JustPaste.it

“ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির সাথে সম্পৃক্ত আন্তরিক ভাইদের প্রতি

খোলা চিঠি

শাইখ ইব্রাহীম আস-সাকরান (আবু উমার)

আলহামদুলিল্লাহ, আম্মা বা’আদ…
এই চিঠি শামের ভূমিতে অবস্থিত আমার অনুজ, তরুণ মুজাহিদ ভাই, ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেসব ভাই “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটিকে সমর্থন দিচ্ছেন এবং সেই সব আন্তরিক ভাই যারা এখনো “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির সাথে কোন না কোন ভাবে সম্পৃক্ত আছেন, তাঁদের সকলের প্রতি-

আমি জানি আপনাদের হৃদয়গুলো আকাঙ্ক্ষায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে আছে আল্লাহ-র এই আয়াতের কথা চিন্তা করে – “নিশ্চয়ই আল্লাহ মু’মিনদের জীবনগুলো কিনে নিয়েছেন”। এবং আমি এ-ও জানি, “আল্লাহ যা নাযিল করেছেন (শারীয়াহ), তা দিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংস কর” -আল্লাহ-র এই আয়াতের গুরুত্ব আপনারা অনুধাবন করেন এবং এই আয়াতের দ্বারা মুসলিমদের উপর যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার বাস্তবায়নের ইচ্ছা আপনাদের চিন্তাক্লিস্ট রাখে।
.
আমি জানি আরব শাসকদের অন্যায় এবং যুলুমের কারণে আপনারা ক্রোধান্বিত, এবং জানি যে আপনাদের দল এবং অন্যান্য দলের মধ্যে যে তিক্ততা বিদ্যমান তা আপনাদের ব্যাথিত করে। কিছু উলেমার প্রতি আপনারা রাগান্বিত কারন তারা অত্যাধিক পরিমানে শাসকদের চাটুকারীতায় লিপ্ত ।
.
কিন্তু এ সকল কিছু সত্ত্বেও, শামে যা ঘটছে, কোন ভাবেই আল্লাহর শরীয়াহ সেগুলোর বৈধতা দেয় না। উপরোক্ত কোন কিছুই শামের বর্তমান ঘটনাবলীতে আপনাদের অংশগ্রহনকে বৈধতা দেয় না। বরং বর্তমানে আমরা যা দেখছি এবং যেটার প্রস্তুতি চলছে সেটা এই ব্যাপারগুলোর চাইতে অধিক ভয়ংকর।
.
এই সকল অজুহাতের কোন কিছুই বিচারের দিন আপনার প্রতিপালকের সামনে আপনার কাজে আসবে না। এগুলোর কোন কিছুই সেই দিন আপনার রবের সামনে আপনার পক্ষে প্রমান হিসেবে যথেস্ট হবে না, যেদিন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন – “তাদের থামাও, নিশ্চয়ই তারা জিজ্ঞাসিত হবে”। তিনি আরো বলেন, “সেদিন, যেদিন মানবকূল তাদের রব্বের সম্মুখে উপস্থিত হবে।”
.
ইতিপূর্বে যে নিস্পাপ রক্ত প্রবাহিত করা হয়েছে এবং যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সত্যতা সম্পর্কে কেউই প্রশ্ন তুলবে না। যদিও এগুলোর খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনলাইন সমর্থকরা তর্ক-বিতর্ক করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা চরমে পৌঁছেছে। কারণ ইতিপূর্বে যা (মুসলিম রক্ত প্রবাহিত করা) ঘটনা ও দুর্ঘটনায় সীমাবদ্ধ ছিল সেটা এখন আদর্শ, মূলনীতি ও মানহাজের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে, এবং এই মর্মে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। কোন রকম অস্পষ্টতা ছাড়াই “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি তাদের মূলনীতি ও মানহাজ হিসেবে এটাকে ঘোষণা করেছে।
.
