প্রধান রচনা
হায় ভারতের মানবতা প্রেম! প্রসঙ্গ বর্ণবিদ্বেষ ও মুসলিম নিধন
প্রিন্সিপাল এ এফ সাইয়েদ আহমদ খালেদ
========================================================================
ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন, “অর্থ কখনও মাথা উঁচু করে থাকতে পারে না।” অর্থাৎ অর্থ-সম্পদ মানুষকে গর্বিত করে। এ মূল্যবান উদাহরণের আলােকে বলা যায়, সম্পদশালী ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের দাপট বিভিন্ন কর্মকান্ডে নানা ভাবে প্রকাশিত হয়। সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে- পরিণাম চিন্তা করে না। এ বাস্তব সত্যটা পশু কুলের দিকে লক্ষ্য করলেও বুঝা যায়। বলশালী ষাড় ছুট পেলে তার মাথার শিং দ্বারা প্রতিবেশীর কাচা ঘরের ডােয়া (মাটির পােস্তা) খুড়ে নষ্ট করে ফেলে। ষাঁড়ের একাজ দেখতে অনেকের কাছে ভাল লাগলেও যে ঘরের ক্ষতি হয় তার মালিক জানে এর ব্যাথা। এখানেই শেষ নয়। উচ্ছল ষাড় তার মনিবের ঘরের ক্ষতি সাধন করতেও কসুর করে না; সুযােগ পেলে হলাে। আপন পর নেই। সমাজে পশু-স্বভাব বিশিষ্ট এক শ্রেণীর মানুষের এ জাতীয় বিচরণ, যথেচ্ছাচার ও পাশবিক আচরণ আদৌ সমর্থন করা যায় না। অন্যায়ের দোসর এ শ্রেণী সুযােগ ও প্রশ্রয় পেলে বিশৃংখলা সৃষ্টির দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিব্রত করে তােলে, সুস্থ থাকতে দেয় না কাউকে। এরা মানবতার শত্রু, রাষ্ট্রীয় উন্নতির অন্তরায়। পবিত্র কুরআন ঘােষণা করছেঃ 'সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, খুন খারাবীর চেয়েও জঘন্য অপরাধ।' সুতরাং এই মনবৃত্তির মানুষ, সংগঠন বা দল ইত্যাদি সভ্য জগতের কলংক। এদের প্রতিহত করার দায়িত্ব প্রত্যেক দেশের সরকারের। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত-এ তিনের বিচারে প্রত্যেক দেশের রাষ্ট্র নায়ককে দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। অবহেলায় খােদার অভিশাপ নেমে আসতে পারে, জাতীয় জীবনে এরূপ অভিশাপ এসেছেও যুগে যুগে। ভারতের মহারাষ্ট্রের অভাবিত ধ্বসলীলা সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এটা ছিল ধর্ম ও মানুষের প্রতি চরম ও নির্মম অবিচারের ঐশী বিচার।
ভারতের আকাশ আজ ঘােলাটে, মেঘ ও বেদনার ধূয়ায় আচ্ছন্ন। বর্ণবাদী বিদ্বেষ, নিপীড়িত গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক নিষ্ঠুর সংঘাত ইত্যাদি আজ ভারত ভূমিকে অস্থির ও কম্পিত করে তুলেছে। শুধু মুসলিম দলনের আনন্দই নয় বরং তা হিন্দুর সামগ্রিক উপভােগের বিষয়। পৈশাচিক ও ঘৃণিত বিদ্বেষী আনন্দের উৎকট গন্ধে ভরা বায়ু আজ বর্ণশ্রেষ্ঠ হিন্দুরা একই চিতার অনুসারী বর্ণহীন হিন্দুদের ঘরেও প্রবেশ করাতে শুরু করেছে বর্ণশ্রেষ্ঠর উদ্ভট দাবীদার চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্রবাদী শিবসেনা-এরা এককালের হিন্দু মহাসভার যােগ্য উত্তরসূরী ও হিংসাপরায়ন বলে পরিচিত। মানবতার ধ্বংস সাধন ও গণজীবনে অশান্তি সৃষ্টি করাই এদের কাজ। ভারতের অধিকাংশ রাষ্ট্রক উচ্চ বর্ণের-শিবসেনা, বিজেপি, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ প্রভৃতি সংগঠনও উচ্চ বর্ণের লােক সমন্বয়ে গঠিত ও পরিচালিত। নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের গৌরবময় কোন অবদানই বর্ণশ্রেষ্ঠগণ স্বীকার ও গ্রহণ করে নিতে রাজী নন। এরা এত উগ্র যে, পশ্চাৎপদ শ্রেণীর কোন মহৎ ব্যক্তির মহৎ কর্মের স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন যদি বা কখনও উঠে, তাহলে উদ্ভট চিন্তা ও ধ্যান-ধারণায় লালিত শিবসেনা ও তার সহযােগী অঙ্গ সংগঠন সমূহ রাষ্ট্রময় অভাবনীয় অশুভ আন্দোলনের সৃষ্টি করে। এদের ঘর পর নেই। বলে অত্যুক্তি হবে না, প্রশাসন-যন্ত্রের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের অভাবেই ভারত ভূমিতে এদের ঔদ্ধত্য অতিমাত্রায় প্রকাশ লাভ করেছে। মুসলিম নির্যাতন ও হত্যা, নানা রকম অন্যায়, দমননীতি, বর্ণবিদ্বেষ ইত্যাদি অবর্ণনীয় লােমহর্ষক ক্রিয়া-কাণ্ড নব্য ভারতের দৈনন্দিন রােজ নামচায় পরিণত হয়েছে। স্বাধীন স্বত্ত্বার স্বাধীন মতামত প্রকাশে চলছে শক্তিমানের নিষ্ঠুর আচরণ। বিচার নেই। কোন জাতির পতন ও কোন দেশের ধ্বংস পূর্বকালীন আলামতই বােধ হয় এই। বলদৃপ্তের নির্যাতন আর দুর্বলের রক্তদান, মানবাত্মার অসম্মান, আর্তের ও অসহায়ের চিৎকারই মুক্তির সূর্য বয়ে আনে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। দুঃখের বিষয়, ইতিহাস পড়ে ও শ্রবণ করে সবাই, কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করা জাতি ও নেতার সংখ্যা খুবই কম। ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতের অবস্থান সম্ভবত এ কাতারেই। শিবসেনাদের পাখা গজিয়েছে। জগৎ চেয়ে আছে পরিণতি দেখার জন্য।
১৯৪৭ সালে সৃষ্ট স্বাধীন হিন্দুস্তানের আকাশে অন্যতম জ্বলজ্বলে এক ব্যক্তিত্ব হলেন ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর। এই অসাধারণ করিৎকর্মা পুরুষের উর্বর চিন্তা ও ধ্যান-ধারণার উদ্ভাবনী শক্তির পরশে ধন্য হয়েছে ভারতের সংবিধান। তিনিই ভারতের সংবিধানের রচয়িতা। প্রণয়নের প্রারম্ভে ও পরে সার্বজনীন স্বীকৃতি লাভে কোন আপত্তি উঠেনি। প্রণয়নকারীর জন্ম ও কুলের খোঁজ পড়েনি। জানা যায়, পদ্মের ফুল পূজার প্রয়ােজনে কনকনে শীত উপেক্ষা করে বিল নামক জলাশয় থেকে নম শূদ্র গােত্রের (হিন্দু মতে অস্পৃশ্য শ্রেণী) লােকে এনে দেয়ায় দোষ নেই; তার হাত থেকে সরাসরি গ্রহণ করায় দোষ, ফুলগুলি মাটিতে রেখে দিলে ব্রাহ্মণ পুরােহিত বাবু ফুলগুলির উপর বিশুদ্ধ পানি ছিটিয়ে তা গ্রহণ করেন, পূজার কাজে লাগান। ডঃ আম্বেদকরের জন্ম, মানব সৃষ্ট নিম্নবর্ণের হিন্দু কুলে- হরিজন সম্প্রদায়ের লােক। জন্মে মহা অপরাধ। তাঁর অবদানে ভারত ধন্য হয়েছে এতে দোষ নেই। পূজার ফুলের ন্যায় দান গ্রহণ করা যায়, কিন্তু এ স্বনামধন্য ব্যক্তিটির নাম লওয়া মহাভারত অশুদ্ধ সম-অপরাধ। মন- তাড়িত ভারতে আজও বিবেক তাড়িত মানুষ জন্ম লাভ করেনি এটাই আফসােস! ইসলাম বলে, জন্ম যথাতথা হলেও কর্মই মানুষকে বড় করে, সুকর্ম তাকে খ্যাতির শীর্ষে স্থান দান করে। নিজ ইচ্ছায় শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না। ডঃ আম্বেদকর, মিঃ জগজীবন রাম প্রমুখ ভেদ -জ্ঞান সম্পন্ন বর্ণ শ্রেষ্ঠদের চেয়ে কোন অংশেই কম ছিলেন না। অমুসলিম বিশ্বের তুলনায় ভারতের ভাগ্যাকাশে এরা পেট্রোম্যাক্স। বিতর্কের অবকাশ নেই, অনেক দেরিতে হলেও আম্বেদকরের মহৎ কর্মের মূল্যায়ন কল্পে মুক্তি বুদ্ধির বুদ্ধিজীবিগণ এগিয়ে এসেছেন। তার কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ মহারাষ্ট্রের বােম্বাইতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। এ প্রশংসনীয় উদ্যোগ ও কর্মের এবং উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন যে কোন সুস্থ দৃষ্টিকোণ হতে প্রশংসার দাবী রাখে। পরিতাপের বিষয়, এ নামকরণে তীব্র আপত্তি উঠেছে শিবসেনার পক্ষ থেকে। শিবসেনারা উচ্চ বর্ণের হিন্দু; ভারতবর্ষ একমাত্র তাদের। পক্ষান্তরে ডঃ আম্বেদকর নিম্নবর্ণের হিন্দু; তার নাম ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তা-চেতনার ভারতে স্থান পেতে পারে না। শিবসেনাদের নােংড়া আন্দোলনের ফলে সামাজিক পরিবেশ ঘোলাটে ও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে সকল শ্রেণীর মানুষের বিশেষ করে দুর্বলের মান- সম্মান, ইজ্জত আজ লাঞ্ছিত।
শ্রেণী বৈষম্য মারাত্মক ক্ষত বিশেষ। এর বিষাক্ত ছােবলে মানুষের মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অপমৃত্যু ঘটে। বর্ণবিদ্বেষ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় হিন্দু জাতি ও সফেদ চর্ম বিশিষ্ট খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে। মানুষের প্রতি মানুষের হীনমন্য মনােভাব সাধারণতঃ এই দুই জাতির মধ্যে বেশী। বড় ও ছােটর প্রশ্নে এদের বাড়াবাড়ি ও অত্যধিক। এই উন্নাসিকতার ফলে যুগে যুগে এদের মধ্যে ধ্বংস নেমে এসেছে। ইংরেজ জাতি আজ কোণঠাসা অবস্থায়, স্বদেশে সংকোচিত ভারতের আচরণ আজ বিশ্বনিন্দিত। তবু শিক্ষা হয় কই। বর্ণবৈষম্য ও ভেদনীতিই জন্ম দিয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সংঘর্ষ-স্বাধীন সত্ত্বার বিলুপ্তি। প্রতিহিংসাপরায়ন বর্ণ বিভেদ ও কর্মকাণ্ড, দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না; বিশ্ব বিবেক কোন বিশেষ দলের একচেটিয়া অন্যায় আধিপত্য নীরবে মেনে নিতে পারে না। শিবসেনা, বি.জে.পির মানবতা বিধ্বংসী উগ্র আচরণ ও কুৎসিত তৎপরতার প্রতি পরােক্ষ মদদ দান করার ফলেই আজ ভারতে মুসলিম নিপীড়ন, নাগ-কুকি আসাম বিদ্রোহ, শিখ জাগরণী আন্দোলন, নিম্ন বর্ণ-বিদ্বেষের প্রকট বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। প্রচুর প্রাণ যাচ্ছে, লােক ক্ষয় হচ্ছে। সমাধানের ইচ্ছা তিরােহিত-ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কদের এতে কিছু আসে যায় না। এ ঘৃণিত মনােভাব ও অন্যায়ের প্রতি দৃঢ় চিত্ততার কারণেই সব অপকর্ম ভারত ভূমিতে একের পর এক ঘটে চলছে। উগ্রবাদী ও চরম প্রতিক্রিয়াশীল দলের কর্মীরা এই সেদিন আজন্ম জিঘাংসা চরিতার্থ করেছে নিম্ন বর্ণের একজন মহিলাকে প্রকাশ্য রাস্তায় উলঙ্গ করে। বিস্তারিত বর্ণনায় কলমের কালি লজ্জায় বের হতে চায় না। লজ্জা নেই শিবসেনা দলের গর্বিত বর্ণশ্রেষ্ঠ নর পশুদের। মানবতার অব্যক্ত বেদনা ভারতের বুকে গুমরে মরছে-প্রতিকার নেই। জাহেলীয়াত যুগ ও নাৎসী বর্বরতাও নারীর প্রতি এরূপ নির্লজ্জ আচরণ হার মেনেছে।
