JustPaste.it

ঈমানের মেহনত বনাম জিহাদ

 

প্রশ্ন: জনৈক সাহাবীর উক্তি রয়েছে
تعلمنا الإيمان ثم تعلمنا القرآن فنزداد إيمانا
এর দ্বারা কি আগে ঈমানের মেহনত ও পরে দ্বীন শিক্ষা ও অন্যান্য আমল যেমন জিহাদ ইত্যাদি সাব্যস্ত হয় না?

 

উত্তরঃ

الحمد لله، والصلوة على رسول الله، أما بعد

 

১. প্রথমে আমরা কথাটির অর্থ ও মর্ম উল্লেখ করছি
تعلمنا الإيمان ثم تعلمنا القرآن فنزداد إيمانا
শাব্দিক অর্থ আমরা ঈমান শিখেছি এরপর কুরআন শিখেছি। ফলে আমাদের ঈমান বেড়ে গিয়েছে।
এটা (যতদূর মনে পড়ছে) কোনো এক সাহাবীর কথা। এর সংক্ষিপ্ত মর্ম হল আমরা আগে ব্যবহারিক (প্রাকটিক্যাল) ফিকহ শিখেছি এরপর দলীল (نص /text) শিখেছি। ফলে আমাদের দীন শক্তিশালী হয়েছে।

 

 

২. কথাটির ব্যাখ্যা হল শুরুতে মাসআলা শিখা, তা আকীদা সংক্রান্ত হোক বা আমল সংক্রান্ত হোক। এরপর সময় সুযোগ অনুযায়ী কুরআন হাদীস ও ইজমা কিয়াসের দলীলের সাথে মিলিয়ে নেওয়া। এর দ্বারা মনে প্রশান্তি আসে। শুরুতেই দলীলের পিছনে না ছুটে নির্ভরযোগ্য (মনে হয় এমন) কাউকে অনুসরণ করে আমল করা। কারণ দলীল বুঝা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। যা করতে গেলে সময় মত বেশিরভাগ আমল করা সম্ভব হবে না। বরং পেরেশানী বাড়বে। সব যুগেই উম্মতের কর্মপন্থা এমন ছিল।

 

 

৩. ফিকহ অর্থ বুঝ। এটা কুরআন হাদীস থেকে যে সিদ্ধান্ত (معنى /mean) বের হয় তাকে বুঝায়। সাধারণত আমলী মাসআলা বুঝালেও আকীদাহগত মাসআলাও এর মধ্যে শামিল। এর বিপরীতে হল text نص উদ্ধৃতি বা মূল পাঠ। কুরআন ও কওলী সুন্নাহ নসের অন্তর্ভুক্ত। ফি'লী সুন্নাহ, ইজমা এ কিয়াস সরাসরি নস নয়। মা'না হয়ে ফিকহের উৎস।


মনে রাখতে হবে, ফিকহ শিখার দুই স্তর। শুধু মাসআলা শিখা (প্র্যাকটিক্যাল)। আর দলীলের সাথে মিলানো (থিউরিটিক্যাল)। ঈমান শিখার দ্বারা ১ম স্তর, কুরআন শিখার দ্বারা ২য় স্তর উদ্দেশ্য।

 

 

৪. ঈমান অর্থ ফিকহ হল কেন? একই শব্দ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্থে এসে থাকে। এটা আগে পরের সাথে মিলিয়ে বুঝতে হয়। যেমন ২য় পারার ১ম পৃষ্ঠায় وما كان الله ليضيع إيمانكم (আল্লাহ তোমাদের ঈমান নষ্ট করবেন না) এখানে ঈমান অর্থ সকল মুফাসসিরের কাছে নামায। যা কিবলা পরিবর্তনের আগে পড়া হয়েছে। তাআল্লামনাল ঈমান এখানে ঈমান অর্থ দীন হলে আকীদা ও আমল উভয়কে শামিল করবে। কারণ দীন এদুটির সমষ্টি। আর দীন অর্থে ঈমান শব্দের ব্যবহার কুরআন হাদীসে অনেক। তখন আকীদা ও আমল শিখার অর্থ হবে এসবের মাসআলা বা পদ্ধতি শিখা। আর যদি ঈমানের আসল অর্থ শুধু আকীদাকে ধরা হয়, তাহলেও সমস্যা নেই। তখন অর্থ হবে আমরা আগে আকীদার মাসআলা জেনেছি। যেমন তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত। এরপরে কুরআনের সাথে মিলিয়েছি। আল্লাহর কতিপয় বান্দাদের মত প্রথমেই সরাসরি মিলিয়ে বুঝতে যাইনি। আর এই অর্থ নিলে আমলের কথা সরাসরি না আসলেও আকীদার উপরেই তাকে কিয়াস করা হবে।

 

 

