JustPaste.it

আমার দেশের চালচিত্র

 

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির চাহিদা পূরণে কতটুকু সহায়ক?

ফারুক হোসাইন খান

========================================================================

 

        শিক্ষা জাতির আত্মিক ও মানবিক উৎকর্ষ সাধন, সমাজে ন্যায় বিচার বা ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যে জাতি যত বেশী সুশিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত, সভ্য। সভ্যতা বিকাশের অন্যতম সােপান হল শিক্ষা! জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান। অর্থাৎ শিক্ষা মনুষ্যত্ব ও পশুত্বের পার্থক্য নির্ণয়ের মাপকাঠি। যাহােক শিক্ষা নিয়ে এই যে এত সব নীতিকথা এসব বহু বাঘা বাঘা পন্ডিত ব্যক্তিদের মুখ নিসৃত অমৃত। আমাদের রাসুল (সঃ)-ও মানব জীবনে জ্ঞান অর্জনের অপরিসীম গুরুত্বের প্রতি আমাদের মনােকার্ষণের জন্য বলেছেন “জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়ােজনে চীন দেশ হলেও যাও”। সুতরাং এ সম্পর্কে খামােখা নসিহত করার দুঃসাহস আমার নেই। শুধু শিক্ষা ব্যবস্থার অভাবে আমাদের জাতীয় ও ব্যক্তি জীবন আজ কোন পথে ধাবিত হচ্ছে, এর ভয়ঙ্কর পরিণতির প্রতি আলােকপাত করাই আমাদের উদ্দেশ্য।

 

        আন্তঃনগর ট্রেনের গতিতে আমাদের সমাজ নৈতিক অধঃপতনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অবক্ষয়ের সয়লাব যেন ফারাক্কার বাধভাঙ্গা স্রোতধারার ন্যায় প্রলয় গতিতে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে মানবতার অবশিষ্ট ছিটে ফোটাটুকুও ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে। অনাচার, অবিচার, জুলুম, শােষণ, স্বার্থপরতা সাইক্লোনের ন্যায় জনজীবনকে বিপর্যস্ত করতে উদ্যত। ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাকারবারী, মজুতদারী প্রতারণা, মিথ্যাচার, পরানুকরণ, বিলাসিতা, পরের হক নষ্ট করার প্রবণতা, ঈর্ষাপরায়ণতা আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হতে চলছে। সততা, সত্যবাদিতা, পরােপকার কিংবদন্তিতে পরিণত হচ্ছে কল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে। এর প্রধান কারণ সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব। প্রশ্ন হতে পারে, দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাতাে অপ্রতুল নয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ছাত্র এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বের হচ্ছে। হ্যা, বের হচ্ছে, তারা বিদ্যার জাহাজ হয়েই বের হচ্ছে।তবে সে বিদ্যা টাকা কামানাের কলা-কৌশলের। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সনদের বদৌলতে শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যারিষ্টার, জজ সাহেব, আমলা কত পদের না অধিকারী হচ্ছেন। পদের সেবা, অর্থ উপার্জন, আখের গােছানাে পর্যন্তই এই বিদ্যার দৌড়।

 

