আফগানিস্তানে আমরা কী দেখেছি
সুলতান সিদ্দিকী
====================================================================
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
অত্যাচারী সৈন্যদের সাথে
১২ই ডিসেম্বর ১৯৮১ শীতের সকাল। একটি সামরিক ট্রান্সপাের্ট বিমান তাদের নিয়ে ফরগানা থেকে কাবুলের নিকটবর্তী বাগরাম বিমান বন্দরে অবতরন করে। তিনদিন পর তাদেরকে বামিয়ান পাঠানাে হয়। বামিয়ানে সুলাইমানভকে জুনিয়ার সার্জেন্ট নিয়ােগ করা হয়। বামিয়ানে তিনি পাঁচমাস অবস্থান করেন। এ পাঁচমাসে তিনি তিনটি মুজাহিদ বিরােধী অভিযানে অংশ গ্রহন করেন। কিন্তু এতে তার মােটেই আন্তরিকতা ছিল না। প্রথম বার বামিয়ান থেকে দশমাইল দূরে এক গ্রামে লুকিয়ে থাকা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে তাকে রাতের বেলা অভিযানে পাঠানাে হয়। একটানা তিন ঘন্টা হাটার পর রুশ সৈন্যদের কাফেলা সকাল ছটার সময় গ্রামের পার্শ্ববর্তী এক পাহাড়ে এসে পৌঁছে। সৈন্যদের সংখ্যা ছিল প্রায় দু'শ। সাতটার সময় কমান্ডার গুলি চালানাের নির্দেশ দিলেন। এতে প্রথমেই বেসামরিক লােক হামলার শিকার হয়। এর পর গ্রামের কোন এক ঘর থেকে আমাদের ফায়ারের জবাবে ফায়ার করা হয়। কিন্তু গ্রামবাসীদের জবাবী হামলা মােটেই শক্তিশালি ছিলনা। সুলাইমানভ গাজী মুরাদ তার ক্লাসিনকোভের পাঁচটি ম্যাগাজিনই খালী করে ফেলে। এমন সময়ে মায়ের উপদেশ মনে পড়ে যায় তার। তিনি বলেনঃ“মায়ের কথামালা আমার মনােজগতে আলােড়ন সৃষ্টি করে। মুসলমানদের ওপর গুলি চালাতে তিনি নিষেধ করেছিলেন। আমার মনে প্রচন্ড তােলপাড় হতে লাগলাে। পরবর্তি দু'রাউন্ড গুলি আমি শুন্যে উড়িয়ে দিলাম”।
মনের সাথে লড়াই
এ লড়াই একটানা দশটা পর্যন্ত নিরীহ গ্রামবাসী দের উপর চলতে থাকে। বড় বড় তােপের আঘাতে গােটা গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তিন ঘন্টার মধ্যে ১৪০জন লােক শহীদ হয়। গ্রামের লােকদের গুলীতে মাত্র এক জন রুশ সৈন্য আহত হয়। দশটার সময় ফৌজি ট্রাক ও ট্যাংক গ্রামে এসে পৌঁছে। সুলাইমানভ ও তার সাথীরা তাতে চড়ে ছাউনিতে ফিরে যায়। নিরস্ত্র নিরপরাধ মুসলমানদের দাফন কাফনহীন শবদেহগুলাে সুলাইমানভের মনে অনবরত দংশন করতে থাকে। ১৯৮২র মার্চ মাসে সুলাইমানভ আরেকটি হামলায় অংশ নেয়। তখন মুজাহিদদের আস্তানার ওপর আক্রমন কালে তার সাতজন সাথী আহত হলেও সুলাইমানভ কোন আঘাত পায়নি। এরপর এপ্রিল ১৯৮২তে রুশ সৈন্যদের যে দলের সাথে সুলইমানভকে শমিল করা হয় তারা একটি গ্রাম ঘেরাও করে। তােপের গুলীতে চল্লিশ জন নিরাপরাধ নাগরিককে শহীদ করে দেয়। মুজাহিদদের জবাবী হামলায় চারজন রুশ সৈন্য নিহত হয়। সুলইমানভ এবারও অক্ষত বেঁচে যান। মনের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেয়া এ যুদ্ধে সুলাইমানভ অতিষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু সে পালাবার কোন সুযােগও খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে একদিন ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন হয়। রুশ সেনা ছাউনি থেকে সুলাইমানভ পালিয়ে যায়।
চুরি হলাে মুক্তির পথ
আফগানিস্তানে সুলাইমানভের সাতমাস কেটে যায়। যুদ্ধের পরিবর্তে এখন সে মুজাহিদদের সাথে মিলিত হওয়ার পথ খুঁজতে থাকে। এ জন্য সে সরগী নামক তার এক বন্ধুকে দলে ভিড়িয়ে নেয়। ২১শে জুন তারা রকেট লাঞ্চারের গুলী চুরি করে বাজারে নিয়ে যায়। আফগানিদের কাছে বিক্রি করে তার মূল্য দ্বারা প্যান্ট ও অন্যান্য জিনিসপত্র খরিদ করে ফিরে আসে। সুলাইমানভ ইতিপূর্বে এ কাজ আরাে দু'একবার করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এবার তারা প্রধান লেফটেন্যান্ট গালিনুলির কাছে ধরা পড়ে যায়। সুলাইমান ও তার সাথীকে দফতরে ডেকে এনে তিনি জিজ্ঞাসা বাদ করেন। চারজন সিপাহি তাদেরকে বেদম প্রহার করে ক্যাম্পের একটি প্রকোষ্টে বন্দী করে রাখে। সন্ধ্যায় খাওয়ার জন্য কামরা খোলা হলে দুজন সন্তর্পণে কামরা থেকে বের হয়ে সােজা ব্যারাকে চলে যায়। ইউনিফর্ম পরিহিত ও অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় বের হওয়ার কারনে কেউ তাদেরকে সন্দেহ করেনি।
