আমার দেশের চলচিত্র
ফারূক হোসাইন খান
==================================================
এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ হাদীস বিশারদ শাইখুল হাদীস মাওঃ আজিজুল হক সাহেব দেশ বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক, ইসলামের ঝাণ্ডাকে শীর্ষে উত্তোলন ও কুফরের প্রসাদ বাতিল করার আন্দোলনে অমিততেজা এক বিপ্লবী পুরুষ। যার নামে থর থর করে প্রকম্পিত হয় বিশাল ভারতের ব্রাহ্মণ শাসকদের হৃদয় থেকে প্রসাদের স্ত্রী পর্যন্ত। কিন্তু এদেশের এই অগ্নি পুরুষ, ইসলাম প্রিয় মানুষের মধ্যমনিকে কেন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল? এই বৃদ্ধ বয়সে তাকে কেন কারা যন্ত্রণা দেয়া হল? কি ছিলো তার অপরাধ? তিনি কি রাষ্ট্র বিরোধী বা সরকারের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক কোন কাজ করেছেন? তিনি কি রাজনীতির নামে সন্ত্রাস, ভাংচুর চালিয়েছেন, বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন, প্রতিপক্ষকে খতম-নির্মূল করার শ্লোগনি নিয়ে রাজপথে নেমেছেন? নাকি জাতিকে বিভক্ত করার কুমতলব নিয়ে প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন যাতে দেশে একটা গৃহযুদ্ধ লেগে যায় ?
ইসলামী ঝাণ্ডাকে উপরে তুলে ধরা, ইসলামী আদর্শকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা বা মজলুম মুসলমানদের পক্ষে কথা বলাই কি তার অপরাধ? কাপালিকদের বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদ করাই কি তার দোষ হয়ে গেল?
বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে ও মসজিদ পুনঃনির্মানের দাবীতে তিনি যে লং মার্চ করেছিলেন তাতে গুলি বর্ষণ করে তরতাজা মুজাহিদদের খুন ঝরানো হয়েছিল। সেই বাবরী মসজিদ ভাঙার নেপথ্যের নায়ক নরসীমা রাওজীর প্রত্যক্ষ মদদে মসজিদ ভাঙ্গার তাণ্ডবের পর পুরো ভারতের হাজার হাজার মুসমানের রক্তের নদী বইয়ে দেয়া হয়েছে। ভূলুণ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য মুসলিম নারীর ইজ্জৎ। মানবতার মহা দুশমন যে আর্য ব্রাহ্মণ আমাদের স্বজাতির এই ভয়াবহ পরিণতির জন্য দায়ী তার ঘৃণিত ও অপবিত্র পদযুগলকে এদেশের মাটিতে স্থান দিয়ে এদেশের মাটিকে অপবিত্র করতে দিতে চাননি বলে মাওঃ আজিজুল হক সহ বহু নেতা কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়। তিনি চানক্যদের গঙ্গার পানি নিয়ে রাজনীতি ও ফারাক্কা বাঁধকে আমাদের মৃত্যু ফাঁদে পরিণত করার আর্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে আপোষহীন ভূমিকা নিচ্ছিলেন বলে তাকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ট্রে বন্দী করা হয়। পার্থিব স্বার্থ ও ব্যক্তি-মর্যাদার প্রতি লক্ষ করে তিনি ইসলামী আদর্শ ও মর্যাদাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন বলেই এই বৃদ্ধ বয়সে তাকে জেলের জুলুম সহ্য করতে হয়। এই একই অপরাধে (!) ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় নবীন প্রবীণ আরও বহু নেতাকে বন্দী করা হয়।
কিন্তু কেন এই অবিচার? আমরা কি এতই নিকৃষ্ট হয়ে গেছি যে বৃহৎ শক্তি বলে ভারতের অন্যায়ের প্রতিবাদ করারও অধিকার আমাদের নেই। আমরা কি আজীবন ভারতের ইচ্ছের বেদীমূলে বলি হতে থাকব? আমাদের দাম্ভিক ও জালিম শক্তির কাছে সর্বক্ষণ মাথা নত করে থাকার আত্মঘাতী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কেন? শসাকের গদীতে আসীন ব্যক্তিগণ অমাদের ভীর ও কাপুরুষ করে গড়ে তোলারই বা কোশেশ করছেন কোন উদ্দেশ্যে?
