ইতিহাসের পাতা থেকে:
স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিঃ পলাশী যুদ্ধ বিপ্লবের ধারা
গোলাম আহমদ মর্তুজা
(পূর্ব প্রকাশের পর)
পলাশীর যুদ্ধোত্তর বিদ্রোহের ধারা
[১৭৫৭-১৮৫৭]: ১৭৫৭তে পলাশীর যুদ্ধ বা মুসলমান শাসনের পতন হয়, আর ১৮৫৭ অর্থাৎ ১০০ বছর পর হয় মহাসংগ্রাম। সৈন্যদের বিরোধীতাকে কেন্দ্র করে যে বিদ্রোহ হয় সেই বিদ্রোহকে 'সিপাহি বিদ্রোহ' বলা হয়েছে। এই ১০০ বছরের মাঝে ছোট বড় বহু আন্দোলন, আক্রমণ, যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের ধারা কিন্তু অব্যাহত থেকেছে। তার কিছু নমুনা দেখানো যাচ্ছে।
১৭৫৮ তে শাহ আলম বিহার আক্রমণ করেন। ১৭৬০ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে পূর্ণিয়ায় বিদ্রোহ করেন খাদিম হুসেন। ১৭৬১ তে উধুয়ানালায় ও ১৭৬৪ তে বক্সারে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন মীর কাশিম। দরিদ্র অশিক্ষিত শ্রমিকদের 'চোয়াড়' বলা হত, তাদের দ্বারা ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে এক বিরাট বিদ্রোহ হয়। ডঃ এন ভট্টাচার্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পুস্তকে লিখেছেন ১৭৭০ খৃঃ চুয়াড়রা বৃটিশ এলাকা সমূহে রীতিমত সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। (পৃঃ৬) ১৭৭২ খৃষ্টাব্দের একটি শোষিত শ্রেণীর সংগ্রামকে ডাকাত দলের হানা বা লুণ্ঠন বলা হয়েছে। 'যে ডাকাত বাহিনী হামলা করেছিল সরকারী রেকর্ডে সংখ্যা ৫০,০০০ বলে উল্লেখিত আছে।" ঐ বছরেই নিঃস্ব ভিক্ষুক ও ক্ষুর্ধাতের দল একটা বিদ্রোহ করে। তারাই ইংরেজ ক্যাপ্টেন টমাসকে নিহত করতে সক্ষম হয়। ১৭৭৩ খৃস্টাব্দে ফকীর ও সন্ন্যাসীদের দ্বারা ইংরেজরা আক্রান্ত হয় এবং তাতে ইংরেজ নেতা মেজর রেনেল গুরুতর আহত হয়ে অকেজো হয়ে যান। ১৭৭৮ ও ৭৯ তে হায়দার আলীর নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইংরেজদের প্রতিনিধি দেবীসিংহের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়ায় ১৭৮৩ তে তিন হাজার লোকের আক্রমণের ঘটনা ঘটে। [দ্রষ্টব্য ডক্টর নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ৮]
১৭৮৭ সিলেটে প্রচন্ড বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৭৮৮তে বিদ্রোহীরা প্রায় তিনশো ইংরেজ ও কর্মীদের হত্যা এবং থানা দখল করেন। ১৭৯২ খৃষ্টাব্দে টিপু সুলতানের সন্ধির পর হতে ছোট বড় অনেকগুলো বিদ্রোহ হয়। ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে ভিজিয়ানা গ্রামে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয়। ১৭৯৫ সালে আসামে বিদ্রোহ হয়। ১৭৯৯ খৃষ্টাব্দে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিপ্লবের জন্য একটি জোট তৈরী হয়; তার নেতাদের নাম-টিপু সুলতান, জামান শাহ, সিন্ধিয়া, আসাদ উদ্দৌলা এবং রোহিলা সর্দার, গোলাম মোহাম্মদ [তথ্যঃ ডক্টর এন ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ৯]। ঐ বছরেই বীর টিপু ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হন। বেনারসের ইংরেজ রেসিডেন্ট মিঃ চেরীকে হত্যা করা হয় ঐ সালেই। ঐ একই বছরে ওয়াজির আলির নেতৃত্বে বেনারস, গাজীপুর ও আজমগড়ে বিদ্রোহ হয়। ডক্টর এন ভট্টাচার্য লিখেছেন, "শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওয়াজির ব্যর্থ হন, কিন্তু তাঁকে ঘিরে যে ঘটনাচক্র তা' নিঃসন্দেহে ইংরেজ বিরোধী সর্বভারতীয় চক্রান্তের তীব্রতা ও ব্যাপ্তির পরিচায়ক।" [পৃষ্ঠা১০]