আজ রাতে আমি “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির “আল-ফুরকান ফাউন্ডেশন” থেকে ৫ই রামাদ্বান ১৪৩৬ হিজরীতে প্রচারিত অফিশিয়াল বিবৃতিটি শুনলাম। এটি ছিল তাদের প্রধান মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আল-আদনানীর বক্তব্য। আল্লাহর কসম, এটি আমাকে প্রচন্ড ভাবে মর্মাহত ও ব্যাথিত করেছে। আমি ভাবতে পারি নি এ ধরনের একটি মনগড়া নীতি ও বিধান; যা শরীয়াহর সাথে সুস্পষ্টভাবেই সাংঘর্ষিক, গ্রহন করার ব্যাপারে তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেবে। (“ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির এই আকীদাটি হল যে মুসলিমই তাদের বিরোধিতা করবে ও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তাদেরকে তারা মুরতাদ গণ্য করে ও হত্যা করে।)
.
কিছু দিন আগেও তারা দাবি করতো তারা এই ধরনের বিশ্বাস পোষন করে না, এবং এটি তাদের মানহাজের অংশ না। যদিও তাদের অনেক কাজের কারণে তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছিল যে তারা এরকম নীতি ও কর্মপন্থা অনুসরণ করে কিন্তু তারা এর আগে সব সময় তীব্র ভাবে এই সব অভিযোগের বিরোধিতা করতো এবং যেসব হারাম রক্ত তাদের কারণে প্রবাহিত হয়েছে সেইসব ঘটনার পক্ষে নানা অজুহাত পেশ করতো। যারা তাদের বিরুদ্ধে এই নীতি ও কর্মপন্থা অনুসরণের অভিযোগ উত্থাপন করতো, “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি তাদের সবাইকে মিথ্যাবাদী, অপবাদ দানকারী ও ফিতনাবাজ প্রমান করতে সচেস্ট হত।
.
শামের মুজাহিদীন দলগুলো অনেকদিন ধরেই বলছে যে, “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি তাদের বিরোধিতাকারী এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এমন সব মুসলিম দলকে তাকফির* করে [অর্থাৎ তাদের কাফির মনে করে]। “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি এসব মুসলিমদের জান-মাল হালাল করে নেয়, তাদের মৃত্যুদন্ড আরোপ করে। কিন্তু তাদের এই নীতি ও কর্মপন্থা যে অত্যন্ত জঘন্য, ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক সেটা তারা নিজেরাও বুঝতো বিধায় এই ব্যাপারটা তারা মুসলিমদের কাছে গোপন করতো এবং প্রকাশ্যে স্বীকার করতো না।
[* তাকফির – কাউকে কাফির ঘোষণা করা এবং তার রক্ত হালাল মনে করা] .
অনলাইনে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির সমর্থকরা প্রচার করতো এগুলো সব মিথ্যা অভিযোগ। এগুলো প্রচার করা হচ্ছে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এবং মুসলিমদের তাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। এসব অজুহাতের মাধ্যমে তারা “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটিকে মযলুম হিসেবে উপস্থাপন করত।
.
অতঃপর জামাদিউল আউয়াল ১৪৩৬ হিজরীতে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির অফিশিয়াল মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আল-আদনানী “তাহলে আসুন আমরা দু’আ করি যেন মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লা’নত পড়ে” [Then Let us Supplicate and invoke the curse of Allah upon the liars] নামে একটি অডিও বিবৃতি প্রদান করে। এই বিবৃতিতে সে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মুসলিম গ্রুপগুলোকে তাকফির করা এবং তাদের রক্তকে হালাল করে নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে। সে এখানেই থেমে থাকল না, বরং সে দাবি করল যে, এইসব অভিযোগ তাদের উপর আপতিত মিথ্যাচার, এবং সাথে সাথে আরও অগ্রসর হয়ে সে এই অভিযোগ অস্বীকার করে এই ব্যাপারে একটি মুবাহালার* ঘোষণা করে। এবং যদি সে এই ব্যাপারে মিথ্যা বলে থাকেন তাহলে এই মুবাহালার মাধ্যমে সে নিজের উপরই আল্লাহর লা’নত ডেকে এনেছে।
.
বিবৃতি সে বলেছিল, “এখানে আমি এমন কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করব যেগুলোর ব্যাপারে আমি তাদের মুবাহালার জন্য আহবান করছি। যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে তাহলে তারা আসুক মুবাহালা করতে। তাই বিশ্বাসীর বলুন, “আমীন” এবং আল্লাহর লা’নত মিথ্যাবাদীদের উপর পড়ুক। হে আল্লাহ, নিশ্চয়ই আবু আব্দুল্লাহ আশ-শামী বলেছেন আমরা….।”
.