ইসলামের চিরন্তন দাবী, বিশ্বের কোন অঞ্চলে একজন মুসলমান নির্যাতিত হলেও বাকী বিশ্বের মুসলমানরা তাদের উদ্ধারে জিহাদ ঘোষণা করবে। মুসলিম রাষ্ট্রের শাসক হয়েও আমাদের প্রকল্পের সে দায়িত্ব পালন করার ইচ্ছে বা সাহস কোনটাই ছিল না। উপরন্তু, মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায় শোকাহত মুসলমানদের দমন করে আমাদের এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে, ঈমান, ইসলাম ও মানবতার পক্ষে কথা বলা মহা অপরাধ। শাইখুল হাদীস সাহেবকে জেলে পুরে পুনরায় প্রমাণ করেছে যে, এদেশে ভারতের অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ও ইসলামের আদর্শ প্রচারকারীর পুরস্কার কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ট।
তাই স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি ভারতের কাছে বিক্রি হয়ে গেছি যে, তাকে সব ব্যাপারে তোয়াজ করে চলতে হবে? তার ইচ্ছে মাফিক আমাদের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে। তার হুকুম ছাড়া এদেশে একটা পিনেরও পতন ঘটবে না? আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বাক স্বাধীনতা কি ভারতের দাদা বাবুদের কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে যে তারা আমাদের ওপর মাতাব্বুরি করতে চায়, আমাদের ন্যায় ও সত্য বাক্য উচ্চারণে বাধা প্রদান করতে চায়? বাংলাদেশের স্বাধীনতার কি কোন কানাকড়ি মুল্য নেই কাপালিক ও চাড়াল-চামুণ্ডাদের কাছে?
মূলত ভারতের শাসন ক্ষমতায় দাম্ভিক ও মানবতা বিবর্জিত ব্রাহ্মণরা আসীন থাকায় তারা যে পরিমাণ না দম্ভ দেখায় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী লম্ভ দেখাতে আমরা উৎসাহিত করি, সুযোগ করে দেই। এদেশের আলো, বাতাসে লালিত পালিত এক শ্রেণীর ‘বন্দে মাতরম’ ভক্ত ও ইণ্ডিয়ান ব্রাহ্মণদের উচ্ছিষ্ট ভোজীরা এদেশকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার তোড়জোর করায় তাদের ঔদ্ধত্যের মাত্রা বেড়ে গেছে। এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর কাপালিকদের চাপিয়ে দেয়া সকল প্রকার হস্তক্ষেপ প্রশাসনের মধ্যমনিরা অবলীলাক্রমে মেনে নেয়ায় এবং তাদের সকল প্রকার অবৈধ ইচ্ছার নিকট আমাদের সরকার নতজানু ভূমিকা পালন করায় দাদা বাবুরা আমাদের সিকিম, ভুটান ঠাওরাচ্ছে।
এরই নামকি স্বাধীনতা, একেই কি বলে জাতীয়তাবোধ বা দেশপ্রেম? নিজের মনের কথাটি যদি দাম্ভিক শক্তির ভয়ে বলতে না পারলাম, নিজের পথে চলতে যদি তঙ্করদের ভয়ে হাটু ঠকঠক করে, অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে যদি বুক কাঁপে, মুখে তালা ঝুলিয়ে নিতে হয় তবে সে স্বাধীনতার মূল্য কোথায়? এমন ভীত কাপুরুষোচিত কার্যকলাপ কি দেশপ্রেম না দাসত্ব স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল না পাওয়া গেলে সে স্বাধীনতার আদৌ কি প্রয়োজন আছে?
