আমরা যাদের উত্তরসূরী
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালী রহ.
আসাদ মাহমুদ
========================================================================
জগৎ বিখ্যাত দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক সাধক ইমাম গাজালী (রাহঃ) তৎকালীন খােরাসান প্রদেশের তুস নামক জেলার তাহেরান শহরে ৪৫০ হিঃ মােতাবেক ১০৫৮ খৃঃ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম আবু হামেদ মুহাম্মদ। উপাধি হুজ্জাতুল ইসলাম - তবে ইমাম গাজ্জালী নামে তিনি প্রসিদ্ধ। এ শব্দটি দু'টি য সমেত গাযযালী না একটি ‘য’ দিয়ে গাযালী তা নিয়ে এ যাবত বহু বিতর্ক হয়েছে। তন্মধ্যে বর্তমান শতাব্দীর বিশিষ্ট দার্শনিক ও ঐতিহাসিক শিবলী নুমানীর গবেষণালব্ধ অভিমতটিই সমধিক প্রণিধানযােগ্য, তিনি এই সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন যে, তার পূর্ব পুরুষ গাযাল অর্থাৎ সুতা পাকানাের ব্যবসা করতেন, সেমতে শব্দটি হবে গাযালী।
শিক্ষাঃ তাঁর পিতা শিক্ষার অমূল্য সম্পদ হতে বঞ্চিত হয়ে আজীবন অনুশােচনায় দগ্ধ হন, তাই মৃত্যুর সময় এক সুহৃদ বন্ধুর হাতে ইমাম সাহেব ও তার ভাই আহমদ কে অর্পন করে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করার জন্য ওছিয়ত করে বলেন যে, আমার একান্ত বাসনা এরা জগদ্বিখ্যাত বিদ্যান হােক, তার সঙ্গে কিছু অর্থও তার হাতে তুলে দেন। পিতার এ বাসনার ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় সময়ে এ সন্তানদ্বয় জগদ্বিখ্যাত বিদ্যান ও যুগান্তকারী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ওছিয়ত অনুযায়ী উক্ত বন্ধু ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রাথমিক শিক্ষা নিজ হাতে সমাপ্ত করিয়ে তুস নগরীর এক অবৈতনিক মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। এ মাদ্রাসায় যুগবিখ্যাত ফকীহ ইমাম আহমদ বিন মুহাম্মদ রাজকানির সাহচর্যে কুরআন হেফজ করে ফেকাহর প্রাথমিক গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেন, জ্ঞানের এ সামান্য ছোঁয়া ইমাম গাজালীর পিপাসাকে যেন উথলে দিল, তাই জ্ঞানের বিশাল সাগর মন্থন করে। অজানাকে জানার বাসনা নিয়ে তিনি জুরজান শহরে ইমাম আবু নসর ইসমাঈলের নিকট জ্ঞানার্জনে ব্রতী হন। এ মাদ্রাসা হতে তিনি নিশাপূর অবস্থিত নিজামিয়া মাদ্রাসায় যান এবং মাদ্রাসার প্রধান উস্তাদ ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আব্দুল মালিক আল জুওয়াইনীর তত্ত্বাবধানে সাধনা করে উন্নীত হন জ্ঞানের শিখর চূড়ায়। ইমামুল হারামাইন কর্তৃক প্রশংসিত তার তিনজন ছাত্রের মধ্যে ইমাম গাযালী ছিলেন অন্যতম। ইমামুল হারামাইনের জীবিত কালেই তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করে তাঁর অশেষ দুয়া লাভ করেন।
