নির্বাচিত নিবন্ধ
হাবীলের কাক-১
লাকুম দ্বীনুকুম ওলিয়াদীন
কামরুজ্জামান লস্কর
[পৃথিবীর মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম জঘন্য পাপ হলো কাবীল কর্তৃর্ক হাবীলকে হত্যা। হাবীলের লাশকে কেমন করে গুম করবে সেই চিন্তায় কাবীল যখন অস্থির হলো তখন আল্লাহ তায়ালা একটি কাককে পাঠালেন তাকে নসিহত করতে। কাকটি একটি মৃত কাককে গর্ত খুঁড়ে মাটি ও পাথর চাপা দিচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখে কাবীল অনুতপ্ত হয়ে বললোঃ হায়, একটি কাকের বুদ্ধিও আমার নেই। আজকের দুনিয়ায় যারা ইসলামকে কটাক্ষ করে, হেয় করে তাদের ওই কাকের বুদ্ধিটুকুও নেই। তাদেরকে উপলক্ষ করে হাবীলের কাক’ নিবন্ধগুলির অবতারণা! -লেখক]
“বল, হে কাফিরগণ!
আমি তার ইবাদত করিনা
যার ইবাদত তোমরা কর
এবং তোমরাও তার ইবাদকারী নও
যার ইবাদত আমি করি
আমি ইবাদতকারী নই তার
যার ইবাদত তোমরা করে আসছো।
এবং তোমরাও তার ইবাদতকারী নও
যার ইবাদত আমি করি।
তোমাদের দ্বীন তোমাদের
আমার দ্বীন আমার।”
এই হচ্ছে সূরা কাফিরূনের পরিস্কার তরজমা। উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ফজরের সুন্নত নামাজে পাঠ করার জন্য দু’টি সূরা উত্তমঃ (১) সূরা কাফিরূন। (২) সূরা ইখলাস।
প্রতিদিন প্রত্যুষে নিদ্রা থেকে জেগে উঠে দিনের শুরুতে এক অদ্বিতীয় আল্লাহ পাকের দরবারে দাঁড়িয়ে একজন মুসলমান সর্বপ্রথম যে কথাগুলি উচ্চারণ করবেন, তা এই হাদীসখানি থেকে জানা গেলো, এবং নবীজি তাকে উত্তম বলেছেন।
কোনো রাখঢাক নয়, কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ নয়, কোনো ঘোর-প্যাঁচ নয়, অত্যন্ত স্পষ্ট করে একজন মুসলমানের নিজের অবস্থান জেনে নিতে ও জানিয়ে দিতে এই সূরাটি নাজিল হয়েছে। নিজের ধর্ম ও অপরের ধর্মের সীমারেখা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে মুসলমানকে। অবিশ্বাসকারীকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে অবিশ্বাসকারী বলে সম্বোধন করতেও বলে দেয়া হয়েছে। অবিশ্বাসকারীর উপাস্যকে অস্বীকার করতে বলা হয়েছে এবং অবিশ্বাসকারী আল্লাহর উপাসনা করে না একথাও জেনে নিতে বলা হয়েছে মুসলমানকে।
অবিশ্বাসীর কর্ম ও মুসলমানের কর্ম এক নয়। তাদের কর্মফল এবং মুসলমানের কর্মফলও এক নয়। এই ঘোষণা বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তা'আলার। এই ঘোষণা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী প্রতিটি মুসলমানের।
ইদানিং আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধির তথাকথিত মহাজনরা কথায় কথায় কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের প্রয়াস পাচ্ছেন। বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার সাফাই গাইতে তারা যখন সূরা কাফিরূনের উদ্ধৃতি দেন, তখন তাদের নির্বুদ্ধিতা দেখে অবাক হতে হয়। যে অমুসলিমের মনকে জয় করার জন্য তারা লাকুম ' বাণী শুনিয়ে থাকেন, তারা সূরা কাফিরূন হয়তো পুরোটা পড়েন নি। কিংবা পড়লেও পুরো অর্থ জানেন না। যদি জানতেন, তাহলে সম্ভবতঃ সূরাটি তরজমা করে তারা আর কাউকে নসিহত করতে চাইতেন না। কেননা প্রথম লাইনের তরজমা শুনেই তাদের বান্ধবেরা না-খোশ হয়ে যেতো। এবং পরবর্তী প্রতিটি লাইনেই তারা বুঝে নিতে পারতো, আমাদের জ্ঞান-পাপীরা কীভাবে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামাবলী পরে অমুসলিমদের সাথে মস্করা করছেন।