[* কোন ব্যাপারে দুটি দল যখন একে অপরের ব্যাপারে মিথ্যাচারের অভিযোগ তোলে, তখন দুই পক্ষ আল্লাহ-র কাছে দু’আ করা যেন আল্লাহ প্রকৃত মিথ্যাবাদীকে তা স্পষ্ট করে দেন এবং মিথ্যাবাদীদের উপর আযাব প্রেরণ করেন]

তারপর আল-আদনানী আরোপিত অভিযোগগুলো একে একে উত্থাপন এবং বলল যে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় যে, “স্টেট নিজেদের হক্ব প্রমাণ করতে মিথ্যা এবং প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। মিথ্যা শপথ করা তো তাদের চরিত্রই হয়ে দাড়িয়েছে, এবং স্টেটের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই হচ্ছে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া। এবং তারা লাওয়াযিম* (সংশয়, সন্দেহ, সম্ভাবনা) এর উপর ভিত্তি করে তাকফির করে।”
[*এই রকম তাকফির মূলত অনুমান বা ধারণার উপর নির্ভর করে করা হয়। অথবা এমন কোন ব্যক্তিকে তাকফির করা যে এমন কাজ করেছে বা কথা বলেছে, যেটা নিজ থেকে কুফর না, কিন্তু এটার ফলাফল শেষ পর্যন্ত কুফরের দিকে নিয়ে যাবে। যদিও সেই ব্যক্তি এটা অনুধাবন করছে না। এবং সেই ব্যক্তি এই চূড়ান্ত ফলাফল যা কুফরের দিকে নিয়ে যাবে, সেটাও আকাঙ্ক্ষা করে না, কিন্তু তার অজ্ঞানতা বা ভুল বোঝার কারণে সে এই কথা বলেছে বা কাজ করেছে। এরকম কথা বা কাজের উপর ভিত্তি করে তাকফির করাকে লাওয়াযিমের উপর ভিত্তি করে তাকফির করা বলে।] .
এরপর সে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ঘোষণা করল –
“হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী দাওলার* বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে এগুলো সব মিথ্যা, না এগুলো দাওলার মানহাজ আর না দাওলা এগুলোতে বিশ্বাস করে, এবং এরকম কোন কিছুর করার অভিপ্রায়ও দাওলা পোষণ করে না। বরং যারা এরকম যারা করে আমরা তাদের থেকে মুক্ত।
.
হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে মিথ্যা বলছে, তার উপর আপনি লা’নত বর্ষন করুন, আমাদের কাছে তার ব্যাপারে আপনার নিদর্শন প্রকাশ করে দিন এবং তাকে আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করুন। হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে মিথ্যা বলছে, তার উপর আপনি লা’নত বর্ষন করুন, আমাদের কাছে তার ব্যাপারে আপনার নিদর্শন প্রকাশ করে দিন এবং তাকে আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করুন। হে আল্লাহ, আমাদের মধ্যে যে মিথ্যা বলছে, তার উপর আপনি লা’নত বর্ষন করুন, আমাদের কাছে তার ব্যাপারে আপনার নিদর্শন প্রকাশ করে দিন এবং তাকে আমাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করুন।”
.
[* দাওলা শব্দের অর্থ রাস্ট্র। এই দলটি প্রথমে নিজেদের, “দাউলাতুল ইসলামিয়্যা ফিল ইরাক”/Islamic state of Iraq, তারপর “দাউলাতুল ইসলামিয়্যা ফিল ‘ইরাক ওয়াশ শাম”/Islamic state of Iraq & Sham এবং পরবর্তীতে “দাউলাতুল ইসলামিয়্যা”/Islamic state বলে নামকরণ করে]

উপরোল্লিখত এই কথাগুলো “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির মুখপাত্র আবু মুহাম্মাদ আল-আদনানীর বক্তব্যে থেকে নেয়া হুবহু উদ্ধৃতি।
.
আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন হে মুজাহিদ ভাইয়েরা এবং “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির সমর্থক ভাইয়েরা, অত্যন্ত কঠোর ভাষায় আদনানী অস্বীকার করেছিলেন, সেটা হল তারা মুসলিমদের মধ্যে থেকে যারাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তারা তাদের তাকফির করে, তাদের রক্ত হালাল মনে করে। এবং সে এই ধরনের বিশ্বাস ও মূলনীতি থেকে নিজেদের মুক্ত ঘোষণা করেছিল যে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কোন মুসলিমকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। সাথে সাথে সে এ-ও শপথ করেছিল, আবু আব্দুল্লাহ আল শামী সহ যারা “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তুলেছে এবং তার (আদনানী) মধ্যে যে-ই মিথ্যা বলুক, তার উপর যেন আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হয়।
.
এরপর থেকে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির সমর্থকরা বারবার তাদের বিরোধীতাকারীদের সাথে বিতর্কের সময় এই মুবাহালার কথা টানতো। এবং তারা বারবার দাবি করতো আদনানীর এই মুবাহালা ছিল হক্বের উপর করা একটি মুবাহালা। এবং হক্ব হবার প্রমান হিসেবে তারা বলতো যে এই মুবাহালার পর “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি অনেক নতুন ভূমি দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
.
কিন্তু আজকে, ৫ই রামাদ্বান ১৪৩৬ হিজরীতে, “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি একটি অফিশিয়াল বিবৃতি প্রকাশ করেছে। “হে লোকেরা, তোমরা আল্লাহ-র দিকে আহবানকারীদের ডাকে সাড়া দাও!” [Oh our people, respond to the caller of Allah”] নামক এই বিবৃতিতে স্বয়ং আল-আদনানীই বলেছে-

“…তাই সাবধান, দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধর করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো।”
.
অর্থাৎ এই কথার মাধ্যমে সে নিজের মুখেই স্বীকৃতি দিয়েছে, সে এবং তার দল ঠিক ওই বিশ্বাস পোষন করে ও কর্মপন্থা অনুসরণ করে, ইতিপূর্বে যা সে অস্বীকার করেছিল এবং যেগুলোর ব্যাপারে নিজেদের এতো বড় গলায় নির্দোষ দাবি করেছিল।
.
সে একেবারে সুস্পষ্ট ভাবে এবং সরাসরিই প্রকাশ করে দিয়েছে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক এই মনগড়া মূলনীতিতে [অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হল কুফর!] বিশ্বাস করে। অথচ এই ব্যাপারে পূর্বে সে নিজেই দু’আ করেছিল, যদি সে এবং তার দল আসলে এই বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে, তাহলে যেন তার উপর আল্লাহর লা’নত পড়ে, যেন তার মিথ্যা সকলের কাছে প্রকাশিত হয়।
.
“ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি এখন দাবি করে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ঈমান ভঙ্গের কারণ। এবং এটা কুফর। এবং কোন মুসলিম যদি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তবে “সে কাফির মুরতাদে পরিণত হবে!”
.
হে আল্লাহ ! এটা কি রকম মনগড়া মূলনীতি যা সরাসরি রক্তপাত সংক্রান্ত শারীয়াহ-র ফিকহের বিরুদ্ধে যায়? এটা কি ভয়ঙ্কর রকমের বি’দাত যা তারা তাওহীদ, আকীদা এবং ঈমান ভঙ্গের কারণ ও বিধানগুলোর ক্ষেত্রে নিজেরা নিজেরা উদ্ভাবন করেছে? আল্লাহ-র নাযিল করা আইনের পরিবর্তে এ কোন মানবরচিত নতুন আইনের প্রতি উম্মাতে মুহাম্মাদীকে এই দলটি আহবান করছে? অথচ তারা বড় গলায় দাবি করে তারা আল্লাহ-র শারীয়াহ বাস্তবায়ন এবং প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ করছে!
.