১৮০০ খৃষ্টাব্দে বিজনোরে বিদ্রোহ হয়।১৮০১ সালে গঞ্জাম জেলায় বিদ্রোহ ঘটে। ১৮০২ খৃষ্টাব্দে মালবাদের বিপ্লবীরা ওয়েনাদ জেলার পানামারাম দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। ১৮০৩ হতে ১৮০৫ পর্যন্ত কর্ণাটকে বিদ্রোহ হয়। ১৮০৪-এ বঙ্গদেশে শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে যে প্রচন্ড বিপ্লব পরিচালিত হয় তা বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮০৫-এ বুন্দেলখন্ডে বিদ্রোহ হয়। এই ভাবে কম বেশী কোথাও না কোথাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে মানুষ মাথা তোলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু উপযুক্ত ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অভাবে সেগুলো ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়েছে।
১৮০৬-এ ভেলোরে ও ১৮০৮ সালে ত্রিবাঙ্কুরে ছোট বড় বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়। ১৮১০ খৃষ্টাব্দে সুরাটের আবদুর রহমান বৃটিশ প্রধানকে মুসলমান হতে বলেন এবং তাঁর কাছ হতে করের দাবি জানান। এত স্পর্ধা নিয়ে যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয় তা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ১৮১৩ তে সাহারানপুর জেলায় বিদ্রোহ হয়। ১৮১৪ তে মুরসন ও হাতরাসে বিদ্রোহের কথা জানা যায়। ১৮১৬ তে বেরেলীতে প্রচন্ড বিদ্রোহ হয়; কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে এর সৃষ্টি হয়েছিল। নামজাদা অনেক ইংরেজ অফিসার তাতে নিহত হন, আর বিপ্লবীদের সাড়ে তিনশো জন শহীদ হন। ঐ বিপ্লবেরও নেতা ছিলেন মুফতি মুহাম্মদ আয়াজ। [ডক্টর ভট্টাচার্য, ঐ, পৃষ্ঠা১২]
১৮১৭ তে উড়িষ্যা ও ১৮১৯-এ খান্দেশে বিদ্রোহ হয়। ১৮২০ ও ২১-এ বেরেলীর সৈয়দ আহমাদের নেতৃত্বে বিরাট আন্দোলন শুরু হয়। প্রথম ধর্মভিত্তিক ও পরে তা ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতিতে রুপান্তরিত হয়। ১৮৩১ খৃষ্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে বহু সঙ্গীসহ তাঁর শহীদ হওয়ার কথা পূর্বেই জানানো হয়েছে।
১৮২০-৩১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সৈয়দ আহমাদের নেতৃত্বে ঐ সর্বভারতীয় সংগ্রাম কোথাও প্রত্যক্ষ আর কোথাও পরোক্ষভাবে চলতে থাকে। ১৮৩২-এ মানভূমে, '৩৫-এ গঞ্জামে, '৩৬-এ সবন্তবদিতে ও ১৮৩৮-এ আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে সারা বঙ্গে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল। ১৮৩৮ সালে শোলারপুরেও সৈন্য বিদ্রোহ ঘটেছিল। ১৮৩৯ এ পুনা '৪০-এ বাদামি, '৪২ এ বুন্দেলখন্ড, সেকেন্দ্রাবাদ, হায়দারাবাদ ও মালিগাঁও-এ বিদ্রোহ হয়। ১৮৪৩ ও ৪৪'- এ যথাক্রমে জব্বলপুর ও কোলাপুরের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। ১৮৪৬ সালে প্রথম '৪৮-এ হয় দ্বিতীয় শিখযুদ্ধ। অবশ্য দুটোতেই ইংরেজদের জয় হয়। ১৮৪৯ এ নাগাল্যান্ডে, '৫০ এ পাঞ্জাবে ও '৫২ তে খান্দেশ ও চোপদা অঞ্চলে বিদ্রোহ রুপ নেয়। ১৮৫৫-৫৬তে রাজমহল ও ভাগলপুরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। আর ১৮৫৭ তে হয় মহাবিদ্রোহ, মহাঅভ্যুত্থান বা স্বাধীনতা আন্দোলন, যাকে বলা হয়েছে 'সিপাহি বিদ্রোহ'।