৫. تعلم القرآن অর্থ (শুধু) তিলাওয়াত শিখা নয়, যা কারো মনে হতে পারে। বরং ব্যাখ্যা সহ শিখা উদ্দেশ্য। তিলাওয়াত যার একটি অংশ। যেমন রসূল সা. এর একটি দায়িত্ব (যা মুসলমানদের তাবলীগ তথা তালীমের অংশ) ويعلمهم الكتاب অর্থাৎ উম্মতকে কুরআন শিখাবেন, ব্যাখ্যা সহ। আর ঈমান বাড়ার অর্থ এর মান quality এবং গুণ যেমন তাওয়াক্কুল, সবর শোকর ইত্যাদির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। হিংসা, অহংকার ইত্যাদির মাত্রা হ্রাস পাওয়া। সংখ্যা quantity বা পরিমাণ বেশি হওয়া নয়। فزادهم إيمانا وعلى ربهم يتوكلون এখানে দীনের মযবুতী উদ্দেশ্য।

 

 

৬. যারা সাহাবীর এই বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দেয় এদের অন্যতম হল তাবলীগ জামাতের কিছু ব্যক্তি। তারা বলতে চায় সাহাবীরা আগে 'ঈমানের মেহনত' করেছেন। এরপর কুরআন বা দীনের মাসআলা মাসায়েল শিখেছেন। এরপর অন্য কিছু করেছেন। এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, ঈমানের মেহনত বর্তমানে একটি বিদআতী পরিভাষায় রূপ নিয়েছে। কারণ-

৭. বাস্তবে ঈমানের মেহনতের প্রথম অর্থ হল নিজের ইসলাহে কুল্ল (পূর্ণ সংশোধন) করা। অর্থাৎ দ্রুত সকল প্রকার আকীদাগত এবং যাহিরী বাতিনী কর্মগত গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়া এবং নিজের উপর আরোপিত আল্লাহর সকল হুকুম সময়মত পালন করা। এজন্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা। এটা হল ঈমান অর্থ দীন নিলে।

 

 

৮. আর যদি ঈমান অর্থ আকীদা নেই তখন ঈমানের মেহনতের দ্বিতীয় অর্থ হবে, ইসলাহে আকীদা করা। অর্থাৎ দ্রুত সকল প্রকার কুফরী ও বিদআতী আকীদা থেকে মুক্ত হওয়া এবং সকল আবশ্যকীয় আকীদায় বিশ্বাস করা। এজন্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা। তখন এর পাশাপাশি আমলের মেহনতও করা লাগবে। অর্থাৎ দ্রুত সকল আমলী গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়া এবং সকল আবশ্যক আমল করা। এজন্য প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করা। শুধু আকীদার মেহনত জায়েয নেই। ব্যক্তির উপর দীনের আরোপিত সবটুকুর মেহনতই করতে হবে।

 

 

৯. ঈমানের মেহনতের তিন নম্বর অর্থ হলো ইসলাহে নফস (আত্মশুদ্ধি) বা তাযকিয়ায়ে নফসের মেহনত। যেহেতু ইসলাহে নফস হলে ঈমান তাযা হয়, ইসলাহে কুল্ল সহজ হয়। এই অর্থটি দূরবর্তী হলেও শর্ত সাপেক্ষে গ্রহণ যোগ্য হবে। শর্তটি হল ইসলাহে কুল্লকে ইসলাহে নফসের উপর নির্ভরশীল করা যাবে না। অন্যভাবে বললে ইসলাহে নফসের দোহাই দিয়ে ইসলাহে কুল্লকে বিলম্বিত করা যাবে না। যেমনটি অনেক ভন্ড পীররা দাবি করে থাকে। যে আগে ইসলাহে নফস, পরে নামায, রোযা বা অন্য কিছু।

 

 

১০. তাবলীগী জামাত আসলে প্রাথমিক ইসলাহের জামাত। প্রাথমিক সংশোধনের একটি কোর্সের উপর পরিচালিত। যার প্রতিষ্ঠাতা কখনোই শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণে নিষেধ করেন নি। কিছু ইজতিহাদী ভুলের সম্ভাবনা মেনে নিলেও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শরীয়ার পূর্ণ অনুসরণ। তিনি ছিলেন ওয়ালা বারার মূর্ত প্রতীক। ব্রিটিশ বিরোধী জিহাদের বাইআত দেওয়া আলিমদের একজন। এই কোর্সের অন্যতম উদ্দেশ্য বলেছেন: ব্রিটিশদের বিদায়ের পর যে রাষ্ট্রীয় ইরতিদাদের সয়লাব শুরু হবে, তা থেকে অসহায় অজ্ঞ মুসলিমদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। (-মালফুযাতে ইলয়াস রহ. দ্রষ্টব্য)।

 

 