দেবতার আসনে বসে যারা দেশ শাসন করে তাদের কাছে এ প্রশ্নের কোন জবাব নেই। তারা শুধু শাসনই করে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে মোটেই ইচ্ছুক নয়। ব্যক্তি চিন্তার কাছে জনতার মতামতের কোন মূল্যই তাদের কাছে নেই। তারা ভুলেই বসে আছে যে, আমরা মুসলমানরা সেই সব জাতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র যারা নিজ নিজ ধর্মকে বিকৃত করেছে। ব্যক্তি স্বার্থ ও পার্থিব স্বার্থ হাসিলের জন্য ধর্মকে অপব্যাখ্যা ও শোষনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। স্বার্থের কাছে ধর্ম একান্ত তুচ্ছ, কিন্তু সাচ্ছা মুসলমানদের নিকট ঈমান, ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ধন। জালিম যত বড় শক্তিই হোক তার কাছে মাথা নত করা মুসলমানের ধর্ম নয়। ভীরুতা ও কাপুরুষতা তাদের কাছে একান্ত নিন্দনীয় ব্যাপার। ইসলাম একদিকে শান্তির ধর্ম প্রয়োজনে শক্তিরও ধর্ম। ভৌগলিক সীমা, রাষ্ট্র, বর্ণ প্রথা ইসলামে একেবারে অচল। তাই বিশ্বের এ প্রান্তের মুসলমান অন্য প্রান্তের বিপদগ্রস্থ মুসলমানের পাশে দাঁড়াতেও কুন্ঠিত হবে না। ঈমানের এই দাবীকে বাস্তবায়িত করার জন্য যত বাধাই আসুক তা সে উপেক্ষা করবেই। আমাদের জাতীয় নীতি নির্ধারকদের এই ঈমানী চেতনার অভাবে ইসলাম বিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদ করায় মুসলমানের হাতে মুসলমানরা নির্যাতিত হওয়ার মত লজ্জাস্কর মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে। ইসলামের ইতিহাসের উজ্জ্বল জৌতিস্ক আজম ইমামে হযরত আবু হানিফা (রহঃ), হযরত আনাস ইবনে মালেক (রহঃ) ও হযরত আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) প্রমুখ ব্যক্তিসহ যুগে যুগে অংসখ্য মুসলিম মনীষী ইসলামের আদর্শের স্বাতন্ত্র ও মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসলিম শাসকদের রোষানলে পড়ে কারাগারে নির্যাতন ভোগ করেছেন বছরের পর বছর ধরে।
ইতিহাস কিন্তু ন্যায় বিচার করতে ভুল করেনি। ইসলামের জন্য তাঁরা যে নির্যাতন ভোগ করেছেন তা যুগে যুগে মুসলমানদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে হাজারো কষ্ট স্বীকারে প্রেরণা যুগিয়েছে। পক্ষান্তরে, তাদের ওপর জুলুমকারীরা জালিম হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে আছেন। দুর্ভাগ্য মানুষের শিক্ষা নেয়ার জন্যই ইতিহাস রচিত হলেও আমাদের সরকারের কর্তা ব্যক্তির ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষা নিতে ইচ্ছুক বলে মনে হয় না।
সুতরাং এই দেশের ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমরা যারা চিন্তিত এই মুহূর্তে তা আগ্রাসী শক্তির থাবা থেকে মুক্ত রাখতে তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। শায়খুল হাদীস জনাব আজিজুল হক সাহেবের মত সর্বজন শ্রদ্ধেয়, জাতি ও দেশ প্রেমিক ব্যক্তির ন্যায় আর কোন দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে দেশের ও জাতির পক্ষে কথা বলার জন্য হয়রানি ও দুর্ভোগের শিকার না হতে হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, মনের ভাষাকে প্রকাশ করতে চাই