প্রধানতঃ মুসলমান পরিচালিত আন্দোলন ও সংগ্রামগুলো ছিল ইংরেজ সরকার ও তাদের দালাল অত্যাচারী কর্মচারী এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইংরেজ স্তাবক ও পদলেহীরা সেগুলোকে শুধুমাত্র আন্দোলন বলে চালাতে চেয়েছে। আরও বলতে চেয়েছে যে, মুসলমানদের আক্রমণগুলো ছিল হিন্দুদের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ সেগুলো ছিল সাম্প্রদায়িক লড়াই। তাই ডক্টর নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য লিখেছেন, "১৮৩১-এ কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহেও তারা সমান নিরপেক্ষতার সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান ভূমি অধিকারীদের উপর হামলা চালিয়েছিল" [ পৃষ্ঠা ১৭]। অধ্যাপক অমলেন্দু দে লিখেছেন, "জমিদারদের স্বার্থ রক্ষাকারী নয় অথবা জমিদারদের বাসস্থানের সংলগ্ন এলাকায় নয় এমন হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীরা কেবলমাত্র হিন্দু হওয়ার জন্য আক্রান্ত হয়েছেন, এমন কোন তথ্য সরকারি বা বেসরকারি সূত্র থেকে পাওয়া কষ্টকর।" [অমলেন্দু দে, পৃষ্ঠা ১২৯]
" মনে রাখা প্রয়োজন, মুসলিম বিপ্লবীরাই [ও.] সর্বপ্রথম বিস্তীর্ণ সংঘবদ্ধ ভারতবর্ষ হতে ইংরেজ বিতাড়নের জন্য দীর্ঘকাল ব্যাপী এক সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। আর এই বিপ্লবকে [ও. আন্দোলন ], মুসলিম কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার অভিপ্রায়ে মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত ভারতবর্ষে প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে উল্লেখ করা যায়।" [অমলেন্দু দেঃ বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, ১৩১ পৃষ্ঠা]
"বিপ্লবী [ও.] খলিফাদের প্রচারের ফলে সুদূর ত্রিপুরা সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, পাটনা, বেনারস, কানপুর, দিল্লী, থানেশ্বর, আম্বালা, অমৃতসর, ঝিলাম, রাওয়ালপিন্ডি, কর্ণাটক, পেশওয়ার ইত্যাদি স্থানে এই দলের কার্যালয় স্থাপিত হয়। তাছাড়া বোম্বাই মধ্য প্রদেশ ও হায়দ্রাবাদেও বিপ্লবী [ও.] মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে অনেকে যোগদান করে।" [ঐ, পৃষ্ঠা ১১২-১১৩]
ঐ মহাবিপ্লব এত মারাত্মক ছিল যে, তার জন্য হরিশ্চন্দ্রের 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' পত্রিকাতেও লেখা হয়-"মহাবিপ্লব" ব্রিটিশ শক্তির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ স্বরুপ দেখা দিয়েছিল। বিদ্রোহকে দমনের জন্য ভারতস্ত ব্রিটিশ শক্তি পর্যাপ্ত ছিল না। খোদ ইংল্যান্ড থেকে প্রভূত রসদের যোগান এসেছিল, সৈন্য এসেছিল পারস্য থেকে, সিঙ্গাপুর থেকে.....