প্রতিভার স্বীকৃতিদানে মহৎ কর্মের মূল্যায়নের যারা নিষ্ঠুর ও পরাম্মুখ তারাই কি নয় নিম্ন বর্ণের? মনের উদারতা ও স্বচ্ছতার অভাব যাদের মধ্যে বিরাজমান; তারা কেমন করে বর্ণশ্রেষ্ঠ হতে পারে? আধুনিক ভারতে মানুষের ন্যায়সংগত মর্যদার ঠাই নেই; অহরহ চলছে সংখ্যালঘুর ওপর নিষ্পেষণ ও নির্যাতন। সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বর্ণভেদ, মুসলিম নিপীড়ন, মজলুমের প্রতি অত্যাচার ইত্যাদি বন্ধের তেমন কোন প্রয়ােজন আছে বলে মনে করে না। ফলে শিবসেনা, বিজেপি, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ ইত্যাদি চরমপন্থী সংগঠন তাদের নােংরা পরিকল্পনা প্রসূত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার নীরব। ভারতীয় শাসনদণ্ডের সর্বশীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিগণ, একজন বাদে সবাই ছিলেন ও আছেন ব্রাহ্মণ সন্তান। তারা অসংখ্য গুণে গুণান্বিত হলেও তাদের চলার পথে আজও কিছু , সংকীর্ণতা ভীড় জমিয়ে আছে। নির্ভরযােগ্য সূত্রে জানা যায় যে, নিম্ন ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে বিরাজিত অসাম্য বৈষম্য ইত্যাদি দূরীকরণ ও সমাধানকল্পে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিঃ মােরারজী দেশাই মিঃ ভি.পি সিংকে চেয়ারম্যান করে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন মন্ডল কমিশন নামে পরিচিত ছিল। কমিশন যথাসময়ে পরবর্তী সরকার প্রধান মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাদের মতামত সম্বলিত তদন্ত রিপাের্ট দাখিল করে। ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ব্রাহ্মণ। উচ্চ বর্ণের ছাপ ছিল তাঁর সারা অঙ্গে ও মননে। রিপাের্টের সুপারিশ কার্যকরণে বাধাপ্রাপ্ত হলাে। এরপর আসেন মিঃ ভি পি সিং ভারতের প্রধান মন্ত্রী হয়ে। তিনি বর্ণবাদের প্রাচীর মূলে আঘাত হেনে।
মণ্ডল কমিশন রিপাের্ট যথাসম্ভব বাস্তবায়ন করে মানবতার ইতিহাসে আর এক নতুন অধ্যায় সংযােজন করেন। যাতে নিম্ন বর্ণের ভাগ্য পরিবর্তনের সূর্য উদিত হয়, সহিংসতা দূর হয়, মুসলিমগণ অনেকটা স্বস্তি লাভ করেন এবং গণজীবনে বেশ শান্তি ফিরে আসে। মণ্ডল কমিশন রিপাের্ট বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে উচ্চ বর্ণের লােকেরা উত্তর প্রদেশ দিল্লী প্রভৃতি স্থানে দাঙ্গা শুরু করে। বর্ণশ্রেষ্ঠ অনেক ছাত্র/ছাত্রী আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে সরকারের প্রশংসিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নেমে পড়ে। এটাই কি ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের মূল চরিত্র? বিতর্কের অবকাশ নেই, তথাকথিত বর্ণশ্রেষ্ঠ ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কদের পরােক্ষ সাহায্যপুষ্ঠ বিভিন্ন উগ্রবাদী পণ্ডিতগণ চটকদারী স্তোপবাক্য দ্বারা নিজেদের “আবুল হেকাম” বলে পরিচয় দান করলেও তাদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড সহজেই বলে দেয়, ওরা খাটি “আবু জাহেল”!