কিছুদিন আগ পর্যন্ত সে বড় গলায় দাবি করতো তদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুসলিমদের তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত [অর্থাৎ কাফির মুরতাদ] বলে মনে করে না। এবং সে বলতো সে দু’আ করে যে সত্যিই যদি সে এবং তার দল এরকম বিশ্বাস পোষণ করে থাকে তাহলে যেন তাদের উপর আল্লাহ-র লা’নত পড়ে। আর আজকে সে নিজেই প্রকাশ করলো তারা শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক এই মূলনীতিতেই বিশ্বাস করে:

“…তাই সাবধান, দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধের করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো।”
.
কেউ কেউ বলতে পারেন, হয়ত আদনানী “আবশ্যকতা (what it necessitates) এবং ফলাফল” এর নীতির উপর ভিত্তি করে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ঈমান ভঙ্গের একটি কারণ বলে বিশ্বাস করছে। অর্থাৎ সে বিশ্বাস করে যদি কোন দল “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাহলে কার্যত ফলাফল হল এই দলটি যে ভূমি দখল করবে এবং সেখান থেকে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটিকে বিতাড়িত করবে সেখানে সেই বিজয়ী দল শারীয়াহ কায়েম করবে না। যার দরুন সেই ভূমি শারীয়াহ ব্যাতীত অন্য কোন মানবরচিত আইন দ্বারা শাসিত হবে। অর্থাৎ “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটিকে কোন ভূমিতে অপসারণ করার অবশ্যম্ভাবি ফলাফল হল সেখানে শারীয়াহ ব্যাতীত অন্য কোন কিছু দ্বারা শাসন করা হবে। অর্থাৎ আদনানী বিশ্বাস করে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ-র শারীয়াহ-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক এবং “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ফলাফল তাই হল আল্লাহ-র শারীয়াহ-র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা* এবং “আবশ্যকতা (what it necessitates) এবং ফলাফল” এর নীতির উপর ভিত্তি করেই যারাই “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তাঁদের ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া মুরতাদ হিসেবে ফতোয়া দিয়েছে।
.
[* এই ধরনের বিশ্বাস এর অর্থ কোন দল, ব্যক্তি কিংবা ইমারাকে আল্লাহ-র শারীয়াহর সাথে মিশিয়ে এক করে ফেলা। যাতে করে ঐ ব্যক্তি/দল/ইমারাহ এর বিরোধিতা- করাকে আল্লাহ-র বিরোধিতা করা বলে উপস্থাপন করা যায়। এই ধরনের বিশ্বাস সম্পূর্ণভাবে বাতিল] কেউ যদি এরকম দাবি করেন তাহলে তাঁদের প্রতি জবাব হবে, তার মুবাহালার মাধ্যমে আদনানী নিজেই তার অনুসারীদের জন্য কোন পথ খোলা রাখে নি। কারণ সেই মুবাহালার সময় সে বলেছিল যদি সে এবং তার দল “আবশ্যকতা (what it necessitates) এবং ফলাফল” এর নীতির উপর ভিত্তি করে তাকফির করে থাকে তাহলে যেন তার উপর আল্লাহ-র লা’নত পড়ে। এই মুবাহালায় সে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ হুবহু বর্ণনা করেছিল এবং তারপর অত্যন্ত কঠোরভাবে দাবি করেছিল যে সেই সব অভিযোগ মিথ্যা। এই অভিযোগ গুলোর মধ্যে লাওয়াযিমের উপর ভিত্তি করে তাকফির – অর্থাৎ, সন্দেহ, সম্ভাবনা, সংশয়, ফলাফল এবং “আবশ্যকতার” উপর ভিত্তি করে তাকফির করার অভিযোগও ছিল। কিন্তু আদনানী তখন বড় গলায় ঘোষণা করেছিল তারা এই ব্যাপারে নির্দোষ এবং “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি এসব থেকে মুক্ত।
.
এই মুবাহালায় আমরা দেখেছিলাম যে, সে অস্বীকার করেছিল যে, যারাই “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের নাকি তারা তাকফির করেন না, এবং “আবশ্যকতা (what it necessitates) এবং ফলাফল” এর ভিত্তিতে তাকফির করার নীতি গ্রহন করার কথাও অস্বীকার করেছিল। সে দুআ করেছিল মিথ্যাবাদী হলে তার উপর যেন আল্লাহ-র লা’নত পড়ে। আজকে (৫ই রমাদ্বান, ১৮৩৬ হিজরী) সে গলা উচু করে তার শ্রোতাদের ঠিক সেটাই শুনালো যেটা সে আগে অস্বীকার করেছিল। যা মিথ্যা প্রমাণ করতে তারা এতোদিন উঠেপড়ে লেগেছিলেন, আজকে নিজেরাই সেই জিনিসটিই স্বীকার করে বসলো।
.
