মাওয়াযে থানুভী (রাঃ) থেকে নির্বাচিত কাহিনী
=======================================================================
চাকর ছেলের বুদ্ধিমত্তা
জনৈক জমিদার শুধু একাজের জন্য একজন লোক নিযুক্ত করে যে, জমিদার যদি কখনও অসংগতিপূর্ণ কোন কথা বলে ফেলে তবে সে তা সত্যে প্রতিপন্ন করার জন্য ব্যাখ্যা করবে। একদিন কথায় কথায় জমিদার বল্লেন, ‘আমরা একবার শিকারে গেলাম। একটি হরিণকে লক্ষ্য করে গুলী ছুড়লাম। গুলিটি হরিণের খুরা ভেদ করে মাথা চিরে চলে গেল।’ মজলিসের সবাই তার এ অসম্ভব কথা শুনে হাসতে থাকে, এক সাথে খুরা এবং মাথায় কিভাবে গুলী লাগতে পারে? জমিদারের চাকর ছেলেটি তখন দাড়িয়ে বলতে লাগলো, আপনারা হাসছেন কেন? আমার মনিব সত্যই বলেছেন। হরিণটি তখন খুরা দিয়ে কপাল খুটছিলো।
পাপ সর্বাবস্থায়-ই পাপ
আমি একবার কান্দালায় গেলাম। এশার পর মসজিদের উত্তর দিকের একটি কামরায় আমার শোয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হয়। এমন সময় মহল্লা থেকে নর্তকীদের গাণের আওয়াজ ভেসে আসলে আমি বললাম, না এ অবস্থায় এখানে থাকা যায় না। কোন নির্জন নিঞ্ঝাট জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। আমার সাথে একজন সূফী সাহেব ছিলেন, আমার পরিবর্তে ওই রাত্রে তিনি সেখানেই থাকলেন। সকালে তিনি বল্লেন, আজ রাতে আমি খুব ধীরস্থির ও মনোযোগের সাথেই নামায আদায় করেছি। মনের মধ্যে কোনো ভাবান্তর, সৃষ্টি হয়নি। আমি তার কথা শুনে বললাম, কোনো ধরণের খেয়াল না আসা তো ভালো কথা নয়। নামাযের সময় মনের মধ্যে আল্লাহর খেয়াল আসা উচিত ছিলো। বস্তুত গানের আওয়াজ মনের মধ্যে ওই রূপ অবস্থা সৃষ্টির ব্যাপারে প্রতিবন্ধক ছিলো। যা ক্ষতিকর বই কি।
উল্লেখ্য যে, তাই পাপের পথ বন্ধ করে পুণ্যের কাজে অগ্রসর হতে হয়। পাপ যদি কখনো ইবাদতের কারণও হয় তবে সে ইবাদতও পাপের মধ্যে গণ্য হয়।
এক ঘুম কাতুরের কাহিনী
মানুষ আল্লাহর এক আজব সৃষ্টি। সব মানুষের দৈহিক কাঠামো দেখতে প্রায় এক হলেও মন মানসিকতার দিক দিয়ে রয়েছে বিরাট পার্থক্য। বিচিত্র তার স্বভাব। অনেকের ঘুম খুব প্রিয়। একটু সময় পেলেই নিদ্রায় গা এলিয়ে দেয়। অঘোরে ঘুমাতে থাকে।
এক ব্যক্তি ছিলো দারুন ঘুম কাতুরে। একদিন সে সবার অজান্তে মাটির নীচের কামরায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। খাবারের সময় খোঁজ পড়লো, কিন্তু পাওয়া গেলো না। এদিক সেদিক তালাশ করার পর পরিবারের লোকেরা মনে করলো, হয়তো কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। ফিরে আসবে। সন্ধ্যা হয়ে গেলো, কিন্তু সে ফিরে এলো না। রাতের খাবারের সময় তালাশ করেও কোন খোঁজ পাওয়া গেলো না। এবার পরিবারের লোকদের টনক নড়লো। যেখানে যেখানে তার যাতায়াত ছিলো সব জায়গায় তালাশ করলো। কিন্তু কোন সংবাদ পাওয়া গেলো না। পরদিন জোরে সোরে তালাশ শুরু হলো। বিশ পঁচিশ মাইল দূরে দুরে যেখানে যাওয়ার ক্ষীণমাত্র সম্ভাবনা ছিলো সেখানেও লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিলো। কিন্তু তার কোন পাত্তা নেই। বাড়িতে কান্নার রোল উঠলো, কেঁদে কেঁদে সবাই ক্লান্ত। অবশেষে সবাই ভাবলো, হয়তো কোন বনে গিয়ে বাঘের কবলে পড়েছে বা কোন গর্তের গভীর পানিতে পরে ইহলোক ত্যাগ করেছে। কেঁদে কেটে সবাই থিতয়ে পড়েছে। তিন দিন পর তার ঘুম ভাঙে। সে সুস্থ্য শরীরে মাটির নিচের কামরা থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরে এসে শুনে যে, তাকে তালাশ করে সবাই অস্থির। তখন সে অত্যন্ত বিস্ময়াভিত হয়ে বললো, বাহ আমিতো মাটির নিচের কামরায় শুয়ে ছিলাম। এতে তোমরা এতোই পেরেশান হলে!
