JustPaste.it


আঁধার থেকে আলোর পথে

 

আবদুল মাজীদ ইব্রাহীমের ইসলাম গ্রহণের ঈমান আলোকিত দাস্তান

লুৎফর রহমান ফারুকী


মধ্য আমেরিকার অন্তর্গত জামাইকা দ্বীপের অধিবাসী আবদুল মজীদ ইব্রাহীম। তার পৈত্রিক নাম ছিলো জর্জ চার্লস। ইসলাম গ্রহণ করার পর লন্ডন থেকে প্রকাশিত 'দি মুসলিম' পত্রিকা তার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এ সাক্ষাৎকারটি ১৯৯৬ সালের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়ে বিপুল সমাদর লাভ করে। বাংলা ভাষাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের খেদমতে আমরা উক্ত সাক্ষাৎকারটির ভাষান্তর পেশ করছি।  
প্রঃ ইসলামের প্রতি কিভাবে আপনার আগ্রহ জাগে?  
উঃ আমার যতটুকু মনে আছে, শুরু থেকেই আমি অনুসন্ধানপ্রিয় ছিলাম। চেষ্টা সাধনার প্রতি ছিলো আমার প্রবল আগ্রহ। বরং এটা আজও আমার জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভাষায় ব্যক্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় যে, আমার মনে সর্বদা একটা প্রশ্নবোধ লেগেই থাকে। আর এই প্রশ্নবোধই আমাকে ইসলামের দিকে প্রবলভাবে টেনে নিয়ে আসে।  
বুঝ-জ্ঞান হওয়ার পর ক্যাথলিক উপসম্প্রদায়ে আমাকে ব্যাপ্টিষ্ট করা হয়। বাহ্যতঃ এটা একটা আজব ব্যাপার ছিলো। কারণ আমার পিতা-মাতা এ মতে বিশ্বাসী ছিলেন না। আর না আমার কনিষ্ঠ ভাই বোনেরা পরবর্তীকালে এ মত অবলম্বন করেছে। আমার পিতা-মাতা খৃষ্টবাদের সেই সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, যে সম্প্রদায় শনিবারকে একটা বিশেষ পবিত্র দিন মনে করে। এ শনিবারের দিন তারা উপাসনা ও বাইবেল পাঠ করা ছাড়া তারা অন্য কোন ধর্মকর্ম করতেন না। এমনকি এই শনিবারের আহার্য বস্তুও শুক্রবার বিকেলেই পাক করে রাখতেন। এই উপসম্প্রদায়ের লোকেরা শুক্রবারে মাংস খায় না এবং মদ পান করে না। আমার পিতা একজন অধার্মিক মানুষ ছিলেন। তিনি কোন ধর্মই মেনে চলতেন না। আমাদের রাজধানী শহর কিংস্টনে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী থাকলেও বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সেখানে কোথাও ইসলাম ধর্মের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলনা। জামাইকাবাসী ইসলাম সম্পর্কে কেবল এতটুকু জানতো যে, এটা ভারতের অন্যান্য ধর্মের মত একটি ধর্ম বিশেষ। কারণ, কেবল হিন্দুস্তান থেকে আগত কিছু লোককে তারা একটা বিদেশী ভাষা উচ্চারণের মাধ্যমে অভিনব পদ্ধতিতে ওঠাবসা ও নড়াচড়া করতে দেখতো। পরে অবশ্য জানা গেলো যে, এই ইবাদতের সাথে হিন্দুস্তানের কতিপয় ধর্মীয় ক্রিয়াকান্ডও মিশ্রিত হয়েছে। জামাইকা দ্বীপে তখনও কোন মসজিদের অস্তিত্ব ছিলনা। সম্ভবতঃ আজও এ দ্বীপে কোন মসজিদ গড়ে উঠেনি।  
বুঝ- জ্ঞান হওয়ার পর আমাকে একটি ক্যাথলিক বয়েজ স্কুলে ভর্তি করা হলো। সে স্কুলের একটি বিশেষ দিক, যা আমার স্মৃতিপটে অঙ্কিত রয়েছে এবং আমার জীবনকে নতুন খাতে প্রবাহিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে 'পাপ  স্বীকারোক্তি' (কনফেসন)-এর সাপ্তাহিক মহফিল। সমস্ত ছেলেকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হতো। সকলকে সেনাদলের মত যথারীতি মার্চ করানো হতো। এভাবে সকলকে গীর্জাভিমুখে নিয়ে যাওয়া হতো। গীর্জা স্কুল থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। সেখানে আমরা পালাক্রমে একের পর এক পাপ স্বীকারোক্তি কক্ষে (কনফেসনাল চেম্বার) প্রবেশ করতাম । সেটি এক বর্গাকৃতি বিশিষ্ট কক্ষ ছিলো, যার মাঝখানে পর্দা ঝুলে থাকতো। পর্দার অপর পার্শে পাদ্রী সাহেবের আসন পাতা ছিলো আর ওপাশে ছাত্ররা নতজানু হয়ে নির্দিষ্ট কাষ্ঠাসনে বসে যেতো। এবার তাদেরকে বিগত সপ্তাহের কৃতপাপ স্বীকার করতে হতো। পর্দার অন্তরালে উপবিষ্ট পাদ্রী সাহেব ছাত্রদের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত দোয়া প্রার্থনা করতেন এবং প্রায়শ্চিত্ব স্বরূপ বাইবেলের কতিপয় বাক্য পাঠ করার আদেশ দিতেন। কোন কোন সময় এমনও হতো যে, আমার কোন পাপ কিংবা পদস্খলন হতো না। কিংবা কোন কৃত পাপের কথা মনে পড়তো। এমতাবস্থায় আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়তাম। যেহেতু কোন পাপ না করেও পাপ স্বীকার করা একটা পাপ সুতরাং অনিচ্ছা সত্তেও কোন না কোন ছোটখাট পাপ করতেই হতো। যেমন মায়ের চোখের আড়ালে চিনির চামচ চুরি করতাম কিংবা ফলের দোকানীর পড়ে যাওয়া ফল উধাও করে ফেলতাম। আমরা সহপাঠীরা পাপ স্বীকার করার ব্যাপারে একে অন্যের উপর বাজি নেয়ার জন্যে বহু অভিনব পদ্ধতিতে নতুন নতুন পাপ সংঘটনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতাম।  
উল্লেখ্য যে, স্বেচ্ছায় বাইবেল পাঠ করা কিংবা গীর্জায় ইচ্ছামত যাতায়াত করা আমাদের জন্যে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিলো। কিন্তু আমি সেই বাধা নিষেধের কোন পরোয়া করিনি। আমার স্কুল জীবনের শেষ বর্ষের কথা। একদিন বাইবেল পড়ে দেখি লিখিত আছেঃ 'দু' ব্যক্তি যদি ঈশ্বরকে হাজির নাজির রেখে কৃত পাপ স্বীকার করে, তখন উভয়ের পাপ মোচন হয়ে যায়।' এ উক্তি পাঠ করার পর আমার চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো যে, বিগত কয়েক বছর যাবৎ আমি আমার পাপ স্বীকার করলেও পর্দার অপর দিকে উপবিষ্ট 'ফাদার' কোনদিন তার কৃত পাপ স্বীকার করেননি। 'এর মানে এই দাঁড়ায় যে, আমার কৃতপাপও মুচিত হয়নি।'  
সুতরাং পাদ্রী সাহেবের সামনে আমি আমার মনের এই সংশয় ব্যক্ত করার সংকল্প করলাম। পরবর্তী সপ্তাহে আমি তাই করলাম। আমার পাপ স্বীকারোক্তির পালা আসলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তার সামনে আমার নিজের এই প্রশ্ন রাখলাম। পর্দার অন্তরালে দীর্ঘ নীরবতা ভঙ্গ করে 'ফাদার' নির্দেশের সুরে বললেন 'এখন বাইরে চলে যাও'। আঙ্গিনায় আমার জন্যে অপেক্ষা কর, অবসর.হয়ে আমি আসবো এবং শান্ত মনে তোমার এ প্রশ্নের জবাব দেবো। আমি বাইরে চলে আসি এবং কনফেসন সমাপ্ত হওয়ার পরেও এক ঘণ্টা যাবৎ আঙ্গিনায় 'ফাদারের' জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু তিনি আসেননি, সুতরাং আমি বাড়ি চলে যাই এবং তার পরে আর কোন দিন গীর্জামুখী হইনি। বরং গণ (Mass) প্রার্থনাতেও শামিল হতে কুন্ঠাবোধ করি। এবার আমি খৃষ্টবাদ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে বিশদ অধ্যয়নে মনোনিবেশ করি এবং এ ব্যাপারে বিশেষভাবে চিন্তা -ভাবনা করতে থাকি। ফলে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, এই ধর্মকে মানুষ মানুষের উপর শাসনের বিশেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।  
স্কুল জীবন সমাপ্ত করার পর যতই আমি পট পরিবর্তন করি না কেন আমার অধ্যয়নে কিন্তু ভাটা পড়েনি। বর্তমানেও এ আগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে যত বই হাতে এসেছে, সমস্তই এক এক করে গোগ্রাসে পড়ে ফেলি। এ বিষয়ে জুংএর মতবাদকে আমি ফ্রয়েডের মতবাদের তুলনায় বেশী প্রকৃতির কাছাকাছি পেয়েছি।  