অন্যদের কথা নাই বা তুললাম, ডঃ ভীমরাও আম্বেদকর ও আল্লামা আবুল কালাম আজাদ, ভারতের সর্বজনমান্য উঁচু পর্যায়ের নেতা, রাজনৈতিক গগণের উজ্জ্বল তারা, বৃটিশ বিরােধী সংগ্রামের মহান ব্যক্তিত্ব। শাসন ব্যবস্থা পদ্ধতি ও শাসন সংক্রান্ত নানা কল্যাণ বহ ভাবধারা ও নীতি নির্ধারণীর ব্যাপারে এ দু'য়ের গভীর ও জ্ঞানপুষ্ট অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। অমর ইতিহাস সৃষ্টিকারী উভয় কৃতি নেতার গােত্রভুক্ত ও স্বজাতীয় লােকজন আজ (মুসলিম ও হরিজন সম্প্রদায়) ভারতীয় শিবসেনা, বি.জে.পি. সেবক সংঘ প্রভৃতি সংগঠনের চরম প্রতিহিংসা পরায়ণ লােকজন দ্বারা অহেতুক ও অকারণে অত্যাচারিত ও বলির পাঠা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তরুণদের প্রতি হচ্ছে নির্মম নির্যাতন, তরুণীদের ইজ্জত ও সম্ভ্রমের প্রতি হানা হচ্ছে কঠিন ও অমানবিক বর্বরােচিত আঘাত। অসহায়ের বেদনা বিহবল হাহাকার জনিত বাতাস দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত ব্যথিত করে তুলছে। হ্যা, অভিশাপের বৃষ্টি, খােদায়ী আক্রোশের নমুনা এত ঝরছে ও দেখা দিচ্ছে, তবু কেন ভারতীয় বর্বরতা ও পৈশাচিকতার উত্তপ্ততা কমছে না, এটাই ভাববার বিষয়। বিশ্বের নিরপেক্ষ বিবেক মনুষ্যত্ব্যের অবমাননায় আজ প্রতিবাদ মুখর। তবে একথা সত্য, সর্বক্ষেত্রে কথায় ও প্রতিবাদে কাজ হয় না। হয়নি আফগানিস্তানে, রাশিয়া সহজে সরে যায়নি, জিহাদী প্রেরণায় উজ্জীবিত ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ সমূহের তরুণ মুজাহিদের তীব্র আঘাতে দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়েই রাশিয়াকে অনেক কিছু হারিয়ে সরতে হয়েছে। দেশ ও জাতি, বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের সীমারেখা ছাড়িয়ে সকল নির্যাতিতকে এক কাতারে সম্মিলিত ও জিহাদী প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, উগ্রবাদীদের রুখে দাঁড়াতে হবে-তবেই মুক্তি। এর বিকল্প কোন কিছু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ মানবে বলে বিশ্বাস কম।
ব্রাহ্মণ্য ও সাম্রাজ্যবাদী ভারতের বৈষম্যমূলক আচরণে মর্মাহত আম্বেদকর একদা উচু নীচু ভেদাভেদহীন শান্তির ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম গ্রহণের হুমকি দিয়েছিলেন। নব্য ভারতের স্রষ্টা মােহনদাস কম চানি গান্ধীর তাৎক্ষনিক হস্তক্ষেপের ফলে, ব্যাপারটি তাৎক্ষণিক ভাবে থেমে যায়। কিন্তু বিদ্বেষী চক্রের বর্ণ বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড তবুও ঠাণ্ডা হয়নি। নির্যাতন ও ঘৃণা চলছে। এর নগ্ন প্রমাণ ও হিংস্রতা ঘটেছে আম্বেদকরের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ জনিত ঘটনা নিয়ে। আর এ ঘটনার নেতৃত্বদান করেন শিবসেনা দলের সু-সন্তান “বাল ঠাকরে”। স্বীয় মেধা ও অধ্যবসায় বলে ধাপে ধাপে উন্নীত ডঃ আম্বেদকর ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অসাধারণ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন, বাল ঠাকরে কি সে খ্যাতির সারিতে পৌছতে পেরেছেন বা পারবেন কোন দিন? সম্প্রদায় বা কুলের বিশ্লেষণে না যেয়েই দেশ ও জাতির জন্য দেওয়া এই অসাধারণ গুণী ব্যক্তির নানা অবদান গ্রহণ করতে গান্ধী, নেহেরু ইতস্ত করেননি-শ্রেণী শত্ৰুবাদে জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আম্বেদকরকে সবাই শ্রদ্ধা করে। তিনি একজন প্রথম কাতারের সফল পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন। এহেন ব্যক্তির কর্মের মূল্যায়নে ভারতের বুকে যদি কোন স্মৃতি চিহ্ন তৈরী করা হয় বা কোন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় তাতে শিবসেনাদের গাত্র দাহের কি আছে? শিবসেনারা কি মন্দাকিনি ধারায় বিধৌত একমাত্র দল এরাই কেবল স্বর্গ লাভ করবে? অন্যদের তাহলে উপায় কি হবে। এরূপ প্রশ্ন সকল সংবেদনশীল মানুষের মনে ভেসে উঠা স্বাভাবিক। নিম্ন বর্ণের হিন্দুগণ কোথায় যেয়ে পরিত্রাণ লাভ করবে রাষ্ট্রীয় সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী, সার্বিকভাবে নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণকারী সংশ্লিষ্ট দেশের শাসকবর্গের কাছে এটাই আজকের জিজ্ঞাসা।
ঔদ্ধত্যের সীমা থাকা উচিৎ! এই সেদিন উগ্রবাদী দলের কর্মীরা নিছক সন্দেহ বশতঃ কর্ণাটকে কয়েকজন মুসলিমকে পুরিয়ে মেরেছে। হায়রে তথাকথিত ভারত মাতার সন্তান বাৎসল্য, হায়রে মানবতা। কোন কর্মে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়? বর্ণ উচ্চ ও নিম্ন কিসে নির্ধারিত হয়? অন্যায় আঘাত যিনি বা যারা হানেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষের বুকে, যাদের জয়ের গর্বিত শকট দুর্বল ও অসহায়ের বুকের উপর দিয়ে চলে, তারা শ্রেষ্ঠ নন, নিম্নও নন-তারা বর্ণহীন। যে বা যারা বুক পেতে সহ্য করেন সবলের আঘাত, জীবনের বিনিময়ে অবিচারের বিরুদ্ধে সােচ্চার যারা তারাই বর্ণশ্রেষ্ঠ হােক না তাদের নিম্নকুলে জন্ম। এশ্রেণীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী ইনশাল্লাহ। অন্যপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট শাসকদের কাছ থেকে বিচারের আশা করা নিছক প্রহসন।
দুর্বলের হাহাকার মিশ্রিত বেদনার ছাপ আজ ভারতের সর্বাঙ্গে। বাক্যের স্ফুরণে সাম্যবাদী ও গণতান্ত্রিক হওয়া যায়না। মুসলিম নিধন ও বর্ণবিদ্বেষ দ্বারা এবং নানা প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, জনজীবন দুর্বিসহ করে কেউ কোন দিন কারাে বন্ধুত্ব অর্জন করতে পারে না। অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী চিরকালই জগত নিন্দিত। হিন্দুস্তান বা ইণ্ডিয়ার রাষ্ট্রনায়কগণ কি এর ব্যতিক্রম বলে দাবী করতে পারেন? শিববেনা, বিজেপি কোন দেশের দল এবং কোন রাষ্ট্রীয় শাসনের অধীন? সাম্রাজ্যবাদী ভারত দেশের সীমা বর্ধনে শক্তি প্রয়ােগ করতে পারে, এদের পৈশাচিক ও ঘৃণ্য তৎপরতা