আমার দেশের চালচিত্র
পৌত্তলিকতার যুগে ফিরে যাওয়ার
অপতৎপরতা রুখতেই হবে
মোহাম্মদ ফারুক হোসাইন খান
অষ্টাদশী এক সুন্দরী যুবতী। দরিদ্র গ্রাম্য কৃষকের কন্যা। জীবনের আঠারোটি বছর গ্রামের আলো-বাতাস ও পিতৃগৃহের স্নেহ-মমতার পরিবেশে কাটিয়েছে। এখন তার একটাই প্রতীক্ষা, স্বামী-সন্তানের সংসার জীবনে প্রবেশ করা। কিন্তু একদিন তার জীবনে নেমে এল মহাপ্রলয়। হাতে ত্রিশূল, কপালে তিলক কাটা, পৈতাধারী কতিপয় দেবতার পূজারীরা এসে তার বাপকে জানালো যে, তোমার মেয়েকে সোমনাথ মন্দিরে ভজন দেয়া হয়েছে। তাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আর জানালো যে, এ মেয়ের মা মেয়ের জন্মের কয়েকদিন পরে মারা যায়। মারা যাবার আগে মেয়েকে সোমনাথ মন্দিরে ভজন দিয়ে যায়। এরা দেবতার পুজারী এবং সোমনাথ মন্দিরের প্রতিনিধি, তাদের কথা অকাট্য সত্য, কোন যুক্তি, কোন তর্ক তাদের সাথে করা যাবে না। বড় প্রতাপশালী সম্রাট পর্যন্ত এদের সামনে মাথা নুইয়ে দেয়, সামান্য এক কৃষক প্রজা তো কোন ছার! এ ছাড়া এদের সাথে তর্ক করলে যে দেবতার অভিশাপ অনিবার্য!!
অতএব নির্দ্বিধায় পুজারীদের দাবী মাথা পেতে নিতে, এত দিনের সুখের স্বপ্ন, স্নেহ-মমতার বন্ধন, আবাস ত্যাগ করে যুবতী সহযাত্রী হলেন পূজারীদের। তার কথা বলার কোন অধিকার নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন স্বাধীনতা নেই; সে যেন এক মাটির প্রতিমা, পূজারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এর বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হলেই দেবতার অসন্তোষ-অভিশাপ বর্ষিত হবে!!
তাকে দেব মন্দিরে ভজন দেয়া হয়েছে, অতএব তাকে আজীবন দেব মন্দিরের চার দেয়ালের মধ্যে কাটাতে হবে। দেব মন্দিরে আগত রাজা মহারাজা ও দেবতার বড় বড় পূজারীদের সন্ততুষ্টিতে তার জীবন উৎসর্গ করতে হবে। এখানে সে দেবীর মর্যাদা পাবে। কিন্তু তার একমাত্র কাজ হবে দেবতার পূজারীদের ভোগে সর্বাত্মকভাবে নিজেকে নিয়োজিত করা। বাকী জীবনে তার অন্য কোন কাজ নেই। বিবাহ নেই, সন্তান নেই, স্বামী নেই, সংসারের কোন ঝামেলা নেই। মন্দিরে পদার্পনের ক্ষণ থেকেই সে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত। তার একমাত্র পরিচয়, সে দেবদাসী, দেবতার পূজারীদের চরণে তার সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়াই তার একমাত্র করণীয়।
আর একটি ঘটনা। কোন এক গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক। চৈত্রের ভর দুপুরে মাঠে কাজ করে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। কাঠ-ফাটা রোদে হালচাষ করে ভয়ানকভাবে পিপাসার্ত। তাই সে পার্শ্ববর্তী এক কূপ থেকে পানি তুলে পিপাসা নিবারণ করল। কিন্তু এই পানি পান করা তার জীবনের জন্য কাল হলো। সে জানতো না যে, এ কূপ পৈতাধারী এক ব্রাহ্মণের। ঐ ব্রাহ্মণ এ কুপীর পানি ব্যবহার করায় তা এত বরকতময় হয়ে গেছে যে, সমাজের অচ্ছ্যুত নিকৃষ্ট জাতি শুদ্রদের তাতে হাত লাগানো মহাপাপ। আর এ মহাপাপ সংঘটিত করায় শূদ্র পরিচয়ের কৃষককে সমাজ থেকে নির্বাসন দন্ড শোনানো হলো। তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দেবতার মন্দিরের নামে বাজেয়াপ্ত করা হলো।
