JustPaste.it

মরণজয়ী মুজাহিদ

মল্লিক আহমাদ সরওয়ার

========================================================================

 

        আলী তিন দিন এ মারকাজে অবস্থান করে গারদেজ শহরের পূর্ন অবস্থা সম্পকে অবহিত হল, পথ ঘাটের বিবরণ নিয়ে চতুর্থ দিন গারদেজ শহরের দিকে রওয়ানা দিল। হানীফ খান যাওয়ার সময় তাকে বলল, এখনও তুমি ছােট, আবেগের বশবর্তী হয়ে সেখানে কোন কাজ করবে না, সব কাজে সুচিন্তিত ভাবে হাত দিবে। শহরে পৌছে আলী এক হােটেলে বসে চা পান করছিল। এমন সময় সে একটা পরিচিত চেহারা হােটেলে প্রবেশ করতে দেখল। চেহারাটা তারই গ্রামের নুর মােহাম্মদ নামের একটি যুবকের। সেও প্রথম দৃষ্টিতে আলীকে চিনতে পারল। আলী ও নুর মুহাম্মদ একই স্কুলের ছাত্র ছিল। তবে সে আলী থেকে ছয় বৎসরের বড়। উভয়ে দাড়িয়ে পরস্পর কোলাকুলী করল, তার পর হােটেলের এক কোনায় গিয়ে আসন গ্রহণ করল। নূর মুহাম্মদ আলীকে বল্লো, মনে করেছিলাম, গ্রামের অন্যান্য লােকদের ন্যায় তুমিও বুঝি শহীদ হয়ে গিয়েছ। এখন তােমাকে জীবিত দেখে আমার খুব খুশী লাগছে।

 

        আর আমাদের গ্রামের কম লােকই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পেরেছিল। মাঝে মাঝে একথা ভেবে আমার মনটা খুব বেদনাহত হয়ে উঠে যে, রুশ বাহিনী আফগানিস্তানে দখলদারী প্রতিষ্ঠার পূর্বে এদেশের পরিবেশ কত সুন্দর ছিল, ফলফলাদীর বৃক্ষ, আকাশচুম্বী পাহাড় পর্বত আর মিষ্টি পানির ঝর্নার মনােরম দৃশ্যে মন দুলে উঠত সীমাহীন আনন্দে। গ্রামবাসী তখন কত সুখে বাস করত, কত মমত্ববােধ ছিলাে পরস্পরে। সবাই সবার দুঃখে ব্যথিত হত। রােযার মাস আসত, ধুম ধামের সাথে রােযা আর ঈদ পালন করতাম। পাহাড়ের ওপর বর্ষাকালে যখন বৃষ্টি পড়ত তখন আমরা খেলতাম, লুটোপুটি খেতাম। আর বসন্ত কালে পাহাড়ের কোলে বন্য ফুলগুলো বাতাসে দুলত, সে দৃশ্য গুলি কতইনা মনমুগ্ধকর ছিল। কত আনন্দের ছিল সে দিনগুলাে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন কি হয়ে গেল, লন্ড ভন্ড হয়ে গেল সব। আনন্দের সে গুলিস্তান আজ বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে, ফুলকলিরাও আর পাহাড়ের কোলে ফুটে‌ না ............. কথা বলতে বলতে নুর মুহাম্মদ হঠাৎ চমকে উঠে নীচু গলায় বলল, “দোস্ত! ভাবাবেগে আমি তােমার কাছে যা বলে ফেলেছি তা যেন আর কেউ জানতে না পারে। আফগানিস্তান এখন আর মুক্ত স্বাধীন দেশ নয়, এসব আলােচনা করাটা সমিচীন নয়-একথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু দীর্ঘ ছয় বৎসর পর আমার গ্রামের লােকদের মধ্যে তােমার সাথেই প্রথম সাক্ষাত হল, তাই দিলের উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারিনি।”

 

        আলী বল্লোঃ আমার নিকট নির্ভয়ে কথা বলতে পার, আমি সরকারী গুপ্তচর নই। গ্রামে আক্রমণের পূর্বেই আমি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ি। বলতো ভাই নুর মুহাম্মদ, আমি চলে আসার পর আমার প্রিয় গ্রামের উপর কি দুর্যোগ গেছে? গ্রামবাসীদের একত্র করে তাদের উপর রুশ বাহিনীকে গুলি করতে দেখেছি। এরপর কি হয়েছে তা আর জানি না। নুর মুহাম্মাদ বলল, এ হােটেলটা নিরাপদ নয়। এর মালিক রুশী চর, চল অন্য কোথাও গিয়ে আলাপ করি। সে আলীকে নিয়ে অন্য এক হােটেলে ঢুকে এক কোনায় গিয়ে বসল, এরপর বলতে শুরু করল, রুশ বাহিনী ট্যাঙ্ক ও সাজোয়া গাড়ী নিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলে, অল্প লােকই তােমার ন্যায় ঘেরাওর পূর্বে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। বোমারু বিমানের হামলায় পুরো গ্রাম ধংসস্তুপে পরিণত হয়। এরপর রুশ বাহিনী ট্যাঙ্কের গােলা বর্ষণ করতে করতে এগিয়ে আসলে পুরুষরা অটল ভাবে তা প্রতিরােধ করে। ট্যাঙ্ক আর সাজোয়া যানের ভিতর থেকে, সৈন্যরা বের হলে আমরা গুলি করে কিছু সৈন্যকে জাহান্নামে পাঠাই, বাকিরা ভীত হয়ে আবার ট্যাঙ্কের ভিতর আশ্রয় নেয়, ধীরে ধীরে আমাদের গােলা বারুদ নিঃশেষ হয়ে গেল, রুশীরা এবার গ্রামের মেয়ে, পুরুষ ও শিশু সবাইকে বন্দী করে এক জায়গায় জমা করল, এরপর আহতদেরকে পৃথক করে মাটিতে ফেলে তাদের উপর ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিল। অন্যদেরকে ঝাঝরা করে দিল গুলী করে। আগুন ধরিয়ে সব লাশগুলি তার মধ্যে নিক্ষেপ করল।

 

        আমার আব্বার এক বন্ধু ছিল সেনা অফিসারদের মধ্যে, তাকে অনুরােধ করায় তিনি আমাদের ঘরটা পােড়ান থেকে বিরত থাকেন। উক্ত সেনা অফিসার আমাকে সাথে নিয়ে ইন্টেলিজেন্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। নুর মুহাম্মদ ইন্টেলিজেন্সের লােক একথায় আলী চৈতন্য হয়। নূর মুহাম্মদ কথা প্রসঙ্গে বলল, তুমি কোন ভয় কর না, আমি আজ পর্যন্ত নিরপরাধ ব্যক্তির ক্ষতি করিনি, আফগান সরকারী ইন্টেলিজেন্স জনগণের উপর কিরূপ অত্যাচার করে তা আমার জানা আছে, তবে আমার পক্ষ থেকে তােমার কোন ভয়ের কারণ নেই। আচ্ছা বলতাে, আজ কাল তুমি কি করছ, আর গরদেজেই বা কি উদ্দেশ্যে এসেছ?

 

        আলী এখানে তার আসার উদ্দেশ্য বলেই ফেলত, কিন্তু যখন জানতে পারল, নর মুহাম্মদ ইন্টেলিজেন্স এর লােক তখন সে নিজের ব্যাপারে কিছু বলাটা অনুচিত মনে করে বলল যে, আমি গারদেজ দেখতে এসেছি।

        নূর মুহাম্মাদ বলল, তুমি এতদিন কোথায়, কি করছিলে?

