সম্পাদকীয়
ঈমান নিয়ে কেউ খেলবেন না
একবার ভারতবর্ষের মুসলিম ব্যবসায়ী ও সমাজপতি শ্রেণীর উদ্যোগে একটি সর্বভারতীয় মহাসম্মেলন দাক্ষিণাত্যের হায়দারাবাদে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মুখ্য আলোচ্য বিষয় ছিল, “প্রচলিত সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের বৈধতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজসচেতন আলিমগণের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা”।
ব্যাংক-বীমা, শিল্প-বাণিজ্য তথা সর্বপ্রকার আর্থিক লেনদেনে পাশ্চাত্য রীতি-পদ্ধতির সুদ যেহেতু সময়ের এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা; অতএব, ভারতবর্ষের সংখ্যালঘু ও ঔপনিবেশিক শোষণে নিষ্পেষিত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শরীয়তের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই দিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মূলধারার সাথে যুক্ত করার ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ের চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। এ জন্য দর্শনতত্ত্ববীদ হক্কানী আলিমগণের একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানোর লক্ষ্যে শীর্ষ মুসলিম সমাজপতি ও ব্যবসায়ীরা এ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানুবী তখন নিখিল ভারতে এতো খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করেননি। নবীন আলিম ও গবেষক হিসেবে তিনি কানপুর মাদ্রাসা থেকে সম্মেলনে যোগদান করেন। হযরত থানুবী তার বক্তৃতায় সেদিন যে ঐতিহাসিক আহ্বান ভারতবাসী মুসলমানের সামনে তুলে ধরেছিলেন, তা আজকের এ সময়েও বাংলাদেশের মানুষের জন্য সমান আবেদন লালন করে। তিনি সেদিন বলেছিলেন, নশ্বর এ পার্থিব জীবনে কিছুটা অনুন্নত আর পশ্চাৎপদ জীবন সাময়িকভাবে যাপন করে নিতে যারা প্রস্তুত, তারা আল্লাহ ও রাসূলের নিষেধাজ্ঞা মেনে সদা-সর্বদা হারাম জীবিকা পরিত্যাগ করেই চলবেন। আর যদি কেউ বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট না থাকতে পারেন এবং বিত্তবান হওয়ার জন্য শরীয়ত নিষিদ্ধ পন্থায় অর্থ-সম্পদ উপার্জনের লক্ষ্যে হারাম পদ্ধতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে চান, তাহলে তিনি হারামকে হারাম জ্ঞানে নিজেকে অপরাধী মনে করে তা করুন। কিন্তু দয়া করে একটি চিরস্থায়ী হারাম পদ্ধতিকে কনভেনশন ডেকে, আলিমদের সীল-দস্তখত নিয়ে হালাল বানানোর অপচেষ্টা চালাবেন না। কেননা, আল্লাহ তাআলা একজন লজ্জিত অনুতপ্ত ও পাপী বান্দাকে ক্ষমা করে দিলেও, একজন অবাধ্য ধর্মবিকৃতকারী ও প্রতারক মুসলমানকে অবশ্যই শাস্তি দেবেন। সুদ যারা খেতে আগ্রহী, তারা গোনাহ মনে করে খেতে শুরু করতে পারেন তবে একে জায়েয করার চেষ্টা করে আল্লাহর গজবে নিপতিত হবেন না।
থানুবী সাহেবের এ বক্তব্যে গোটা উদ্যোগটিই নস্যাত হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষের হক্কানী আলিম সমাজ একটি যুগান্তকারী প্রত্যয় লাভ করেন। অন্যায়-অপকর্ম কেউ করে ফেললেও এটিকে বৈধতার পোশাক পরিয়ে সকল মুসলমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা নিরুৎসাহিত হয়। করাচীর বিশিষ্ট্য গবেষক জনাব ইকবাল কোরেশী সঙ্কলিত 'থানুবী রচনাবলী' থেকে ঘটনাটি উদ্ধৃত করার মূল কারণ হচ্ছে, সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি সেমিনার ও সংবাদ সম্মেলনের সাথে এর সাদৃশ্য।
বিশেষভাবে ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ অত্যন্ত গুরুত্বসহ শেষ পাতার লিড নিউজ হিসেবে এ মর্মে সংবাদটি প্রকাশ করে যে, দেশের হক্কানী আলিমগণের সমন্বয়ে একটি সংগঠন জাতীয় ওলামা পরিষদ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইসলামের অপব্যাখ্যা ও ধর্মের নামে নানা অসংলগ্ন মতামত দিয়ে দেশব্যাপী আলিম সমাজের মধ্যে যে মতানৈক্য সৃষ্টি এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে যত বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়; এসব কিছুর প্রতিবিধানকল্পে দেশের সর্বাপেক্ষা যোগ্য, প্রতিনিধিত্বশীল আলিমগণের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে এই পরিষদ। এর উপদেষ্টা পরিষদে এমন সব আলিমের নামও রয়েছে যাদের ইলম, প্রজ্ঞা ও পরহেযগারী সম্পর্কে গোটা আলেম সমাজই আস্থাশীল। কিন্তু ঝামেলা বেধেছে তখনই, যখন এসব আলিমের প্রায় সবাই পরবর্তী সপ্তাহব্যাপী এ পরিষদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে থাকেন। কেউ বলেন,“আমি এ পরিষদে নেই।” কেউ বলেন, সংবাদ সম্মেলনে আমি উপস্থিত ছিলাম না। কেউ আবার বলেন, 'শিখা চিরন্তনের স্বপক্ষে ওলামা পরিষদ যে বক্তব্য দিয়েছে, তার সাথে আমরা একমত নই, এটা কতিপয় সরকার ঘেষা নীতিচ্যুত আলেমের অভিমত।' ইত্যকার বিবৃতি থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, কথিত ওলামা পরিষদ মূলত একটি ব্যর্থ অপপ্রয়াস।