হে আমার সত্যান্বেষী মুজাহিদ ভাইয়েরা, আমরা সত্যান্বেষী সমর্থক ভাইয়েরা.., আপনারা কি জানেন “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির ঘোষিত এই মূলনীতি: “…তাই সাবধান,দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো” –মানবরচিত মনগড়া মূলনীতিগুলোর মধ্যে সবচাইতে ভয়ঙ্কর মূলনীতির একটি যা সরাসরি শরীয়াহর বিরুদ্ধে যায়?! আপনারা কি জানেন যে এটা হচ্ছে আল্লাহ যা নাযিল করেছে তা ব্যাতীত অন্য কিছু দিয়ে বিচার করার সবচাইতে চরম পর্যায়ের উদাহরণের একটি?
.
শারীয়াহ যদি অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে, যেমন দুই পক্ষের সম্মতিতে গৃহীত সুদের ক্ষেত্রে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যাতীত অন্য কিছু দ্বারা বিচার করার অনুমোদন না দেয়;তাহলে চিন্তা করুন কিভাবে রক্তপাতের বিধান নিয়ে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যাতীত নিজেদের মনগড়া কোন বিধান চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে! অথচ এই রক্তপাতের বিধান সংক্রান্ত বিষয় হল এমন একটি ব্যাপার যা ফিকহের বিষয় এবং যা সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সাবধানতার দাবি রাখে।
.
হে আমার ভা্* স্মরণ করুন যে আল্লাহ যা দিয়েছেন সেটার বদলে অন্য কোন বিধান আরোপ করা হচ্ছে তাওহীদর বড় ধরণের বিরোধীতা এবং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কোন বিধান আরোপ করা শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, নতি স্বীকার, এবং দাসত্ব করা এবং নবীজী ﷺ এর অনুসরণ করার নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন। আর “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির ঘোষিত এই মূলনীতি: “…তাই সাবধান, দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো” হল একটি নব উদ্ভাবিত বিদ’আতি বিধান, এবং তাওহীদের গুরুতর লঙ্ঘন।
.
যারা এরকম বলে যে তাদের বিরোধিতা বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ঈমান ভঙ্গের কারণ – তাদের ব্যাপারে এবং তাদের এই চরম সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে ‘আলিমদের বক্তব্য উল্লেখ করার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু তারপর নিজের ব্যাপারে এবং পাঠকের ব্যাপারে লজ্জাবোধ করলাম। এই দ্বীন কি তাহলে এতটাই অদ্ভুত এবং অজ্ঞাত হয়ে গেল যে এইরকম মনগড়া কথা যা সরাসরি শরীয়াহর বিরোধীতা করছে সেটা শুনেও আমরা অনুধাবন করতে পারছি না? শারীয়াহ-র ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান কি এতোটাই কমে গেছে যে শারীয়াহ-র সাথে সুস্পস্টভাবে সাংঘর্ষিক এরকম বিদ’আতি বিধান এক এক জন তৈরি করবে আর আমরা সেটা চিনতে পারবো না?
.
ইমাম ইব্*ন তাইমিয়্যা তার কিতাব “আস-স্ব’রিমুল মাসলুলল”-এ [২/১৫] উলেমাদের ইজমার কথা উল্লেখ করে বলেছেন – “ব্যক্তি কোন নবীকে হত্যা করে সে কাফির”, তিনি এ ব্যাপারে ইমাম ইশাক বিন রাহুইয়াহ এর রিওয়ায়েতে উলেমাদের ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর শপথ, আমাদের কি আজকে এই অবস্থা হয়ে গেল যে কোন যুদ্ধরত দলকে আমাদের দালীল দিয়ে প্রমান করতে হবে যে তারা নবী না? আর তাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অর্থ কাফির হয়ে যাওয়া না?
.