বন্ধে শক্তি প্রয়ােগ করতে ব্যর্থ কেন? কেবল সদুত্তোর দ্বারা অশান্ত পরিবেশ শান্ত করা যায় না, বাস্তব ভিত্তিতে পদক্ষেপ ও কর্মের দ্বারা সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটালেই সরকারের সত্যতা প্রমাণিত হয়, অন্যের ভালবাসা লাভ করা যায়। আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। জন এফ কেনেডী নির্যাতিত নিগ্রোদের শুধু বক্তৃতার দ্বারাই নয় সম্পূর্ণ উদ্ধারে ও তাদের যথাযথ পাওনা আদায়ে যােগ্যতার আসনদানে ব্যক্তিগতভাবে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করার কারণে স্ব-গােত্রীয় সাদা খ্রীস্টানদের হাতে নিহত হয়েও বিশ্ববাসীর কাছে অমর হয়ে আছেন; কেনেডি নন্দিত এরকম নজীর একটি নয়, বহু আছে। বর্ণবাদের উচ্ছেদ ও সাম্প্রদায়িক নিষ্পেষণ বন্ধের আশু প্রয়ােজনে কেনেডীর পথ অনুসরণ করেই ভারতীয় শাসকবর্গকে সুনজীর সৃষ্টি করে মানুষের শ্রদ্ধাভাজন হতে হবে, যেমন কিছুটা হলেও হয়েছেন ভি.পি. সিং, জ্যোতি বসু। বাংলাদেশের কুখ্যাত মহিলা তাসলিমা নাসরিনের মুসলিম কর্তৃক হিন্দু নিপীড়ন ও মন্দির ধ্বংসের মিথ্যা কাহিনী সম্বলিত লিখিত 'লজ্জা' নামক বই পশ্চিম বঙ্গের মুসলিম নিধনে আলােড়ন সৃষ্টির জন্য বহুল প্রচার লাভ করলেও, সুফল কিছু সাধন করতে পারে নি। এজন্য পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কর্ণধার এদেশের গণমানুষের হৃদয়ে বিশেষ শ্রদ্ধার আসন লাভ করেছেন।
পক্ষান্তরে কুখ্যাত লেখিকা ও তার দোসররা ডাষ্টবিনের খােরাক হয়েই আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কোনটি গ্রহণ করবেন, মানুষের প্রতি ভালবাসা না লেলিয়ে দেওয়া শিবসেনা ও পুলিশ-সৈন্যের নির্মমতা? উৎপীড়িত বিশ্বে আজ সাড়া জেগেছে, মুক্তির দীপ শিখা দেখা দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের চরম শিকারে পতিত হয়ে এবং জীবনের অমূল্য সময় যৌবনের সমাপ্তি ঘটিয়েও নেলসন ম্যাণ্ডেলা শ্বেতাঙ্গ শাসকদের কাছে মাথা নত করেননি, কারাগার থেকে বের হয়েও স্তিমিত হননি- আরাে দপ্ত ও উজ্জ্বল হয়েছেন, যৌবন হারিয়েছেন, এ ক্ষোভ তাঁর নেই। করতে ও দেখতে চাহেন দক্ষিণ আফ্রিকায় নির্মম শ্বেতাঙ্গ শাসনের অবসান। দীর্ঘদিনের নিষ্পেষিত কষাঙ্গদের বেদনাভরা জীবনের মুক্তির আনন্দঘন দিন ও শান্তির আবেহায়াত। বিশ্ব বর্ণবাদের ঘৃণিত স্রষ্টা ও ইসলামের শত্রু হলাে হিন্দু ভারত ও বৃটেন তথা শ্বেতকায় খ্রীস্টান জাত। এরা বাক্যের আবরণে ঢাকা গণতন্ত্রের ডামাডােল বিশেষ। অন্তর শয়তানী ফন্দির উৎসস্থল। রক্তঝরা ফন্দি-ফিকির করেও তিনশত বছরের ঊর্ধ্বে শাসিত দক্ষিণ আফ্রিকা আজ হাতছাড়া হতে চলেছে। বিজয়ের পতাকা ইনশাল্লাহ নির্যাতিত নিগ্রোদের পক্ষেই উড়বে। অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী ভারতবর্ষকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি দৃষ্টিদান করতঃ অন্যায়, অবিচার ও জুলুমের অবসান ঘটাতে হবে; ঘৃণা বিদ্বেষ ও প্রতিশােধের পথ পরিহার করে বর্ণ, ধর্ম, জাতি নির্বেশেষে সবার প্রতি প্রেম নিবেদন করতে হবে-মহামিলনের সেতু তৈরী করতে হবে, শােষিত জনতার কৃপা দৃষ্টি লাভ এভাবেই সম্ভব।