        বাঁচতে হলে, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রয়ােজন, এই চাহিদা মিটানাে পর্যন্তই এই বিদ্যার সীমানা। এই বিদ্যা একজন ইঞ্জিনিয়ারকে কিভাবে বহুতলা ভবন নির্মাণ করতে হবে সে নির্মাণ শৈলী শেখায়, কিন্তু নিজ জীবন যাপন প্রণালীকে সুন্দর ছকে সাজিয়ে কিভাবে ‘মানুষ’ হওয়া যায় সে বিদ্যা যােগাতে অক্ষম। বস্তুকে ঘষে-মেজে রং চড়িয়ে কিভাবে বহুরূপে ভােগ করা যায় তা খুব ভালভাবেই শেখাতে বিদ্যা পারঙ্গম। এ বিদ্যা মানুষের মনে এ ধারণাই জন্মায় যে, চারিদিকে যা কিছু দৃশ্যমান সবই তােমার ভােগের জন্য, তুমি বিজ্ঞান অস্ত্রকে ব্যবহার করে এগুলি সর্বোত্তম উপায়ে ভােগ করবে এটাই তােমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ বিদ্যা শিক্ষার্থীদের অন্যের নিকট থেকে যথাসম্ভব উপকার পেতে শেখায় কিন্তু উপকারের বিনিময়ে উপকার বা মানবিক প্রশ্নে উপকার করতে শেখায় না। তাই এই বিদ্যার ধারক মানুষেরা হয় স্বার্থপর। স্বার্থত্যাগী বা নিঃস্বার্থপর নয়। বস্তুকে ভােগ করার কলা- কৌশল মানুষ এ বিদ্যা থেকে পেলে ও নিজের কর্ম, সাধনা, অর্থ, চিন্তা-চেতনা অন্যের ভােগে ব্যয় করে সত্যিকার মানুষ হওয়ার কোন কলা-কৌশল এ বিদ্যা-সমুদ্র সিঞ্চন করেও খুঁজে পাওয়া যায় না।

 

        এ বিদ্যার পূজারী একজন ডাক্তার মানুষের দেহে রােগ নির্ণয়ে ওস্তাদ হলেও তার নিজের মনের রােগ নির্ণয়ে সে অক্ষম। মােট কথা, প্রচলিত বিদ্যা অর্জন করে মানুষ প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবি-সাহিত্যিক প্রভৃতি সমাজের মর্যাদাকর পদগুলি যত সহজে অর্জন করতে পারে তত সহজে তারা 'মানুষ' হতে পারে না।

 

        প্রসঙ্গক্রমে মাদ্রাসা ও মক্তবের শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন হতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও প্রতি বছর উল্লেখযােগ্য পরিমাণ শিক্ষার্থী জ্ঞানী এবং বিবেকবান হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীদের বিপরীত। মাদ্রাসা পড়ুয়ারা নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছেন, দ্বীনি জ্ঞান অর্থাৎ সৎ জীবন যাপন, মানব সেবার চেতনা তারা পাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তারা এর প্রয়ােগের ক্ষেত্র পাচ্ছেন না। বলতে গেলে এদেশের মাদ্রাসা পড়ুয়ারা সমাজের একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ। এর অন্যতম কারণ বৈষয়িক জ্ঞানের অভাব। মাদ্রাসার সিলেবাসে নীতিশাস্ত্র, চরিত্র গঠন, মানব জীবনের লক্ষ উদ্দেশ্য সম্পর্কে তালিম দেয়ার পর্যাপ্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বৈষয়িক তথা আধুনিক সমাজে বেচেঁ থাকার, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ব্যবসা-বানিজ্য, প্রশাসনিক কার্যক্রম, শিল্প, উৎপাদন, বিজ্ঞান চর্চা সংক্রান্ত পর্যাপ্ত বিষয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আদৌ এ বিষয় অন্তর্ভূক্ত নেই। ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৪টি বছর বা তারও বেশি সময় লেখাপড়ায় কাটিয়ে একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী যখন কর্ম জীবনে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নেয় তখন সে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার কোন উপায় বা পথ খুঁজে পায়না। জীবিকা উপার্জনের কোন পন্থা সম্পর্কে সে বাস্তব কোন ধারণা না পাওয়ার ফলশ্রুতিতে বেকারত্বের দংশনে কুকড়ে মরে। পক্ষান্তরে সাধারণ শিক্ষিতরা ছাত্র জীবনের পুরােটাই কিভাবে উপার্জন করে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হয় সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে ব্যয় করে। লেখা পড়ার পাট চুকিয়ে অর্জিত বিদ্যা কাজে লাগিয়ে উপার্জনের পথ করে নেয়া তাদের জন্য সহজ বলেই সমাজের ব্যবসায়-বানিজ্য, শিল্প, কারখানা, প্রশাসনে সাধারণ শিক্ষিতদের আধিপত্য।

 

        দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ব্যবসা করা সুন্নত, অথচ আধুনিক যুগের উপযােগী ব্যবসা ও ব্যবসার পদ্ধতি সংক্রান্ত কোন বিদ্যাই মাদ্রাসা সিলেবাসে নেই। কোন শিক্ষার্থী ছাত্র জীবন শেষে যদি ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা উপার্জনে মনস্থির করেন তবে তাকে কর্মক্ষেত্রে নেমে অনভিজ্ঞতার দরুন মূলধন হারানাে, ব্যবসায়ে লােকসানের ব্যাপক ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক ব্যবসার নিয়ম-নীতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় এটা তাদের কাছে দুঃসাহস মনে হয়। অথচ প্রথম যুগে মুসলমানরা দেশে- বিদেশে ব্যবসা ও ধর্ম প্রচার দুটোই একই সাথে করতেন। এ যান্ত্রিক যুগে নিত্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতির ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষনের প্রাথমিক জ্ঞান, প্রাথমিক চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়টুকু ও কোন কোন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ১৮ বছরের সিলেবাসেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, একটি নষ্ট বৈদ্যুতিক সুইচ মেরামতের ক্ষেত্রেও একজন সাধারন শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির চেয়ে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ব্যক্তির দুর্বলতা বেশী। কোনটা ছুলে কোনটা নষ্ট হয়ে যায়- এ ধরনের মানসিকতা তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ফলে অন্যের সাহায্য গ্রহণ করতে হয় অথচ একটু ব্যবহারিক জ্ঞান থাকলে অনায়াসে সে নিজের কাজ নিজেই করতে পারে।

 

        অংক শাস্ত্র মানুষের মেধা বিকাশে বিশেষ একটা বিষয়। পাটিগণিত ও দশমিক গণিত মালা মুসলমানরাই সভ্য জাতির দাবিদার ইউরোপীয়দের শিখিয়েছিলেন। বীজগণিত শাস্ত্রের জন্মদাতা মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খারেজমী। কিন্তু হতবাক হতে হয় যখন এদেশে মাদ্রাসার সিলেবাসে ব্যতিক্রমও আছে। এই গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রটি খুঁজে পাওয়া যায় না। বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণ সাধনের এক বিশেষ জ্ঞান, এই জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিত্য নতুন আবিস্কারের দ্বারা মানুষের জীবন যাত্রা সহজ ও সুশৃংখল করা, পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের জিজ্ঞাসার সমাধান দেয়া যায়। এছাড়া আমাদের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির ভাল-মন্দ গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত হওয়া, দ্রব্যের সুষ্ঠু ব্যবহার বিধি আয়ত্ব করার একমাত্র মাধ্যম বিজ্ঞান। প্রথম মানুষ আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকে পৃথিবীর সকল সৃষ্টি বস্তুর ব্যবহার বিধি শিখিয়েছিলেন। এজন্যই সকল সৃষ্টি দ্রব্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল। ইসলামের অভুদ্যয়ের পর মুসলিম বিজ্ঞানীরা আধুনিক বিজ্ঞান যুগের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন বলে ইতিহাসের পাতায় সে যুগ সােনালী যুগ হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু সে 'বিজ্ঞান চর্চা' আজ মাদ্রাসার গন্ডির ভেতরে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। এই আত্মঘাতি কর্মকান্ডের কারণে জাতি আজ ভয়ঙ্কর ভাবে পশ্চাৎপদ। জাতির প্রগতি ও উন্নতির চাকা স্থবির। দেশে ছিটে ফোটা যে বিজ্ঞান চর্চার ব্যবস্থা আছে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় মানবতার কল্যাণ সাধনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ মাদ্রাসা পড়ুয়া কোন বিজ্ঞানী সেখানে নেই।

 