 

        আলী চিন্তায় পড়ে গেল যে, তাকে কি বলবে। একটা কারণ না বলে তো নয়, সত্য কথাটা প্রকাশ করা অসম্ভব আবার মিথ্যাও বলা যায় না। অনেক ভেবে চিন্তে সে বলল, নুর মুহাম্মদ ভাই, বয়সে আমার চেয়ে তুমি। বড় তাই এক জন গৃহহারা মানুষ কোথায় থাকে, কি করে তা তাে তােমার জানা আছে। পাহাড়ী অঞ্চল আর শহর বন্দর নিয়েই তাে আফগানিস্তান, আগে ঘুরে বেড়াতাম পাহাড়ে-পর্বতে, এখন এই শহরেই আছি।

 

        আলীর কথা শুনে নূর মুহাম্মদ হেসে বলল, আসল কথা তুমি বলতে চাইছ না, ঠিক আছে তােমার যা খুশী। তবে সব সময় আমার একথাটা স্মরণ রাখবে যে, শহরে অচেনা লােকদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখা হয়। তাই সতর্ক থেকো। তােমাকে আমার সাথেই নিয়ে যেতাম, কিন্তু তােমাকে সেখানে রাখার অনুমতি পাব না, আর সেখানে গেলে যে মিশন নিয়ে এসেছ সম্ভবতঃ তা সম্পূর্ণ করতে পারবে না।

 

        আলীর সন্দেহ হল, হয়ত আমার প্রােগ্রাম সম্পর্কে নুর মােহাম্মদ কিছু জানতে পেরেছে। অথবা আমাকে কথার পাঁচে ফেলে আসল বিষয় জেনে নিতে চাচ্ছে। আলী মনে মনে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিল যে, সে এর চেয়ে বেশী আর কিছু বলবে না। আলীকে তার সতর্ক থাকার কথা বলে নুর মুহাম্মদ বিদায় নিল।

 

যে হােটেলের ব্যাপারে নুর মুহাম্মদ বলেছিল যে, এর মালিক সরকারী চর এবং সেখানে গােয়েন্দা বিভাগের প্রচুর লােক আসা যাওয়া করে আলী সে হােটেলে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিল। আলীর ধারণা যে, আলাের নিচে অন্ধকার থাকে, তাই এ জায়গাটা আমার জন্য অধিক নিরাপদ!

 

        গারদেজ আসার পর আজ তৃতীয় দিন চলছে। যে ক’ব্যক্তির ব্যাপারে কমাণ্ডার তাকে বলেছিল যে, ওখানে তারা তােমার কাজে আসবে, তাদের কারো সাথেই সাক্ষাৎ হলাে না। সবার ঘরে তালা ঝুলানাে। তার কোথায় গেছে সে কথা কেউ জানেনা। শেষতক আলী ছাউনীতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, মেজর ফাইয়াজ সেখানে থাকলে সরাসরি তার সাথে যেন সাক্ষাৎ করা যায়। আলী ছাউনীতে মেজর ফাইয়াজ খান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সবাই বলল যে, অন্য ছাউনীতে তিনি বদলী হয়েছেন। কোথায় বদলী হয়েছে? কেউ এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। জিজ্ঞেস করতে করতে আলী কর্ণেল মুসার সাথে সাক্ষাত করল।

 

        কর্ণেল মুসা আলীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে এবং তাকে ডজন খানিক প্রশ্ন করে। কে তুমি? কোথা হতে এসেছ?মেজর ফাইয়াজের সাথে কি সম্পর্ক ইত্যাদি। মানসিক ভাবে আলী এসব প্রশ্নের জন্য প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল। তাই সে কোনরূপ বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়নি। তবে এখানেও একই উত্তর মিলল, তিনি বদলি হয়ে গেছেন। কোথায় বদলী হয়েছেন, একথা কর্ণেল মুসা বল্লো না। বল্লো যেহেতু যুদ্ধ চলছে তাই কোন সেক্টরে আছেন তা জানা নেই।