ইনসাফ ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই মহামতি খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) কর্তক অধিকৃত দেশ সমূহে আজও ইসলামী পতাকা উড্ডীন রয়েছে। আর এই শাসনের অনুকরণে বৃটিশ ভারতের কংগ্রেস শাসিত প্রদেশ সমূহে শাসকদের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য মিঃ গান্ধী নির্দেশ দা করেছিলেন। নিশ্চয় তিনি দুর্বল ও অসহায়দের প্রতি জুলুম ও অবিচার করতে বলেননি। গান্ধী কি ব্রাহ্মণ ছিলেন না? আজকের ব্রাহ্মনগণ এত রুষ্ট কেন মুসলিমের প্রতি, কেন ক্রুদ্ধ নিম্ন বর্ণের হিন্দুর প্রতি, বাকশক্তি হরণে কেন এত নির্মম, কেন তারা বিদ্বেষ পরায়ণ? এ কথার বিশ্লেষণে বিস্মিত হতে হয়। উচ্চাভিলাষী আকাংখা কোন দেশের পক্ষেই শুভ ফলাফল দান করে নি। অতীত ইতিহাসের ঘটনা পঞ্জী নাই বা তুললাম। সােমালিয়ার বুকে আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন সাধ লজ্জাজনক পরিণতি কি আমাদের চোখে এখনও ভাসমান নয়? ইতিহাস কথা কয়। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রনায়কদের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সে কথা কান পেতে শােনা অবশ্যই উচিত।
হিন্দু ও যিবাদীদের দর্শনের অন্যতম মূলমন্ত্র হলাে ‘প্রেম’! এ প্রেমের নজীর এই দুই। জাতির ভিতর বর্তমানে লক্ষ্যনীয় কি? সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় উগ্রবাদীদের সন্ত্রাসে মহান বাণী প্রেম ভারতভূমি হতে বিদায় নিয়েছে এবং বিদায়ের প্রাক্কালে হয়তাে বলে গেছে, আমার অবর্তমানে শেষ কর যতসব মুসলিম, ধ্বংস কর সব মসজিদ, চালাও নির্যাতন নিম্ন বর্ণের হিন্দুর প্রতি, সম্ভ্রমের হানি ঘটাও হরিজন মহিলাদের, সকল ন্যায় সংগত আন্দোলন ও স্বাধীকারের বুকে হানো কুঠারাঘাত। সম্ভবতঃ একারণেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মুসলিম, হরিজন, শিখ পশ্চাপদ ও দুর্বল শ্রেণীর জীবনে নেমেছে দুর্গতি। কৃতি সন্তান ডঃ আম্বেদকরের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণে বর্ণশ্রেষ্ঠদের তাই দারুণ ক্ষোভ ও আপত্তি। অতীতের কুরুক্ষেত্র হলেও সংশ্লিষ্ট দেশের সব কিছুতেই যেন রক্তগঙ্গার রূপধারণ।
এর সমাধান নেই?
পরিসমাপ্তি নেই?
এই কি প্রেমের আদর্শ?
পরিশেষে আমি ক্ষুদ্র হলেও ইতিহাসের আলােকে এ কথাই বলা সমীচীন বলে মনে করি যে, কোন দেশ, জাতি, সম্প্রদায় ও গােত্রের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া শাসন ও নির্যাতন গণতন্ত্র নয় স্বৈরাচারের নামান্তর। জনগণ কর্তৃক গ্রহণীয় যে শাসন তাই গণতন্ত্র -আর তখনই বলা যায় গনতান্ত্রিক সরকার। কামনা করি উগ্রবাদী দল সমূহের আত্ম সংশােধন এবং ভারতীয় রাষ্ট্রনায়কগণের আত্মশুদ্ধি মূলক জাগরণের।
═──────────────═