন। আমান দিলেন। নিরাপত্তা দিলেন।
     সুরাকা তার ওয়াদা রাখলো। কথা রাখলো। পথে মহানবীকে অনুসন্ধানকারী সবাইকে সে ডেকে ডেকে বলে দিতে লাগলো-এদিকে কেউ নেই। সে নিজে তালাশ করে দেখে এসেছে। 
      মহানবী নিরাপদে পৌঁছলেন মদিনায়। এভাবেই সুরাকা তার কথা রেখেছিলেন। পরে মুসলমানও হয়ে গেলেন তিনি। অন্ধকার থেকে এলেন আলোর জগতে। নূরের দেশে।
      সুরাকার এ ঘটনাটা গোপন ছিলো। কিভাবে যেনো ফাঁস হয়ে গেলো। ক্ষুব্ধ হলো মুশরিক দল পতিরা। আবু জাহেল সুরাকাকে ডেকে পাঠালেন। গেলেন সুরাকা। আবু জাহেল তাকে গাল-মন্দ করলেন। ভৎর্সনা করলেন। এরই জবাবে সুরাকা লিখলেন বিখ্যাত এই কবিতা।
    এতো কিছু করেও কি কাফিররা ইসলামের বিজয় ঠেকাতে পেরেছিলো? পারেনি। কারণ ইসলামের আদর্শ নির্মল। এতে কোন সাত পাঁচের গোজামিল নেই। ইসলাম মানুষকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়।
     কয়েকশ' শতাব্দি ধরে নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের হাহাকার ঘুচাবার জন্যই আল্লাহ মুহাম্মদ (সঃ) কে পাঠালেন। দিলেন মানব জাতির মুক্তির সনদ-আল-ইসলাম। জীবন দর্শন-আলকুরআন।
     আরবের নির্যাতিত নিপীড়িত অসহায় সর্বহারা জন-সাধারণ সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ছিলো উদগ্রীব। চাতক পাখীর মতো অপেক্ষা করেছিলো কখন! কখন তাদের মুক্তির বার্তা ঘোষিত হবে? কখন আসবেন প্রতিশ্রুত সেই ত্রাণ কর্তা, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)?
     অপেক্ষার শেষ আছে। শেষ হলোও। অপেক্ষার অবসান হলো। ইসলাম এলো। মানুষের, মানবতার মুক্তির বার্তা ঘোষিত হলো ।
       ইসলামে সবাই দৌড়ে আসতে চাইলো, যেমনি আসে বানের স্রোত। কিন্তু বাধ সাধলো সমাজপতিরা। না, বেশি দিন নয়। মুক্তি পাগল মানুষের মুক্তির মিছিল রোধ করা গেলো না। শেষাবধি তারা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিলো। 
     ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন হলো নীল আকাশে। বাতাশে ছড়িয়ে পড়লো মুক্তির গোলাপী সুবাস।