JustPaste.it

মুসলিম গণহত্যায় কাদিয়ানীদের কালো হাত

 

ফজলুল করীম যশোরী

==================================================

 

        ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যু বরণ করেছে এদেশের লক্ষ লক্ষ নিরিহ মানুষ, নিহত হয়েছে শত শত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী এবং নির্যাতিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ নারী। এ নির্যাতন ও গণহত্যা কোন বিচ্ছিন্ন তথা আকস্মিক ঘটনার ফলাফল নয় বরং এর পিছনে ছিল সুদূর প্রসারী সুপরিকল্পিত এক নীল নকসা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তথাকথিত আহমাদিয়া জামাত ভুক্ত কাদিয়ানী সদস্যরাই ঘটিয়েছিল এ নির্যাতন ও গণহত্যার সিংহভাগ। বাস্তব ইতিহাসের নিরীখে এ সত্য আজ দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট।

 

        তবে স্বাধীনতার দু’যুগ পরে এ সত্যটি উপলব্ধি ও উদঘাটন করতে হলে কিছু ঐতিহাসিক পটভূমির আলোকে ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। তাই আমরা কাদিয়ানী ষড়যন্ত্রের গোপন রহস্য তাদের বাংলাদেশী মুসলমানদের প্রতি আক্রোশ ও গণহত্যার কারণ সম্পর্কে কিছু তত্ত্ব ও তথ্য পেশ করছি।

 

        মূলতঃ জগৎ শেঠ, উমী চাঁদ ও মীর জাফররের ঔরষদ্ভত ইংরেজ মহারাণীর গর্ভজাত-অবৈধ টেষ্টটিউব সন্তান, এই কাদিয়ানী, আহমদীয়া গোষ্ঠী। প্রায় ৮শ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠি, সুযোগ সন্ধানী স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রের সহযোগিতায় ছলে বলে কৌশলে ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। তবে ১৭৫৭ সালের পলাশী ময়দানের যুদ্ধ নাটকের মাধ্যমে বাংলার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে এদেশের হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতা তাদের বিরুদ্ধে অবিরাম গতিতে চালিয়ে যায় সংগ্রাম ও প্রতিরোধ আন্দোলন। এমনকি ১৮৫৭ সালে এ আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা পরবর্তীতে তাদের ভাষায় ‘তথাকথিত সিপাহী বিদ্রোহ’ (?) নামে আখ্যায়িত হয়। এ দীর্ঘ সময়ে এদেশবাসীকে দমন করার লক্ষ্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে অত্যাচার ও নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালিয়ে যায়। এ সময় তারা ১৪ হাজার আলেমকে আগুনে পুড়িয়ে, ফাসীর কাষ্টে ঝুলিয়ে এবং লক্ষ্য তৌহিদী জনতাকে নির্মমভাবে শহীদ করে। অতঃপর দৃশ্যত তথা কথিত সিপাহী আন্দোলন ব্যর্থ।

 

        হলেও ইংরেজ জাতি বুঝতে পারলো যে, এভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে মুসলিম জাতিকে দমন করা মোটেই সম্ভব নয়। বরং এতে মুসলমানদের জেহাদী চেতনা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধিই পেতে থাকবে। এজন্য তারা মুসলিম জাতির অদৃশ্য শক্তির উৎস সন্ধান এবং তা নির্মূল করার পদ্ধতি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ১৮৬৯ সালে উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে একটি কমিশন বা প্রতিনিধি দলকে ভারতে প্রেরণ করে। উক্ত প্রতিনিধি দল প্রায় এক বছর যাবত ভারত বর্ষের, বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে, ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লাগাতার বিদ্রোহের জেহাদী প্রেরণার উৎস নির্ণয় এবং তা নির্মূল ও ধ্বংস করার উপায় সম্পর্কে একটি কার্যকরী রিপোর্ট তৈরি করে বৃটিশ সরকারের নিকট পেশ করে। রিপোর্টের বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপঃ “মুসলমানদের ধর্মীয় নেতারা বৃটিশ শাসিত ভারত বর্ষকে দারুল ‘হরব’ বা শক্রদেশ বলে ফতুয়া জারী করার ফলে, মুসলমানদের জন্য ইংরেজ জাতির বিরুদ্ধে জিহাদ করা “ফরজ” বলে গণ্য হয়। এমনকি মুসলমানরা বিভিন্ন ফের্কাবন্ধী থাকা সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে তারা ইস্পাতের ন্যায় সুদৃঢ় ও কঠিন। আর তাদের এ জাতীয় ঐক্যের অন্যতম মূল ভিত্তি হলো “খতমে নবুওয়তের বিশ্বাস।”

 

