JustPaste.it

ইসলামী জিহাদের মাইলফলক জঙ্গে মানজিকার্ট

-লেঃ, কর্ণেল, এম, এম, কোরায়শী

==============================================================

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

          রোমেনাস অবশ্যই একজন সাহসী এবং অভিজ্ঞ সেনানায়ক ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন উগ্র স্বভাবের। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি পদাতিক সেনাদের হেয়পতিপন্ন করে ভুল করেছেন, দুর্বল করে দিয়েছেন রোমান শক্তিকে। আর্মেনিয়া অঞ্চলের আখলাতেই ছিল সেলজুকদের সর্বশেষ ঘাঁটি। সেই ঘাঁটি দখল করার জন্য তিনি তাঁর পদাতিক সেনাদের সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্যই আর্মেনিয়া থেকে পদাতিক সেনাদের মানজিকার্ট ডেকে পাঠান। কিন্তু তাদের যুদ্ধের ময়দানে আসার পূর্বেই আলপ-আরসালান তার বাহিনীসহ রোমেনাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেবলমাত্র অশ্বারোহী বাহিনী নিয়েই রুমেনাস সেলজুকদের মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়।

          ঝানু দাবা খেলোয়াডরা যেমন চমৎকার নৈপুণ্য এবং পরিকল্পনা দিয়ে খেলতে বসে। রুমেনাস এবং আলপ-আরসালানও তেমনি অসম সাহসিকতা এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। কখন কিভাবে যুদ্ধ করতে হয় তারা তা জানতেন। তারা জানতেন পরস্পরের কলাকৌশল সমর্থ এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। দাবা খেলায় খেলোয়াড়ের ব্যক্তিত্ব যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তেমনি ভাবে যুদ্ধের ময়দানে অধিনায়কের উপর যুদ্ধের ফলাফল অনেকখানি নির্ভরশীল। রোমেনাস অন্যায় ভাবে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। সর্বোপরি সম্রাট কনষ্টানটাইনের বিধবা পত্নী কে বিয়ে করে রাজদণ্ড গ্রহণ ও কনষ্টানটাইনের নাবালক পুত্র মাইকেলের অভিভাবক এবং সহযোগী হিসেবে রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেন। রোমেনাস যেভাবে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন দেশে আরো অনেকের সেভাবে রাজদণ্ড গ্রহণ করার মত যোগ্যতা ছিল। ফলে অন্যান্য যোগ্য যুবরাজরা তাকে অবজ্ঞা এবং ঈর্ষার চোখে দেখতে শুরু করে। সে কারণেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরার জন্য প্রতিটি যুদ্ধে জয়লাভ করা তার জন্য জরুরী ছিল। রোমেনাস ভালভাবেই জানতেন যে যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারলে তার সুখঃ ও স্বপ্নে হয়তো নেমে আসবে বিপর্যয়। ফলে সিংহাসনে আরোহণ করার পর থেকেই তাঁকে অবিরাম সংঘর্ষ এবং যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় এবং যুদ্ধ বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই কেটে যায় তার তিনটি বছর।

          এ দিক থেকে বিবেচনা করলে আলপ-আরসালান এর অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তার এ ধরনের কোন দূশ্চিন্তা ছিল না। ইসলামের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। আব্বাসীয় খলিফা তার চাচা তঘরিলের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সূত্রেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেলজুকদের একটি সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কারণেই আব্বাসীয় খিলাফতের সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আলপ-আরসালান এত দ্রুত গতিতে মানজিকার্টের ময়দানে হাজির হন যে রোমেনাস তার পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হবার অবকাশ পায় নি। রোমেনাসের বিরুদ্ধে আলপ-আরসালান এর এটাই ছিল প্রথম বিজয়। তাছাড়া বড় রকমের বিজয় অর্জনের কোন পরিকল্পনা নিয়ে আলপ-আরসালান যুদ্ধের মাঠে আসেননি। আর্মেনিয়া সীমান্তকে অরক্ষিত রেখে উত্তর সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের দমন করা সম্ভব ছিল না তাই তিনি আর্মেনীয় সীমান্তকে বিপদ যুক্ত করার জন্য মানজিকার্টে ছুটে আসেন। যুদ্ধের ময়দানে এসেই তিনি শান্তির প্রস্তাব দিলেন কিন্তু রুমেনাসের চিন্তা-ভাবনা ছিল অন্যরকম। রাজধানী থেকে যুদ্ধযাত্রার সময় থেকেই তিনি অনেক উচ্চাবাচ্য করেন। নানাভাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে জাহির করার চেষ্টা করেন। নিজের মান সম্মানের খাতিরেই বড় রকম একটি বিজয় খুবই জরুরী ছিল। বিশেষ করে আলপ-আরসালান এর বাহিনীর সংখ্যা স্বল্পতা দেখে তার সেই আশা আরোও বেড়ে যায়। এ ধরনের একটি সহজ বিজয়কে তিনি কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাইলেন না। সুতরাং তিনি অত্যন্ত দাম্ভিকতার সঙ্গে আলপ-আরসালানের শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন।