কারো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া। কোন দাম্ভিক শক্তি আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে যদি পুতুল খেলায় মত্ত হতে চায় তবে তার অশুভ হত দুটোকে ভেঙ্গে দিতে দয়ার দুর্বলতা দেখাতে রাজী নই। আমরা বুক ফুলিয়ে আমাদের ঈমানী অস্ত্র চালিয়ে দাম্ভিক শক্তিকে ঝাঝরা করে দিতে মোটেই অক্ষম বা ভীত নই। স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার, কার বাপের সাধ্য আমাদের সে অধিকারে নাক গলায়। হাজার বছরের গোলামীর চেয়ে একদিনের স্বাধীন জীবনও আমাদের কাজে মহা মূল্যবান।
অতএব স্বাধীনতার এই অমিয় মন্ত্রে আমাদের উজ্জিবীত হতে হবে, দেশ প্রেমের নব চেতনা নিয়ে আমাদের সীসা ঢালা প্রতিরোধ প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে স্বাধীনতার বিরোধী আগ্রাসী শক্তি ও তাদের এদেশী দোষর শকুন- শকুনীলের নাকের ডগার ওপর। কোথায় সেই অকুতোভয় স্বদেশ প্রেমিক যোদ্ধাদের কাফেলা?
এই বাংলাদেশের আলো বাতাসে লালিত পালিত হয়ে, বাংলার বুকে জন্ম নিয়ে একটি মহল বাংলার ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসকে হৃদয় থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত করছে। মীনার ইসলাম, রাসূল - (সাঃ)-এর ইসলাম, আল্লাহ্র মনোনীত দ্বীন ইসলামের ওপর ছুরি চালিয়ে, ইসলামের অপরিহার্য ডালপালাগুলোকে ছেটে ছুটে মোঘল দানব আকবরের ‘দ্বীনে ইলাহী” কিসিমের এক নতুন দণ্ড-মুণ্ডহীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে সরল সহজ মুসলমানদের ঈমানকে হরণ করার পায়তারা করছে উক্ত মহল। এদের পূর্ব সূরীরা যুগে যুগে আব্দুল্লাহ বিন উবাই এর ভূমিকা পালন করে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধন করার অন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। ইসলামের ইতিহাসে এরা মোনাফেক, জাতির গাদ্দার হিসেবেই সুপরিচিত। এরা মুসলিম নামে মুসলিম সমাজের মধ্যে মিলেমিশে থেকে ইসলামের শত্রুদের এজেন্ট হিসেবে বিভীষণের ভূমিকা পালন করত। সেই মোনাফেক গোষ্ঠীর এদেশীয় সার্থক উত্তরাধীকারী হলো সেকুলার এবং বামপন্থী হিসেবে পরিচিত মহলদ্বয়ের অন্তর্ভূক্ত মুসলিম নামাবলী অলংকৃত আদম সন্তানগণ। এরা এই মুসলিম দেশেটিতে পাশ্চাত্য থেকে ধার করে আনা সেকুলারিজম {ধর্মনিরপেক্ষতা) রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে নতুন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদটি পাশ্চাত্যের জঠর থেকে ঊণিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভূমিষ্ঠ হয়। এর জন্মদাতারা যখন এটি জন্ম দেন তখন ইউরোপে আস্তিকতা ও নাস্তিকতা নিয়ে চলছিল প্রচণ্ড বিতর্ক। খৃষ্টধর্মে রাষ্ট্র পরিচালনার কোন সুনির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় গীর্জার পাদ্রীরা খেয়াল খুশিমত আইন করে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে জনগণকে শাসনের নামে উৎপীড়ন চালাত। তাদের শোষণের যাতাকলে পৃষ্ঠ হতে হতে এবং ধর্মকে বিজ্ঞান ও প্রগতির ঘোর বিরোধীর ভূমিকায় দেখে এক সময় ইউরোপের পুরো খৃষ্টান সমাজ ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে পাদ্রীদের যুগ যুগ ধরে শোষনের ফলে এক