[দ্রঃ S. R. Sharma: The Making of Modern India 1951, p.45-46]
১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ পূর্ণতা পেতে পারে নি জমিদার আর রাজা-মহারাজাদের বেইমানী করার কারণে- "যাদের উপর নির্ভর করে ইংরেজরা সে যাত্রায় পার হয়ে গিয়েছিল। তারা ছিল ইংরেজ শাসনের দ্বারা সৃষ্ট কিছু অনুগত রাজা, মহারাজা ও জমিদার। উদাহরণ স্বরুপ, বর্ধমানের মহারাজা মহাবিদ্রোহের সময় ইংরেজদের প্রভূত সাহায্য করেছিলেন।" [ডক্টর ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা ২৯]
"সিপাহী বিদ্রোহ " নয়, জনগণের মহাবিপ্লবঃ
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ শুধু সিপাহীদের নয়। ভারতীয় সৈন্যরা করেছিলেন সত্যি কথা, তবে সৈন্যদের বিদ্রোহ তার আগে ও পরে বহুবার হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, এই ১৮৫৭-র আন্দোলনে শুধু সিপাহীরা নয় লাখ লাখ সাধারণ মানুষও প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র ধরে লড়াই করেছেন, কোটি কোটি মানুষ তাদের সমর্থন করেছেন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ, খাদ্য ও অস্ত্র যুগিয়েছেন সাধ্যানুসারে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাধ্যাতীত ভাবে।
সাতান্নর বিপ্লবকে "সিপাহী বিদ্রোহ " বলার প্রতিবাদে কার্ল মার্কস বলেন, "ব্রিটিশ শাসক শ্রেণীরা অভ্যুত্থানকে কেবল সশস্ত্র সিপাহী বিদ্রোহ রুপে দেখতে চায়, তার সঙ্গে যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক অংশ জড়িত তা লুকাতে চায় তারা" [ প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধঃ কার্লমার্কস ফ্রেডারিক এম্বেল্পস, পৃষ্ঠা১০]। বিদ্রোহের ইতিহাস যাঁরা প্রথমে লিপিবদ্ধ করেছেন তাদের সকলেই ছিলেন ইংরেজ। বেশির ভাগ লেখক আবার ইংরেজ রাজপুরুষ। " ইংরেজ ঐতিহাসিকরা একে বলেছেন সিপাহী বিদ্রোহ আর ভারতীয়রা বলতে চান ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম।"
[ সিপাহী।যুদ্ধের ইতিহাসঃ মণি বাগচি, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা ১]
মুর্শিদাবাদ জেলা তখন ছিল উন্নতর জেলা এবং সেখানে ছিল মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য। সেখান থেকেই ভারতের মুসলমান শাসন হস্তান্তরিত হয়েছিল ইংরেজদের হাতে। পূর্বেই বলা হয়েছে ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লব মুর্শিদাবাদের বহরমপুরেই শুরু হয় সৈন্যদের বিদ্রোহিতার ভিতর দিয়ে। সেখান থেকে এই সংবাদ ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। তার পরের মাসে গন্ডগোল হয় ব্যারাকপুরে। দেশের সর্বত্র মাওলানা, পীর ও ফকির বেশধারী অসংখ্য মানুষ সিপাহীদের আরও বিদ্রোহী করতে সাহায্য করেন।মার্কসও এ কথা স্বীকার করেছেন। হট্রগোল আরো জোরদার হয়ে উঠল সৈন্যদের টোটা ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্টে এ কথা পৌঁছে দেয়া হল যে, দাঁতে কেটে যে টোটা বন্দুকে হচ্ছে তাতে চর্বি আছে; আর চর্বি যেখানে বিক্রি হয় সেখানে গরু, মেষ, শূয়োর প্রভৃতি পশুর চর্বি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সুতরাং আরও ঘোরতর করে রটিয়ে দেয়া হলো যে, টোটাতে শুয়োর ও গরুর চর্বি একত্রে মেশানো আছে। এ সম্বন্ধে এই উদ্ধৃতিটি বিশেষ ভাবে লক্ষনীয়- "১৮৫৭-র গোড়ার দিকে সেই মাত্র প্রচলিত শুয়োর ও গরুর চর্বি মাখানো টোটার প্রবর্তন, ফকিরেরা বলতে লাগলো- ইচ্ছা করে করা হয়েছে, যাতে প্রত্যেক সিপাহী জাত খোয়ায়।.....