          আপোষ প্রস্তাব বিফলে যাওয়ায় আলপ-আরসালান যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। সংখ্যার বিচারে তার বাহিনী ছোট হলেও সেলজুক অশ্বারোহী তীরন্দাজেরা ছিল ভিষণ চঞ্চল ও চতুর। তারা ঘোড়ায় চড়ে শত্রুর শিবিরে আক্রমণ চালায়, অবিরাম গতিতে তীর বৃষ্টি নিক্ষেপ করে এবং শত্রু সীমানার মধ্যে না গিয়ে পরক্ষণেই নিরাপদ দূরত্বে সরে আসে। রোমান বাহিনীতে বেসিলে সিয়াছ নামের একজন গভর্নর ছিল। সেলজুক তীরন্দাজের এ ধরনের আক্রমণের জন্য তিনি ভীষণ ভাবে উত্তেজিত হন। তড়িঘড়ি করে একটি বাহিনী গঠন করে সে তুর্কিদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়, দ্রুত গতিত সম্পন্ন সেলজুক অশ্বারোহীরা পেছনের দিকে সরে যায়। ভারী রোমান অশ্বারোহীরা তবুও থামল না, তারাও তুর্কিদের পিছু ধাওয়া করে এভাবে এমাইল কয়েক যাওয়ার পর হঠাৎ করেই বিসিলে সিয়াছ দেখতে পেল যে অশ্বারোহী তীরন্দাজরা ছুড়ছেনা, নড়ছে না, তারা নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। ছুটোছুটি কমিয়ে দিয়ে সে অশ্বারোহী সেনাদের গুছিয়ে নিল। তৈরি হলো চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য। বিসিলে সিয়াছ এবং তার বাহিনীর যেন আর বিলম্ব সইছিল না। তাদের যেন কি এক উন্মাদনায় পেয়ে বসলো। আক্রমণের জন্য তারাও ওঁৎ পেতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সবকিছু উলট-পালট হয়ে যায়। চারদিক থেকে রোমান অশ্বারোহীদের উপর তীর বৃষ্টি শুরু হয়। তীরগুলো যেন নির্দয়ভাবে বেঁচে বেঁচে অশ্বারোহীদের গায়ে বিধতে থাকে।

          সম্রাট রোমেনাস সহজেই বেসিলে সিয়াছ এর অবস্থা অনুধাবন করতে পারেন। বিলম্ব না করে তাকে সাহায্য করার জন্য একটি উদ্ধারকারী দল পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ততক্ষণে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তারা গিয়ে দেখে যে রোমানরা সেখানেও ওঁৎ পেতে বসে ছিল তাই একটা শবশয্যায় পরিণত হয়েছে। মৃত গোড়া এবং নিহত সৈনিকেরা এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এমনকি উদ্ধারকারী দলও অব্যাহতি পেল না। তারাও সেলজুকদের আক্রমণের শিকার হলো। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি শিকার করে ফিরে আসতে হলো মূল ঘাঁটিতে। এটা ছিল মানজিকার্টের যুদ্ধের আলপ-আরসালান এর দ্বিতীয় বিজয়।

          পরদিন পত্যুষে রোমেনাস তার বাহিনীকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে সাজালেন। বাহিনীর পশ্চাদ্ভাগের সাথে সেনা ছাউনির নিবিড় সংযোগ রাখার ব্যবস্থা রাখলেন। কেপাডোসিয়ান আর্মেনিয়ান এবং চার্চিনিয়ানস এর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল রোমান বাহিনীর দক্ষিণ প্রান্ত। বাম প্রান্তে ছিল ইউরোপীয় সেনারা মধ্যভাগে ছিল তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং রাজধানী অঞ্চলের সৈনিকেরা। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিলেন রোমেনাস নিজে। পশ্চাদ্ভাগে ছিল অর্থলোভী বেতনভোগী জার্মান ও নরম্যান সৈনিকেরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পূর্ব সীমান্তে অতিরিক্ত সেনারা। ডিউকাসকে নিয়োগ করা হলো এই বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে। বলাবাহুল্য একজন যোগ্য সেরা নায়ক হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।

