টুকরো টুকরো কথা
কৃতজ্ঞতা বনাম অকৃতজ্ঞতা
বুদ্ধিমান কে?
এক ব্যক্তি তার বন্ধুকে বলল, আজকালের শিশুরা বড় পাকা বুদ্ধিমান। এদেরকে বোকা ঠাওরানো বড় কঠিন।
দৃষ্টান্ত স্বরূপ সে বলল যে, তার এক ছেলে টেলিভিশনে একটা ফিল্ম দেখছিল। তাতে বাস্তবের সাথে সম্পর্কহীন একটি দৃশ্য দেখে ছেলেটি বলে ওঠল, নাহ, এমন তো হয় না! এটা নিশ্চয় ক্যামেরার কারসাজি!! বাস্তবে এমনটি ঘটে নাকি?
জবাবে দ্বিতীয় বন্ধু বলল, আসলে এটা বাচ্চাদের বুদ্ধিমত্ত্বা নয়-তোমার বোকামী। খানিকটা অবাক কণ্ঠে প্রথম বন্ধু জিজ্ঞেস করল, আমি কী করে বোকা হলাম? এখানে তুমি আমার বোকামীর কী দেখতে পেলে? দ্বিতীয় বন্ধু বলল, শোন, তুমি টেলিভিশনের একটি দৃশ্যকে অবাস্তব বলছ। অথচ, টেলিভিশন রাতদিন সারাক্ষণ এমন সব প্রোগ্রাম-ই প্রচার করছে, বাস্তবতার সাথে যার বিন্দুমাত্র মিল নেই। তথাপি তা দেখে তুমি মূল্যবান সময় নষ্ট করছ! টেলিভিশনের পর্দায় বিভিন্ন দৃশ্য দেখে কখনো তুমি অভিভূত হয়ে পড়, জালিমের নির্মম আচরণ দেখে শিহরিত হও, ঘৃণা প্রকাশ কর, দুঃখজনক দৃশ্য দেখে দুঃখিত হও, আবার আনন্দের কিছু দেখলে উফুল্ল হও! অথচ, তুমি তো জান, টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখানো হয়, তা বাস্তব ঘটনা নয়! এখন তুমিই বলো, জেনে শুনে অজ্ঞের মত আচরণ করা বোকামি নয় তো কি?
সবশেষে দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুকে বলল, প্রকৃত বুদ্ধিমান কে জান? নবীজির ভাষায়ঃ “বুদ্ধিমান কেবল সেই ব্যক্তি, যে নিজের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছে এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য কাজ করেছে?”
শয়ন ও জাগরণ
মানুষের নিদ্রা মূলত এক ধরনের মৃত্যু। এ কারণেই মুমিন শোয়ার সময় নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েই শোয়, বলে, হে আল্লাহ! আমি তোমার-ই নামে মৃত্যু বরণ করছি এবং তোমার-ই নামে আবার জীবিত হব।
ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে মুমিন নতুন জীবনের জন্য মহান আল্লাহর শুকর আদায় করে এবং বলে যতসব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে মৃত্যু দিয়ে পুনরায় জীবন দান করেছেন। আবার একদিন তার-ই কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে।
ইসলামের শিক্ষা অনুসারে শয়ন ও জাগরণের এ নিয়ম মরণ ও জীবন লাভের-ই নামান্তর। মানুষ সৎকর্মশীল মুমিন হলে শয়ন ও জাগরণের সময় জীবন ও মরণের দীক্ষা লাভ করে।
ঈমানদার ও বেঈমানের শয়ন-জাগরণ এক নয়। উভয়ের শয়ন-জাগরণের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি পার্থক্য হলো, বেঈমান পরের দিনের নানা ঝামেলা মাথায় নিয়ে ঘুমায়। অথচ, সে জানে না যে, তার এই পরের দিন কত দূরে! এমনও তো হতে পারে যে, এই দিনটির নাগাল সে কখনো পাবেনা!