আমাদের কতক মূর্খ বুদ্ধিজীবি নিজেদের চিন্তাপ্রসূত বিদ্যাবুদ্ধি জাহির করে চলেছেন। বুদ্ধিই যাদের জীবিকা তাদের জন্য দুঃখ করাই উচিত। আল্লাহর দ্বীনের জ্ঞান তারা অর্জন করেন না সংগত কারণেই। কেননা এই জ্ঞান জীবিকা অর্জনের জ্ঞান নয়।
দ্বীনের ইলম দিয়ে পেট ভরে না, প্রাণ ভরে। দ্বীনের ইলম দিয়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবি হওয়া যায় না, দ্বীনদার হওয়া যায়। দ্বীনদারী দুর্লভ বস্তু, বুদ্ধি বেচা-কেনা থেকে তা সম্পূর্ণ পবিত্র।
আমাদের জ্ঞানপাপী বুদ্বিজীবিরা মুসলিম ও অমুসলিমের ব্যবধান মিটিয়ে দিতে চান। এই ইচ্ছা, তারা ইশারা-ইংগিতে হামেশা প্রকাশ করে থাকেন। নানা ফন্দি-ফিকিরে ছল-চাতুরীতে তারা মনের গোপন পঙ্কিল বাসনা পূরণ করতে চান। জ্ঞান-বুদ্ধির বাক চাতুরীতে মায়াজাল সৃষ্টি করে মানুষের মনে মোহ জাগাতে সচেষ্ট থাকেন। মানবতা ও ভ্রাতৃত্বের মোহনবাঁশী বাজিয়ে মিথ্যার ধুম্রজাল সৃষ্টি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। এই দিকভ্রান্তরা নিজেরা যেমন পথের দিশা হারিয়ে অন্ধকারের ঠিকানায় দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছেন, সেই সাথে আরো কিছু অবুঝ ও সরল মানুষকেও ধোঁকা দিয়ে আপন নিবাসের বাসিন্দা করে নিচ্ছেন।
অথচ ইসলাম বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর সীমান্ত চিহ্নিত করে দিয়েছে এবং এই সীমান্ত অতিক্রমের উপর নিয়মনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই সাথে বিশ্বাসীর নিরাপত্তা ও অবিশ্বাসীর নিরাপত্তা উভয়টির উপর প্রচন্ড গুরুত্ব আরোপ করেছে। কোনো ফন্দি-ফিকির তো দূরের কথা, পার্থিব কোনো কারণই এই সীমান্তরেখা অতিক্রম করতে পারে না। ইসলাম কোনো মুসলিমকে এমন সুযোগ দেয় নি যে, সে কোনো অমুসলিমের উপর চড়াও হতে পারে । ইসলাম মুসলমানের দ্বীনের হেফাজতে যেমন কঠোর তেমনি অমুসলিমের ইজ্জত-হুরমত, মান-মর্যাদা ও ধন-সম্পদ সব কিছুর হেফাজতেও কঠোর।
ইসলাম একটি বিশ্বাসের নাম। একটি জীবন বিধানের নাম। পরকালীন জীবনের মুক্তির সনদের নাম। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেম-প্রীতি, মঙ্গল প্রদীপ, পূজার বেদী এসবের সাথে সুদূরতম সম্পর্কও নেই ইসলামের।
তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের, আমাদের কর্ম ও কর্মফল আমাদের।