সময় তারা ঈশ্বরের অস্থিত্ব নিয়েও শংসয় প্রকাশ করতে শুরু করে। ক্রমে শংসয়বাণীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় তারা একসময় সকল অনাচার ও নিপীড়নের হোতা ঈশ্বর-পুত্র পাত্রীদের কার্যকলাপ গীর্জার চার দেয়ালের মধ্যে সীমিত করে দেয়। জেকব, হলিয়ক, ব্রেডলাক, সাউথ ওয়েল, থমাস কপার প্রমুখ দার্শনিকদের থিউরি অনুযায়ী এবং পরবর্তিতে আরও বিভিন্ন আন্দোলন ও প্রবক্তাগণের দলাই-মালাই, ঘষা-মাজার পর রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মের প্রভাবহীন আধুনিক সেকুলারিজম। এর মূল কথা হল ‘রাষ্ট্র তার রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন হবে ধর্মের প্রভাব মুক্ত। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে না। রাজনীতি, অর্থনীতি সংস্কৃতি ও প্রশাসন এসব ইহজাগতিক ব্যাপার-স্যাপার। সুতরাং এগুলো ইহজাগতিক আইন-কানুন, নিয়মানুযায়ী পরিচালিত হবে, ধর্মের ভিত্তিতে নয়। ধর্মের লক্ষ্য পারলৌকিক মুক্তি। সুতরাং তা ব্যক্তি জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসৃত ধর্মহীন সিলেবাস অনুযায়ী লেখাপড়া করে বুদ্ধিজীবী বনে যাওয়া এদেশীয় মুসলমানের সন্তানেরা বেশ ভাল করেই রপ্ত করে নেয় পাশ্চাত্যের এই উদ্ভট ও ধর্ম বিরোধী বক্তব্যকে। ওরা পাশ্চাত্যের আস্তিকতা ও নাস্তিকতার মধ্যে সংঘাতময় পরিবেশের ছাচে ফেলে ইসলামকে বিবেচনা করতে থাকে, মুসলমানদের ধর্মীয় মনীষীদেরকে মূল্যায়ন করতে থাকে পাশ্চাত্যের শয়তানের প্রতীক প্রাত্রীদের কাতারে ফেলে। সভা-সমাবেশ, মিছিল মিটিং সেমিনার সিম্পোজিয়াম ও প্রচার মাধ্যমে যখনই সুযোগ পায় গলাবাজী করতে থাকে "মৌলবাদ নির্মূল কর, ধর্মীয় রাজনীতি বন্ধ কর, মসজিদে রাজনীতি বন্ধ কর, রাজনীতি থেকে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা কর” ইত্যাদি। কিন্তু ওরা ক্ষুণাক্ষরেও একটু মাথা ঘামায়নি যে, সেকুলারিজমের উৎপত্তি হয়েছে পাশ্চাত্যে। পাশ্চাত্যের ধর্মান্ধ ও স্বার্থান্ধ্য পাত্রীদের অপকর্মের ফলে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্যই সেকুলারিজমের উৎপত্তি। ইউরোপের যে সমস্যার জন্য এর জন্ম আমাদের দেশে তেমন কোন সমস্যা নেই। ইসলাম বিজ্ঞান বিরোধী নয়। এদেশের সেকুলার বুদ্ধিজীবীরাও সভা-সেমিনারে দাবী করেন যে, “একদল ধর্ম ব্যাবসায়ী ধর্মের নামে। ব্যবসা করে এবং ধর্মের নামে রাজনীতি করে, মসজিদসহ সকল ধর্মীয়স্থানের পবিত্রতা নষ্ট করে, জনগণকে শোষণ করে। কিন্তু ধর্ম পবিত্র জিনিস, রাজনীতির সাথে একে মিলিয়ে ফেললে ধর্মের, ধর্মীয় স্থানের পবিত্রতা নষ্টহয়! "ইসলাম ধর্ম পরধর্ম সহিষ্ণু, অন্য ধর্মের ব্যাপারে ইসলাম হস্তক্ষেপ করে না" ইত্যাদি।
সুতরাং, ইসলামের পর-ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে যারা এত সুন্দর ফতোয়াবাজী করেন 'তারা কেন সেই ইসলামকে বাদ রেখে পাশ্চাত্যের একটা মনগড়া মতবাদ কায়েমের ঠিকাদারী নিয়েছেন। তাদের ভাষায় ইসলামের ন্যায় পবিত্র জিনিসটা নিয়ে কিছু সংখ্যক দুষ্ট লোক ব্যাবসা করেন, শোষন করেন, মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করেন। কিন্তু তারা কেন ধর্মের মত পবিত্র জিনিসটা ঐ সব