অপরদিকে ঈমানদার ঘুমায় মৃত্যুর চিন্তা মাথায় নিয়ে। পরদিন প্রত্যুষে জাগ্রত হয়ে সে মনে করে, এ দিনটি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য পরম পাওয়া। এ দিনটিতে আমি আমার অতীত পাপের জন্য তাওবা করে নতুনভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারব এবং আল্লাহর সন্তোষজনক নতুন নতুন আমল করতে পারব।
বেঈমানের দিনরাত কাটে তার নিজের ধান্দায় আর মুমিনের দিনরাত অতিবাহিত হয় মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মধ্য দিয়ে।
সুধারণার এক অনুপম দৃষ্টান্ত
আবদুল্লাহ ইবনে মুতী এর এক কন্যা তার স্বামী তালহা ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আওফকে-যিনি কুরাইশের একজন বিখ্যাত দানশীল ও উদার ব্যক্তি ছিলেন, বললেন, আপনার ভাইদের চেয়ে কৃপণ আর নীচু লোক আমি আর দেখিনি। তালহা (রাঃ) এ কথার ব্যাখ্যা চাইলে স্ত্রী বলল, আমি খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি যে, আপনার নিকট যখন অগাধ সম্পদ থাকে, তখন তারা আপনার পিছনে ঘুরঘুর করে। আর একটু সংকট দেখা দিলে কারুর-ই পাত্তা পাওয়া যায়না। শুনে তালহা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ! এটা তো ওদের উত্তম স্বভাব এবং মহানুভবতার পরিচয়। বিষয়টা তুমি যেমন বুঝেছ, আসলে তেমন নয়। ব্যাপার হলো, আমি যখন ওদের সম্মান ও মূল্যায়ন করার যোগ্যতা রাখি, তখন তারা আমাদের কাছে আসে। আর যখন আমরা তাদের হক আদায় করতে ব্যর্থ হই, তখন আর তারা এসে আমাদের ঝামেলায় ফেলেনা। এটা আমাদেরই ত্রুটি।
কৃতজ্ঞতা বনাম অকৃতজ্ঞতা
হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহর সাথে কথা বলার জন্য একদিন তূর পাহাড়ে চললেন। পথে পরপর তিনজন লোকের সাথে তার সাক্ষাত ঘটলো। তাদের দুজন পুরুষ একজন মহিলা। প্রথম ব্যক্তি মূসা (আঃ) কে দেখে বলল, জনাব! একটু দাড়ান, কথা আছে। মূসা (আঃ) দাড়ালেন। লোকটি বলল, জনাব! তুর পাহাড়ে গিয়ে আপনি আল্লাহর নিকট আমার একটি আবেদন পৌঁছে দেবেন এবং তিনি যা বলেন, ফেরার পথে তা আমাকে জানিয়ে যাবেন। আমার সমস্যা হলো আল্লাহ আমাকে এত বিপুল সম্পদ দিয়ে রেখেছেন যে, তা সামলানোই আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আপনি আল্লাহকে বলবেন, যেন তিনি আমার সম্পদ কমিয়ে শুধু এতটুকু রেখে দেন, যা আমি সামলাতে পারি।
লোকটির কথা শুনে মূসা (আঃ) সামনে অগ্রসর হলেন। কিছুদূর যাওয়ার পর এক মহিলার সাথে সাক্ষাত ঘটলো। মহিলা তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, যাচ্ছেন তো তূর পাহাড়ে, তা আল্লাহর নিকট আমার আরজিটুকু পেশ করবেন এবং তিনি যা বলেন, ফেরার পথে আমাকে জানিয়ে যাবেন। ব্যাপার হলো, আমি নিতান্ত অসহায়। একেবারে নিঃস্ব, সম্পদ বলতে কিছুই নেই। এই যে জীর্ণ কুড়ে ঘরটি দেখছেন, এই আমার নিবাস, একমাত্র সম্বল। আমার মত অসহায় বোধ হয় দুনিয়াতে আর কেউ নেই। বড় কষ্টে আমি দিন কাটাই। আল্লাহর কাছে আমার আকুল আবেদন যেন তিনি আমার প্রতি একটু দয়া করেন।
