JustPaste.it

মধ্য প্রাচ্য সমস্যার সমাধান কোথায়?

ইবনে বতুতা

          "কোন আরব রাষ্ট্রে হামলা করলে ইসরাইলের অর্ধেক ধ্বংস করে দেব"।সুপ্রিয় পাঠক, আমার মতো নাদান বান্দার বুকে এত হিম্মত নেই যে, এতো বিস্ফোরক মার্কা কথাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দেব অথবা গ্রাম্য নিছক বিতর্কের ঝড় তোলার কল্পকাহিনীও বলা হচ্ছে না। মধ্য প্রাচ্যের হিরো থেকে জিরোতে পরিণত ইরাকী নেতা সাদ্দাম হোসাইন একদা ৪ হাজার টন রাসায়নিক অস্ত্র  ও হাজার খানেক স্কাড মিসাইলের ডিপোর উষ্ণতার জোরে ইসরাইলকে তর্জনী তুলে এ কথাগুলি বলেছিলেন।

          স্বভাবতই মন চলে গিয়েছিল পাশ্চাত্যের তৃতীয় ক্রুসেডার বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত দ্বাদশ শতাব্দীর মুসলিম বিশ্বের ইতিহাস রোমান্থনে। ইসলামের সেই ঘোর দুর্দিনে ধ্রুব তারার মতো আবির্ভূত হলো এক উজ্জ্বল জোতিষ্ক সালাহউদ্দিন আইয়্যুবি।এই বীর কেশরীর ঘোড়া চালোনা ও অসি চালোনার মুখে ক্রুসেডার বাহিনী কচুকাটা হয়ে গেল, মুসলমানরা ফিরে পেল পবিত্র ভূমি জেরুজালেম। আজ আবার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে মুসলিম বিশ্ব আশায় বুক বেঁধেছিল যে, মধ্য প্রাচ্য যখন পাশ্চাত্য ও ইহুদী শক্তির নখরাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে, আরব মুসলমান ভাইদের রক্ত নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীরা যখন হোলি খেলছে, ঠিক তখনই বুঝি তার দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে আবির্ভূত হয়েছে নব্য সালাহউদ্দিন, প্রাচ্যের নতুন সিংহ শার্দূল সাদ্দাম হোসাইন।

          কিন্তু অচিরেই সে আশা মরিচীকার ন্যায় দূর দিগন্তে মিলিয়ে গেল।সাদ্দাম হোসাইনের পরবর্তী কার্যকলাপ এবং তার ক্ষমতা দখলের ইতিহাস সচেতন মানুষের কাছে খুবই বিস্বাদ লাগলো। তার বাক্যকে নিছক বাগাড়ম্বর মনে করা ছাড়া তাদের আর কোনো গত্যন্তর থাকল না।উপসাগরীয় সঙ্কটকালে ইসলাম প্রিয় জনতার কাফেলা ইসলামের খাদেম মনে করে যে সাদ্দাম হোসাইনকে নৈতিক সমর্থন জোগাত, রাজপথকে মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত করে রাখতো, বুকে সাদ্দামের ছবি এঁটে যারা আল্লাহু আকবার তাকবির ধ্বনি দিয়ে "সাদ্দাম তুমি এগিয়ে যাও,আমরা আছি তোমার সাথে" শ্লোগানে মুখরিত করেছিল, পরবর্তীতে আহম্মক সাদ্দাম হোসাইনের হটকারীতায় তাদের সে আবেগ অনুশোচনায় পরিণত হয়, নত শিরে, ভগ্ন মনে ও মৃদু পায়ে তারা ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। আলোর পিছনে যে কদাকার অন্ধকার লুকিয়ে থাকে তাও তাদের সামনে উন্মোচিত হয়। সে যে বিভ্রান্তি ও চক্রান্তের শিকার তা আর কারো বুঝতে বাকি থাকলো না।

          ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে আরব জাতীয়তাবাদের শ্লোগান নিয়ে মধ্য প্রাচ্যের সিরিয়ায় মাইকেল আফলাক নামক একজন আরব খৃষ্টান পন্ডিত "বাথ পার্টি নামক" একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে।এই পার্টির ইসলাম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা ছিল "ইসলাম কেবল মাত্র আরবদের একটি জাতীয় বিপ্লব। এই বিপ্লবে অনারবগণ শরিক হয়ে  একে ঘোলাটে কিরে ফেলেছে।আরবের মুশরিকরা এই বিপ্লবকে সফল করার জন্য বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে মাত্র। এ বিপ্লবের সাফল্যের জন্য তারাও (মুশরিকরা) বিপ্লবের সহযোগী মুসলমানদের ন্যায়  কষ্ট করেছে।অন্য ধর্মের সাথে ইসলামের কোন পার্থক্য নেই।ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত কোন ধর্ম নয়, এ আরবদের স্বাভাবিক জাগরণ মাত্র।আরবরা যখন গাফলতির ঘুম থেকে জেগে উঠছিল ঠিক তখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটে এবং মুসলমানরা নব জাগরণের কৃতিত্ব দাবি করে"।

          মুলত ইসলাম বিদ্বেষী এই খৃষ্টান ব্যক্তিটির ভূমিকা ছিলো মুসলিম ছদ্মবেশী ইহুদী পন্ডিত মুনাফিক ইবনে সাবার মতো।এই ব্যক্তি ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফ্রান্সে অধ্যয়নরত ছিল।ফ্রান্সের চক্রান্তে ১৯৪৭ সালে সে মধ্য প্রাচ্যের জাগরণশীল ইসলামী আন্দোলনকে বিভ্রান্ত এবং ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন বিরোধী একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে মুসলমানদের মধ্যে কৌশলে দাঙ্গা ও হানাহানি সৃষ্টি করে ইসলামী আন্দোলনকে ধ্বংস করার পায়তারা চালায়।ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ইসলামের দর্শন বিরোধী আরব জাতীয়তাবাদ এ দলের মূল আদর্শ হওয়ায় উলামা সমাজ এর কঠোর বিরোধিতা করে। ফলে সচেতন মুসলমানদের মধ্যে এ আন্দোলন কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। মাইকেল আফলাক তখন তার ভ্রান্ত দর্শন সংখ্যালঘু কট্টর 'দরজী' ও 'উলূবী' শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়।চরম ইসলাম বিদ্বেষী এ দু'সম্প্রদায়ের জন্য তার পার্টির দ্বার অবারিত করে দেয়া হয়।অবশ্য মুসলিম নামধারী কিছু নাস্তিককেও সদস্য পদ দেয়া হয়।তবে এরা ছিল দ্বিতীয় শ্রেণীর সদস্য। মুসলমানদের ধোকা দেয়ার জন্য কিছু সংখ্যক নাস্তিককে পার্টির উচ্চ পদও দেওয়া হয়। মাইকেল আফলাক সংখ্যা গরিষ্ঠ আরব মুসলমানদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আরব জাতীয়তাবাদের ধোঁয়া তুলে বাথ পার্টি প্রতিষ্ঠা করলেও তিনি নিজেই ছিলেন ঘোর ইসলাম বিদ্বেষী। খৃষ্ট ধর্মের প্রতি তার প্রবল অনুরাগ ছিলো। যার দরুন সে প্রায়ই ভ্যাটিকান পোপের নিকট ছুটে যেত। ১৯৬৮ সালে ইরাকে এবং ১৯৭০ সালে সিরিয়ায় তার প্রতিষ্ঠিত বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসলে পরে এই সাফল্যের জন্য তাকে আফলাককে 'মানব সেবা' পদক দেয়া হয়।বেগাট গোত্রের সন্তান সাদ্দাম হোসাইন তখন সবে মাত্র যৌবনে পদার্পণ করেছেন।এই সময় মাইকেল আফলাকের এ আন্দোলনে সে জড়িয়ে পড়ে।ইতিহাসের পাতায় সাদ্দামের বেগাট গোত্র 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে চিহ্নিত। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যে বাস এবং তুর্কীদের  অস্ত্র  ও অর্থে প্রতিপালিত হলেও হেযাজের শরীফ হোসাইনের ন্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা তুর্কীদের বিরুদ্ধে বৃটেনকে সাহায্য করে। ১৯২০ সালে ইরাকের আলিমগণ যখন একটা জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলেন তখন বেগাট গোত্র বৃটিশের সমর্থনে লুটপাট, দাঙ্গা ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে প্রচুর অর্থের মালিক হয়।সাদ্দামের পিতা ছিলেন বেগাট গোত্রের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি। একবার সে নিজ গোত্রের ৩০ টি শিশুকে হত্যা করে। তাদের অপরাধ ছিল তাদের পিতা বা মাতা বেগাট গোত্রের বাহিরে বিবাহ করেছিল। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সাদ্দামের পিতাকে গোত্র থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং সে তিত্রিত অঞ্চলে এসে নতুন গোত্র গড়ে তোলে। এই খুনী পিতার সন্তান সাদ্দাম বাল্যকাল থেকেই ছিল একঘেয়ে চরিত্রের।যা ভাবত তাই বাস্তবে করতো। তা ভুল হলেও বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সম্পন্ন করতো। ভয়ডরহীন বিশেষ মানসিক শক্তির অধিকারী, ঠান্ডা মাথায় খুন করার সাহস এবং দক্ষতা, সর্বোপরি কথা দিয়ে মানুষকে তুষ্ট করার অপূর্ব দক্ষতা (যা এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায়) তার চরিত্রের বিশেষ গুণ। পনের বছর বয়সী সাদ্দাম তার চাচা মিসহিনের সাথে এক ব্যক্তির শত্রুতা থাকায় তাকে খুন করে বাগদাদ পালিয়ে যায়। এ সময়ই সাদ্দাম বাথ পার্টিতে ঢুকে একটি নিজস্ব খুনী বাহিনী গঠন করে।  পরবর্তীতে সাদ্দাম বৃটিশদের চক্রান্তে ও আর্থিক প্রলোভনে প্রেসিডেন্ট উৎখাতের অভিযান চালায়, কোটিপতি ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহর ধন সম্পদ লুটে নেয়ার জন্য তাকে সপরিবারে নিজ হাতে খুন করে। এ সব ঘটনায় পার্টিতে সাদ্দামের প্রভাব বেড়ে যায় এবং বৃটিশদের সহযোগিতায় মাইকেল আফলাকের সাথে বৈঠক হয়। এ বৈঠকের পর আফলাক সাদ্দামকে নিজ পুত্রের ন্যায় প্রতিপালন করতে থাকে।সাদ্দাম ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠে।তার খুনী চক্র বাথ পার্টির অংশ হয়ে যায়।আফলাক এবং বৃটিশ সরকার উভয়ের নিকট থেকে সে অঢেল অর্থ পেতে থাকে।এভাবেই আজকের সাদ্দামের প্রাথমিক জীবন অন্ধকার ও ক্রুর পরিবেশের মধ্যে অতিবাহিত হয়।ইসলাম বিদ্বেষী মাইকেল আফলাকের সান্নিধ্যে এসে দাম্ভিক সাদ্দাম পরবর্তীতে চরম ইসলাম বিদ্বেষী ভাবধারায় আক্রান্ত হয়।এর প্রতিফলন দেখা দেয় তার ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পরে। তখন অত্যন্ত নৃশংসভাবে হাজার হাজার আলিমকে হত্যা করা হয়। সমস্ত ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং প্রধান প্রধান সকল বিরোধী নেতাকে ফাঁসি অথবা কারারুদ্ধ করা হয়।