ফ্রয়েডের চিন্তা ও মতবাদে মেকানিয়ত প্রধান। সে যাই হউক, আমি 'সম্মোহন' ক্রিয়া সম্পর্কে প্রচুর অধ্যয়ন করেছি। এটা বাস্তবেও প্রয়োগ করেছি। এই অধ্যয়ন ও অনুশীলনের ফলে আমি আমার নিজের এবং জনসাধারণের সম্পর্কে প্রচুর নিগুঢ় তথ্যের সন্ধান পেতে সক্ষম হয়েছি।            
১৯৫৬ সালে আমি বিলেতে আসি। এখানে সারা দেশ ঘুরে ফিরে দেখলেও বেশীর ভাগ সময় ল্যাস্টরেই কাটাই। পরে অবশ্য লন্ডনে স্থানান্তরিত হয়ে যাই। সেখানকার এক পাঠাগারে রাশিয়ার এক গণিত শাস্ত্রবিদ ও সুফী সাধক যুসাস্পসিকী প্রণীত গ্রন্থ “অতি প্রকৃতির সন্ধানে” (In Search of the Miraculous) অধ্যয়ন করার সুযোগ পাই। লেখক এগ্রস্থে রাশিয়ার আর একজন প্রখ্যাত আধ্যাত্মবাদী ক্রুসিবের শিষ্য থাকা অবস্থার যে সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল লাভ করেছেন, তা উল্লেখ করেছেন। ক্রসি তার জীবনের গোড়ার দিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছেন। তার দর্শনের সারসংক্ষেপ হলো যে, “মানুষ বস্তুতঃ সুপ্ত অবস্থায় বিরাজ করে আত্মোপলব্ধী লাভের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াসের মাধ্যমেই সে জাগ্রতি ও চেতনা লাভে সক্ষম হয়। কিন্তু এই প্রয়াস একার পক্ষে ফলপ্রসূ হতে পারে না বরং এ প্রয়াসে নিমগ্ন ব্যক্তিদের পারস্পরিক সান্নিদ্ধ ও সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারে। ত্রুসিব তার এ মতবাদকে বাস্তবে রূপদান করার জন্যে প্যারিসে একটি সংস্থা গঠন করেছেন। এবং স্বীয় শিষ্যমণ্ডলী ও ভক্তবৃন্দের সমন্বয়ে একটি বৃত্তও গঠন করেছেন। এ বৃওটি  ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে। গোটা ইউরোপে তার শাখা গঠিত হয়। ইংল্যান্ডে এ মতবাদে বিশ্বাসী এক ব্যক্তির সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিলো। পরে অবশ্য তিনিও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে যান। তার বক্তব্য হলো, এই চিন্তা পদ্ধতি খুবই যুক্তিযুক্ত, বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিবেকসম্মত। এ চিন্তাধারার অধিকারী ব্যক্তি মাত্রই স্বাভাবিকভাবে ইসলামের আদর্শের দিকে প্রভাবিত হয়।  
এই গ্রন্থে আলোচিত বিষয়বস্তু আমাকেও প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে আত্মসমীক্ষণ ও আত্মসমালোচনায় আমার চিন্তাধারার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সুতরাং একবার এক সোমালিয় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতকালে কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, “আপনি কি মুসলিম?" “না তো', আপনার কি করে এ সন্দেহ হলো? আমি সবিন্ময়ে বললাম ।  
জীবন সম্পর্কে আপনার চিন্তাধারা হুবহু মুসলমানদেরইঃ   
'আমি যে চিন্তাধারার বিভিন্ন কক্ষে উকি মেরেছি, তা আমি তাকে সবিস্তারে খুলে বললাম। তখন তিনি আমাকে শনিবার অপরাহ্নে লন্ডন ইসলামিক সেন্টারে যাবার পরামর্শ দিলেন। তার মতে সেখানে আমার মনে উত্থিত প্রশ্নাদির উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 