পরিস্থিতি কি তাহলে এমন হয়ে গেল আজকে একটা দল মনে করছে তাদের মধ্যে নবীদের বৈশিষ্ট্য আছে এমনকি তারা নবীদের পর্যায়ে পৌছে যে কারনে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মানেই দ্বীন ত্যাগ করে কাফির হয়ে যাওয়া, যেমনটা নবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে হয়? ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন। তাওহীদের ক্ষেত্রে ভ্রষ্টতা ও বিপথগামীতা কিভাবে এতদূর পৌছালো?
.
আপনারা কি মনে করেন আমাদের এসব যুবকদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে, তাদের নম্রভাবে বলা উচিত যে, “আমরা তোমরা যে চেস্টা চালাচ্ছো তার কদর করি, কিন্তু আমরা শুধু এটুকু পরিষ্কার করতে চাই যে তোমরা ইন শা’ আল্লাহ, নবী-গণের অন্তর্ভুক্ত নও যে তোমাদের যে বিরুদ্ধে যেই যুদ্ধ করবে সেই কাফির হয়ে যাবে?! হায়! এই উম্মাহ-র অবস্থা কি এতোটাই লজ্জাজনক অবস্থায় পৌছে গেছে?

তবে আসলেই বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আপনি এমন অনেকক দেখবেন যারা তাওহীদ, রক্তপাতের বিধান, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ছাড়া অন্য কোন বিধান আরোপ ও ইমান ভঙ্গের কারণসমূহের ক্ষেত্রে এই চরম সীমালঙ্ঘনের [অর্থাৎ “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির এই ঘোষণা] ব্যাপারে নিশ্চুপ হয়ে আছে। আর তাদের এই নিশ্চুপ থাকার কারণ হল আল-ওয়ালা ওয়াল বার’আ এর ব্যাপারে ধারণাগত দুর্বলতা এবং ভ্রষ্টতা। তাদের ওয়ালা এবং বার’আ হল একটি নির্দিষ্ট দলের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা-র জন্য না । এই ধরনের আচরন তো আমাদের ওই কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা আল্লাহ তাঁর খালিল ইবরাহিম আলাইহিস সালাম, সম্পর্কে তার কিতাবে বলেছেন এবং আমাদেরো একই কথা তদের বলতে ইচ্ছা হয়- “স্মরণ করো যখন ইবরাহিম তার পিতা এবং সম্প্রদায়কে বলল, নিশ্চয়ই তোমরা যা কিছুর ইবাদাত করো, আমি সেসব হতে মুক্ত।”
.
যাদের দলান্ধতা এই রকম পর্যায়ে পৌছেছে যে তারা কোন দলের উপর ভিত্তি করে, ওয়ালা এবং বার’আ নির্ধারণ করে তাদের ব্যাপারে ইমাম ইব্*ন তাইমিয়্যা বলেছেন, তাদের জিহাদ হচ্ছে “জিহাদ ফি সাবিলিশ শাইতান”। অর্থাৎ ইমাম ইব্*ন তাইমিয়্যার মতে তাদের জিহাদ হল, শয়তানের পথে জিহাদ”। তিনি আরো বলেন যে এদের অবস্থা এবং এদের ব্যপারে হুকুম তাতারদের মতোই, এবং তাদের যুদ্ধ জিহাদ না। তিনি বলেন-

“যে কেউ কারো সাথে ওয়ালা (বন্ধুত্ব) স্থাপন করল এই কারণে যে, সে যাদের সমর্থন করে সেও তাদের সমর্থন করে এবং সে যাদের সাথে শত্রুতা করে সেও তাদের সাথেই শত্রুতা করে, সে হচ্ছে তাতারদের মতই একই শ্রেণীভুক্ত যারা শয়তানের পথে জিহাদ করে। তারা না মুজাহিদ ফী সাবিল্লিল্লাহ আর না মুসলিম সৈন্য। এটা অসম্ভব যে তাদের মত লোক মুসলিমদের যোদ্ধা হবে, বরং তারা তো শয়তানের যোদ্ধা।” [আল-ফাতাওয়া ২৮/১৯] .