          তুর্কি অশ্বারোহী বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে বিরাট একটি অর্ধচন্দ্রের আকারে অবস্থান নিল। সুলতান আলপ- আরসালান দাঁড়ালেন সবার মাঝখানে সেলজুকদের যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে তারা রোমান সেনাদের বিভিন্ন স্থানের উপর অবিরাম তীর ছুটতে শুরু করে। শত্রু সেনারা খুবই সংশয়ের মধ্যে পড়ে যায়। একটি সুযোগের জন্য তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু আক্রমণের জন্য তেমন কোনো সুযোগ তারা ফেলো না। আসলে রোমান বাহিনীতে হালকা অশ্বারোহী এবং খণ্ডযুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত সৈন্য ছিল না, ফলে সেলজুকরা একতরফাভাবে তিরি বৃষ্টি অব্যাহত রাখল। অত্যন্ত নির্মম এবং অসহায় ভাবে মারা গেল রোমান সৈনিকেরা নিহত হল তাদের ঘোড়াগুলো। রোমেনাস এবং তার বাহিনী দীর্ঘসময় ধরে এই সময়ের যুদ্ধ অবলোকন করলো। বুঝল যে এভাবে সেলজুকদের মুকাবিলা করা অসম্ভব, এটা অসহ্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। রোমেনাস গোটা বাহিনীকে সম্যুক হওয়ার নির্দেশ দিলেন। রোমানদের গতিবিধি সম্পর্কে তুর্কিরাও ছিল সচেতন। রোমানদের এগিয়ে আসতে দেখেই তুর্কিরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এবং শৃঙ্খলার সাথে পেছনের দিকে সরে যায়। কিন্তু তারা তীর বৃষ্টি অব্যাহত রাখে এবং রোমান বাহিনীর প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। তারা রোমানদের ভারি অশ্বারোহীর কখনো পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো কাছাকাছি আসতে দেয়নি আবার নিজেরাও এতটা পেছনে সরে যায়নি যাতে করে রোমান বাহিনী তাদের আক্রমণ সীমার বাইরে চলে যায়। এমনি সন্ধিগ্ধ এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সুসজ্জিত এবং নিপুন দুটি বাহিনী সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এগিয়ে যায় মানজিকার্টের বিশাল বিস্তৃত সমতল ভূমির দিকে। রোমানদের ভারী অশ্বারোহীরা এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। পিপিসায় গলা শুকিয়ে আসে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তারা অগ্রযাত্রায় বিরতি দেয়, গোড়া থেকে নেমে আসে এবং সেনাছাউনিতে ফিরে যাওয়ার পথ ধরে।

          রোমানরা পশ্চাদপসরণ শুরু করার সাথে সাথেই তাদের উপর নেমে আসে চরম বিপর্যয়। সারাদিন ব্যাপী এই বিপর্যয় যেন তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল যে অশ্বারোহী তীরন্দাজরা এতক্ষণ পেছনের দিকে সরে যাচ্ছিল এবার তারা শক্ত হয়ে দাড়ায়। অবিরাম তীর বর্ষণ করে রোমানদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সম্ভবত রোমানদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। একই সময় তিনি সমস্ত যোদ্ধাদেরকে যুদ্ধের ময়দান থেকে প্রত্যাহার করাতে পারেননি। মধ্যভাগের সেনাদের কাছে সর্বপ্রথম সেনাছাউনিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পৌঁছে এবং তদনুসারে তারা প্রত্যাহারের কাজ শুরু করে। প্রান্তভাগ এবং পশ্চাদ্ভাগের সেনাদের কাছে রুমেনাসের নির্দেশ অনেক পরে পৌঁছে। ফলে শুরুতে তারা মধ্যভাগের সেনাদের গতিবিধি বুঝে উঠতে পারেনি। যখন তারা রোমানাসের এই সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারে তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে এবং খুবই এলোমেলো এবং বিশৃঙ্খলা ভাবে তারা যাত্রা শুরু করে।

          তুর্কিরা সুযোগের সন্ধানে ছিলো। সেনাবাহিনীর আগে-পিছে প্রত্যাবর্তনের কাজ শুরু করার কারণে বিভিন্ন ধরনের মধ্যে বেশ ফাঁক সৃষ্টি হয়। তুর্কি তীরন্দাজরা অতর্কিত এই দুর্বল স্থানে আঘাত হানে রোমানরা এবার মস্ত বড় সংকটের মধ্যে পড়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে রোমান্স তুর্কি তীরন্দাজদের এই অতর্কিত হামলা প্রতিহত করার নির্দেশ দেন।