        অথচ মাদ্রাসার সিলেবাসে পড়ুয়াদের মানব কল্যাণ সাধনে অপরিসীম গুরুত্ব দেয়া হয়, যা ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। অনুরূপভাবে জাতির অন্যতম সেবক সাংবাদিক, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, প্রভৃতি মহলেও মাদ্রাসা পড়ুয়াদের অবস্থান প্রায় শূন্যের কোঠায়। দেশের কতটি দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা মাদ্রাসা শিক্ষিতদের নিয়ন্ত্রণে? কেউ এ প্রশ্ন করলে একটাই উত্তর হবে, সমাজ বদলের এ হাতিয়ার পরিচালনা পদ্ধতি সংক্রান্ত কোন জ্ঞান মাদ্রাসার সিলেবাসে নেই। বন্দুক চালানাের প্রশিক্ষন ও ব্যবহার বিধি জানা না থাকলে কেউ যেমন বন্দুক চালাতে পারে না তদ্রুপ সাংবাদিকতা, সাহিত্য চর্চা, দৈনন্দিন জীবনে উদ্ধৃত সমস্যাবলীর সমাধান সম্পর্কে কোন জ্ঞান মাদ্রাসার ছাত্ররা পাচ্ছে না বলেই তারা এ দায়িত্ব পালনে এত অসহায়। নাস্তিক, জড়বাদী, ভােগবাদী ও সেকুলার মনােভাবাপন্ন সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের দৌরাত্বে্য এজন্যই আজ জাতি আতঙ্কগ্রস্থ। দেশের ৯০% মানুষ মুসলমান হলেও এই আধুনিক যুগে তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাবলীর সুষ্ঠু ইসলাম সম্মত সমাধান বাতলে দেয়ার পর্যাপ্ত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদের প্রকট অভাব। তাদের এ দুর্বলতার অন্যতম কারণ মাতৃভাষা, জ্ঞানের অভাব। চৌদ্দ বা তারও বেশী পাঠ্য বছর অতিবাহিত করেও অধিকাংশ মাদ্রাসা পড়ুয়া বাংলায় ভালােভাবে কথা বলতে পারেন না। সাহিত্য সৃষ্টি, লেখালেখির প্রশ্নতাে অবান্তর। অথচ এদেশের বাংলা ভাষাভাষী সহজ, সরল ও নিরক্ষর মানুষদের দ্বীন ইসলাম সহজে বােধগম্য করাতে হলে বাংলা ভাষার বিকল্প নেই। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে মাদ্রাসার পড়ুয়ারা এ শ্রেনীর লােকদের সাথে আলাপ-আলােচনায় সাহিত্য ও ব্যাকরণগত দুর্বলতার কারণে মনােঃপীড়ায় ভােগেন।

 

        বিশ্বে ভুগােল ও জ্যোতিষ বিদ্যা চর্চায় মুসলমানরা ইতিহাস সৃষ্টি করলে ও মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি ধারীরা সঠিকভাবে বিশ্বে কতটি মুসলিম দেশ তা বলতে অপারগ হবেন এমন মাদ্রাসা সিলেবাস এদেশে রয়েছে। এভাবে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় যে, ছাত্র জীবনে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে মাদ্রাসা পড়ুয়ারা সমাজের কোন কর্মক্ষেত্রে স্থান করে নিতে পারেনি, একচেটিয়া ভাবে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা স্থান করে নিয়েছেন। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনার সকল চাবিকাঠি তাদের মুঠোয় চলে গেছে। তারা সমাজ ও রাষ্ট্রপরিচালনার জ্ঞান ঠিকই পেয়েছে কিন্তু চরিত্র গঠন ও নৈতিকতার কোন শিক্ষা পায়নি বলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বানিজ্য সর্বত্রই নীতি-নৈতিকতা বিসর্জিত হয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বসদের তােষন আজ প্রধান নীতিতে পরিণত হয়েছে। জাতি দুনীতিবাজ ও দাম্ভিক ক্ষমতাবান প্রশাসকদের নিকট জিম্মি হয়ে পরেছে। তিক্ত হলেও সত্য, মাদ্রাসা পড়ুয়ারা অন্যায়ের সাথে আপােষ না করার অপরাধকে ঘৃণা এবং অপরাধীকে প্রশ্রয় না দেয়ার নৈতিক শিক্ষা পেলেও জীবন- জীবিকার তাগিদে তারা আজ সকল ক্ষেত্রেই উক্ত শ্রেনীর ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হচ্ছে। ব্যবসা-বানিজ্য, শিল্প, উৎপাদন ব্যবস্থা, মুদ্রণ শিল্প, কুঠির শিল্প, সংবাদপত্র শিল্প, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, বিজ্ঞান চর্চা, সাহিত্য চর্চা, ইসলাম সম্মত সুকুমার শিল্প চর্চা, দেশের প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার, গবেষণা প্রভৃতি জাতির ভাগ্য বিনির্মাণের উপাদান সমূহে তাদের কোন প্রভাব, অবদান বলতে কিছুই নেই।