এখানে যে দু'টি ঘটনার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা এই আবহমান বাংলার এক সময়কার অতি সাধারণ ঘটনা ছিল। এ বাংলারই বুকে অহরহ এ ঘটনা ঘটতো। মুসলিম বিজয়ী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বাংলায় আগমনের পর ইসলামের আলোয় অন্ধকার সমাজ আলোকিত হওয়ার পরেই কেবল এসব অভিশাপ থেকে বাংলার মানুষ মুক্তি পায়।
তৎকালীন পৌত্তলিক সমাজ নানা অনাচার ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল। ধর্মের নামে এক শ্রেণীর মানুষ অপর শ্রেণীর ওপর চালাতো নিপীড়ন, নির্যাতন। সমাআজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে ছিল জাতপাতের দুর্ভেদ্য দেয়াল। ব্রাহ্মণরা ছিল সমাজের অতি শ্রদ্ধার পাত্র আর শূদ্ররা ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট। সমাজের সর্বেসর্বা ছিল ব্রাহ্মণরা, পক্ষান্তরে শূদ্রদের ছিল না কোন সামাজিক মর্যাদা, অধিকার। তারা ছিল অচ্ছুৎ, এদেরকে মানুষ ভাবলে সে উঁচু শ্রেণীর হলেও তাকে ক্ষমার অযোগ্য মনে করা হতো। পৌতাধারী ব্রাহ্মণরা এদেরকে ঘৃণিত কীট সাব্যস্ত করে বনে-জংগলে তাড়িয়ে দিত, তাদের সহায়-সম্পত্তি মন্দিরের নামে বাজেয়াপ্ত করে ভোগ দখল করত। দেবমূর্তি পূজার একচেটিয়া ঠিকাদার ব্রাহ্মণ শ্রেণী যে এলাকায় মূর্তি স্থাপন করতো, সেখানে শূদ্রদের ন্যায় নিম্ন শ্রেণীর বসবাসের কোন অধিকার ছিল না। ব্রাহ্মণরা যে কুয়া থেকে পানি তুলত, যে মন্দিরে দেবতার ভজন গীত গাইত, সেখানে শূদ্রদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। তারা মন্দিরের বেশ দূরে থেকে দেবতার নামে ভজন দিত, উচ্চ বাবুদের প্রণাম করত। কেননা, নীচু শ্রেণীর মানুষ তাদের গাত্র স্পর্শ করলে বা তাদের সাথে কথা বললে, তাদের ধর্ম-কর্ম বৃথা যেত। ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতো। নীচু শ্রেণীর মানুষের এ ভাষায় কথা বলারও অধিকার ছিল না। তারা এ ভাষায় একটি বর্ণও উচ্চারণ করলে তাদের কানে গরম সীসা ঢেলে দেয়া হতো।
মনুর আদর্শের নামে হিন্দু ধর্মের ঠিকাদার ব্রাহ্মণ শ্রেণী সমাজকে এমন কুসংস্কারে নিমজ্জিত করে রেখেছিল যে, সেখানে আল্লাহর বা সৃষ্টিকর্তার এ কোন একক ধারণা ঠাই পাবার সুযোগ ছিল না। ত্রিশ কোটি দেবতাকে ঘিরে সৃষ্টিকর্তার ধারণা আবর্তিত হতো। এদের কল্পিত মূর্তি তৈরী করে চলতো পূজা অর্চনা। গাছ,পাথর, সূর্য, আগুন, গরু,সাপ, এসবের মধ্যেও তারা দেবশক্তি আবিষ্কার করে পূজা করতো। আল্লাহর সৃষ্টি কোন কিছুর মধ্যে ব্যতিক্রম কিছু পরিলক্ষিত হলেই তাকে পূজা করা শুরু হয়ে যেতো। এ সমাজ ব্যবস্থায় নারী সমাজ ও অচ্ছুৎ ও অস্পৃশ্য শুদ্রদের চেয়ে কোনো অংশে কম নিকৃষ্ট ছিল না। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে নারী সম্পর্কে বলা হয়েছে, "মৃত্যু, নরক, সাপ, আগুন, বিষ এর কোনটিই নারী অপেক্ষা খারাপ ও মারাত্মক নয়।"