        তাই মুসলমানদের বৃহৎ ঐক্যে ফাটল ধরাতে হলে প্রথমতঃ “ডিভাইড এন্ড রুল”-এর পলিসি অবলম্বন করে। মুসলমানদের বিভিন্ন ফের্কার মধ্যে স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। এ কাজের জন্য শিয়া সম্প্রদায়কে কাজে লাগানো আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। অধিকন্তু খতমে বুয়তের বিশ্বাসের ফলে মুসলমানদের মধ্যে যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি নিহিত রয়েছে তাতে ফাঁটল ধরাতে হলে তাদের মধ্যে আমাদের আস্থাভাজন একজন ব্যক্তিকে নবীরূপে দাড় করাতে হবে। অতঃপর ধর্মজ্ঞানহীন মুসলমানদের মধ্যে তার নবুওয়ত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের প্রতি আমাদের সরকারের সর্বপ্রকার সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। এক সময় (তথাকথিত) নবীর মাধ্যমে ঘোষণা দেওয়াতে হবে যে, “আমার নিকট অহী নাজিল হয়েছে যে, ভারত বর্ষে বৃটিশ সরকার আল্লাহর রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।” এমনকি আল্লাহ পাক আমার নিকট আরো অহী নাজিল করেছেন যে, এখন থেকে (ইংরেজদের বিরুদ্ধে) জিহাদ করা হারাম বলে ঘোষণা দেওয়া হল।” এভাবে মুসলমানদের অন্তর থেকে জিহাদের প্রেরণা ও উম্মাদনা দূরীভূত করা সম্ভব হবে। অন্যথায় ভারতে আমাদের শাসনকাল দীর্ঘায়ীত করা সম্ভব নয়।

 

        হান্টার কমিশনের রিপোর্টে একথাও উল্লেখ ছিল যে, নবী সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় আমাদেরকে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যে লোকটিকে নবুওয়তের দাবিদার রূপে তৈরী করব তাকে। ওরিয়েন্টালিষ্টদের দ্বারা বিশেষ যত্নসহকারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং তাকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তার রচিত পুস্তকাদি প্রকাশের জন্য আমাদের সরকার তাকে গোপনে অতি কৌশলে অর্থের যোগান দিবে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ ও প্রচার বিভাগের সাহায্যে তার রচিত পুস্তকাদি মুসলমানদের সর্বমহলে প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিবে। এ সময় মুসলিম সমাজে তাকে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত করার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তাহল একদিকে আমাদের পোষ্য উগ্র হিন্দু, আর্য সমাজ ও খৃষ্টান মিশনারীগণ ইসলামের ওপর আক্রমণ করে বই পুস্তক লিখবে।

 

        অপর পক্ষে আমাদের ‘ওরিয়েন্টালিষ্ট’ বা প্রাচ্যবিদদের সাহায্যে প্রস্তাবিত ‘নবী’ হিন্দু পাদ্রীদের বই পুস্তকের উত্তরে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাবে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বই পুস্তক রচনা করে ব্যাপক ভাবে প্রচার করতে থাকবে; এতে মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বে। অতঃপর সে আধ্যাত্মিক পীর সেজে তার প্রতি আকৃষ্ট ভক্তদেরকে মুরীদ বানাতে থাকবে। মুরীদদের মন মস্তিষ্ককে সে এমন ভাবে গড়ে তুলবে যাতে তারা মুসলিম আলেম সমাজের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে ওঠে। তখন সে নিজেও আমাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী আলেমদের সমালোচনা মূলক বিভিন্ন পুস্তক-পুস্তিকা এবং প্রবন্ধ লিখে প্রচার করতে থাকবে। এমনিভাবে মুসলমানদের একটি উল্লেখ যোগ্য অংশ যখন তার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল ও ভক্তে পরিণত হবে তখন সে নিজেকে যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক বলে দাবি করবে। এ সময় সংস্কারের নামে সে এমন সব বক্তব্য প্রচার করবে যাতে তার ইমাম মেহেদী বলে দাবি করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এক সময় অনুকুল পরিস্থিতি বুঝে সে নিজেকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করে বসবে। ইমাম দাবী করার পর আবেগ প্রবণ মুসলমানরা হয়ত তার ওপর ক্ষেপে যেতে পারে এমনকি তাকে হত্যাও করতে পারে।

 