অযোধ্যা ও উত্তর পশ্চিমের প্রদেশগুলিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লোকদের উস্কাতে লাগলো ঐ ফকিরেরা। [দ্রঃ কার্লমার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, পৃষ্ঠা১৯৮]
ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে মুসলমানরাই সর্বাগ্রে বিদ্রোহী হয়। কারণ মুসলমান সৈন্যরা মনে করেছিল যে, তাদের ধর্মে হাত দেয়া হচ্ছে। মুসলমানদের উত্তেজিত হবার কারণ সম্বন্ধে ইংরেজরা তাদের কর্মচারী হেদায়েত আলীর কাছ থেকে যে রিপোর্ট নিয়েছিল তা এই রকমঃ
(ক) দাড়ি কাটা বাধ্যতামূলক ছিল না, কিন্তু পরে দাড়ি কাটতে বাধ্য করা হয়েছিল।
(খ) শুয়োরের চর্বিযুক্ত টোটা দাঁতে কেটে ব্যবহার করতে হয়;
(গ) সরকারি হাসপাতালে মেয়েদের পর্দা তুলে দেয়া হয়;
(ঘ) সৈন্যদের শপথ নেয়া হয় যে কোন দেশের সঙ্গে বা যে কোন দূর দেশের যুদ্ধে যোগদান করতে হবে-ইত্যাদি।
মুসলমান মৌলবাদী, মাওলানা, ফকিরেরা এবার সারা দেশে রটিয়ে দিলেন যে, ময়দাতে হাড়ের গুঁড়ো মেশানো আছে। হিন্দুদের মধ্যে ছড়ানো হল, ইংরেজদের তত্ত্বাবধানে যে সব ময়দা তৈরী হচ্ছে তাতে গরুর হাড়ের গুঁড়ো মেশানো হচ্ছে। সারা দেশের কেউ আর আটা বা ময়দা কিনতে চায় না। এমনকি ভারতীয় সৈন্যরাও রুটি খেতে অস্বীকার করলো। এমনিভাবে লবণে হাড়ের গুঁড়ো, ঘিয়ের সঙ্গে জন্তুর চর্বি এবং কুয়োর জলে শুয়োর ও গরুর মাংস ফেলে জল অপবিত্র করা হয়েছে- এমন গুজবও রটে গেল। "পাউরুটিকে তখন লোকে বলতো বিলিতী রুটি আর তাদের ধারনা ছিল, এই বিলিতী রুটি খেলে জাত যাবে।" [তথ্যঃ মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ৪৫]
সমুদ্র পার হয়ে ভারতের বাইরে যুদ্ধে যাওয়া রীতি বিরুদ্ধ কাজ ছিল বলে ভারতীয় হিন্দু সৈন্যরাও ইংরেজদের ওপর ক্ষেপে ওঠে। সৈন্যদের রান্নার ব্যাপারে হিন্দু মুসলমান উভয়ের জন্য যে পৃথক পৃথক পাচক থাকতো তা তুলে দেয়ায়ও ক্ষোভের অন্যতম কারণ। লর্ড ডালহৌসীর সময়ে ঈশ্বরচন্দ্রকে সামনে রেখে বিধবা বিবাহ আইন পাশ করা হলে অনেকে তাঁদের ধর্মে হস্তক্ষেপ হয়েছে বলে মনে করেন। তাছাড়া লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথাকে শুধু নিষিদ্ধই করলেন না, আইন করে দিলেন যে, সতীদাহের ব্যাপারে জড়িত ব্যক্তিদের প্রাণদন্ড দেয়া হবে। শেষে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের কর্তৃত্ব ইংরেজ কোম্পানির হাতে নিলে ক্ষোভ চরমে ওঠে। তাছাড়া তখন খৃষ্টান ধর্মপ্রচার এত ব্যাপক হচ্ছিল যে, হিন্দু মুসলমান উভয় জাতির সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা ক্ষেপে উঠতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাদ্রীরা হাট, ঘাট, বন্দর, জেল, হাসপাতাল, স্কুল, সর্বত্রই তাদের ধর্ম প্রচার করতে থাকে। প্রত্যেক স্কুলে বাইবেল শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। ছাত্রদেরকে প্রশ্ন করা হত, তোমাদের প্রভু কে এবং কে তোমাদের মুক্তিদাতা? ছাত্ররা শেখানো খৃষ্টীয় পদ্ধতিতেই তার উত্তর দিত। [দ্র: সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসঃ আহমাদ ছফা, পৃষ্ঠা ১২, ১৩ ও ১৪]
