JustPaste.it

মরণজয়ী মুজাহিদ

ধারাবাহিক উপন্যাস

মল্লিক আহমাদ সরওয়ার

======================================================

 

        সায়েমা এবং খলীল বকরীর বাচ্চাটি মরে যাওয়ায় ভীষণ কষ্ট পায়। যার কারণে ওরা রাতের খানাও খেল না। অনেক রাত পর্যন্ত বিছনায় শুয়ে শুয়ে মায়ের নিকট বকরীর বাচ্চাটির কথা আলোচনা করতে করতে এক সময় ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে সায়েমার আম্মা দেখলেন, বকরীটিও রাতে কিছু খায়নি। খাওয়ার জন্য ঘাস পানি যা দেয়া হয়েছিলো পুরোটাই রয়ে গেছে। পরের দিন আলী তাদের জমীন পার হয়ে পাহাড়ের ওপর উঠলে আচানক দেখতে পায়, অদূরেই একটি মানুষ উপুর হয়ে পড়ে আছে। নিকটে যেয়ে দেখে, এ যে তার দোস্ত আহমাদ গুল! বেহুশ অবস্থায় পড়ে আছে আহমাদ গুল।

 

        তার আহত বাযু বেয়ে দর দর করে রক্ত ঝরছে। মূলত তার সম্পূর্ণ হাতটাই বাযু থেকে আলাদা হয়ে গেছে। আলী তাকে তুলে তাদের বাগানের মধ্যে নিয়ে আসলো। ইতিমধ্যে আলীর পিতাও সেখানে এসে উপস্থিত হয়। আলী পিতাকে সব ঘটনা খুলে বলে। বাপ - বেটা সেবা শুশ্রুসা ও চেষ্টা তদবীরে এক সময় হুশ ফিরে আসে আহমাদ গুলের। সে তাদেরকে বলে, ‘পাহাড়ের ওপর বেড়াতে আসলে এক জায়গায় সে একটি সুন্দর কলম দেখতে পায়। চমৎকার দর্শনীয় কলমটি সে হাতে তুলে নেয়। এর সাথে সাথে সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতটুকু মনে আছে। এরপর কি হয়েছে তা জানি না।’

 

        সেদিন দুপুর বেলা সায়েমা এবং খলীল ঘর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের ওপরে খেলা করার জন্য এসে দাড়ায়। যেখানে বকরীর বাচ্চাটির মৃত্যু ঘটেছিলো বেশ কিছুক্ষন সেখানে খেলার ছলে ছুটাছুটি করছিলো। এসময় সায়েমা অদূরেই একটি সুন্দর বস্তু দেখতে পেয়ে দৌড়ে সেদিকে যায়। বস্তুটি ছিলো সুন্দর একটি ঘড়ি। সায়েমা খলীলকে বলে দৌড়ে ঘড়িটির কাছে যেয়ে হাতে তুলতেই সেটি বিকট শব্দে বিস্ফিারিত হয়। সাথে সাথে সায়েমা হুশ হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অবস্থা দেখে খলীল ভীষণভাবে ঘাবড়ে যায় এবং চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বাড়ী চলে আসে।

 

        সায়েমার আব্বা পাহাড়ের ওপর উঠে যা দেখলেন, তা ছিলো খুবই মর্মান্তিক। সায়েমার একটি বাযু সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে টুকরো টুকরো অবস্থায় বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে। ঘাড় ও মুখায়বও তার জখম হয়েছে। যখম থেকে প্রবল বেগে রক্ত ঝরছে। সায়েমার আব্বা তাকে কোলপাজা করে বাড়ী নিয়ে আসলে এক হৃদয় বিদারক অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাড়ী শুদ্ধ স্বশব্দ কান্নার রোল পড়ে যায়।

 

        দু’দিন পরে আলী ও তার আব্বা আহত সায়েমাকে নিয়ে বরফ বেষ্টিত পাহাড় এবং ঘন বন - জঙ্গল অতিক্রম করে রুশী ফৌজদের থেকে গা বাঁচিয়ে মুজাহিদদের এক ঘাঁটিতে এসে পৌছে। মুজাহিদরা গাড়ীতে করে তৎক্ষণাৎ সায়েমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডাক্তার সায়েমাকে পরীক্ষা করে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “বাচ্চাটিকে তাৎক্ষণিকভাবে পৌছালে বাঁচানো সহজ হতো। কিন্তু তারপরও আমরা চেষ্টায় ত্রুটি করব না।”

 