কিছুক্ষনের মধ্যে তাঁরা কুলতুপছি নামক একটি গ্রামে পৌঁছে যায়। কোথাও না থেমে সম্মুখ পানে অবিরাম চলতে থাকে। এবার আরও দু'টি বস্তি অতিক্রম করে শেষরাতে যখন আরেকটি গ্রামে গিয়ে পৌঁছে; ক্ষুধা-পিপাসায় তারা দারুন কাতর হয়ে পড়ে। এবার থেমে একটি ঘরের দরজায় করাঘাত করলাে। ঘরের অধিবাসীরা স্বভাবতঃ ইতস্তত করতে থাকে। তারা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফার্সি ভাষায় বলল যে, রুশ বাহিনী গ্রাম ঘেরাও করে রেখেছে। তােমরা যদি আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করাে তাহলে আমরা চুপচাপ ফিরে গিয়ে তাদেরকে বলবাে যে, গ্রাম একেবারে জনমানব শূন্য। এ গ্রামে কেউ নেই। ঘরওয়ালারা খাবারের ব্যবস্থা করলাে। তৃপ্তির সাথে খেয়ে চুপে চুপে তারা সেখান থেকে চলে গেল।
প্রত্যুষে তারা যে গ্রামটিতে পৌঁছে, সেখানে সশস্ত্র মুজাহিদদের একটি ঘাঁটি ছিল। মুজাহিদরা দু'জন রাশিয়ান সৈন্যকে আসতে দেখে বন্দুক তাক করে তাদেরকে নিরস্ত্র করার পর গ্রেফতার করে হেজবে ইসলামীর আঞ্চলিক কমান্ডার আব্দুল হাই রউফীর কাছে নিয়ে যায়। এই সামরিক মারকাজে সুলাইমানভ ও তার বন্ধু সরগী চার মাস অতিক্রম করে। এখানে তাদেরকে সঠিক ভাবে ইসলামী শিক্ষা দান করার পর সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মুসলমান হওয়ার পর সুলাইমানভ নিজের জন্য আব্দুল হাই নাম পছন্দ করেন।
তার শত্রু
সুলাইমানভ, যিনি এখন আব্দুল হাই নামে পরিচিত। আফগানিস্তানে রাশিয়ান সৈন্যদের সাথে কাটিয়ে আসা দিনগুলি সম্পর্কে সে সীমাহীন অনুতপ্ত ও লজ্জিত। তাঁর অনুতাপ এটাই যে, তিনি এমন একটি বাহিনীর সিপাহী রূপে কাজ করেছেন, যারা শান্তি, সত্য ও মানবতার শত্রু। যে দ্বিতীয় হামলায় তিনি অংশ গ্রহন করেছিলেন সে সময়কার তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পনেরজন রুশ সৈন্যের একটি দল কোন একটি ঘরে প্রবেশ করে। ঘরে ছিল মাত্র দু'জন নিরস্ত্র পুরুষ। রুশ সৈন্যরা তাদের ধরে বেধে ফেলে এবং তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাতে থাকে। ঘরের মহিলারা তা বরদাশত করতে না পেরে বেরিয়ে এসে বাধা দেয়। ফলে ঘরের নিরাপরাধ লােকদের ওপর বৃষ্টির মত গুলি ছুড়ে নারী পুরুষ সকলকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর তারা ঘরের যাবতীয় মুল্যবান জিনিস লুট করে ভাগ করে নেয়। এ দৃশ্য আমার জন্য অসহনীয় ছিলাে। ফলে একজন সিনিয়র অফিসারকে বললাম যে, আপনারা একি করছেন? উত্তরে তিনি কড়া ভাষায় আমাকে ধমক দিয়ে বলেন যে, তুমি খুব বেশী কথা বলতে শুরু করেছ! সাবধান হয়ে যাও! অন্যথায় তােমার পরিণামও ভাল হবে না।
রাশিয়ায় আর যাবােনা
দীর্ঘ তিন বছর মুজাহিদদের হাতে বন্দী থাকার পর রাশিয়া ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কিনা জানতে চাওয়া হলে আব্দুর রহীম বলেনঃ পরাধীনতার দেশ রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। যে দেশের এক শহর হতে অন্য শহরে যেতে হলে পাসপাের্ট ও ভিসার প্রয়ােজন হয় সে দেশ কার পছন্দ হয়? আমি স্বাধীনতাকামী মুজাহিদদের সাথে থেকে খুবই আনন্দিত। আফগান মুজাহিদরা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যদি বিজয় লাভ করে তাহলে আমি স্বাধীন আফগানিস্তানের একজন নাগরিক হয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহনের ইচ্ছা রাখি। আমি এখন মুসলমান। কোন অমুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করা এখন আমার নিকট অকল্পনীয় মনে হয়। এটা আমার জন্য হবে কষ্টকর এ ব্যাপার। (চলবে)
═──────────────═