মিঃ হোমসের উদ্ধৃতি দিয়ে আহমাদ ছফা বলেছেন, " হায়দার আলীর মতো সামরিক প্রতিভার অধিকারী হলেও একজন সিপাহীকে কিছুতেই (তার) অধীনস্ত একজন ইংরেজ সিপাহীর মাইনে দেয়া হবে না....এই বৈষম্যের কারণে কর্তৃপক্ষের প্রতি সিপাহীদের বিশ্বাস ক্রমশঃ শিথিল হয়ে আসে।" এ সম্বন্ধে তিনি আরো বলেন- ইংরেজ অফিসাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে হিন্দু স্ত্রীলোক রাখতেন। অনেক সিপাহীকে অর্থ ও নানা চাপ দিয়ে তাদের আত্মীয়দের এনে দিতে বাধ্য করাতেন তাঁরা। অবশ্য দারিদ্র্যের কারণে, টাকার লোভে অনেকে আপন আত্নীয়াদেরকেও সাহেবদের দিয়ে দিত। [আহমদ ছফাঃঐ, পৃষ্ঠা ২৫,৩১]
ব্যারাকপুরের সৈন্য মঙ্গলপান্ডে তাঁর ধর্মে হস্তক্ষেপ হয়েছে মনে করে ইংরেজদের উপর ক্ষেপে ওঠেন। তিনি লেফটেন্যান্ট বগকে গুলি করেছিলেন। মিঃ বগও পিস্তলের গুলি ছোঁড়েন। অবশ্য দুজনেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হন। মঙ্গলপান্ডে তাঁর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আত্মহত্যার জন্য নিজের বুকে গুলি করলেন। মৃত্যু হল না, হাসপাতালে যেতে হল; পরে বিচারের নামে প্রহসনে জনসাধারণের সামনে তাঁর ফাঁসি হয় [৮ই এপ্রিল]। নিঃসন্দেহে তাঁর বুকের সেই রক্ত আজ ভারতের হিন্দু মুসলমান সকলের জন্য এক গর্বময় ইতিহাস - সম্ভার।
১৮৫৭ সালের ৩১ শে মে সারা ভারতে একসঙ্গে বিদ্রোহ, বিপ্লব ও আন্দোলনের আগুন জ্বেলে অভ্যুত্থান ঘটানো হবে ঠিক করা হলো। আর সর্বত্র সংবাদ পাঠাবার ব্যবস্থা হলো 'চাপাটি রুটির ' মাধ্যমে। ঐ রুটির ভিতরে থাকতো পত্র। সুদক্ষ ব্রিটিশ গুপ্তচরও তা টের পায় নি। মুসলমান ফকির মাওলানাদের এই কৌশলটি তাঁদের সুনিপুণ বুদ্ধির পরিচয় বহন করে- "বিদ্রোহের বাণী সেদিন সারা ভারতে প্রচারিত হয়েছিল এক আশ্চর্য উপায়ে- চাপাটির মারফত।....এছাড়া, মুসলমান সিপাহীদের প্ররোচিত করবার জন্য বহু মুসলমান ফকিরের সাহায্য গ্রহণ করা হয়েছিল।" [ মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ৭৩] ওদিকে ৩১ শে মে আসার আগেই মীরাটে ২৫ জন ভারতীয় সৈন্যকে কঠিনভাবে শাস্তি দেয়া হয়।ফলে কর্ণেল স্মিথের উপর লোক আরও ক্ষেপে ওঠে। এত হৈ চৈ সত্ত্বেও তিনি ' দিল্লী গেজেটে' লিখলেনঃ 'দিল্লী শান্ত; বিদ্রোহীদের শাস্তি দেয়ার পর মনে হচ্ছে, এখানে আর কোন বিপদ ঘটার সম্ভাবনা নেই।' তারপরেই দেখা যায়, ভারতীয় জনসাধারণ ও সৈন্যরা জেলখানার লোহার গেট ভেঙে ফেলেন এবং বিপ্লবী স্বেচ্ছাসেবক ও সৈনিকদের পায়ের বেড়ি খুলে দিয়ে মুক্ত করে দেন। খবর পেয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে কর্ণেল ফিনিশ একদল ইংরেজ সৈন্য নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বিপ্লবীদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেদিন কিন্তু সৈন্যরা কোন সম্মান তো জানালেনই না, বরং সকলে সিংহের মত গম্ভীর চোখের ভাষা দিয়ে জানিয়ে দিলেন- "আমরা তোমার গোলাম নই।" পলকের মধ্যে বিপ্লবীদের বন্দুক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বের হতে লাগলো; কর্ণেল ফিনিশ সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন।