 

        তাদের কর্মতৎপরতা মাদ্রাসা ও মসজিদ কেন্দ্রীক। এরই মধ্যে সীমিত তাদের পদচারণা। ফলে সাধারণ জনগােষ্ঠীর আপাত দৃষ্টিতে মাদ্রাসা শিক্ষার ওপর সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রাধান্য পাচ্ছে। তাদের মনে ক্রমে ক্রমে ধারণা জন্মাচ্ছে যে, মাদ্রাসা শিক্ষিতরা শুধুমাত্র আমাদের দ্বীনি খেদমত করবেন, বাকী বৈষয়িক কর্মতৎপরতা চালাবেন সাধারণ শিক্ষিতরা। আমাদের বক্তব্য মাদ্রাসা শিক্ষার বিরােধীতা করা- এহেন কোন চিন্তার অবকাশ নেই। ইসলামের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা এবং এই শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের মডেল সমাজের কাছে তুলে ধরার প্রাণপণ জিহাদী তৎপরতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়, পার্থিব উদ্দেশ্যে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করায় ইসলামের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দেশে সে ধরণের পরিবেশও নেই। অন্যদিকে পরিশ্রমের মাধ্যমে হালাল উপার্জন করে জীবন ধারণ করাও ফরজ। কিন্তু শুধু দ্বীনি বিদ্যায় শিক্ষিত মাদ্রাসা পড়ুয়ারা এখন কী করবেন? ছাত্র জীবনের মুল্যবান সময় শুধু দ্বীনি জ্ঞান অর্জনে কাটিয়েছেন, কর্ম জীবন সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নেই। এমতাবস্থায় সংসার ধর্ম পালন, পরিবার পরিজনের ভরণ-পােষণের জন্য কী উপায় করবেন? দরবেশী বা বৈরাগ্য জীবন যাপন ছাড়া কোন বিকল্প আছে কি? ইসলামে 'বৈরাগ্য' অবলম্বন করাকে ও কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে। অতএব সমাধান কী? ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে পারিবারিকভাবে উস্তাদ রেখে সন্তানদের লেখা-পড়া শেখানাে হতাে। পরবর্তিতে বিদ্যালয় প্রথার উদ্ভব হয়। এই উভয় শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের যেমনি দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া হতাে একই সাথে প্ৰশাসনিক, রাজনৈতিক, সামরিক, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কেও পর্যাপ্ত জ্ঞান দেয়া হতে হলে শিক্ষার্থী যেমন কর্মনিষ্ঠ, সৎ ও মানবকল্যাণকামী কাজী, প্রশাসক, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, শাসক হতেন।

 

        একই সাথে দ্বীনি জ্ঞানে হতেন যােগ্য আলিম। তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ইসলামী বিধি বিধান সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট হতেন। ফলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে দুষ্ট প্রকৃতির লােকের অস্তিত্ব থাকলেও এসব আলিমগণের প্রভাবে মােটামুটি ইনসাফ বজায় থাকত। আজকের মিশরের বিশ্ববিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সুদান এবং সৌদি আরবের শিক্ষা কারিকুলামে অতীতের ঐতিহ্য অনুসরণ করায় দেশের শাসন ব্যবস্থা স্বেচ্ছাচারীদের কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হলেও প্রশাসনে বিচার ব্যবস্থা, শিল্প উৎপাদন, ব্যবসা-বানিজ্যে এখনও ইনসাফ, মানবতা ও ন্যায়-নীতি কিছুটা টিকে আছে। এসব দেশে এখনও আলিম বিচারক, আলিম প্রকৌশলী, আলিম সৈনিক বর্তমান।