স্বামী মৃত্যুর সাথে সাথে সহমৃত্যুবরণ বা সতীদাহ রীতি পালন করতে বাধ্য হতো অনেক হিন্দু নারী। 'মনুর আদর্শে' নারী জাতি পিতা, স্বামী বা সন্তানের নিকট থেকে কোন কিছু পাবার অধিকার ছিল না। মনুর বিধান মতে নারীর নিজ ঘরেও কোন কিছু করার স্বাধীনতা ছিল না। নারী ছিল শুধু ভোগের সামগ্রী। ধর্মশাস্ত্রে দেবতাদের যে পরিচয় এবং যে সব কাহিনী বিধৃত হয়েছে, তার অধিকাংশই নারীর সাথে ব্যাভিচার তথা লীলা-খেলা, নারী অপহরণ ও অবাধ যৌনাচার আশ্রিত। ধর্মীয় শাস্ত্রে দেবতা ভাগ্নের রূপ ধারন করে মামির সাথে প্রেমলীলার কাহিনীও বেশ রসালোভাবে বর্ণিত হয়েছে। দেবতাদের এসব নারী ঘটিত কাহিনী আধুনিক পর্ণো সাহিত্যকেও হার মানায়। যে জাতির দেবতাদের ব্যভিচারকর্ম ধর্মশাস্ত্রে রসালোভাবে বর্ণিত হয়েছে, সে জাতি ব্যভিচারকে কতখানি পবিত্র, জায়েজ কর্ম মনে করবে, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে!
এদেশের মানুষ জাতপাত ও বর্ণ বৈষম্যের এহেন জাঁতাকলে যখন নিপীড়িত হচ্ছিল, মানবতা ও সৌভ্রাতৃত্বের কবর রচিত হচ্ছিল প্রতিনিয়ত, তখন ইসলাম এলো সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতার দাওয়াত নিয়ে। নিপীড়ত মানুষকে দিলো আলোর দিশা, মুখে ফোটালো শান্তির স্নিগদ্ধ হাসি। হেরা পর্বতে দীপ্ত মশালের আলোতে বিদূরীত হলো সকল অন্ধকার, জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশার চাদর ছিড়ে উড্ডীন হলো মানবতার বিজয়ী পতাকা। সেই থেকে আট শ' বছর যাবৎ এ ভূখন্ডে ইসলাম স্বমহিমায় ভাস্বর।
কিন্তু 'ধর্ম নিরপেক্ষতা', 'বাঙালী সংস্কৃতি' ও 'উৎসের' সন্ধান করার নাম করে সে জাহেলিয়াতকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। একদা এ দেশের মানুষ যে জাহেলিয়াতকে ত্যাগ করে ইসলামকে আকড়ে ধরেছিল, সে জাহেলিয়াতের নব্য অন্ধ ভক্তরা ইসলামের পরিবর্তে তাকে প্রতিষ্ঠা করতে আদাজল খেয়ে নেমেছে। রাষ্ট্রীয় শক্তি এদের সহায়ক হওয়ায় এদের এখন পোয়াবারো। উৎসের সন্ধানের কথা বলে এদেশের ইসলামপূর্ব পৌত্তলিক জাহেলিয়াত যুগের অন্ধ চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্যকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে ইসলামকে উৎখাত করার কর্মকান্ড বেশ তোড়জোড়ের সাথেই চলছে। এদের কাছে ইসলাম নাকি উন্নতির পথে অন্তরায়। তাই উন্নতির শীর্ষ দেশে পৌঁছতে এরা শেকড় সন্ধানে নেমে পড়েছে। ইতিহাসের পাতা ঘেটে সে পূতিগন্ধময় অন্ধকার যুগকে মহিমান্নিত রূপ দিয়ে প্রতিষ্ঠার খোয়াবে তারা বিভোর।
আমাদের পূর্ব পুরুষরা এ অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসতে অনেক নিপীড়ন সহ্য করেছেন। অনেক রক্ত ঝরিয়েছেন। পৌত্তলিকতার ধ্বজাধারী, কপালে তিলক আর গলায় পৈতাধারী, আভিজাত্যের অহমিকায় অন্ধ ব্রাহ্মণ কাপালিকদের কৃপাণের আঘাতে তাদের রক্তের নদী বাইয়ে গেছে। নিঃস্ব নিঃসম্বল হয়ে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। তবুও তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-র পথ থেকে বিচ্যুত হন নি। কিন্তু আজ মুসলিম নামের মুসলিম ঘরের সন্তান হয়েও পৌত্তলিকতার অন্ধভক্ত শ্রেণী এ ভূখন্ড থেকে ইসলামের আলো ফু দিয়ে নিভিয়ে দিতে প্রয়াসী। যে কঠিন ত্যাগের বিনিময়ে এ ভূখন্ডে ঈমানের আলো বিকশিত হয়েছিল, তাকে উৎখাত করতে তারা চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এ ষড়যন্ত্রের ধারা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি ভৌগোলিক সীমানা নিয়েও বিস্তৃত।