আমি ইসলামিক সেন্টারে পৌছে দেখি যে, বিভিন্ন জাতিসত্তার সময়ে গঠিত একটি যুবদল বৃত্তকারে বসে আছে। সেখানে যে জিনিষটি আমাকে মুগ্ধ করেছে, তা হচ্ছে তাদের আড়ম্বরহীনতা অসাধারণ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ঐকান্তিকতা। তখনই আমার বিবেক বলল এতদিন যে মঞ্জিলের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছি, তা আজ পেয়ে গেছি। সুতরাং অল্পদিনের মধ্যেই আমি ইসলামের কোলে আশ্রয় খুঁজে নিলাম। তথাপি আমি বলবো যে, মুসলমান হওয়া বস্তুতঃ একটি নিরবছিন্ন স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার ফল। এটা এমন একটি প্রক্রিয়া, যা অব্যাহত থাকা আবশ্যক। এ মঞ্জিল ততক্ষণ পর্যন্ত হাসিল করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না মানুষের দৃঢ়সংকল্প তার সহযোগী হয়। এক ভাই এভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ 'কোন মানুষ কেবল ফরম পূরণ করেই একজন ভালো মুসলিমে পরিণত হয়ে যায় না, এটা তো কলেমা তাইয়েবার প্রতি দৃঢপ্রত্যয়ী এক নিরবিচ্ছন্ন সম্পর্কের নাম,। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যে কোন প্রভু নেই, কলেমা তাইয়েবা হচ্ছে তার বীজ, যার শাঁস আর আবরণ হচ্ছে দ্বীনে হানীফ । ইসলামের ফল তার স্বীয় আকৃতি নিজেই গঠন করে।' এর অর্থ যাই হউক না কেন এই সংক্ষিপ্ত বাক্যের সঠিক তাৎপর্য উপলব্ধি করাও চৈতন্যের আবশ্যিক ফল।  
প্রঃ দয়া করে আপনার অনুসৃত ইসলামপূর্ব ও বর্তমান জীবনের পার্থক্যটুকু স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলুন ।  
উত্তরঃ আমি আমার এই অনুভূতি একটা উদাহরণের দ্বারা ব্যক্ত করবো। এমন ব্যক্তির কথা কল্পনা করুন, যে সারা জীবন গুমোট অন্ধকার কক্ষে আবদ্ধ ছিল। সে আলোর জন্যে ব্যাকুল অবস্থায় পথের সন্ধানে ব্যস্ত। এ অবস্থায় যদি তার ভাগ্য প্রসন্ন হয়, প্রাচীরের গায়ে যদি সামন্য একটা ফাটল দেখা দেয় তার মধ্য দিয়ে যদি অন্ধকার ভেদ করে দিনের আলোকরেখা কক্ষে প্রবেশ করে, তখন সে ব্যক্তির যে কী আনন্দ হয়, তা কল্পনা করা যায় কি? সে আনন্দে নেচে উঠবে, উম্মাদের মত দেয়াল খুড়তে আরম্ভ করবে। ফাটলটি আরও বড় করে পূর্ণ আলোক রশ্নী দ্বারা উপকৃত হওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। নিঃসন্দেহে ইসলাম আমার হৃদয়গৃহে এক বিরাট বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে। আর সবচাইতে গুরুতৃপূর্ণ কথা হলো, আমি শান্তির অফুরন্ত সম্পদ লাভে সক্ষম হয়েছি, জীবনের শুরু থেকে আমাকে ব্যকুল করা ভুরি ভুরি প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমি পেয়ে গেছি। 
আমার জীবন উন্নত ও অমূল্য লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। অন্যথায় আমার এ ব্যাকুল আত্মা পথহারার মত কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেড়াতো, তা কে জানে সুতরাং আমি আমার ইসলামে দীক্ষা গ্রহণের সুসংবাদ জানিয়ে আমার আম্মাকে চিঠি লিখি। তিনি উত্তেজিত হয়ে আমাকে উত্তরে লিখলেন যে, এই বখাটেপনা ত্যাগ করে সুশৃখলভাবে কোন সৌজন্যমূলক কাজে আত্মনিয়োগ কর। এরপর দীর্ঘ তিন মাস যাবৎ তিনি আমাকে কোনো পত্র না লিখলেও আমি ইসলাম সম্পর্কে লিখিত বিভিন্ন পুস্তিকা তার নামে নিয়মিত পাঠাতে থাকি। আর চিঠিতেও আমি ইসলামী শিক্ষার বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করে তাকে লিখতে থাকি। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানী যে, তার আচরণে নমনীয়তা এসেছে এবং আপোষের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে যাই হোক, ইসলাম সম্পর্কে লিখিত আমার নাগালে যত গ্রন্থ এসেছে, সবগুলো আমি এতদসত্বেও মনে হচ্ছে যে, এখনও আমি জমির উপরিভাগেই আঁচড় দিয়ে যাচ্ছি। আজও ভূগর্ভে পৌছতে সক্ষম হইনি। তাই আমি অতিসুন্দর বিজ্ঞানময় দিশারী আল কুরআনের মূলভাষা ও শব্দাবলীতে নিহিত বাণী আয়ত্ব করার উদ্দেশ্যে রীতিমত আরবী ভাষা শিক্ষায় মনোনিবেশ করি।  