সারা ভারতে বিশাল জনতা ও বিপ্লবীদের তখন যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ; তাঁর সম্পর্কে পূর্বেই আলোচনা হয়েছে।সৈন্যরা মাঝে হুঙ্কার দিতেন, 'দ্বীন দ্বীন রবে। মুসলমান যোদ্ধারা বলতেন, "আমরা স্বধর্ম রক্ষা করবার জন্য এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি।" আরও বলা হত ইংরেজ শাসন ধ্বংস হোক' বাদশাহ দীর্ঘজীবী হোন। [দ্রঃ মণি বাগচি, পৃষ্ঠা ৯৯-১০০]। বাগচি মহাশয় 'দ্বীন' বানান 'দীন' লিখেছেন। কিন্তু ওটা ' দীন' না হয়ে 'দ্বীন' হবে।' কারণ দীন অর্থে দরিদ্র আর দ্বীন বলতে ধর্মকে বোঝায়।
বিপ্লবী সৈন্যরা একদিন মীরাটের রাস্তা ধরে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন। মিঃ ফ্রেজার ও ডাগলাস তখন ক্রোধে অধীর হয়ে বিপ্লবীদের ওপর গুলি ছুঁড়লে অনেকেই মারা যান। সাহেবরা অবশ্য লুকিয়ে পড়েন। এর প্রতিশোধে মিঃ ফ্রেজার, মিঃ হাচিনসন, মিঃ ডাগলাস, জেনিং দম্পতি ও মিস ক্লীফোর্ডকে নিহত হতে হয় বিপ্লবীদের হাতে। পরে কমান্ডিং অফিসার কর্ণেল মিঃ রিপ্লে দিল্লীতে বিপ্লবীদের শিক্ষা দেবার জন্য বাছাই করা ইংরেজ সৈন্য এবং আরও কয়েকজন বিচক্ষণ অফিসার নিয়ে তাঁদের সামনে দাঁড়ালেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে প্রবল গুলি বর্ষণ শুরু হলে মিঃ রিপ্লে ও চারজন অফিসার নিহত হন।
যদিও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কঠোর নিষেধ ছিল ইংরেজ শিশু ও মহিলা যেন নিহত না হয়, তবুও বিপ্লবীরা সেই চরম মুহূর্তে তাঁর এ কথা পালন করতে পারেন নি। ১৬ই মে বেসামরিক অনেক খৃষ্টান নারী ও বালককে আরো ভাল বন্দীখানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বের করে লম্বা দড়ি দিয়ে বেষ্টনী দিয়ে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে নিহত করা হয়। ঐ সংকট সময়ে একজন বুদ্ধিমতী মহিলা মিসেস আলডোয়েল বলেছিলেন, মারার আগে তাঁদের কী অপরাধ আছে জানিয়ে দিলে ভাল হয়; কারণ মহিলা ও শিশুরা আপনাদের তো কোন দিন কোন ক্ষতি করেনি। উত্তরে বিপ্লবীরা ওই সময় খৃষ্টান জাতির কাউকে ছাড়বেন না বলে জানান। চতুর মহিলা বুঝলেন, জনতার বেশির ভাগই মুসলমান। তাদের মুখে আওয়াজ 'দ্বীন দ্বীন জিন্দাবাদ!, ইংরেজকে খতম কর' ইত্যাদি। তাই মিসেস আলডোয়েল বললেন, "আমি মুসলমান হয়েছি, তবুও কি আমি রেহাই পাবো না?' এই উত্তরে বিপ্লবীরা তাঁকে ও তাঁর তিন পুত্রকে অবশ্য স্পর্শ করেন নি। 'সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসেও লেখা রয়েছে, “রক্ষা পাইয়াছিল শুধু মিসেস আলডোয়েল ও তাহার তিনটি শিশুপুত্র। সে নিজেকে মুসলমান ধর্ম অবলম্বিনী বলিয়া প্রকাশ করাতে ঘাতকেরা তাহার জীবন সংহার করে নাই ।” [মনি বাগচির লেখা সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসের ১১২ পৃষ্ঠা]
মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য ছিল এই আন্দোলনে-তাই বলে কি সত্য তথ্যগুলো চাপা দিতে হবে বর্তমান ও আগামী দিনের পাঠকদের জানতে না দেয়ার জন্য? মণি বাগচি লিখেছেন,“দিল্লীতে বিষাদ, মিরাটে লজ্জা। ছয় দল বিদ্রোহী ও নগরবাসী উন্মত্ত মুসলমান দল তাদের বাদশাহের নামে এই সংহার কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল । শাহজাদারা বিদ্রোহী পক্ষের সহায়তা করিয়াছিলেন," [সি, যু, ই, পৃষ্ঠা ১১২]। এতে বিপ্লবীরা নিষ্ঠুর ছিলেন বলে মনে হতে পারে কিন্তু মনে রাখা দরকার, ইংরেজরা প্রথমে যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় ইতিপূর্বে দিয়েছে তার প্রত্যুত্তর ছাড়া এগুলো অন্য কিছু নয়।