          ১৯৭৯ সালের ১৭ জুলাই সাদ্দাম হোসেন ক্ষমতা গ্রহণের ১৫ দিনের মধ্যে ৩০ জন কর্মকর্তা এবং একই বছর ২৫ শে অক্টোবর ২২ জন উচ্চ পদস্থ সেনা অফিসার ও কমান্ডারকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন।একই বছর সরকারের ৪ জন মন্ত্রীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।১৯৮৩ সালের ১৯ শে জুন সাইয়েদ মহসীন আল হাকিমের পরিবারের ৬ জন আলিমকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।কেবল সরকারের বিরোধিতা করার কথিত অপরাধে।এছাড়াও সে শুদ্ধি অভিযান, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অসংখ্য ইসলামী আন্দোলনের কর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সেনা অফিসারকে গোপনে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে। সে এত দক্ষতার সাথে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে যে, সাদ্দামের পর দেশের নেতৃত্ব দেয়ার মত কোন যোগ্য নেতা গড়ে উঠতে পারছে না। তার স্বৈরাচারী শাসনে অতিষ্ট হয়ে কুর্দীরা বিদ্রোহী হয়ে উঠে।সাদ্দাম এই কুর্দীদের দমন করার জন্য ১৯৮৮ সালে মোশুলে বিষাক্ত নার্ভ গ্যাস ও মাস্টার গ্যাস নিক্ষেপ করে ২০ হাজার কুর্দী নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। শহরে রাজপথে লাশের স্তূপ পড়ে যায়।সাদ্দামের ইসলামের প্রতি যদি সামান্য অনুরাগও থাকত তবে তার দ্বারা এ গণহত্যা ঘটতে পারতো না। কেননা ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্রেও নিরস্ত্র মুসলমান নারী-শিশুকে হত্যা করার অনুমতি দেয় নি।এই সাদ্দাম হোসাইন পাশ্চাত্যের কুপরামর্শে এবং অস্ত্রের দাপটে প্রতিবেশী ইরানের উপর ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। ৮ বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে দেশ দুটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়, লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হয়।পঙ্গু হয় আরো কয়েক লক্ষ লোক।আরব বিশ্বের উদীয়মান সামরিকশক্তি মুখ ধুবড়ে পড়ে।এর ফলে আমেরিকা-ইসরায়েল বাক-বাকুম করতে থাকে। ১৯৯০ সালে গোয়ার্তুমির কারণে এই লোকটি আন্তর্জাতিক সকল মীমাংসা বৈঠককে উপেক্ষা করে শক্তির জোরে কৃত্রিম সীমান্ত সংকট সৃষ্টি করে কুয়েত দখল করে এবং এই ইস্যুতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে সদলবলে মধ্যপ্রাচ্যে জড়ো হওয়ার সুযোগ করে দেয়।আমেরিকা সেখানে তার শয়তানী খেলের চূড়ান্ত মহড়া দেখায়।যুদ্ধের মাধ্যমে সে আরব দেশগুলি থেকে খরচ বাবদ শত শত কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়।সৌদি আরবের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে ১০০০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে। আবার সেই অস্ত্রের মাধ্যমেই সৌদি আরবের সেনাদের কৌশলে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করায় যাতে এ অস্ত্রের চালান দ্রুত ফুরিয়ে গেলে নতুন করে অস্ত্র বিক্রি করতে পারে। আমেরিকা নতুন এমন কতগুলি অস্ত্রের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে যা কোন যুদ্ধ ছাড়া পরীক্ষা করা যাচ্ছিল না।ইরাকের অসংখ্য সেনা হতাহত হয়,সামরিক শক্তির চরম ধ্বংস সাধিত হয়।পক্ষান্তরে, আরব বিশ্বের চিরশত্রু ইসরাইলের অস্ত্র ভান্ডার মার্কিনী মারণাস্ত্রে আরও সমৃদ্ধ হয়। অথচ একমাত্র ইরাকের সামরিক শক্তির দ্বারা মধ্য প্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলকে শায়েস্তা করা যেত।এই যুদ্ধের ফলে অনুন্নত মুসলিম বিশ্বের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও কলকারখানায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।ইরাক, কুয়েত ও সৌদি আরবে কর্মরত লাখো লাখো বিদেশী মুসলমান  শ্রমিকেরা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়।কুয়েতকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে সাদ্দামের পলাতক বাহিনী। সবগুলি তেলকুপে আগুন লাগিয়ে দেয়ায় মুসলিম বিশ্বের শত কোটি ডলার সম্পদের ক্ষতি হয়।এ যুদ্ধে পাশ্চাত্য সার্বিক লাভবান হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কেবল মুসলিম বিশ্ব।আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর বোমা বর্ষণের ফলে হতাহত হয় নিরীহ ইরাকী মুসলমানরা, ধ্বংস হয় তাদের সম্পদ ও ঘরবাড়ি। আবার ইরাকের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাহরাইন ও সৌদি আরবের বেসামরিক মুসলমানরা।হাতে গোনা কয়েকজন মার্কিন সেনার হতাহতের বিনিময়ে বিরাট বিজয় ও প্রচুর অর্থ সম্পদ লাভ করে। পক্ষান্তরে, ইরাক হাজার বছর পিছিয়ে পড়ে।আমেরিকার পরবর্তী প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের জন্য অসহায় ইরাকী জনগণকেই চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।তারা এখনও দুর্ভিক্ষ ও মার্কিনী বিমান হামলায় মারা যাচ্ছে।