 

        ছাউনী হতেও আলী বিফল হয়ে ফিরে আসল। এখন শুধু এক ব্যক্তি বাকী আছে যার নিকট মেজর ফাইয়াজের সন্ধান মিলতে পারে। সে হল আব্দুল করীম। শেষ পর্যন্ত আলী আঃ করীমের ঘর তালাশ করতে বের হল, দরজার কড়া নাড়লে ভিতর হতে এক বৃদ্ধ মহিলার কণ্ঠ শুনা গেল, তুমি কে? সালাম দিয়ে আলী বলল, আম্মা! আমি আঃ করীমের সাথে দেখা করতে চাই। ভিতরে চলে আস বেটা। আমি ছাড়া এ ঘরে আর কেউ নেই। আলী ভিতরে ঢুকে পুনরায় সালাম দিল। মহিলার বয়স প্রায় ষাট বছর হবে, তিনিই আঃ করীমের মাতা। আঃ করীম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তার আম্মা বলল যে, দু'মাস হল সে ঘরে ফিরছে না। তার সব বন্ধু বান্ধবের নিকট আমি তার কথা জিজ্ঞেস করি, কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারেন না। ঘরের বাইরে কখনাে সে এত সময় কাটায়নি। জানি না

 

        ছেলে আমার কেমন আছে, তার আরাে ক'জন সাথীর কোন খবর নেই। আচ্ছা বেটা! তুমি কোথা থেকে এসেছ?

 

        আমি গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে তার সাথে সাক্ষাত করতে এসেছি। আলী তার কথা শেষ করার পূর্বে মহিলা বলল, বেটা, খানা খাওয়ার কথা তাে তােমাকে জিজ্ঞেস করিনি।

 

        তুমি বস, এখনি তােমার জন্য খানা নিয়ে আসছি একথা বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। পাশের ঘর থেকে আলী শুনতে পেল যে, মহিলা তার পড়শীকে বলছে, অন্য শহর থেকে আমার ছেলের এক বন্ধু এসেছে আমাকে কিছু টাকা ঋণ দাও। আঃ করীম আসলেই তােমাকে দিয়ে দিব।

 

        পড়শী অত্যন্ত বদ মেজাজী। সম্মান করার পরিবর্তে বলল, চাচী! তােমার ছেলে তাে আর ফিরে আসবে না, তাই তোমাকে অতিরিক্ত আর ঋণ দিতে পাব না, তোমার ছেলে ডাকাতদের সঙ্গী ছিল, সরকার তাকে বন্দী করে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।

 

        আঃ করীমের আম্মার অত্যন্ত গোস্বা হল, তারপর ও ধৈর্য্যের সাথে বললেন, বেটা! আমার ছেলে বহুত ভদ্র এবং পাচ ওয়াক্ত নামাযী, সে কখনাে ডাকাত হতে পারে না। দেখ, মেহমান ঘরে বসে আছে, তুমি আমার রূপার হারটা নিয়ে হলেও কিছু টাকা দাও। ছেলে আসলে টাকা দিয়ে হার ফিরিয়ে নিব। এখন আমার ছেলের মান সম্মানের প্রশ্ন, মেহমান কি ভাববে যে আঃ করীমের ঘরে গিয়েছিলাম কিন্তু তার মা খানা খাওয়ার    কথাও জিজ্ঞেস করল না। আঃ করীম লাপাত্তা হওয়ার পর তাে তার কোন বন্ধুও আসেনি। মানুষের কি হল যে, তারা কেউ বলে না, আমার ছেলে কোথায় আছে। বেটা হারটা নিয়ে কিছু টাকা ঋণ নাও। পড়শী বেপরােয়াভাবে বলল, না চাচী! তােমাকে দেয়ার মত আমার কাছে কিছু নেই। অন্য কোথাও চেষ্টা কর।

অনুবাদঃ আবু উসামা

 

═──────────────═