কর্মজীবনঃ ইমামুল হারামাইনের মৃত্যুর পর তিনি অত্যন্ত শােকাহত হয়ে পড়েন এবং নিশাপুর ছেড়ে বাগদাদ চলে আসেন। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রী নিযামুল মুলক তার জ্ঞান ও পান্ডিত্যের খ্যাতিতে আগেই মুগ্ধ ছিলেন। তখন বাগদাদের মাদ্রাসায়ে নিযামিয়ার প্রধান উস্তাদের পদ শূন্য হয়ে পড়ায় নিযামুল মুলক তাঁকে এ দায়িত্ব গ্রহনের অনুরােধ জানান। ইমাম সাহেবের যােগ্যতা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বড় বড় বিদ্যানদের সাথে তার বিতর্কের ব্যবস্থা করা হয়, ইমাম সাহেব বিতর্কে জয়ী হয়ে প্রধান উস্তাদের পদ অলংকৃত করেন। এসময় তার বয়স ছিল ৩৪ বৎসর। অল্প বয়সে এ মহা সৌভাগ্যলাভের কারণে সবাই তার নিকট জ্ঞানাহরণের জন্য উৎসুক থাকত। এমনকি রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় সকল বিষয়ে প্রশাসন ও তার সুচিন্তিত পরামর্শ গ্রহণ করত।
দেশ ভ্রমন ও আধ্যাত্মিক সাধনাঃ ঐ যুগে গ্রীক, রােমান, আস্তিকতা, নাস্তিকতা, খৃষ্টবাদ, শিয়া ইত্যাদি বহু মতবাদ মুসলিম মানসে অনুপ্রবেশ করে। যার ফলে ইসলামী আকীদা ও বিশ্বাসের প্রকৃত রূপ হাজারাে মতবাদের সাথে মিশ্রিত হয়ে পড়ে। আর এ সব মতবাদের ফলে মুসলমানদের মাঝে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হয়। ইমাম সাহেবও বহু মতবাদের এ ধূম্রজালে আটকা পড়ে যান। প্রত্যেক মতবাদের চিন্তাধারা সম্পর্কে তিনি অবগতি লাভ করতে থাকেন। এর ফলে ইমাম সাহেবের চিন্তাধারায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং তার ধর্মীয় বিশ্বাসে শিথীলতা দেখা দেয়। ইমাম সাহেব বলেন, এমন মনে হচ্ছিল যেন আমি নাস্তিক হয়ে যাব। যাক শেষ পর্যন্ত তাছাউফ তথা আত্মশুদ্ধির মহান সাধক হযরত জোনায়েদ, শিবলী ও বােস্তামী প্রমুখ বুযুর্গদের কিতাব পাঠ করে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হই যে, আসলে দ্বীনের ভিত্তি হল ঈমানের সাথে সাথে আমলের অভ্যাস গড়ে তােলা এবং সে জন্য প্রয়ােজন বহু সাধনার। আমি আমার জীবনের দিকে লক্ষ্য করে অনুভব করি তাতে কিছু ত্রুটি ও ইখলাসের অভাব বিদ্যমান। এসব চিন্তা ভাবনা ও সন্দেহের মধ্যে ছয় মাস গত হয়, এরপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে দেশ ভ্রমন ও আধ্যাত্ম সাধনায় লিপ্ত হব। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪৮৮ হিঃ রজব মাঝে অতি গােপনে তিনি বাগদাদ ছেড়ে সিরিয়া পৌছেন। এ ভ্রমণকালে বিলাসিতার সব উপকরণ পরিত্যাগ করেন। দামী পাতলা কাপড়ের পরিবর্তে মােটা কম্বল পরিধান করলেন, সুস্বাদু খাদ্য ছেড়ে মামুলী খানায় প্রয়ােজন সারতেন। সিরিয়ায় দু'বছর যিকির ফিকির ও মুরাকাবায় লিপ্ত থেকে বাইতুল মাকদাস গমন করেন এবং ঈসা (আঃ) এর জন্মভুমি পরিদর্শন করেন। এখানে সাধনায় ব্রত হন। সুযােগ পেলে মাঝে মধ্যে শিক্ষা প্রদানেও লিপ্ত হতেন। হিঃ ৪৯৯ সনে বাইতুল মাকদাস থেকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর মাযার যেয়ারতের উদ্দেশ্যে হেবরনে উপস্থিত হন। এখানে ইমাম সাহেব তিনটি প্রতিজ্ঞা করেনঃ