          ইতিমধ্যে অবস্থানগতভাবে রোমান বাহিনীতে বড় বড় রকমের গরমিল দেখা দিয়েছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রত্যাবর্তনের কাজ আরও পিছে শুরু হওয়ার কারণে ডিউকাসের নেতৃত্বাধীন পশ্চাদ্ভাগ যাদের সবার আগে শিবিরে পৌঁছার কথা, তারা পড়ে যায় সবার পিছনে। আবার মূল অগ্রবর্তী বাহিনী, যাদের সবার পরে শিবিরের পৌঁছার কথা, তারা চলে যায় সবার সামনে। প্রত্যাবর্তনের পথে নতুন করে তুর্কিদের মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেয়ার ডিউকাসের নেতৃত্বাধীন বাহিনী এবার অগ্রবর্তী বাহিনীর অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু তুর্কিদের মোকাবেলার খবর সময় মত তার কাছে পৌছায়নি। ফলে ডিউকাস যেভাবে শিবিরের দিকে ফিরে যাচ্ছিল এখনো সেভাবে প্রত্যাবর্তন করতে থাকে।

          এভাবে ডিউকাসের প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গ নিয়ে বহু তর্কের সৃষ্টি হয়। রোমান ঐতিহাসিকদের মতে এটা ছিল ডিউকাসের বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ণ আচরণ এবং জেনে শুনেই সে এমনটি করেছিল। আসলে কি রোমান ঐতিহাসিকদের এই অভিযোগকে সত্য বলে ধরে নেয়া যায়!? নাকি ডিউকাসের কাছে সময় মত সিদ্ধান্তের খবর না পৌছার কারণেই এমনটি হয়েছিল!? সম্ভবত শেষোক্ত অনুমানটি সত্য। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে রোমানদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল এবং অনুন্নত। শিবিরে প্রত্যাবর্তনকালে রোমান বাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা এবং গড়মিল দেখা দিয়েছিল তা থেকেই রোমানদের এই দূর্বলতার নজির মিলে। সকল অধিনায়কের সময়মতো সিদ্ধান্তের কথা জানাতে না পারার কারণে রুমেনাস মুল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। অগ্রবর্তী বা পশ্চাতবর্তী দল বলে কিছু থাকলোনা। তুর্কি সেনারাও এই যুগের সদ্ব্যবহার করল। অতর্কিতে তারা রোমান বাহিনীর প্রান্তভাগের মধ্যে ঢুকে পড়ে। পেছনদিক থেকে আক্রমণ করে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে রোমান সেনাদেরকে। বামপ্রান্তের সেনাদের কাছেও তুর্কিদের মোকাবেলা করার সংবাদ যথাসময়ে পৌঁছায়নি। ফলে তারাও প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেল না। তারা মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবুও তারা এককভাবে তুর্কিদের মোকাবেলা করল। কিন্তু তাদের সেই প্রয়াস বিফলে গেল, অল্পতেই হার মানলো তুর্কিদের কাছে। তুর্কিরা যুদ্ধের ময়দান থেকে তাদেরকে তাড়িয়ে দিল। অনুরূপভাবে তুর্কিরা রোমান বাহিনীর ডান প্রান্তের সৈন্যদেরকেও তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলল এবং নির্মূল করে দিল সম্পূর্ণভাবে। তুর্কি সেনারা এবার রোমান বাহিনীর মধ্যভাগের উপর দৃষ্টিদিল। রোমেনাস নিজে এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তুর্কিরা চারদিক থেকে এই দলকে গিরি ফেলছিল রোমেনাসের নেতৃত্বে তারা যে প্রতিরোধটুকু গড়ে তুলেছিল তুর্কিদের দুর্বার আক্রমণের মুখে তাও ভেঙেচুরে খান খান হয়ে গেল।

          তুর্কিদের হাতে হতাহত হয় অনেক সেনাপতি। রোমেনাসের ঘোড়াটিও নিহত হলো। তিনি নিজে আহত হন বন্দি হলেন তুর্কিদের হাতে। বন্দি হলো আরোও অনেক। রোমেনাসের নেতৃত্বাধীন মধ্যভাগের একটি লোকও পালিয়ে যেতে পারল না, হয় তারা তুর্কিদের হাতে বন্দি হল, নয়তো মারা গেল তলোয়ারের নিষ্ঠুর আঘাতে। অল্পসময়ের মধ্যে মানজিকার্টের ময়দান দিয়ে বয়ে গেল রক্তের বন্যা। এমনি করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে ভারী অশ্বারোহীর তীরন্দাজদের মধ্যকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটল। পর্যুদস্ত হলো রোমানাসের শক্তিশালী রোমান বাহিনী। চূড়ান্ত যুদ্ধের এই দিনটি ছিল ১০৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ আগস্ট।