এমনি এক ঘটনা ঘটেছে ‘আটাওয়াহ্’ নামক স্থানে। সেখানে জনৈক সম্পদশালী ব্যক্তির নিকট আমার এক পরিচিত লোক থাকতো। ঘটনাটি সেই বর্নণা করেছে। একদিন সেই ধনী লোকটি রাতে নিরব এক স্থান ঘুমিয়ে পরে। স্থানটিতে প্রচুর মুক্ত বাতাস, কিন্তু দালানের ছাদ বেয়ে সেখানে পানি পরতো। ঘটনাক্রমে রাতে প্রবল বৃষ্টি হয় এবং ছাদের সব পানি তার গায়ের ওপর পরতে থাকে। সারা রাত তার উপর পানি পরলো, কিন্তু সে কোন দিশাই পেলো না। সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারলো যে, সারা রাত তার উপর পানি পরেছে। পানিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। বুঝ এবার ঘুম কাকে বলে।
আমি দেওবন্দে পাঠরত অবস্থায় ফয়েজ মোহাম্মদ নামে এক ছাত্র ছিলো। তার পিতা কোনো এক জমিদারের কর্মচারী ছিলেন। সে এতো বেশী ঘুমাতো যে, শত ডাক চিৎকার হট্টরগোল করলেও তার ঘুম ভাঙতো না। তার কানের কাছে বন্দুক এনে ফায়ার করলে তবে তার ঘুম ভাঙতো৷ তাই প্রত্যেক দিন জমিদারের পক্ষ থেকে তাকে জাগ্রত করার জন্য একবার কানের নিকট বন্দুকের ফায়ার করা হতো।
উল্লেখ্য যে, এ ধরণের ঘুম কাতুরে ব্যক্তিদের নিকট পৃথিবীতে সবকিছুর চেয়ে ঘুমই বেশী প্রিয়। মনে হয় তারা জান্নাতে গিয়েও আল্লাহর নিকট ঘুমেরই আবেদন করবে। কেননা জান্নাতে যা চাওয়া হবে তা-ই পাওয়া যাবে।
তাই ঘুম কাতুরেরা মনে হয় জান্নাতে গিয়ে ঘুমের আবেদন করবে। এব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের মাঝে বাহ্যিক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। কারণ, কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, অর্থ “আর সে মন যা চাবে তা পাবে।” আর হাদীসে আছে, “ঘুম মৃত্যুর সমতুল্য।” মৃত্যুর সমতুল্য।”
তবে এ কথা সত্য যে, জান্নাতে ঘুম থাকবে না। তাই এই আয়াতের মর্ম হলো, আল্লাহ সব বিষয়ে শক্তিমান। তিনি জান্নাতীদের মনে ঘুমের বাসনা জাগ্রত করবেন না। এর কারণ, ঘুম মূলত কোন পছন্দীয় ও প্রশংসিত বিষয় নয়। তবে দুনিয়াতে ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে। ঘুম মানব শরীরের সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। ঘুমের পর শরীর ঝরঝরে সুস্থ হয়ে উঠে। তাই মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়লে সব কিছু ফেলে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নেয়। তবে জান্নাতে যেহেতু কোন ক্লান্তি নেই তাই সেখানে ঘুমেরও কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকেই জান্নাতীদের মনে কখনও ঘুমানোর ইচ্ছা জাগ্রত হবে না।
সাহচর্যের প্রভাব
এক বুযুর্গের ছেলে মাদ্রাসায় পড়তো। একবার ওই বুযুর্গ ব্যক্তি তার ছেলের নিকট মাদ্রাসায় যান। ঘটনাক্রমে ছেলে তখন কামরায় ছিলো না। তার কামরায় তিনি একটি বাজারের তৈরী রুটি দেখতে পান। ছেলের আগমন প্রত্যাশায় তিনি কিছুক্ষন কামরায় বসে অপেক্ষা করেন। কিছুক্ষণ পর ছেলে এসে পিতাকে দেখে ছালাম দিলো, কিন্তু পিতা সালামের উত্তর দিলেন না। বল্লেন, তোমার সাথে কথা বলবো না। কারণ তুমি বাজারের তৈরী রুটি খাও। ছেলে বিনয়ের সাথে বললো, আব্বা! এ রুটিটি আমার নয়। এই কামরায় আরেক জন ছাত্র থাকে। এ রুটি তার। বুযুর্গ এবার বল্লেন, তাহলে তুমি এমন ছেলের সাহচর্যের থাক যে বাজারের তৈরী রুটি খায়? আর সাহচর্যের নিশ্চয় একটা প্রভাব আছে। সুতরাং তুমি আমার সাথে কথা বলার উপযুক্ত নও।
উলখ্য যে, এটা কোন শরয়ী হুকুম নয়। এর দ্বারা এমন কোন ফতুয়া দেয়া যায় না যে, বাজারের রুটি খাওয়া নাজায়েয। এটা হলো তার ব্যক্তিগত অভিরুচী। তবে তিনি তার কথায় এমন এক সূক্ষ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যা সাধারণ লোকের পক্ষে অনুধাবন করা খুবই কঠিন। কেননা বাজারের রুটি বিভিন্ন মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। ক্ষুধার্ত অনাহার ক্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা দেখে আক্ষেপ করে। দেখে খেতে না পেরে তারা হৃদয়ে বেদনা অনুভব করে। যাতে খাবারের বরকত চলে যায়৷ এ কারণেই বুযুর্গ বাজারের তৈরী রুটি খাওয়া পছন্দ করেননি। এরূপ সূক্ষ জ্ঞান ও অনুভূতি আল্লাহ ওয়ালাদের মাঝেই বর্তমান থাকে। সাধারণ লোকের মধ্যে এইরূপ রুচি ও অনুভূতি খুব কমই লক্ষ্য করা যায়।
[অনুবাদঃ ম. আ. মাহদী]
═──────────────═