 

        আমাদেরও দাবী তাই, আমাদের হাজার বছরের পুরােনাে ঐহিত্যকে পুরােপুরি অনুসরণ করা হােক। এদেশের আইনজীবী, প্রকৌশলী, প্রশাসক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সমাজপতি প্রমুখ সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের সাথে যারা সম্পৃক্ত, তারা যাতে একই সাথে বৈষয়িক ও দ্বীনিজ্ঞান, চরিত্র গঠন ও নৈতিক জ্ঞান লাভ করতে পারে সে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হােক। অর্থ মানব জীবনের অন্যতম চালিকা শক্তি। এজন্য বৈধ উপায়ে তা অর্জনের জন্যও ইসলাম বিধি- বিধান প্রণয়ন করেছে। মানব জীবনে অর্থ উপার্জনের গুরুত্ব রয়েছে বলেই আল্লাহ ঘােষণা করেছেন, “নামাজ শেষ হওয়ার পর তােমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর।” (সূরা জুমআঃ ১০)।

 

        রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “হালাল রিযিক অন্বেষণ করা আল্লাহ তায়ালার ফরজ ইবাদতের পর (সবচেয়ে বড়) ফরজ।”(কানযুল উম্মাল, ২য় খণ্ড)

 

        তাছাড়া মানুষের জীবিকা এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনে দরকারী হবে বলেই আল্লাহ মানব পিতা আদম (আঃ)-কে পৃথিবীতে সকল সৃষ্ট দ্রব্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতিতে (ব্যতিক্রম নগন্য) জীবিকা এবং আল্লাহর সৃষ্ট বস্তু সংক্রান্ত বিষয়সমূহকে বাদ দিয়ে শুধু ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়ায় সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক।

 

        এদেশ একটি দরিদ্র দেশ, দেশে বেকার সমস্যা অন্যতম সমস্যা। রাসূল (সাঃ) আমাদের দারিদ্র্যকে ঘৃণা করতে এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে দারিদ্র‌্য দূর করতে উপদেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কাঠুরিয়ার গল্প সকলেরই জানা। সুতরাং দেশের বেকার ও দারিদ্র্য সমস্যা সমাধান নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক মাদ্রাসা পড়ুয়ারও দায়িত্ব। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে দ্বীনি শিক্ষার পাশাপাশি নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

        ১। কুটির শিল্প প্রশিক্ষণঃ ছাত্রদের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন হস্তশিল্প ও কুটির শিল্প সম্পর্কে জ্ঞান দান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা। ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা শেষে অল্প মূলধন বিনিয়ােগ করে সম্ভাবনাময় যে কোন শিল্পকে বেছে নিতে পারবে। দেশে বহু সম্ভাবনাময় কুটির শিল্প যথাযথ উদ্যোগের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে এগুলাে প্রাণ ফিরে পাবে।

 

        ২। পােষাক শিল্পঃ দেশে পােষাক শিল্প জাতীয় আয়ের অন্যতম উৎস। বৃহৎ অথবা ক্ষুদ্র উদ্যোগে পােষাক শিল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের কাপড় বুনন, পােষাক কার্টিং, সেলাই ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় কর্মকাণ্ডের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করলে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত অথবা সমবায় পদ্ধতিতে নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে পারবে।

 

        ৩। কারিগরি প্রশিক্ষণঃ আধুনিক ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি মেরামত, যানবাহন ড্রাইভিং ও মেরামতের ওয়ার্কশপ পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ চালু করলে শিক্ষার্থীরা বেকার সমস্যা লাঘবে সহায়তা করতে পারবে।

 

        ৪। পশু-পাখি পালনঃ হাস-মুরগী, গরু ছাগল ফার্মের পদ্ধতিতে লালন বর্তমানে একটি লাভজনক ব্যবসা। মাদ্রাসা ছাত্ররা এ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান পেলে এক্ষেত্রে ও পিছিয়ে থাকার কারণ নেই। 