প্রশ্নঃ একজন নওমুসলিমকে তার পৈত্রিক ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দরুন প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এটা কোন সাধারণ মুসলমান অনুভব করতে পারেনা। এ ধরনের সমস্যাবলি সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করুন।  
উত্তরঃ সমস্যাবলীর প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করার পূর্বে আমি একটা বিরাট উপকারের দিকে ইংগিত করবো। একজন নও মুসলিম যা কিছু লাভ করে, সাধারণ মুসলমানরা তা থেকে সাধারণত বঞ্চিত থাকে। আমার মতে যে পৈত্রিক ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে দীক্ষিত হয়, সে প্রাচীরের উভয় পার্শ্ব সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত থাকে। অর্থাৎ একদিকে সে তার সাবেক ধর্ম সম্পর্কেও অবহিত থাকে অপর দিকে ইসলামের সৌন্দর্য ও পরিচয় লাভ করে। এরূপে তার দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয় আর সমস্ত ধর্মের উপর ইসলামের সার্বিক শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কেও তার প্রত্যয় জন্মে। অতএব একজন সাধারণ মুসলমান অতি কষ্টে যে বিশ্বাস ও প্রত্যয় লাভ করে, তা সে অনায়াসে লাভ করতে সক্ষম হয়। 
সমস্যাদী সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, একজন নও মুসলিমকে মানসিক দ্বন্দের সম্মুখীন হতে হয়। কারণ তাকে নির্ভেজাল ইসলামী শিক্ষা ও জন্মসূত্রিক মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত অনৈসলামিক আচার-ব্যবহার বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হয়। আর উভয় প্রকারের আচরণের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখে তার মাথা ঘুরে যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই কিছুদিন পূর্বে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো যে, আমি শিয়া না সুন্নি? এটা জানা কথা যে, দ্বীনের ভিত্তি কালেমা তাওহীদের দ্বারা বাধা যে কোন মুসলমান এ ধরনের প্রশ্নে অবশ্যই বিব্রত বোধ করবে। এক মিল্লাতের সদস্য হয়ে কি করে পরস্পরে তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদ করে সময় নষ্ট করতে পারে? আর যে জিনিসটি একজন নওমুসলিমকে ব্যাকুল করে তোলে, তাহলো সাধারণ মুসলমানদের ইসলামের প্রতি অনাগ্রহ, কর্মবিমুখতা ও উৎসাহহীনতা। এটা একটা তিক্ত সত্য। নিঃসন্দেহে দ্বীনের তাবলীগ প্রত্যেক মুসলমানের জন্যে ফরয। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কেবল কিছু সংখ্যক ছাত্র ও চাকুরীজীবী মুসলমানরাই এ দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু অপ্রতুল পুঁজি, সীমিত উপায় উপকরণাদীর দরুন তার আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যথায় আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে. মুসলমানেরা যদি স্বীয় দ্বীন প্রচারকে অগ্রাধিকার দিতো এবং দ্বীন ইসলামকে নির্ভেজাল ও খাটি রূপে পেশ করতো এবং নিয়ম পরিকল্পনার মাধ্যমে চেষ্টা সংগ্রাম করতো, তাহলে লক্ষ কোটি মানুষ অসাধারণ আগহ নিয়ে এদিকে ছুটে আসতো এবং ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে শান্তি পেতো।