(১) কোন বাদশাহের দরবারে যাব না।
(২) কোন তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হবনা।
(৩) কোন বাদশাহর উপঢৌকন নিবনা।
কিছুদিন পর হেব্রন থেকে হজ্জ উপলক্ষে মক্কা ও মদীনায় যান। বেশ কিছু দিন মক্কা মদীনায় থাকার পর মিসর ভ্রমন করেন। মিসর থাকাকালীন ইমাম সাহেব মরক্কোর ন্যায় পরায়ন বাদশাহ ইউসুফ বিন তাশফীনের সাথে সাক্ষাতের নিয়ত করেন, কিন্তু আমীর ইউসুফের মৃত্যু হওয়াতে এ আশা আর পূরণ হয়নি।
ভ্রমন ও সাধানার এ দীর্ঘ সাগর পাড়ী দেয়ার পর ইমাম সাহেবের হৃদয়ে পূঞ্জীভূত সব সন্দেহ বিদূরিত হল, জ্ঞানের আরেক নতুন অধ্যায় আল্লাহ পাক তার সামনে খুলে দিলেন। সুমলিম উম্মাহর আকীদা ও বিশ্বাসের ভ্রান্তির সমস্যাগুলো তার নিকট সুস্পষ্ট ভাবে ধরা পড়ল এবং সেগুলাের প্রকৃত সমাধানও তিনি খুঁজে পেলেন; আকীদা-বিশ্বাস ও দ্বীনের ব্যপারে মুসলিম উম্মাহর এ অধঃপতন দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন।
এ সময়ে কাশফ ও স্বপ্ন যােগে, অতীত বহু বুযুর্গ, তাকে নির্জনতা ছেড়ে মুসলিম উম্মাহর পথ প্রদর্শনে আত্মনিয়ােগের নির্দেশ দেন। এবার বাড়ি ফিরে এলেন, ঐশীজ্ঞান, কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত যুক্তির আলােকে গ্রন্থ রচনা, শিক্ষা-দীক্ষা, উপদেশ দানে নিমগ্ন হলেন। তার তত্ত্বপূর্ন লিখনি ও বক্তৃতায় ভ্রান্তি ও সন্দেহের সব আবর্জনা অপসারিত হল, অনৈক্যের কুঞ্চ রেখা মুছে দিয়ে জাতিকে বাতলে দিলেন ঐক্যের সরল পথ। তথাপি তার এ সংস্কার প্রাথমিক পর্যায়ে সমালােচনার সম্মুখীন হয়, তবে আস্তে আস্তে এসব সমস্যাও দূর হল, তৎকালীন উলামায়ে কেরাম তার এ সংস্কারকে স্বাগত জানালেন! নির্জনবাস হতে ফিরে এসে পুনরায় ৪৯৯ হিঃ বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যপনা করেন। কিছুদিন পর সেখানে থেকে তুস শহরে এক মাদ্রাসায় যোগ দেন এবং বাকি জীবন সেখানেই কাটিয়ে দেন। অবশেষে ৫০৫ হিঃ মােতাবেক ১১১১ খৃঃ ৫০ বৎসর বয়সে মুসলিম উম্মাহর এ মহান সংস্কারক পরপারে যাত্রা করেন। মৃত্যুর দিন সকালে ফজরের নামাজের পর তিনি কাফনের কাপড় হাতে নিয়ে বলেন, রবের আদেশ শিরােধার্য্য, একথা বলে শয়ন পূর্বক শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
রচনাঃ তার রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ৪০০, তম্মধ্যে তাফসীরের ইয়াকুতুত্তাবলীগ (৫০ খন্ড), এহইয়াই উলুমুদ্দীন, মিনহাজুল আবেদীন, কিমিয়ায় সাআদাত, তুহুফাতুল ফালাসিফা ইত্যাদি সুপ্রসিদ্ধ।
═──────────────═