খারাপ (!) লোকদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন না? কেন ধর্মকে খারাপ লোকদের হাতে ব্যবহৃত - হতে দিচ্ছেন? আসলে রাজনীতি কি একটা মহা অপবিত্র জিনিস যা ধর্মের সাথে মিশালে ধর্মকেও অপবিত্র করবে, মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবে? তাহলে এমন মহা অপবিত্র জিনিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তারা নিজেদের কেন সমাজের চোর ডাকাতের ন্যায় 'দাগী' হিসেবে চিহ্নিত করছেন, ভালো মানুষরা কি অপবিত্র জিনিস পছন্দ করতে পারে?
ওদের কাছে এসব প্রশ্নের কোন জবাব , নেই। ওদের মন-মানসিকতা অন্যের কাছে বাধা। ভাল মন্দ বিবেচনা করার শুলের নিজস্ব কোন জ্ঞান নেই। ওদের মিশনই হল পাশ্চাত্যের প্রভূদের সেকুলারিজম আমদানী করে তার বাংলা তরজমা এদেশে কায়েম করা। ওরা নিজেদের তথাকথিত গণতন্ত্রের পোদ্দার বলে জাহির করে যে, গণতন্ত্রে নাকি সকলের মতামত ব্যক্ত করার স্বাধীনতার কথাও বলা হয়। ওনারা সে গণতন্ত্রের কথা বলে সমাজতন্ত্র ও ধর্মবিরোধী একটা মতবাদ জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে গলাবাজী করতে পারলে ধর্মের ভিত্তিতে কেউ রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করার মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন না কেন? তাদের অপরাধ কি তাদের 'মৌলবাদী প্রগতি বিরোধী', 'পশ্চাৎপদ', ধর্ম ব্যবসায়ী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে তাদের কণ্ঠ রোধ করার নির্মূল করার অগণতান্ত্রিক তৎপরতা চালানো হয় কেন? ধর্মনিরপেক্ষতার নট-নটীরা জবাব দিবেন কি?
পাশ্চাত্যের অধিকাংশ লোকজন ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, পরকাল সম্পর্কে তারা একেবারেই নির্বোধ। তাছাড়া খৃস্ট ধর্মকে আধুনিকী করণের সময় পাদ্রীরা পুরো খৃষ্টজগতের সামনে একটা ধারণা পেশ করে যে, “যিশু খৃষ্ট শুলে চড়ে আত্মত্যাগ করেছেন পুরো খৃষ্টান সম্প্রদায়ের দ্বারা সংগঠিত অতীত এবং ভবিষ্যতের সকল পাপরাশির প্রায়শ্চিত্ব করার জন্য। সুতরাং ভবিষ্যতে কোন খৃস্টান হাজারো পাপ করলেও তা আর পাপ বলে বিবেচিত হবে।। ঈশ্বরের দরবারে তা আগেই মোচন হয়ে গেছে।”
পাশ্চাত্য জগত এই উভয় ধ্বংসাত্মক ধারণার বশবর্তী হয়ে পাপের কোলে নিজেদের সপে নিয়েছে। খেয়াল খুশিমত রাষ্ট্র ও সমাজকে শাসন-শোষন করার দণ্ড হাতে তুলে নিয়েছে। জীবনকে তারা দুটি ভাগে ভাগ করেছে। এক ইহজাগতিক ও অন্যটি পারলৌকিক। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এসব কর্মকাণ্ড ইহলৌকিক এবং ব্যক্তিগত ধর্ম পালন এটা পরলৌকিক। অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা, সামাজিক তৎপরতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিকে পরকালে কোন জবাব দিতে হবে না। কিন্তু ইসলাম কি ঐসব খৃস্টান মতলববাজদের সাথে একমত ? হাদীসে আছে, “দুনিয়া হচ্ছে পরকালের কর্মক্ষেত্র মানুষ দুনিয়র কর্মফল পরকালে ভোগ করবে।” সুতরাং, একথা কি বলা যায় যে, মানুষ শাসক হয়ে সন্ত্রাস চালিয়ে দুর্বলকে হত্যা করবে, প্রশাসনে থেকে ঘুষ-দুর্নীতি, ব্যভিচার-অশ্লিলতা, মদ্যপান করবে কিন্তু আল্লাহ এর কৈফিয়ত চাইবেন না বা চাইতে একেবারেই অক্ষম?