        তিন দিন পর হাসপাতালে সায়েমার হুশ ফিরে আসে। সায়েমাকে চোখ খুলতে দেখে আলী আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বাজার থেকে তার জন্য বহু রকমের বিভিন্ন খেলনা এনে তার সামনে রেখে দেয়। যার মধ্যে প্লাস্টিকের একটি সুন্দর ঘড়িও ছিল। সায়েমা চোখ খুলে প্লাস্টিকের ঘড়িটার দিকে তাকিয়েই চিৎকার দিয়ে দ্বিতীয়বার বেহুশ হয়ে পড়ে। ডাক্তার চিৎকার শুনে ছুটে আসেন এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন সায়েমার হুশ ফিরিয়ে আনার জন্যে। কিন্তু ডাক্তারের সকল চেষ্টা বিফল হলো। ক’মিনিট পর হতাশার সাথে ডাক্তার বল্লেন, “মেয়েটি আর জীবিত নেই। তাররূহ এখন জান্নাতবাসীদের সাথে মিলিত হয়েছে।”

 

        আলী ডাক্তারের কথা শুনে আদরের ছোট বোন সায়েমার লাশের উপর পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠে। নিশ্চল পাথরের ন্যায় মুক হয়ে চেয়ে থাকে আলীর আব্বা নিস্পাপ মেয়ের চেহারার দিকে। তার চোখ দিয়েও ঝরছিলো অঝোরে অশ্রু ধারা। দীর্ঘক্ষণ পর পিতা পুত্রের অবস্থায় কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে আসলে ডাক্তার বললেন, “সায়েমা খেলনার সেকেলে তৈরী বারুদী বোমার আঘাতে আহত হয়েছিলো। এই বোমাগুলো খুবই খতরনাক। যা রুশী ফৌজরা আফগানিস্তানের আগামী প্রজন্মকে ধ্বংস বা পঙ্গু করে দেয়ার উদ্দেশ্যে এখানে সেখানে ফেলে রাখছে। এই কয়দিনে বারুদী খেলনা বোমায় আহত বহু শিশু কিশোর যুবককে আমরা চিকিৎসা করেছি। তাদের মধ্যে অনেকেই শাহাদত বরণ করেছে। তাদেরকে আমরা বহু চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি।

 

        এ খেলনা বোমা রুশী ফৌজরা মানুষ চলাচলপথে চারণভূমিতে এবং বসতিপূর্ণ পাহাড়ের ওপর ফেলে রাখে। যাতে স্পর্শকারীর শরীরের কোন একটি অংগ নষ্ট বা বিকল হয়ে যায়। কখনো কখনো ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারাবার কথা শুনা যায়। দেখতে সুন্দর এই সব খেলনা বোমা শিশুরা হাতে নিতেই বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হয়। রুশী ফৌজদের এই হীন কাজ বড়ই অমানবিক ও হৃদয় বিদারক। তারা এই জঘন্য পথে আফগান জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়ার পায়তারা চালাচ্ছে। এর দ্বারা সকলকে ভীত সন্ত্রস্ত করার প্রয়াস চলছে। যেন বড় হয়ে এ প্রজন্ম রুশী ফৌজদের মুকাবিলায় হাতিয়ার উঠাতে হিম্মত না করে। সাথে সাথে তারা আফগান জাতিকে চিরদিনের জন্য গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করার স্বপ্ন দেখছে। এর পর তারা থাবা বিস্তার করবে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের দিকে।”

 

        আলী খুব মনোযোগের সাথে ডাক্তারের কথা গুলো শুনলো। নিজের অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয় তার হাত। তার বুকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো প্রতিশোধের অনির্বাণ শিখা। মনে মনে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে, এ যালিম রুশীদের থেকে তার প্রিয় বোন সায়েমার খুনের বদলা সে নি-বে-ই।

 

সায়েমার লাশ নিয়ে ফেরার পথে আলী তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করে,

 

        : আব্বু, রুশীরা আফগানীদেরকে কেন হত্যা করছে?

জবাবে তার আব্বা বলেন, “আসলে আফগানীদেরকে নয় বরং ওরা মুসলমানদেরকে হত্যা করছে। কেননা আফগানের মুসলমানরা যে আল্লাহ ও রাসুলে বিশ্বাস করে–এটাই তাদের অপরাধ।”

আলী পুনরায় জিজ্ঞেস করে,

 

