JustPaste.it

রুশ কয়েদীদের জবানবন্দীঃ আফগানিস্তানে আমরা কি দেখেছি?

মূল: সুলতান সিদ্দিকী

ড্রাইভারের কাহিনী

==============================================================

 

          উনিশ বছরের বুঝাকভ সবেমাত্র উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন। পিতার সাথে কৃষি খামারে চাকুরী নেয়াই ছিল তাঁর ইচ্ছা। কিন্তু তার সে আশা আর পূর্ণ হলো না। নিজ গ্রাম উকুয়া ত্যাগ করে তিনি তিরমিজ শহরের ফৌজী একাডেমীতে গিয়ে পৌছেন। আওরাল শহরের কুরগানের উপকণ্ঠে ছিল তাঁর বাড়ি। তাঁর পিতা এক কৃষি খামারে ট্রাক্টরের ড্রাইভার ছিলেন। তাঁর বৃদ্ধা মা সংসারের অন্যান্য কাজ আঞ্জাম দিতেন। ১৯৮২র জুন মাসে তিনি কুরগানের এক হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। দারিদ্রের কারণে উচ্চ শিক্ষার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কলেজে ভর্তি হতে পারেন নি। ১৯৮৩ সালে তাঁকে ফৌজী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়। মাত্র তিন মাসে তিনি ড্রাইভিং শিখে ফেলেন। ভারী ফৌজী গাড়ী চালানোর সাথে সাথে বন্দুক চালানোর দক্ষতাও তিনি অর্জন করেন।

 

 

অজানা মনজিল

-------------------------------------------------------------------------------------

 

           ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত করার পর বুঝাকভকে একটি ভারী ফৌজী হেলিকপ্টারে করে আজানার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই হেলিকপ্টারে তাঁর মত আরো ৩৬০ জন নওজোয়ান ছিল। হেলিকপ্টারটি আফগানিস্তানে পৌছার পর তাঁরা এর রহস্য বুঝতে পারে। তাঁদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য আগত সিনিয়ার সৈন্যদের থেকে জানতে পারে যে, তারা এখন আফগানিস্তানে অবস্থান করছে। তিন দিন পর বুঝাকভকে উত্তর প্রদেশগুলো থেকে তেল ভর্তি ট্যাংকার দক্ষিণাঞ্চলের কাবুল, বাগরাম ও গরদেজ ইত্যাদি স্থানে পৌছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। বুঝাকভ বলেন যে, তেল ও অন্যান্য জিনিস পত্র বহনকারী ট্রাকের হেফাজতের জন্য ট্যাংক ও সাজোয়া গাড়ীর খণ্ড খণ্ড কাফেলা সামনে পিছনে প্রহরারত থাকতো। তা সত্ত্বেও অদম্য সাহসী মুজাহিদরা সে সব ট্যাংকার গুলোর উপর হামলা চালাতো।

 

          এক সফরের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বুঝাকভ বলেন, তেলবাহী পঞ্চাশটি ট্যাংকার ও আটটি ট্যাংকের এক কাফেলা (যার মধ্যে আমার ট্যাংকারও ছিল) নিয়ে আমরা উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলের দিকে যাচ্ছিলাম। জালালাবাদ ছিল আমাদের গন্তব্যস্থল। জালালাবাদ থেকে কয়েক কিলো মিটার দূরে কাবুল-জালালাবাদ মহাসড়কে মুজাহিদরা আমাদের বহরের উপর প্রচণ্ড রকেট হামলা চালায়। তাঁদের ফায়ারিং এ ষোলটি ট্যাংকার ও চারটি ট্যাংকে আগুন ধরে যায়। আমার তেলের ট্যাংক চালনীর ন্যায় ঝাঝরা হয়ে যায়। ফলে ফোয়ারার ন্যায় তেল পড়তে শুরু করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তেলে আগুন ধরেনি। কমাণ্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্থ গাড়ি থামিয়ে দ্রুত সামনে অগ্রসর হই। আমি সামনে অগ্রসর হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে জালালাবাদ পৌঁছে যাই। তথায় পৌঁছে দেখি যে; আমার ট্যাংকার সম্পূর্ণ খালি, মুজাহিদদের হামলার ফলে সব তেল পড়ে গিয়েছে। গোটা গাড়ী চালনীর ন্যায় ঝাঝরা হয়ে গেলেও ভয়াবহ আগুনের হলকা থেকে রক্ষা পেয়ে আমি অক্ষত অবস্থায় বেঁচে যাই।

 

 

সাথীদের সাথে ঝগড়া

-------------------------------------------------------------------------------------

 