ইসলামে কি কাউকে প্রভূ সেজে, আইন করে অন্য মানুষকে গোলামের ন্যায় শাসন করার অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামের দ্বিতীয় রোকন যাকাত—যা আদায় করা সম্পর্কে কুরআনের বহু স্থানে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের শাসন কর্তা ধনীদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করবেন এবং এভাবে রাষ্ট্রের অর্থনীতির মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখবেন। কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের অনুসৃত অর্থনীতির কাঠামোতে যাকাত উপেক্ষা করা হয়। কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, চোরের হাত কাটা এবং ব্যভিচারের জন্য বেত্রাঘাত বা প্রস্তুরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যা ইসলামী সরকার না থাকলে কার্যকর করা সম্ভব নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদে একে অমানবিক ও মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে প্রত্যাখ্যান করা হয়। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষ সরাসরি ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপে বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত। বোধগম্য নয় যে কুরআনে সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান উল্লেখ থাকার পরও এ দেশীয় সেকুলার পণ্ডিতরা কোন প্রত্যাদেশের জোরে ইসলামকে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে ফতোয়া দিচ্ছে। নিজেরা ইসলামের ফরজ বিধান অস্বীকার করছে অন্যকেও অস্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করে তাদের ঈমান লুটে নেয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মদীনার মূল ইসলামকে রাষ্ট্র ও সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে তাদের মৌলবাদী আখ্যা নিয়ে প্রমাণ করতে চাইছে যে, এদের চিন্তা চেতনা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। মদীনার মুহাম্মদ (সাঃ) এর ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এ যুগের জন্য একটা মস্তবড় অপরাধ!