ঐ মিরাটে পঞ্চাশ জন বিপ্লবী ধরা পড়লেন তাদের বিচার না করে প্রত্যেকের হাত বেঁধে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে কামান দাগা হলো; সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশটি প্রাণ ও তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উড়ে গেল কামানের গোপনলায়। অবশ্য ঘটনার নায়ক মিঃ ফ্রেজারকে বিপ্লবী আবদুল কাহার গুলি করে হত্যা করেন।
ঠিক এই সময় [৮ই জুন, রাণী ভিক্টোরিয়া এক আইন পাশ করলেনঃ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বাছাই করা ইংরেজ অফিসারদের নিয়ে গঠিত নতুন কমিটি বিপ্লবী ও বিদ্রোহীদের ফাঁসি, দ্বীপান্তর ও কারাদণ্ড দিতে পারবে। আপীল করার আর কোন রাস্তা রইল না ।
বেনারসে হিন্দু সংখ্যাধিক্য। সেখানে তখন এক হাজার চারশো চুয়ান্নটি দেবমন্দির এবং দুশো বাহাত্তরটি মসজিদ ছিল। মোঘল বংশের বিপ্লবী “ফিরোজ' এই সময়ে বেনারসে পৌঁছাতেই তাকে দেখবার জন্য হিন্দু মুসলমানদের ভিড় জমে উঠলো। তখন কাশীর লোকসংখ্যা মিঃ মেকলের মতে পাঁচ লক্ষ। শতকরা ৯০ জন হিন্দু। মোঘল রাজকুমারদের নেতৃত্বে সমস্ত লোককে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। ব্যবসাদারদের পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করানো সম্ভব হয়েছিল। [দ্রঃ মণি বাগচি ] । ইংরেজদের বিরুদ্ধে মানুষকে উত্তেজিত করতে বিপ্লবীরা টোটায় চর্বি মেশানোর কথাতেই বেশী সাফল্য লাভ করেছিলেন। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা যে, কাশীর রাজা ইংরেজদের বিপক্ষে তো গেলেনই না, বরং সর্ব প্রকার সাহায্যই করেছিলেন। মণি বাগচি লিখেছেন, ৪ঠা জুন রাত্রে কাশীর রাজা ইংরেজ মিশনারীদের নিরাপদ স্থানে আশ্রয় দান করেছিলেন। এমন কি, অর্থ ও সৈন্য সাহায্য করতেও তিনি কৃপণতা করেননি। শহরে জনতা, আতঙ্ক ও গোপনলমাল মুসলমানেরা উড়িয়েছে সবুজ পতাকা। কয়েদীরা মুক্ত হয়েছে জেলখানা থেকে।” [ সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৪৯)
ইংরেজ সৈন্য নিয়ে মিঃ নীল চরম আক্রমণ করলেন বিপ্লবীদের। পরাস্ত হতে হলো বিপ্লবীদের-কাশীর রাজার সাহায্য পেয়ে মিঃ নীল নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নিলেন। কাশীর বাইরে হতে আসা বিপ্লবী জনতা এবং কাশীর জনসাধারণ বহু বিশ্বাসঘাতক শিখকে নিহত করলেও কিন্তু শেষ উদ্ধার হয়নি। সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাসে লেখা হয়েছে- “বহুলোকের ফাঁসি হইল, পল্লীতে পল্লীতে নির্মম বেত্রাঘাত বেপরোয়া ভাবে চলিল। সারি সারি ফাঁসিকাষ্ঠে বহু নির্দোষীর প্রাণবায়ু বহির্গত হইল। কর্ণেল নীলের নির্দেশে ইংরেজ সৈনিক ও কর্মচারীরা কাশীর পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে প্রবেশ করিয়া সেখানকার বহু লোককে রাস্তার দুই ধারের গাছে গাছে ফাঁসি দিয়ে লোকের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করিতে লাগিল।" (পৃষ্ঠা ১৫৭) [চলবে)