রবীন্দ্র সংগীতের ইবাদত করে ইহকালে বুজুর্গী অর্জন করা সম্ভব। পরকালে যাদের বিশ্বাস নেই, তারা ইবাদতের অর্থই বুঝে না। নাস্তিকের বুদ্ধি মাথায় থাকে না, থাকে হাঁটুতে। ওদের বিবেচনায় দুই হাঁটুর বুদ্ধি এক মাথার চেয়ে বেশী বলে বয়সকালে নাস্তিকেরা বেশী জ্ঞান-বুদ্ধির পরিচয় দেয়। পৃথিবীর সব নাস্তিকই জগতে উত্তরাধিকারীদের জন্য ওয়ারিশী সম্পদ হিসাবে লাঞ্ছনা ও ঘৃণাকে শুধু রেখে গেছে। যাদের ধর্মে বিশ্বাস নেই তারা ‘লাকুমদ্বীনুকুমের' নসিহত করে। এটা বিশ্ববেয়াকুফী বৈ আর কী হতে পারে? তথাকথিত তরজমাকারীরা এটা খুব বুঝে যে, ধর্মে বাড়াবাড়ি নেই; এটা বুঝে না যে, এই ধর্মে মাখামাখিও নেই। এই দ্বীন মানুষকে পবিত্র করে, সেই জন্য পবিত্র হবার পর কেউ অপবিত্র হলে এই দ্বীন তাকে প্রত্যাখ্যান করে, তার প্রতি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
রবীন্দ্র সংগীত যাদের ইবাদত, তারা মৃত্যুর সময় কবিগুরুর কোনো কবিতা পাঠ করার বাসনা হয়তো রাখে। আর আত্মার কোনো আত্মীয় মৃত্যুকালে তাকে সোনারতরী কিংবা কোনো ঘুমপাড়ানীয়া সংগীত শোনাবে আর সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়বে-এরকম সে ভাবতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এমনটি হবে না। দৌড়াদৌড়ি শুরু হবে। তখন কালেমার জন্যে সে যেমন পেরেশান হবে তার নিকটাত্মীয়রাও তেমনি পেরেশান হবে। মৃত্যুর পর ওরা নানান কথা বানিয়ে বলবে। কত আসান তরীকায় কলেমা পড়তে পড়তে জান্নাতের দিকে তাকে যেতে দেখলো, সেকথা বারবার বলবে।
আজ যে মুসলমানের ঔরসে জন্ম নিয়ে দ্বীনের সাথে বাগাওয়াতি করে, মুশরিকের সাথে ঘর করতে যায়, সে তার সন্তানের জন্য কী অসিয়ত করে যায়? তার তো কোনো ধর্ম নেই। কিন্তু সে যাকে অপবিত্র করলো সেই দুর্ভাগা সন্তানের মুক্তির পথটি কেন সে বন্ধ করে গেলো? লাকুমদ্বীনের ভুল অর্থ বুঝে নিজে দ্বীনহারা হলো, ভবিষ্যৎ বংশধরের পথটাও বন্ধ করে দিলো এরা অন্যের বাড়াবাড়ি নিয়েই মেতে থাকে, নিজের বাড়িবাড়িটা দেখে না। নিজের বাড়াবাড়িতে নিজেই যে ধ্বংস হয় সেই বুঝ ওদের না থাকলেও তাদের বংশধররা ঠিকই বুঝতে পারে, অভিশম্পাত দিতে থাকে এবং এভাবেই আল্লাহ তায়ালার লানত ও শাস্তি যথারীতি কার্যকরী হয়ে যায়।
আমার এক মুরব্বী জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে হঠাৎ করে এক রাজনৈতিক আন্দোলনের ঘোর সমর্থক হয়ে উঠলেন। তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা এখন ঐ আন্দোলনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। শেষ বয়সে এমন বেসামাল অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়েছি। তবে তার দীর্ঘ কর্মময় জীবনের শেষ দিনগুলির পরিণতি দেখে বুঝা যায়, আল্লাহর নিকট কোনো অতীত নেই, কোনো ভবিষ্যতও নেই, সবকিছু বর্তমান। তিনি আজ জানেন কাল আমি কী করবো। আমরা আমাদের পিতৃপুরুষের চিন্তা-চেতনা ও আশা-আকাংখার উপর পাথর চাপা দিয়েছি, তাদের রেখে যাওয়া ক্ষেত-খামারকে উজাড় করে দিয়েছি, সকল বাঁধের অর্গল খুলে দিয়ে অবাধ বিচরণের চারণভূমি বানিয়েছি, তখনি তাদের রক্তের অভিশাপ উত্তর পুরুষের সংসারকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। আজ যে সংসার ছারখার হতে চলেছে, তাকে যারা নির্মাণ করেছিলো, তারা অসংখ্য দংশন সহ্য করে নিরাপদ বাসস্থান তৈরী করে গিয়েছিলেন আমাদেরই জন্য। কিন্তু আমরা তা বুঝতে চাই না।