 

        ৫। কৃষি উৎপাদনঃ এদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কিন্তু কৃষি পদ্ধতি সেই মান্ধাতা আমলের হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে এখনও আমরা পশ্চাৎপদ। আধুনিক কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি, বীজ, সার, জমির উর্বরতা, কীটনাশক প্রয়ােগ পদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান দান করতে পারলে শিক্ষার্থীরা নিজ পিতৃ জমি অথবা জমি বর্গা নিয়ে দেশে কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারে।

 

        ৬। ব্যবসা-বাণিজ্যঃ ব্যবসা-বাণিজ্য নবী (সাঃ)- এর সুন্নাত। দেশে বহু প্রকারের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত। এসব থেকে বাছাই করে ইসলাম সম্মত উপায়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ছাত্রদের প্রশিক্ষণ প্রদান করলে তারা স্বাবলম্বী হওয়ার সাথে সাথে একটি সুন্নাত ও পালন করতে পারবে।

 

        ৭। বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণাঃ কোন জাতির উন্নতির অন্যতম প্রধান শর্ত বিজ্ঞান চৰ্চা ও ব্যাপক গবেষণা কর্মকাণ্ড। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ বর্তমান পাশ্চাত্য জগত। এই সংঘাতপূর্ণ এবং যন্ত্রপাতি নির্ভর বিশ্বে মুসলিম জাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্য আমাদেরই সবচেয়ে বেশী বিজ্ঞান চর্চায় আত্মনিয়ােগ করা প্রয়ােজন। আল্লাহর এ ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ঘােষণাঃ “তােমরা কাফিরদের বিপক্ষে অনুরূপ প্রস্তুতি নিয়ে তাদের মােকাবিলা কর।” বর্তমান মুসলিম বিশ্ব প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও গবেষণা কর্মে পাশ্চাত্য থেকে অনেক পশ্চাৎপদ বলেই মুসলিম বিশ্ব পাশ্চাত্য নির্ভর। সুতরাং ইসলামী চেতনার পাশাপাশি ছাত্রদের বিজ্ঞান ও গবেষণা কর্মে নিয়ােজিত করতে হবে।

 

        ৮। মুদ্রণ ও সংবাদপত্র শিল্পঃ সাংবাদিকরা জাতির বিবেক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সৎ ও বিবেকবান মাদ্রাসা পড়ুয়াদের অনুপস্থিতির কুফল জাতি নিশ্চয় উপলব্ধি করছে। সুতরাং জাতিকে সুপথে চালিত করতে মুদ্রণ ও সংবাদপত্র শিল্পে নিজের অবস্থান সৃষ্টি করতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচী হাতে নেয়া জরুরী।

 

        ৯। প্রশাসনিক জ্ঞানঃ ছাত্রদের প্রচলিত প্রশাসনিক জ্ঞানের পাশাপাশি যুগােপযােগী ইসলামী প্রশাসনিক পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানদান করতে হবে। এর ফলে সাধারণ জনসাধারণকে উভয় প্রশাসন পদ্ধতির সুফল ও কুফল সম্পর্কে ধারণা দিয়ে প্রশাসনকে সুপথে আনা যেতে পারে।

 

        ১০। সাহিত্য চর্চাঃ জাতিকে সুপথ প্রদর্শনের জন্য একদল যােগ্য কবি-সাহিত্যিক, লেখকের প্রয়ােজন অপরিসীম। দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সত্যিকার ইসলামী চেতনার কবি-সাহিত্যিকের এদেশে খুবই অভাব। ফলে ভােগবাদী ও ঝড়বাদী সাহিত্য নামক আবর্জনার সয়লাবে জাতি ভেসে যাচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে। সুতরাং মাতৃভাষায় ব্যাপক সাহিত্য চর্চার ব্যবস্থা করে জাতিকে নিশ্চিত ধ্বংসের পথ থেকে ফেরানাে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

 

═──────────────═