১১. কিন্তু আজ সমস্যা হল এর অনেক অনুসারীই কোর্সের নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে ইলম অর্জন ও আমল করাকে স্বীকৃতি দেয় না। বরং বাঁধা দেওয়ার জন্য নানা রকম অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়। তারা বলে থাকে সাহাবীরা আগে ঈমানের মেহনত করেছেন, পরে অন্য কিছু করেছেন। অনেকে বলে মক্কায় শুধু ঈমানের মেহনত ছিল। ঈমানের মেহনত বলতে তারা কখনো ইসলাহে নফস, কখনো আংশিক ইসলাহে আকীদা, কখনো 'দাওয়াতের মেহনত' উদ্দেশ্য করে। (যেটা আরেক বিদআতী পরিভাষা।) দলীল হিসাবে তাআল্লামনা..... এই উক্তি পেশ করে। কিন্তু এটা মারাত্মক ভুল বরং কুফরী কথা। (তবে নির্ধারিত ব্যক্তিকে যে কেউ কাফির বলতে পারবে না।) কারণ, তখন ফলাফল হবে ঈমানের মেহনত বাদ দিয়ে কোনো আমল করা যাবে না, যদিও ফরয হয়। যেমন ভন্ড পীররা বলে তাযকিয়ায়ে নফস ছাড়া নামায পড়া যাবে না। আর ঈমানের এই মেহনত কোনোদিন শেষ হবে না। এমন তাযকিয়াও কোনোদিন অর্জন হবে না।

 

 

১২. এদের কথা মানলে মদীনায় ঈমানের মেহনত ছিল না। তাহলে কথিত ঈমানের মেহনতের জন্য সর্বোচ্চ তের বছর সুন্নাত নাম দিয়ে নির্ধারণ করা হোক। অনন্ত কাল ব্যাপি ঈমানের মেহনতের নামে বিদআত বন্ধ করা হোক। যে সব সাহাবী মদীনায় বা পরে ঈমান আনলেন তারা কি ঈমানের মেহনত করেন নি? তারা না করলে আমরা কেন করব? আর তারা করলে তখন কি ইলম অর্জন এবং অন্যান্য আমল থেকে বিরত ছিলেন? ঈমানের মেহনত ব্যাক্তিগত না জাতিগত? ব্যক্তিগত হলে তা মক্কার সাথে খাস হবে না। অন্য আমলের জন্য বাঁধাও হবে না। আর জাতিগত হলে এত বড় তাবলীগী জামাত কেন যথেষ্ট হচ্ছে না তা নির্ণয় করতে হবে।

 

 

১৩. আসল কথা হলো, সাহাবীগণ ১ম অর্থে (পূর্ণ সংশোধনের অর্থে) ঈমানের মেহনত করেছেন। যখন যে হুকুম ছিল, পালন করেছেন। এক্ষেত্রে মক্কা মদিনার পার্থক্য নেই। কিন্তু এটাকে অপব্যাখ্যা করে সীমিত অর্থে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

 

 

১৪. দাওয়াতের মেহনতের ব্যপারে কথা হল পরিভাষায় কেবল কাফিরদের সংশোধনকে দাওয়াত বলে। মুসলমানদের মৌখিক সংশোধনকে শাব্দিক অর্থে দাওয়াত বলা যায়। নিয়মমাফিক কাফির ও মুসলমানদের সংশোধন আবশ্যক। তবে দাওয়াতের মেহনত বলে যে সূরত বুঝানো হয়, দল বেঁধে গিয়ে মুসলিমদের সংশোধনের চেষ্টা, এটা নফল। সঠিক আকীদা সহ করলে সওয়াব হবে। কিন্তু কাফিরদের সংশোধনের হুকুম ও ফজিলত এখানে ফিট করা, অথবা সামগ্রিক সংশোধনকে অস্বীকার করা গোমরাহী।

 

 

১৫. কাফিরদের গিয়ে বুঝানো এটা রসূলদের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল। যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্জন হল, জিহাদের হুকুম আসল; গিয়ে বুঝানোর ফরযিয়্যত মানসূখ হয়ে নফল হয়ে গেল। এখন কাফিরদের দাওয়াত ইকদামী জিহাদ কেন্দ্রিক। আর রাষ্ট্র হাতছাড়া হলে আগে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধ, পরে কাফিরদের দাওয়াত। মৌখিক দাওয়াত দিলে নফল হবে, গুনাহ হবে না। হ্যাঁ বাস্তবে ব্যক্তিগত ভাবে কোনো কাফিরের সাথে দেখা হল যে দাওয়াত পায়নি। তাকে মৌখিক দাওয়াত দিতে হবে। এজন্য খুঁজতে হবে না। কারণ মূল দাওয়াত এখন ইকদামী জিহাদ। তার আগে আছে তাহরীরী জিহাদ বা মুক্তিযুদ্ধ।

 

সংগ্রহে ও সম্পাদনায় সালমান মুসতফী।