        তাই এ সময় তার হেফাজত ও নিরাপত্তার জন্য আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে সতর্ক থকার নির্দেশ দিতে হবে। ইত্যাবসরে ওরিয়েন্টালিষ্টরা তাকে নবুয়তী দাবির জন্য প্রস্তুত করে নেবে। একাজের জন্য তারা ইতিপূর্বে খতমে নবুওয়তের অপব্যাখ্যা ও নতুন নবী আগমনের লক্ষ্যে যে সব যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেছে ওসব প্রমাণাদী সংগ্রহ করে তার দাবীর সপক্ষে মজবুত প্রশিক্ষণ দেবে। তবে সে প্রথমেই সরাসরি নবী দাবী না করে পর্যায়ক্রমে জিল্পী নবী, বুরুজী নবী, উম্মতী নবী, শরীয়তী নবী ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হতে থাকবে। তারপর এক সময় পরিস্থিতি বুঝে সে নিজেকে শেষ নবী বলে দাবি করবে। অবশ্য তার এ দাবীকে প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণ যোগ্য করতে হলে সরাসরি বৃটিশ সরকারকেও যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে হবে। অর্থাৎ দাবী অনুযায়ী যারা তাকে নবী বলে স্বীকার করে তার দলভুক্ত হবে, তাদের সরকারী চাকরীসহ সর্ব প্রকার সুযোগ সুবিধার দ্বার খুলে দিতে হবে। এতে দেখা যাবে, ইংরেজী শিক্ষিতদের একটি অংশ এবং দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত সাধারণ মুসলমানরা চাকরী-বাকরী ও সুযোগ সুবিধার লোভে নিৰ্দ্ধিধায় তাকে নবী বলে মেনে নেবে।

 

        প্রতিনিধিদল আরো যুক্তি দেখালো যে, উক্ত নীল নক্সা অনুযায়ী আমরা যদি নতুন নবী সৃষ্টি করতে সক্ষম হই তবে এতে আমরা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উভয় দিক থেকে আশাতীত সফলতা লাভ করতে পারব।

 

        উইলিয়াম হান্টার রচিত ‘দি ইণ্ডিয়ান মুসলমান’ ও ১৮৭০ খৃঃ লণ্ডণে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের মুদ্রিত রিপোর্ট ‘দি এ্যারাইবের অব দি বৃটিশ ইম্পায়ার ইন ইন্ডিয়া’ থেকে উদ্ধৃত (কাদিয়ানী ধর্মমত পৃঃ-৫০-৫৫)

 

        হাসার কমিশনের উপরোক্ত রিপোর্ট ও সুপারিশক্রমে বৃটিশ সরকার ভারতে কার্যত গোয়েন্দা বিভাগকে মুসলমানদের মধ্য হতে একজন আজন্ম দালাল ও কুচক্রিকে নবুওয়তের মিথ্যা দাবীর জন্য প্রস্তুত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে তাকে নবী দাবীর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে নির্দেশ দেয়। সরকারের নির্দেশ ক্রমে বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগ ভামতবর্ষের যাবতীয় ফেত্নার সূতিকাগার পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জিলার কাদিয়ান নামক স্থানের গোলাম আহমদকে নির্বাচন করে। গোলাম আহমদ কাদিয়ানী ও তার পরিবারটি তৎকালে বৃটিশ সরকারের দালালী ও পদলেহনী সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। যার প্রমাণ স্বরূপ কাদিয়ানীর স্বরচিত বই পুস্তক থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হল।

 

        “আমার পিতা মরহুম গর্ভনরের দরবারে গেলে কুর্সি পেতেন। তিনি বৃটিশ সরকারের প্রকৃত কৃতজ্ঞ ও হিতাকাংখী ছিলেন।” (এজালায়ে আওহাস ১৫৭ পৃ)

 

        “এ অধমের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মির্যা গোলাম কাদের যত দিন জীবিত ছিলেন তিনিও পিতা মরহুমের পদাঙ্কনুসরণ করেছেন। তিনিও বৃটিশ সরকারের আন্তরিক খিদমতে মনে প্রাণে নিয়োজিত ছিলেন।” (শাহাদাতুল কুরআন পৃঃ ৮৪) 

 

        “ইংরেজ সরকারের পক্ষে আমি প্রায় পঞ্চাশ হাজার পুস্তক-পুস্তিকা ও বিজ্ঞাপন ছেপে এদেশে ও অন্যান্য দেশে প্রচার করেছি। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ জিহাদের নাপাক ধাবণ ত্যাগ করেছে। যা মূর্খ মোল্লাদের শিক্ষায় তাদের অন্তরে বদ্ধমূল ছিল। এ সমস্ত খিদমত আঞ্জাম দিতে পারায় আমি গর্বিত। বৃটিশ ইণ্ডিয়ার কোন মুসলমানই আমার খিদমতের নজির দেখাতে সক্ষম হবে না।” (সেতাবায়ে কায়সারাহ পৃঃ -৭)

 

        “আমি আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় বহু পুস্তক রচনা করে তাতে লিখেছি যে, অনুগ্রহ দাতা বৃটিশ গভর্ণমেন্টের সাথে জিহাদ কিছুতেই দূরস্ত নেই; বরং খাটি মনে ইংরেজ সরকারের আনুগত্য করা প্রত্যেক মুসলমানদের জন্যই ফরজ।”

 

        উপরোক্ত বর্ণনাগুলো কাদিয়ানীর স্বরচিত গ্রন্থ থেকে নেওয়া। সুতরাং বৃটিশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ যে নবী দাবীর জন্য কাদিয়ানীকে নির্বাচিত করেছিল তা বুঝতে আর বাকী থাকার কথা নয়। [ অসমাপ্ত ]

 

*****