আমরা যাদের উত্তরসূরী
হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত কাশেম নানুতবী (রহঃ)
আমীনুল ইসলাম ইস্-মতী
========================================================================
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখনই যেখানে ঈমানের প্রবল বাতাস বয়েছে, আকীদা, আমল ও আখলাক - এই তিন শাখাতেই তখনই বিস্ময়কর ঘটনাবলী বরং আশ্চর্য ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। শৌর্য ও বীর্য সুদূড় বিশ্বাস ও প্রত্যয়, সাধুতা ও আমানতদারী, আত্মত্যাগ ও আত্মহনন, সহমর্মিতাবোধ ও সেবামূলক প্রেরণা, ঈমান ও আত্মজিজ্ঞাসা, বহ্যিক সাজ - সজ্জা ও সৌন্দর্যের প্রতি নির্লিপ্ততা, আত্মবিশ্বাস ও উচ্চ দৃষ্টিভঙ্গি অধিকন্তু ন্যায় ও সুবিচার, দয়াদ্র চিত্ততা ও স্নেহ মমতা, বিশ্বস্ততা ও জীবন উৎসর্গের এমন সব দুর্লভ নমুনা প্রাণবন্ত নজীর কিংবা প্রতিচ্ছবি লোকের সামনে এসেছে যা মানবতার স্মৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে চলছিলো, যার পুনরুজ্জীবন ও পুনরুদ্ধারের কোন আশা ভরসাই আর অবশিষ্ট ছিল না। আর জাতি ধ্বংসের প্রান্ত সীমানায় এসে উপনীত হয়েছিল, তখনই তাদের মাঝে কোন মহা পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। যিনি ধ্বংস - প্রায় জাতিকে মুক্তির পয়গাম শুনিয়েছেন, জাতীয় জীবনের পূর্ব দিগন্তে আবার দেখা দিয়েছে সুবহে সাদিক । শান্তির পরশে হেসে উঠেছে জাতীয় জীবন। মুসলমানদের পতন যুগে এ উপমহাদেশেও অনেক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত কাসিম নানুতুবী (রহঃ) এমনই একজন মহাপুরুষ।
ইত্তেবায়ে সুন্নাতের মূর্ত প্রতীক, রাহে নবুওয়াতের পথ প্রদর্শক, আপন লক্ষে অতন্দ্র প্রহরী, খোদায়ী প্রেমের একনিষ্ঠ সাধক, শিরক - বিদয়াত ও গোমরাহীর মুখোশ উন্মোচনকারী , আধ্যাত্মিক জগতের দিশারী , স্বাধীনতা যুদ্ধের বিশিষ্ট সমরনায়ক, বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানতুবী (রহঃ)। যিনি ছিলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) -এর বংশধর। ১৮৩২ খৃস্টাব্দ মোতাবিক ১২৪৮ হিজরী সনে ভারতের উত্তর প্রদেশে সাহারানপুর জিলার অন্তর্গত নানুতা নামক প্রসিদ্ধ গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে বাস্তব অবদান ও কৃতিত্বের নিরিখে বিশ্ববাসী তাকে আজ “হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেমুল উলুম ওয়াল খায়রাত" নামে চিনে। তার পিতার নাম শায়খ আসাদ আলী। দাদা গোলাম শাহ একজন সরল প্রকৃতির বিত্তশালী পুরুষ ছিলেন। নিজে অীলম না হলেও আলিম বুযুর্গদের সঙ্গে ছিল তার গভীর আন্তরিকতা।
শিক্ষাজীবনঃ
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা তৎকালীন মুসলিম পরিবারের প্রথা অনুসারে নিজ বাড়ীতে সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৮৪৩ সালে বিচক্ষণ ও বিদগ্ধ অলি, বিভিন্ন বিষয়ে সুপণ্ডিত, উস্তযুল উলামা হযরত মাওলানা মামলুক আলী (রাহঃ) -এর নিকট বিভিন্ন বিষয়ের অধিকাংশ কিতাবাদী অধ্যয়ন করেন। জন্মগতভাবেই তিনি অসাধারণ মেধা ও সুতীক্ষ্ম স্মরণ শক্তির অধিকারী ছিলেন। তাই অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন বিষয় যথা নাহু, ছরফ (আরবী ব্যাকরণ), ইলমে বালাগাত (অলংকার শাস্ত্র), মানতিক (তর্কশাস্ত্র) ও ফালসাফা (দর্শন শাস্ত্র) ইত্যাদির উপর পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মাওলানা মামলুক আলী সাহেব তাঁর প্রখর ধীশক্তি ও মেধার কথা জেনে তাকে দিল্লীর সরকারী কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু তিনি ক'মাস পরেই কলেজ থেকে বিদায় নিয়ে হাদীস শাস্ত্রের বিশদ জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে সনামধন্য মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল গনী মুজাদ্দেদী (রহঃ) -এর খেদমতে হাজির হন এবং তার নিকট ইলমে হাদীসের অসাধারণ বুৎপত্তি লাভ করেন। আর সে সময়ে হযরত গঙ্গোহীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ফলে উভয়ে ইলমে জাহেরীর (বাহ্যিক জ্ঞান) সঙ্গে সঙ্গে ইলমে বাতেনী তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানে উৎকর্ষ সাধনের জন্য আওলিয়া কুল শিরোমণী কুতুবুল আলম মুজাহিদে আকবর হাজী ইমদাদুল্ল মহাজিরে মক্কী (রহঃ) -এর দরবারে উপস্থিত হন। তাঁর সাহচার্য লাভে তারা আধ্যাত্মিকতায় এত উচ্চ মাকাম ও মর্যাদা লাভ করেন যে, হযরত হাজী সাহেব বলতেন, “কাসিমকে আল্লাহ তায়ালা আমার মারেফাতের বর্ণনাকারী হিসেবে তৈরী করেছেন।
ছাত্র জীবনের স্বপ্নঃ
হযরত কাসিম নানুতবী বাল্যকালে এমন কিছু স্বপ্ন দেখেছিলেন যা ইঙ্গিত বহন করেছিলো যে, তিনি ভবিষ্যতে এক জ্ঞান সিন্ধুতে পরিণত হবেন। যা হবে অসংখ্য জ্ঞানের শাখা প্রশাখার উৎস - মূল । হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী হযরত কাসেম নানুতভী (রহঃ) -এর জীবনী গ্রন্থ “সাওয়ানেহে উমরীতে” লিখেন, হযরত কাসিম নানুতবী (রহঃ) ছাত্রবেলা একস্বপ্ন দেখেন যে, তিনি কাবা ঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তার থেকে হাজারো নিঝরণী প্রবাহিত হচ্ছো। স্বীয় উস্তাদ মামলুক আলী সাহেবকে এই স্বপ্ন সম্পর্কে অবহিত করলে, তিনি বলেন তোমা হতে ইলমে দ্বীনের অজস্র ধারার সৃষ্টি হবে।
অন্য এক স্বপ্নে তিনি দেখেন যে, “তিনি আল্লাহ পাকের কোলে বসে আছেন। তাঁর পিতামহ এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা এই দেন যে, “আল্লাহ পাক তোমাকে প্রচুর ইলম দান করবেন। তুমি একজন বিশ্ববিখ্যাত আলিম হবে, তোমার অসামান্য খ্যাতি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। আর একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি কাবা শরীফের ছাদের উপরে কোন একটি স্থানে বসা ছিলেন। কুফার দিকে তার মুখমণ্ড। সেই কুফার দিক হতে একটি নূর তার দিকে আসছে এবং তার পদযুগল স্পর্শ করে চলে যাচ্ছো। হযরত শাহ ইসহাক (রহঃ) -এর ব্যাখ্যায় বলল যে, এই ব্যক্তি দ্বারা হানাফী মাজহাব শক্তিশালী হবে। তিনি পাক্কা হানাফী হবেন। সারা দুনিয়ায় তার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু প্রসিদ্ধতা লাভের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ইহজগত ত্যাগ করলেন। সত্যই তার প্রতিষ্ঠিত দারুল উলুম দেওবন্দ এবং এর আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান হতে কুরআন, হাদীস, ফিকহ, তথা ইলমে দ্বীনের যে প্রচার প্রসার ও খিদমত হয় এই শতাব্দীতে তার নজীর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কুরআন হাদীসের সঙ্গে সঙ্গে হানাফী মাজহাবেরও যে বিরাট খিদমত হয়েছে তাও দিবালোকর ন্যায় সুস্পষ্ট।
কর্মজীবন, কৃতিত্ব ও অবদানঃ
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠাঃ দারুল উলুম তথা মুসলিম বিশ্বের সর্বাপেক্ষা অধিক মকবুল এই দ্বীনী প্রতিষ্ঠানকে আজীবন সাধনার দ্বারা তিনিই প্রতিষ্ঠিত করে যান। আজকে সেই দারুল উলুমের নীতি ও পদ্ধতির অনুসরণে বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক দেশের “কওমী মাদ্রাসা” থেকে সঠিক ইসলামী শিক্ষা পাচ্ছো। হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানুভী, সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী, হযরত আল্লামা সাব্বীর আহমদ উসমানী, মুবাল্লিগে ইসলাম মাওলানা ইলয়াছ দেহলবী, শায়খুল হিন্দু মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী, হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, হাকীমুল ইসলাম ক্বারী মোঃ তৈয়ব (রহঃ) প্রমুখ মহান প্রতিভাগুলোর জন্ম দিয়ে দারুল উলুম তার বাস্তব রূপ ও শ্রেষ্ঠ নমুনা বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরেছে। যে সকল মহা মনীষীর পরশ - ছোয়ার শত শত নমুনা আজও শোভাবর্ধন করছেন “কালাল্লাহ আর কালার রসুল" উচ্চারণ মঞ্চগুলোতে।