জ্ঞানীরা তখন পূণ্যবান ছিলেন, এখন জ্ঞানপাপীরা তাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছে। এরা মানুষকে বুঝায় সব নদীর উৎস এক এবং সব নদীর সংগমস্থল অর্থাৎ পরিণতিও এক । কিন্তু নিজের পরিণতির কথা চিন্তা করে না।
বহুদিন আগের কথা। সিলেটের চা-বাগানে শ্রমিক নিয়ে এসেছিলো ইংরেজরা। শ্রমিকেরা আর দেশে ফিরে যায় নি। চা-বাগানই এদের বাড়ী-ঘর, সবকিছু। বাগানের ম্যানেজার সাহেবই ওদের মা-বাপ। চা-বাগানের কাজ থেকে শুরু করে ম্যানেজার সাহেবের পায়ে জুতা পরাতো পর্যন্ত সব কাজই ওরা করে আসছে বংশ পরম্পরায়। বাইরের জগতের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সারাদিন ঝড়বৃষ্টি রৌদ্রতাপে কঠোর পরিশ্রম, সামান্য পারিশ্রমিক, আর রাতভর তাড়ি আর মদে চূর হয়ে পড়ে থাকাই এই কুলিজীবনের ইতিহাস। এই জীবনেই তাদেরকে অভ্যস্ত করে রাখা হয়েছে। ম্যানেজার সাহেব মারা গেলে ওরা হাউমাই করে কাঁদে আবার ম্যানেজার সাহেবের মেয়ের বিয়েতে দিনরাত মাতাল হয়ে নেচে গেয়ে ফুর্তি করে। এক বাগানের কুলিরা অন্য বাগানের ম্যানেজার সাহেবের সুখে-দুঃখেও অংশ গ্রহণ করে। কিন্তু নিজেদের দুঃখে ওরা মাতমও করে না, সুখের কারণে আনন্দ প্রকাশও করে না। এভাবেই তাদেরকে বানিয়ে নেয়া হয়েছে। দেশ স্বাধীন হবার পর বাগানগুলিতে বাইরের কিছু হাওয়া লাগতে শুরু করলো! বিশেষ করে জাতীয় দিবসগুলোতে বাগানেও বিভিন্ন কর্মসূচী হতে লাগলো। শোক দিবস, মৃত্যুদিবস পালন হতে লাগলো। এইসব দিনে বাগানে ছুটি দেয়ার নিয়ম চালু হতে লাগলো। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুতে চা-বাগানের শ্রমিকরা ছুটি পেয়ে অবাক হয়ে গেলো। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলে সারা দেশে শোকের ছায়া নামে। সবকিছু বন্ধ হলো। চা-বাগানেও ছুটি ঘোষণা করা হলো। কুলিরা দল বেঁধে তাদের সরদারের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, হারে ছরদার, ইউ জাবাবুর রহমান কউন হায় রে? সরদার কিছুক্ষণ চিন্তা করে জবাব দিলোঃ হোয়েগা কোউ বড়ি বাগানকি ম্যানিজার ছাব।
এই কুলি আর সরদারের মতো আমাদের মহান পিতৃপুরুষের বহু উত্তরাধিকারী আজ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। আবু জাহেলী অজ্ঞতায় ওরা অবতার আর মুহাম্মদে তফাৎ বুঝেনা। ওরা যীশুখৃষ্টকে ঈশ্বর মনে করে আবার আল্লাহকেও ঈশ্বর। বলে। ওদের ধারণা সব নদীর উৎস যেমন এক তেমনি সব ধর্মের উৎসও এক। অতএব ইসলামের উৎসও তাই। এই ঐকিক নিয়মে ওরা বুঝে, সব নদী সংগমস্থলে এক মোহনায় বিলীন হয়ে যায়। অতএব ইসলাম ধর্মের শেষও ঐ খানেই। অর্থাৎ মুসলমানের পরিণতিও তাই, যা অন্যের পরিণতি। অথচ আল্লাহ বলেছেন, একমাত্র ইসলামই তার মতোনীত দ্বীন'।
আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, তার কিতাব ও তার দ্বীনকে চিনে না বলেই ওরা ওদের পথ প্রদর্শকদের শিখাতো মালিকদেরই শুধু চিনে। তোমাদের দ্বীন তোমাদের, আমাদের দ্বীন আমাদের। এই স্বাধীনতার অর্থ আপোষ নয়। আমরা যার ইবাদতকারী সেই এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তা'আলার দ্বীনের উপর দৃঢ়পদ থাকাই আমাদের ইবাদত, আমাদের অংগীকার। এই দ্বীনে হানিফ থেকে না এদিকে না ওদিকে সামান্যতম হেলে যাবার কোনো অবকাশ আছে। আলোর সাথে অন্ধকারের কোনো আপোষ হয় না।হয় আলো, নয়তো অন্ধকার। আলো নিভলে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাবে। আলোর উদ্ভবে অন্ধকার বিলীন হবে। আলোময় ইসলামই আমাদের জীবন বিধান। এই আলোর ভূবনে বসবাসকারী যেসব হতভাগারা চোখ থাকতে অন্ধ হয়েছে তাদের সাথে পথ চললে পরিণতি কী হবে সেকথা বুঝার ক্ষমতা যাদের নেই, তাদের কথাও কুরআনে আছে। কুরআনুল করীমে সব মানুষের পরিচয় আছে। যে কুরআন পড়ে সে নিজেকে চিনে, অন্যকেও চিনে। যে পড়ে না তাকে অন্যরা চিনে।
আমার এক সহকর্মীকে প্রায়ই দেখি কানাকানি করতে। তার কাছে যারা আসেন, তারাও আকারে-ইংগিতে কথা বলেন। আমি পরিস্কার বুঝতে পারি যা নিয়ে তারা কথা বলেন, সে সব সার্বজনীন ব্যাপার। তাহলে এই ইশারা-ইংগিত কেন? আসলে তারা এমন এক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আছেন, যার সাথে তাদের দ্বীন কখনো কখনো আপোষ করে থাকে। এরা আলোর ভূবনে বসবাসকারী। কিন্তু অন্ধকার জগতেও তাদের বান্ধবরা আছে। কুরআনের ভাষায় একবার এদিকে তো একবার ওদিকে; এই ইতিউতি কানাকানি করে আত্মপ্রবঞ্চিত জীবনে নিষ্ফলতার বোঝা-ই বাড়িয়ে চলেছে। আল্লাহ বলেন, এদের কান আছে তবু এরা শুনে না। কী শুনেনা? আল্লাহর পবিত্র কিতাবের কথা শুনে না, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অসিয়তকৃত মুজাহিদের আযান শুনে না, নবীর ওয়ারিশরা ডেকে ডেকে হয়রান হচ্ছেন তাদের ডাকে কানে আঙ্গুল দিয়ে আপন আদর্শে উৎফুল্ল হয়ে অভিশপ্ত পথের দিকে চলতে থাকবে। এইসব অন্তরের একটি দ্বারও যেতো খুলবার নয়। বরং দ্বীনের ব্যাপারে বুজুর্গী দেখাবে ওস্তাদের মতো। আল্লাহ ও রাসূলের নামে আপন ধ্যান-ধারণার কথা বলার ওস্তাদি শ্রোতাকে বিস্মিত করে দেবে। লাকুমদ্বীনুকুমের তাফসীর করে নিজে বুঝেছে অন্যকেও বুঝিয়েছে ধর্মে ধর্মে তফাৎ নেই, সবই মানব ধর্ম। যে আমার আমি তার; পরকাল যদি একান্তই থেকে থাকে, মুক্তির পথ খোলা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হতভাগারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে বলে দাবী করে, অথচ আল্লাহর দাবীকে উপেক্ষা করে নিজে আরেক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকে। কুরআন মানে বলে দাবী করে অথচ কুরআনের কথায় আর তার নিজের কথায় কোনো মিল না থাকলেও আপন বক্তব্যে অবিচল থাকবে। পরিবারের সুখ-দুঃখে নবীর নামে মিলাদ পড়াবে। কিন্তু নবী জীবনের কোনো আদর্শই নিজের জীবনে, পারিবারিক জীবনে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিরাপদ আশ্রয়ে বসবাস করবে, অথচ ইসলামী জীবন বিধানকে গ্রহণ করা অসম্ভব বলে জ্ঞানগর্ভ মতামত দেবে।