সর্বত্র শোনা যায় বাঙালী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার এবং বাঙালী সংস্কৃতির জয়ধ্বনি। একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই নাকি এ মহতি উদ্যোগ। আবহমান কালের অভ্যস্ত ছিল, সে গুলোই নাকি আমাদের প্রকৃত সংস্কৃতি। পরবর্তিতে মুসলিম যুগে যে সংস্কৃতি অনুসৃত হয়েছে, তা বাঙ্গালীর সংস্কৃতি নয়, বিদেশী সংস্কৃতি। এভাবে বাঙালী সংস্কৃতিকে তথা আবহমান কালের দোহাই দিয়ে ইসলামী সংস্কৃতিকে বিদেশী সংস্কৃতি এবং তাকে বর্জন করা, ঘৃণা করার পথ উন্মুক্ত করা হচ্ছে। তাদের কথিত মহিমান্বিত আবহমান কালের সংস্কৃতির কিঞ্চিত রূপ নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেকালের মানুষ উলু ধ্বনি, কাসা ধ্বনি, ঢাক-ঢোল পেটানো, জড় পূজা, গাছ পূজা, গাভী পূজা, মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে আগুনের কাছে মঙ্গল কামনা, স্বরস্বতী দেবীর কাছে বিদ্যা-বুদ্ধির কামনা করায় অভ্যস্থ ছিল। তারা গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র স্নান করে সকল পাপ মোচন করতো, তাদের নৈতিক মূল্যবোধ এত অধঃপতিত ছিল যে, গাভীর সাথে মানুষের যৌন মিলনের চিত্র অঙ্কন করে ধর্মীয় পবিত্র স্থান মন্দিরের গাত্রে সজ্জিত করে রাখতো। নিজের মেয়েকে গণব্যভিচারে সহায়তা করতে দেবমন্দিরে পাঠাতো দেবসাদী বানিয়ে।
তথাকথিত আবহমানকালের এ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হলো মঙ্গল-প্রদীপ। অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে কোন অনুষ্ঠান বা কোন কাজ শুরু করার পূর্বে মঙ্গল-প্রদীপ জ্বালানো এখন আবশ্যকীয় পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অথচ মঙ্গল-প্রদীপ জ্বালানো আবহমান কালের বাঙালী হিন্দুর সংস্কৃতির অংশ। তারা মঙ্গল কামনার জন্য প্রদীপের আগুনের কাছে আশ্রয় নিত। ইসলামের সংস্পর্শে এসে তারাই মঙ্গল কামনার জন্য আগুনকে ছেড়ে আগুনের শ্রষ্টা আল্লাহ্কে স্মরণ করতে শিখে এবং কোন কাজের শুরুতে 'বিসমিল্লাহ'.... বলে শুরু করে। আবহামান কালের বেড়াজালে এভাবেই ইসলামের একত্ববাদের শিক্ষার স্থলে পৌত্তলিকতা তথা শিরক প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে।
অসাম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতির নামে আজকাল আর একটি মারাত্মক প্রবতা লক্ষ্য করা যায়। সেটি হলো কোন অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াতের পাশাপাশি গীতা পাঠ করা। কোথায় আসমানী কিতাব আল-কুরআন আর কোথায় মানব রচিত দেব-দেবীদের লীলাখেলার রসাত্বক বর্ণনায় ভরপুর গ্রন্থ গীতা। অথচ এ দুইকে একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকতার ধ্বজাধারীরা। কে না জানে আল-কুরআন অবতীর্ণ হবার পরে অন্য সব আসমানী কিতাব পর্যন্ত অচল, মূলতবী হয়ে গেছে। অন্যসব আসমানী কিতাব যার তুলনায় আলোচনার যোগ্যতা রাখে না, সেখানে মনু মহারাজ নামক এক মানবের মনগড়া ধর্মীয় গ্রন্থকে এরা পাশাপাশি দাড় করাবার ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক বাঙালীদের দ্বারা পরিচালিত মিছিল, শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের মুখোশের সমারহ। এসব মুখোশ হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রের কল্পিত চরিত্র। নারদ, রাক্ষস, হনুমানের কথা এভাবে এরা স্মরণ করে থাকে। হিন্দুদের একান্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান-নগ্ন পদে শোভাযাত্রা, হোলি উৎসব ইত্যাদি নতুন নামে নতুন আকারে আমাদের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে অঙ্গিভুত করা হয়েছে। পূজা-পার্বন উপলক্ষে হিন্দু সমাজে মূর্তি বানানো ও তা প্রতিষ্ঠা করার যে ধুম পড়ে যায় ভাস্কার্য নির্মাণের নামেও তা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠা করার ধুম এদেশে বারো মাসই লেগে আছে। হিন্দু ধর্মের 'পূনর্জনম' দর্শন এখন নাটকের অন্যতম উপাদান। আল্লাহ্ শব্দ উচ্চারণ করতে বাঙালী এখন লজ্জাবোধ করে। তারা বিধাতা, সৃষ্টিকর্তা, ঈশ্বর শব্দে অভ্যস্থ হবার চর্চা করছে। ইসলামী শব্দগুলো বাংলা করণের প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। বাংলা করণের তাণ্ডবে অচিরেই তুর্কী স্টাইলে মসজিদ থেকে বাংলায় আজান উচ্চারিত হলে, নামাজের সূরা-ক্বিরআত বাংলা তরজমায় হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।
দুনিয়ার ইসলাম এসেছে সকল অন্ধকার, মিথ্যাকে অপসরণ করার জন্য। ইসলামের নবী (সাঃ) যখন আরব মুশরিকদের কাছে সত্যের দাওয়াত দিয়েছিল, তখন তাদের কিছু নেতৃবর্গ তাদের পূর্বপুরুষের মনগড়া ধর্ম ও কুসংস্কার আকড়ে থাকার জন্য সচেষ্ট ছিল, তারা সত্যের মশালকে নিভিয়ে দেয়ার জন্য কত না প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। শেকড় সন্ধানের নামে পুর্বসূরীদের অন্ধকার জীবন দর্শনকে প্রতিষ্ঠার এ সয়লাবও সে আবু লাহাব, আবু জাহেলের কর্মকান্ডের সাথে তুলনীয়। কুরাইশ সর্দার সত্যের সৈনিকদের কাফেলার গতি রুদ্ধ করতে না পেরে একদা রাসূল (সাঃ) এর কাছে আপোষ প্রস্তাব দিয়েছিল এই বলে যে, আপনি এক বছর আমাদের দেবতাদের পূজা করবেন, আমরাও এক বছর আপনার আল্লাহর পূজা করবো। অসম্প্রদায়িক বাঙালী সংস্কৃতির ধ্বজাধারীদের কর্মকান্ড তো সেই একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিমপ্রধান এ দেশে তারা সরাসরি ইসলাম বিরোধিতা না করে, কৌশলে মুসলমানদের পৌত্তলিকতা তথা শিরকে লিপ্ত করাচ্ছে। ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও মঙ্গল প্রদীপের আগুনের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করে কৌশলে তার ঈমানকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পূনর্জন্ম, ঈশ্বর, প্রভৃতি পৌত্তলিক দর্শনে অভ্যস্থ করানো গেলে স্বাভাবিকভাবেই তার ঈমানী চেতনা নির্বাপিত হয়ে যাবার কথা।
একটি মুসলিম দেশে কতিপয় আবু জাহেলের প্রেতাত্মার এ ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড থেকে মুসলিম সমাজকে উদ্ধারে এ দেশের আল-ফারুকের উত্তরসূরীরা আর কত নীরব, নিশ্চুপ থাকবে। পৌত্তলিকতার এ সয়লাব রুখতে মুহাম্মদ বিন কাসিম, বখতিয়ার খিলজীর উত্তরসূরীদের কি কিছুই করার নেই?