সেকুলার পন্থীরা যতই ধর্মের দোহাই পারুক, হজ্জ করুক আর নামাজ পড়ুক ওরা মুলতঃ ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন, ওদের তৎপরতা ইসলামের মৌলিক অস্তিত্বের জন্য ধ্বংসাত্মক। আল্লাহ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জীবন ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গ করলাম। আমার নিয়মিত তোমাদের উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।* (মায়েদা-৩)
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফয়সালা করে দেয়ার পর সে ব্যাপারে কোন মুমেন নারী-পুরুষের কোন ইখতিয়ার থাকে না।” (আল আহযাবঃ ৩৬)
আল্লাহর নাযিল করা যাবতীয় বিধান অনুযায়ী যারা বিচার ফয়সালা করে না তারা কাফের, যালেম তারা ফাসেক।” (সূরা মায়েদাঃ ৪৪ - ৪৭)
ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র মনোনীত জীবন বিধান"। (আলে ইমরান-১৯।
ইসলাম ব্যতীত যদি কেউ অন্য কোন জীবনাদর্শ অনুসরণ করে আল্লাহ কখনও তা গ্রহণ করবেন না। (আলে ইমরানঃ ৮৫)
সুতরাং ইসলামকে শুধু মাত্র ব্যক্তি জীবনের গণ্ডীতে আবদ্ধ করার চেষ্টা আল্লাহর উল্লেখিত ঘোষণার সরাসরি লঙ্গন। আল্লাহ আমাদের পূর্ণাঙ্গজীবন যাপন করার জন্য আল কুরআন প্রেরণ করেছেন। রাসূল (সাঃ) এই পবিত্র গ্রন্থখানাকে সংবিধান করে ইসলামী রাষ্ট্রর বাস্তব কাঠামো তৈরী করে সে অনুযায়ী আমাদের পথ চলার নির্দেশ করেছেন। অতএব আমরা কিভাবে মেনে নিতে পারি যে, আল্লাহু মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যাপন করার বিধান তৈরী করতে পারলেন, পরকালে এর কৈফিয়ত নেয়ার ব্যবস্থা রাখলেন কিন্তু মানুষের রাষ্ট্র ও সমাজের বিধান দেয়ার সামর্থ তাঁর ছিল না। এবং পরকালেও এর কৈফিয়ত নিতে পারবেন না!
সর্বশেষে বলতে হয়, সেকুলার মতবাদ ইসলাম সমর্থিত নয়। এর জন্মদাতা পাশ্চাত্যের ইহুদী-খৃস্টানেরা। তাদের মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ উপকারী বন্ধু মনে করে তাদের মতবাদকে তারাই গ্রহণ করবে যাদের চরিত্র স্বয়ং আল্লাহই তুলে ধরেছেন, “হে ঈমানদারগণ, ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকরূপে গ্রহণ করোনা। এরা নিজেরা পরস্পর বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক। তোমাদের মধ্যে কেউ যদি তাদেরকে বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষক রূপে গ্রহণ করে তবে সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। (মায়েদা–৫১)।
মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে যারা ইসলামের জন্য আন্দোলন করছেন এবং খাটি ইসলামের পথে যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে অমাদের সেকুলার পতিরা মৌলবাদী বলে ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং ভারত আমেরিকা, রাশিয়ার ন্যায় ইসলামের দৃশমন রাষ্ট্র গুলির সাথে গলাগলি বেঁধে তারা কুরআনের এই সত্যকেই প্রমাণ করছে।
অতএব আল্লাহ প্রেমিক ইসলামের সুগভীরমূলের সাথে সম্পর্কিত ও আস্থাশীল সত্যিকার মৌলবাদীদের সচেতন হতে হবে, ইসলামের ঘরের শত্রু বিভীষনদের ধ্বংসাত্মক ছোবল থেকে ইসলামের অখণ্ডতা রক্ষা করতে প্রস্তুতি নিতে হবে। | ওদের চিহ্নিত করে সরল সহজ মুসলমানদের ওদের ধোকা থেকে দূরে থাকার জন্য সতর্ক করতে হবে। সারা বাংলার অলিতে-গলিতে, পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে, "সেকুলারবাদীরা ইসলামী সমাজ, ইসলামী রাষ্ট্র, যাকাত, ইসলামী শরিয়ত ও জিহাদে বিশ্বাস করে না।
ওদের এ মোনাফেকী তৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের আপামর মুসলমানকে জিহাদের দাওয়াত পৌছে দিতে হবে। ঈমানী চেতনার এত ব্যাপক বহিঃপ্রকাশ করতে হবে যাতে ওরা চারিদিকে মৌলবাদী ছাড়া আর কিছু না দেখতে পায়। মৌলবাদী 'মৌলবাদী' চিৎকার করতে ঘটাতে যেন ওরা দম বন্ধ হয়ে গতায়ু হয়। কোথায় আছে সেই মৌলবাদের ঝান্ডাধারী প্রথম কাফেলা? সময় এসেছে এবার উড়াও তোমার ঝাণ্ডা।
******