        : “আব্বু, রুশীরা আল্লাহ ও রাসুলকে শত্রু মনে করে কেন? আল্লাহ্ তো আমাদের সকলকে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের জন্য তৈরী করেছেন কত রকম ফল - ফুল, সবুজ পৃথিবী, নীল আকাশ। আল্লাহর রাসুল তিনিও তো কত ভাল মানুষ। তিনি কাফির মুশরিকদের ছেলেদেরকেও তো কত আদর করতেন। অসুস্থ দুশমনকেও তিনি সেবা শুশ্রুসা করতে যেতেন এবং তাদের রোগ মুক্তির জন্যে দুআ করতেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি ঐ সকল দুশমনদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন যারা তাঁর উপর সীমাহীন যুলুম নির্যাতন চালিয়ে স্বদেশ - মাতৃভূমি ত্যাগে তাকে বাধ্য করেছিলো।”

 

        আলীর কথা শুনে তার আব্বা বল্লেন, “বেটা! রুশীরা শয়তানের অনুসরণ করে, আর শয়তান হলো আল্লাহ এবং রাসূলের কাট্টা দুশমন। রুশীরা মনে করে, আল্লাহ বা সৃষ্টি কর্তা বলতে কিছু নেই। মানুষ, জীব জন্তু, গাছ - পালা সবকিছু এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে। পরকালেও তারা বিশ্বাস করে না। এজন্য যুলুম করতে ওরা মোটেও দ্বিধা করে না। কেননা যুলুমের জন্য পরকালে শাস্তি ভোগ করার ভয় তাদের নেই। মনে রেখো, যে সব লোক বা জাতি আল্লাহর ওপর ঈমান ও বিশ্বাস রাখে না তারা এই বর্বর রুশীদের ন্যায় সীমাহীন অত্যাচারী হয়ে থাকে। অত্যাচার করাকে তারা অন্যায় মনে করে না। শয়তান ও এদের মধ্যে কোন প্রভেদ নেই।”

 

        গ্রামে পৌছে তারা খবর পেল যে, আরো অনেক শিশু এ বারুদী খেলনায় শহীদ হয়েছে এবং যখমী হয়েছে অসংখ্য। সায়েমার লাশ নিয়ে আসলে দীর্ঘক্ষণ ধরে সায়েমার আম্মা ও ফুফু কান্না কাটি করে। কোন ভাবেই আলী তার মার কান্না থামাতে পারছিলো না। আলী তার আম্মুকে লক্ষ্য করে বললোঃ “আম্মু চোখের পানি মুছে ফেল।”

 

        প্রতিশোধের অগ্নিতে প্রজ্জলিত আলী শপথ করে বল্লো, “আমি এক একটি রুশীকে কতল করে বোন সায়েমার এক এক ফোটা খুনের বদলা নিব। ওদের এদেশ থেকে তাড়াবই। খোদার দুশমনদের বুঝিয়ে দেব, যে কওম আল্লাহ ও তার রাসূলকে মানে না তারা যত বড় শক্তিশালীই হোক না কেন ধ্বংস ও পরাজয় তাদের অনিবার্য।”

 

        এমনিভাবে ছোট ছোট শিশু যখমী ও শহীদ হওয়ার ফলে গ্রামময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাপ মা ছোট বাচ্চাদেরকে ঘর থেকে বের হতে দেয় না। এমন কি বহু পরিবার এরই মধ্যে নিজের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে হিজরত করে পাকিস্তানের পথে পাড়ি জমিয়েছে। নিরবতা ও উদাসিনতার মধ্য দিয়ে আলীর দিনগুলো কাটলেও হৃদয়ে তার প্রতিশোধের বহ্নিশিখা দিন দিন প্রজ্জলিত হচ্ছে। কোন কাজেই তার মন বসছে না।

 

        ঘুমের ঘোরে প্রায়ই সায়েমাকে সে যখমী অবস্থায় খুনের মাঝে তড়পাতে দেখে। কয়েক বার সে তার আব্বুর নিকট মুজাহিদের সাথে যোগ দেয়ার জন্যে অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু, আব্বু তাকে প্রবোধ দিয়ে বলেছে, “বেটা তুমি এখনো ছোট। অস্ত্র তুলে যুদ্ধ করার মত বয়স, শক্তি ও বুদ্ধি তোমার এখনও হয়নি। কিছু দিন অপেক্ষা কর।”

 

        খলীল এখন আর পাহাড়ে গিয়ে খেলা করে না। সারাটা দিন উদাসীন ভাবে তার আম্মার কাছে বসে থাকে। বকরীটিও বুঝি তার বাচ্চা ও সায়েমার মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করতে পারল না। সকাল বেলা ওঠে দেখে, রাতের কোন এক সময বকরীটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। [চলবে]

 

❝———————————

যে লোক মরে গেল, কিন্তু যুদ্ধ বা জিহাদ করল না—জিহাদ করার কোন ইচ্ছাও তার মনে জাগেনি, সে মুনাফিকীর একটা অংশ নিয়েই মরল। —আল হাদীস

———————————❞