যারা কৌশল জানে, আত্মস্বীকৃত বুদ্ধিজীবি হয়ে কথার মারপ্যাঁচে রাতকে দিন বুঝায়, সত্যকে আড়াল করে মিথ্যার মায়াজালে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে, ইসলামের শ্বাশ্বত সরল পথের পথিককে বিভ্রান্তি ও অভিশপ্ত পথের দিকে নিয়ে যায়, তাদের অনুসরণকারীরা এখন বিজয় মিছিল করছে। নির্বোধদের মিছিল পথের শুরু থেকে শেষ পৰ্যন্ত বিস্তৃত। এর অর্থ এই নয় যে, তাগুতের বরপুত্ররা কামিয়াব হয়ে গেছে। দুনিয়াতে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দার উপর সে কখনো বিজয়ী হতে পারবে না। দ্বীনে হানিফের উপর যে দৃঢ়পদ থাকবে সে কখনো পরাজিত হবে না। সূরা কাফিরূন যে মুখে ও অন্তরে নিঃশঙ্কচিত্তে পরম বিশ্বাসে উচ্চারণ করতে পারবে, তার অভিভাবক হবেন স্বয়ং বিশ্বজগতের প্রভু। শয়তান তার শত্রু হলে হতে পারে, এটা কোনো পরোয়া করার বিষয় নয়।
একদল মানুষ কুরআন অধ্যয়ন করে মানুষকে নসিহত করার জন্য, আরেক দল পড়ে অন্যকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এমন অনেক আছে যারা কুরআন ও হাদিস খুব জানে কিন্তু কথাবার্তায়, চলাফেরায় অন্য তাল অন্য সুর। তাহলে কুরআন-হাদীসের এই। জ্ঞান তাদের কী কাজে লাগে? অবশ্যই কাজে লাগে। তর্ক করতে লাগে, আপন মত ও পথের অনুসারীদের বিভ্রান্ত করতে কাজে লাগে। “লা ইকরা-হা ফিদ্দ্বীনের মতো ছোট ছোট লাইন অথবা সূরা কাফিরূনের মতো ছোট খাট সূরার কিছু অংশের যেসব হাস্যকর অর্থ ও ব্যাখ্যা করে বসে, না জানি পুরো কুরআনের কী অর্থ এদের উর্বর মস্তিকে মওজুদ হয়ে আছে। ভাবতেও অন্তর কেঁপে উঠে।
আপন মত ও পথকে কুরআন ও হাদিসের স্ববিকৃত অর্থ দিয়ে গ্রহণযোগ্য করার কৌশল কিভাবে তাদের অনুসারীদের বিভ্রান্ত করে তার একটি নজীর আমি কিছুদিন আগে দেখেছি। আমার বসবাস তখন আরবের জিদ্দা শহরে। আমার বাসায় একটি যুবক ছেলে এলো দেখা করতে। প্রতিবেশীর আত্মীয়, দেশ থেকে এসেছে ওমরাহ করতে। কথা প্রসঙ্গে জানলাম, ওরা বেশ কয়েকজন বন্ধু দলীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাদের পরমপ্রিয় নেতার নামে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে মক্কা মুকাররামায় এসেছিলো। বন্ধুরা এদিক সেদিক ঘুরছে, সে আত্মীয়ের সাথে দেখা করতে এসেছে, রাতে ফ্লাইট, সকলে একসাথে দেশে ফিরে যাবে। জিজ্ঞেস করলাম, বাবা-মা কেউ আছেন? জবাব দিলো নেই, মা ছোট রেখে মারা গেছেন, বাবা লালন-পালন করেছেন, এখন তিনিও নেই। আবার জিজ্ঞেস করলামঃ তাদের জন্য ওমরাহ করেছো? হঠাৎ যেতো ছেলেটির কী হলো। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল, কোনো কথা নেই। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ যেতো সম্বিত ফিরে পেলো। মুহূর্তে টান টান হয়ে উঠে দাঁড়ালো। আত্মীয়ের দিকে ফিরে বললোঃ মামুজান, আমি একটা অমানুষ। ওদের বলে দেবেন, আমি আজ ওদের সাথে দেশে ফিরে যাচ্ছিনা। দরজার কাছে গিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললোঃ বড় ভাই, আমি মক্কা যাচ্ছি। চেয়ে দেখি, তার দু'চোখ ভরা অশ্রু টলমল করছে।