বাংলাদেশের সংগ্রামী আলিম সমাজ প্রতিটি সরকারের আমলেই ইসলাম ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মতৎপরতার সোচ্চার প্রতিবাদ করে এসেছেন। যারা এ ধরনের সংগ্রাম ও সাধনায় বিরামহীন শ্রম ও ত্যাগ দিয়ে এসেছেন, তাদের নাম-ধাম বাংলাদেশের তাওহীদি জনতা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু হঠাৎ করে যদি নতুন কিছু মুখ থেকে গোটা ইসলামের সুরক্ষা ও শুদ্ধতা নিশ্চিত করার উদ্দীপনা শোনা যায়, তখনি মানুষের মনে সংশয় জাগে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত আত্মপ্রকাশ পর্বে ওলামা পরিষদের সভাপতিরূপে যে আলিম পরিচিত হয়েছেন তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ আওয়ামী ওলামা লীগের সভাপতি। আর দৈনিক ইনকিলাব, দিনকাল, ইত্তেফাক, সংগ্রাম ইত্যাদি পত্রিকাকে পেছনে রেখে শুধু দৈনিক জনকণ্ঠ এ ওলামায়ে কেরামের উত্থান ঘটনাটির কভারেজ বিপুল উৎসাহ আর সম্মানের সাথে দেয়ায়ও মানুষ একটু সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠে।
তাছাড়া সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটে যখন ‘ওলামা পরিষদ’ তার জন্মলগ্নেই নিজের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ফলাও করে প্রকাশ করে; যা তারা দু'চারটে ভালো কাজ প্রদর্শনের পরও করতে পারতো। পরিষদ নেতা বলেন, 'শিখা প্রজ্বলন একটি দেশজ আচার, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম। ইসলামের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া আল্লাহর রাসূলও শক্তির প্রতীকরূপে আগুন ব্যবহার করেছেন।' এ জাতীয় কথা শুনেই দেশের সর্বস্তরের জনগণ ও আলিম সমাজের মনে উদ্যোগটির নেপথ্য উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাদের স্মৃতিতে জাগরূক হয়ে ওঠে সম্রাট আকবরের ‘দ্বীনে ইলাহী’ সমর্থক দরবারী মোল্লাচক্রের ভূমিকার কথা।
যে সিদ্ধান্তমূলক আলোচনা করেছেন, এরপর কোন আলিমের পক্ষে শিখা চিরন্তন বা শিক্ষা অনির্বাণকে ইসলামী রূপদান তথা এর বৈধতা প্রমাণ কি আদৌ সম্ভব? কিন্তু এরপরও আলিম নামধারী কতিপয় ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়েছে যে করেই হোক শিখা চিরন্তনকে তারা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রতিষ্ঠিত করবে। এ জন্যে গঠনের চেষ্টা করছে জাতীয় ওলামা পরিষদ।
এ পর্যায়ে দেশের হক্কানী আলিম সমাজকে সেই বহু যুগ পূর্বকার ঘটনাটির প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। একটি ইসলাম-বিরোধী কাজ বা অনেকগুলো ইসলাম-বিরোধী কাজও কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সরকার করতে চাইলে করুক। কিন্তু তাই বলে একে বৈধ বানানোর জন্য ওরা যেন কোন আলিমের সহযোগিতা না পায়। কেননা, অপরাধ, শিরক ও নাফরমানি করা এক জিনিস, আর এটিকে বৈধ বানানোর জন্য কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা আর সীরাত শাস্ত্রের বিকৃত উপস্থাপন অন্য জিনিস। সুবিধাবাদী ব্যক্তিদের প্ররোচনায় আলিম সমাজ যেন তাদের দ্বীনী দায়িত্ব ও আল্লাহ-রাসূলের সাথে কৃত ঈমানী প্রতিশ্রুতির কথা বিস্মৃত না হয়ে যান। হাকীমুল উম্মত মাওলানা থানুবীর প্রত্যয়ী অভিমত থেকে তারা যেন আজকের সংকটময় মুহূর্তেও শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাছাড়া এ দেশের জনগণকেও একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও আসমানী কিতাব তথা শরীয়ত বিকৃতি একটি ইহুদীসুলভ আচরণ। আলিম নামধারী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি এ ইহুদী অনাচারে লিপ্তও হয়, তথাপি প্রচারণা আর আড়ম্বরের ধোকায় না পড়ে তারা যেন জননন্দিত ও সর্বজনবিদিত আলেম, উলামা, পীর, মাশায়েখ ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীদের পথ নির্দেশই মেনে চলেন। যাদের নিঃস্বার্থ সংগ্রাম ও সাধনার বলে দু'শ বছরের ঔপনিবেশিক মানস এবং ৫০ বছরাধিক কালের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বর্ণাঢ্য রাষ্ট্র বিবর্তনেও দ্বীন, ঈমান, কুরআন সুন্নাহ ও ইসলামী চেতনা মূল্যবোধ অবিকৃত নিপুণতায় টিকে আছে।