          সাদ্দাম হোসাইন বাথ পার্টির আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে দেশে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কায়েম করে রাশিয়ান ঘেঁষা সমাজতন্ত্র। শাসনতন্ত্রে নামে মাত্র ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম রাখা হয়েছে।ইসলাম একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।অন্য কোন মতবাদের সাথে ইসলামকে জোড়াতালি দেয়ার কোন সুযোগ নেই। অথচ সাদ্দাম হোসাইন সুবিধা মাফিক ইসলামী শরীয়ত ও কমুনিজমের সমন্বয়ে একটি সংবিধান কায়েম করেছেন যা একই পাত্রে শরাব ও শরবত রাখার মত কারবার।সাদ্দাম ও বাথ পার্টির নেতৃত্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ছিল কো-মস্কো পররাষ্ট্রনীতি। লেবানন ও প্যালেস্টাইনের মুসলমানদের ওপর ইজরাইলী ইহুদীদের বর্বর দমন, নির্যাতনের পরও ইরাক সর্বদা রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে।কাশ্মীরী মুসলমানদের ওপর ভারত নির্যাতনের স্টিমরোলার চালালেও ইরাক বরাবরই ভারতকে সমর্থন জানিয়ে আসছে।আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ পরিষদ সোভিয়েত ইউনিয়নকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান সম্বলিত প্রস্তাব পাস করলে ইরাক এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েতের পক্ষে ভোট দান করে।এছাড়া বর্তমানে বসনিয়ার মুসলিম গণহত্যার বিরুদ্ধে সকল মুসলিম রাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ইরাকের কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।বার্থ পার্টি ফ্রান্সের আর্থিক ও সার্বিক সহযোগিতায় গঠিত হয়েছিল এবং এর সকল নীতি নির্ধারণে ফ্রান্সের অবদান ছিল বলেই উপসাগরীয় যুদ্ধের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ফ্রান্সের সাথে ইরাকের ছিল সুসম্পর্ক।