পাদরী ও হিন্দু পণ্ডিতদের সঙ্গে বিতর্কঃ
ইংরেজ সরকারের সার্বিক সহায়তায় খৃস্টান পাদরীগণ ভারতে খৃস্টান ধর্ম প্রচার করতে শুরু করে। তাদের ধর্ম প্রচারের ব্যাপকতা দেখে হিন্দুরা স্বীয় ধর্ম প্রসারে তৎপর হয় এবং প্রসিদ্ধ শহর শাজাহান হতে পাঁচ ছয় মাইল দূরে চাদপুর এলাকায় হিন্দু পুরোহিত রঈস মুন্সী, পেয়াললাল খোদা (খোদায়ী, পরিচয়) শিরোনামে ধর্মীয় বিতর্ক সম্মেলন আহবান করে। এতে হিন্দু, খৃস্টান ও মুসলমানরা অংশ গ্রহণ করে। হিন্দু পণ্ডিত রঈস মুন্সী, সর্ব প্রথম কিছু আলোচনা করে বসে পরেন। অতঃপর শুধু মুসলমান ও ঈসায়ীদের মধ্যে আলোচনা অবশিষ্ট থাকে। ঈসায়ীদের পক্ষে অনেক পাদরী উপস্থিত ছিল। তন্মধ্যে বিশিষ্ট তার্কিক পাদরী নাউলস ও ছিল। তার দাবী ছিল, ঈসায়ী ধর্মের সামনে ইসলাম ধর্মের কোন ভিত্তি নেই। মুসলমানের পক্ষে মাওলানা কাসিম নানুতবী, মাহমুদুল হাসান, ফখরুল হাসান গাঙ্গোহী প্রমুখ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। প্রথম দিন তুমুল বিতর্ক হল, বিভিন্ন মুসলিম তার্কিক খৃষ্টান পাদরী নাউলিস এর অবান্তর প্রশ্নাদির জবাব দেন এবং স্বপক্ষের দাবীর উপর বিভিন্ন প্রমানাদি পেশ করেন। দ্বিতীয় দিন কাসিম নানুতবী (রহঃ) বিতর্কে অংশ নেন, ইসলামের হক ও হক্কানিয়াতের উপর এবং দ্বীনে ইসায়ী রহিত হওয়ার উপর তিনি এমন প্রমানাদি পেশ করেন, যার ফলে সম্মেলনের সকলে তাকে বাহবা দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাদরী নাউলিস বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, আজ আমরা পরাজয় বরণ করেছি। এর পরে ও পণ্ডিত দয়ানন্দ স্বরস্বতী, পাদরী নাউলিস এবং ইঞ্চিলের ব্যাখ্যাদাতা পাদরী স্কট এর সাথে বিভিন্ন বিতর্ক সম্মেলনে হযরত কাসিম। নানুতবী অংশ গ্রহণ করেন এবং বিজয় লাভ করেন। আর সেদিন মুসলমানদের শত্রু হিন্দুরাও বলতে বাধ্য হয়েছিলো যে, মুসলমানদের বিজয় আর বন্ধ করা যাবে না। হিন্দু এবং খৃস্টান পাদরীদের পরাস্ত করলে চারদিকে তার অসামান্য খ্যাতি বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে তাঁর উপস্থিত যুক্তি প্রমাণ সমূহ হুজ্জাতুল ইসলাম নামে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মিশনারীর লোকেরা মুনাজারা করা থেকে বিরত থাকে।
বুখারী শরীফের টীকাঃ
কুরআনে করীমের পর বিশুদ্ধতম কিতাব সহীহ বুখারী শরীফ। বর্তমান বুখারী শরীফের শেষ ছয় পারার টীকা হযরত নানুতবী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে নিখুঁতভাবে লিখেছেন। তাঁর অন্যান্য অবদানের মধ্যে রয়েছে, অলি উল্লাহী আন্দোলনে গোটা জীবন উৎসর্গ করার পাশাপাশি তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র ধারণ করেন। প্রসিদ্ধ শামেলীর যুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রধান সেনাধ্যক্ষ। তাঁর অবদানের আর একটি দিক হলো যে, হিন্দুদের অনুসরণে তখনকার দিনে মুসলমান সমাজেও বিধবা বিবাহ একটি মন্দকর্ম বলে জ্ঞান করা হতো। হযরত নানুতবী নিজ বংশের লোকজন দ্বারা এই কুপ্রথার নিরসন করেন এবং ইসলামের বিশুদ্ধ নীতির প্রচলন ঘটান।
আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভঃ রাসুল (সাঃ) -এর যোগ্য উত্তরসূরী ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রসেনা, শামেলীর বাহাদুর সেনাপতি, বিশ্বের আলোড়ন সৃষ্টিকারী অবিসংবাদিত আলিম, যুগশ্রেষ্ঠ তাপস, মুনাজিরে ইসলাম মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ৪ ঠা জুমাদাল উলা ১২৯৭ হিজরী মোতাবিক ১৫ এপ্রিল ১৮৮০ সালে বৃহস্পতিবার জোহরের নামাজের পর আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। দারূল উলুম সংলগ্ন গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। যা বর্তমানে ‘মাকবারায়ে কাসিমী' নামে সুপরিচিত। আল্লাহ আমাদের সকল আকাবিরের কবরকে তাঁর নূরে পরিপূর্ণ করে দিন।
═──────────────═