মহিলার দুঃখের কাহিনী শুনে মূসা (আঃ) আবার হাঁটতে শুরু করেন। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর আর একজন লোকের সাথে তার দেখা। এ বেচারার অবস্থা আরো করুণ। একেবারে পঙ্গু। উভয় হাত-পা কাটা। আছে শুধু মাথা আর ধড়। যেন একটি গোশতের টুকরা মাটিতে পড়ে আছে। মূসা (আঃ) কে দেখে সে কাতর স্বরে বলল, মূসা! আমার কোনো আবেদন নেই। নেই কোনো অভিযোগও। তুর পাহাড়ে গিয়ে আপনি দুনিয়াতে আমাকে এভাবে রাখার তার অভিপ্রায় কী? কেন তিনি আমাকে এভাবে ফেলে রেখেছেন? তিনি আমাকে কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ কী জবাব দেন, মেহেরবানী করে ফেরার পথে আমাকে একটু জানিয়ে যাবেন, এই আমার অনুরোধ।
মূসা(আঃ) তূর পাহাড়ে গেলেন। আল্লাহর সাথে কথা বললেন। এ তিন ব্যক্তির আরজির কথাও জানালেন এবং আল্লাহ যা বললেন, ফেরার পথে প্রত্যেককে তা জানালেন। প্রথম ব্যক্তিকে জানালেন যে,আল্লাহ তোমাকে তাঁর নেয়ামতের না শুকরী করতে বলেছেন, তবেই তোমার সম্পদ কমে যাবে। মূসা (আঃ) এর মুখ থেকে এ কথাটা শোনা মাত্র লোকটি আঁৎকে ওঠে এবং বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে ওঠে এতো হতেই পারে না! আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ! যে আল্লাহ আমাকে এত প্ৰাচুৰ্য্য দান করলেন, কোন মুখে আমি তার না-শুকরী করব! এ আমার কল্পনারও অতীত। সাথে সাথে লোকটির সম্পদ আরো বেড়ে গেল।
মহিলাকে মূসা (আঃ) বললেন, তোমার আরজি আমি আল্লাহর দরবারে পেশ করেছি। তিনি তোমাকে সব সময় তার শুকরিয়া আদায় করতে বলেছেন। তবেই তোমার সব অভাব দূর হয়ে যাবে। এ কথা শুনামাত্র মহিলা ঝট করে বলে ফেলল, এটা কি কোনো কথা হলো? এতো কষ্ট ভোগ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব কেন? আল্লাহ্ আমাকে কি দিয়েছেন যে, তার শোকর করব? যান আপনার কথা আর আমি শুনতে চাই না। মহিলার মুখ থেকে এ ধৃষ্টতাপূর্ণ কথাগুলো বের হওয়া মাত্র একটি দমকা হাওয়া এসে তার কুড়ে ঘরটাও উড়িয়ে নিয়ে গেল।
এবার তৃতীয় ব্যক্তি-অর্থাৎ হাত-পা বিহীন পঙ্গু লোকটিকে মূসা (আঃ) জানালেন, আল্লাহ বলেছেন, জাহান্নামের দেওয়ালের একস্থানে খানিকটা ছিদ্র থাকবে। তোমাকে দিয়ে আল্লাহ ঐ ছিদ্রটি বন্ধ করবেন। এ কাজের জন্যই তিনি তোমাকে সৃস্টি করেছেন। কথাটা শোনামাত্র লোকটি আনন্দে আত্মহারা- হয়ে বলে উঠল, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ্ তা হলে আমাকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি! আমাকেও তিনি একটি কাজে ব্যবহার করবেন তা হলে! পঙ্গু লোকটির মুখ থেকে কৃতজ্ঞতার এ কথাটি বের হওয়ার সাথে সাথে তার হাত-পা তৈরি হয়ে যায়। এভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের বিনিময়ে চিরতরে ঘুচে যায় তার পঙ্গুত্ব, লাভ করে পূর্ণাংগ দেহ ও সুন্দর মনের এক নতুন জীবন।
আবু তাসনীম