          সাদ্দাম হোসাইন কর্তৃক লেখা পার্টির কর্মসূচি ও মৌলনীতি তার আত্মজীবনী ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তার নিজের লেখা প্রবন্ধ ও রচনাবলী অধ্যয়ন করলে তার ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনারও একটা ধারণা পাওয়া যায়। তার লেখা 'আল-মাসআলাতুদ দীনিয়াত' নামক বইয়ের ২২ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, "প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার আবর্তনের মাধ্যমে ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার প্রসারতার কারণে বিভিন্ন আরব দেশগুলোতে নানা প্রকার ইসলামী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে দেখা যায়"।২০ নং পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, "ইসলামী আন্দোলনগুলো হচ্ছে বাথ পার্টির অগ্রযাত্রার একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। ইসলামী আন্দোলনগুলি প্রাচীন পন্থীদের আড্ডাখানা।সেখানে হাল জামানার কথাবার্তা খুবই কম শোনা যায়।"

          অন্য একটি বই "নাজ রাতুনকিত তুরাহ ওয়াদদীন" এ তিনি লিখেছেন যে, "আমাদের দর্শন দ্বীনও নয় এবং ঐতিহ্যও নয় বরং আমাদের দর্শন হলো জীবন ও জগতের উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়াবলীর সমষ্টি।" ইরাকী জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, "তারা ইসলামী জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তারা সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে বাথ পার্টি কর্তৃক গৃহীত কর্মসূচির সাথে অসংগতিপূর্ণ কাজ না করে"।

          সুতরাং এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আজকের উপসাগরীয় সংকটের মূলে রয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী চক্র ও পাশ্চাত্যের চক্রান্ত। তারাই সুকৌশলে এ সমস্যার সৃষ্টি করেছে এবং এ সমস্যা সমাধানের নামে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতি সাধন করে চলছে। আজকের ইরাকের সাদ্দাম হোসাইন সে ধ্বংস লীলায় ১ নাম্বার খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র। [অসমাপ্ত]