          রুশ বাহিনী থেকে পালিয়ে আসার মর্মস্পর্শী কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে বুঝাকভ বলেনঃ আমি এগার মাস যাবত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম। এর পর একটি ঘটনা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং রাশিয়ান ফৌজ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে মুজাহিদদের সাথে সম্পর্ক গড়তে উৎসাহিত হই। ঘটনাটি তাঁর জবানীতে শুনুনঃ “অবশেষে আমি তেল নিয়ে বাগরাম পৌঁছি। গাড়ী খালি করে পরিষ্কার করার জন্য সিনিয়র ড্রাইভারের সাথে নিকটবর্তী একটি নালায় নিয়ে যাই। কিন্তু নালার নিকট পৌছে আমার সাথীদ্বয় কেন যেন প্রথমে তাদের গাড়ী ধুয়ে দেয়ার জন্য আমাকে নির্দেশ দেয়। আমি এই অযৌক্তিক নির্দেশ মানতে অস্বীকার করায় তারা আমার উপর অতর্কিত ঝাপিয়ে পড়ে। আমি একা আর তাঁরা হলো দু'জন, বয়সেও তাঁরা আমার চেয়ে বড়। ফলে তাঁদের কিল, ঘুষি, আর লাথি খেয়ে আমি আহত হই। উপায়ন্তর না দেখে চরম উত্তেজিত হয়ে গাড়ীতে রাখা ক্লাশিনকভ রাইফেল নিয়ে তাঁদের প্রতি গুলি করি। এক পর্যায়ে একজন নিহত ও অপর জন মারাত্মক অবস্থায় মাটিতে তড়পাতে থাকে। এরপর আর বিলম্ব না করে কেউ এসে পড়ার আগেই ফৌজী ক্যাম্পের বিপরীত দিকে পালাতে শুরু করি। দীর্ঘক্ষণ দৌড়ানোর পর এক গ্রামে গিয়ে পেছি।

 

          তখন আমি এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ি যে, সামনে এক কদমও আর অগ্রসর হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্ষুধাপিপাসায় প্রাণ আমার তখন যায় যায়। বহু কষ্টে একটু সামনে অগ্রসর হওয়ার পর পাঁচ ছয় বছরের একটি বালকের দেখা পাই। আমাকে দেখে বালকটি ভয় পায়। আমি আলতো ভাবে তাঁর হাত ধরে ইশারায় তাকে বুঝালাম যে, আমি ক্ষুধাপিপাসায় কাতর। এবার তাঁর ভয় দূর হলো। আমাকে একটি গাছের নীচে বসতে বলে বালকটি দ্রুত ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর সেই সাহসী ছেলেটি কিছু রুটি ও পানি নিয়ে ফিরে আসে। পরম তৃপ্তির সাথে সেই রুটি ও পানি খাওয়ার পর হৃদয়বান ছেলেটি আমাকে তার বাড়ীতে মেহমান হতে বলে। কিন্তু আমি মেহমান না হয়ে সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকি। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি মুজাহিদদের এক ক্যাম্পে উপস্থিত হই। তথায় কমাণ্ডার মোমেন খান ও তাঁর গ্রুপের মুজাহিদদের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। আমার কাছে ক্লাশিনকভ ও কার্তুসের চারটি মেগাজিন ছিল। ওস্তাদ মোমেন খানের হাতে তা হস্তান্তর করে দেই। তিনি খুব খুশী হন। মুজাহিদরা বড় সহানুভূতির সাথে আমার জখমে পট্টি বেঁধে দেয়। কিছুদিন চিকিৎসা নেয়ার পর আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠি।

 

 

 

ভয়ের দিনগুলো

------------------------------------------------------------------

 

          প্রায় এক মাস মোমেন খানের সামরিক ঘাঁটিতে অবস্থান করার পর মুজাহিদরা আমাকে পাকতিয়ার স্বাধীন এলাকায় স্থানান্তরিত করার মনস্থ করে। মুজাহিদদের সাথে তাদের গাড়ীতে করে পাকতিয়া যাওয়ার সময় পথিমধ্যে রাশিয়ান জঙ্গী বিমানগুলো থেকে প্রচন্ড বোমাবাজী করতে দেখেছিলাম। আফগানিস্তানে রুশ বাহিনীর সাথে এগার মাসের অবস্থান সম্পর্কে মন্তব্য করে বুঝাকভ বলেনঃ “দিনগুলো ছিলো খুব ভীতিপ্রদ। ফৌজি অফিসার আমাকে বুঝাবার চেষ্টা করতো যে, সড়ক পথ বিলকুল নিরাপদ। ভয়ের কোন কারণ নেই। কিন্তু সব সময়ই কোথাও না কোথাও বন্দুকের আওয়াজ, ট্যাংক ফায়ারের গগণ বিদারী শব্দ শোনা যেত। আর আমরা গাড়িতে বসে ভয়ে জড়সড় হয়ে যেতাম।” বুঝাকভ আরোও বলেনঃ সিনিয়ার ড্রাইভাররা একবার যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেতে অস্বীকার করে বসে। কিন্তু পরক্ষণে কমাণ্ডার তাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার ভয় দেখালে তাঁরা ক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হয়। সেদিন তাঁরা সবাই ক্রোধ ও উত্তেজনার সাথে গাড়ি চালিয়েছিল। (চলবে)

 

 অনুবাদঃ নোমান আহমাদ