ইব্*ন তাইমিয়্যার মতে যারা কোন নির্দিষ্ট দলের উপর ভিত্তি করে আল-ওয়ালা আল-বার’আ নির্ধারণ করে, তারা তাতারদের সমতুল্য ও শ্রেনীভুক্ত এবং শয়তানের পথে জিহাদকারী। তাহলে আজকে আমাদের সময়ে যে একটি দল মনে করে যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে কুফর এবং ইসলাম ত্যাগ করা তাদের দেখলে আপনি কি বলতেন হে আবু আব্বাস (ইব্*ন তাইমিয়া)? হে আবু আব্বাস আপনি কি বলতেন তাদের ব্যাপারে যারা বলে, “…তাই সাবধান, দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো।”
.
যদি নির্দিষ্ট কোন দলের ভিত্তিতে আল-ওয়ালা আল-বার’আ স্থাপনকারীদের ইমাম ইব্*ন তাইমিয়্যা শয়তানের পথে জিহাদকারী বলেন, তাহলে তাদের ব্যাপারে কি বলবেন যারা মনে করে যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া?? যারা একটি নির্দিষ্ট দলের ভিত্তিতে শুধু আল ওয়ালা ওয়াল বার’আ নির্ধারণ করছে না বরং একটি দলের ভিত্তিতে ঈমান ও কুফরের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে এই বলে যে “…তাই সাবধান, দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো।” – তারা কার সেনানী?
খেয়াল করুন, এই বক্তব্য কিন্তু উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে টুইটারের দেয়া কোন স্টেটমেন্ট না। এটা কোন টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের সময় বেখেয়ালে বলে ফেলা কথা না। এটা কোন অপ্রস্তুত বক্তার অপ্রস্তুতির কারনে ভুলবশত করে ফেলা হঠাৎ উক্তি না। বরং এটা একটা অফিশিয়াল বিবৃতি যেটা আগে লেখা এবং প্রস্তুত করা হয়েছে প্রধান মুখপাত্রের কন্ঠে অডিও রেকর্ডিং করার জন্য।
.
তবুও এমন হতে পারে যে দলান্ধ কেউ এখন এসে আমাদের কাছে দাবি করে বসবে যে আসলেই, ““ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে ঈমান ভঙ্গ করা”। অর্থাৎ আদনানীর ৫ই রমাদ্বানে দেয়া বক্তব্যে উচ্চারিত এই এই মূলনীতি কুরআনের এবং নবীর শরীয়াহ দ্বারা প্রমানিত, তাহলে তার আগে এটা চিন্তা করা উচিত যে মুবাহালার সময় আদনানী যখন বলেছিল তারা “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুসলিমদের মুরতাদ কাফির মনে করে না, তখন সে এই কথার মাধ্যমে “কুরআন এবং নবীর শরীয়াহর মূলনীতি” (দলান্ধ ব্যক্তির দাবি অনুযায়ী যা কুর’আন ও হাদীস দ্বারা প্রমানিত) অস্বীকার করেছিল।
.
যেসব মুজাহিদ এবং সমর্থকেরা এখনো “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটিকে সমর্থন করছেন, তারা যদি “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির করা মুবাহালাটিকে অনুমোদন করে থাকেন, যেখানে “দাওলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকেই দাওলা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মনে করে, এবং তাদের ইসলাম ত্যাগকারী হিসেবে গণ্য করে এবং তারা সংশয়, সন্দেহ এবং দলের স্বার্থ এবং এর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তাকফির করে” এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছিল; তাহলে তাদের উচিত নব ঘোষিত, শরীয়াহর সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক এই মনগড়া মূলনীতি ঘোষণার আলোকে তাদের অবস্থান পুনঃ বিবেচনা করা। কারণ নতুন এই ঘোষণা মুবাহালার সময়ে দেয়া বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো।
.
কারণ এই মূলনীতি, “…তাই সাবধান, দাওলাতুল ইসলামের (‘ইসলামিক স্টেট) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কারনে তুমি কুফরে পতিত হবে, তুমি তা উপলব্ধি করো আর না করো” – হল আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা লঙ্ঘন করে হিযবিয়্যাহ-র উপর ভিত্তি করে ঈমান ভঙ্গের ১১ তম কারণ তৈরী করা। অতএব সেইসব মুজাহিদ ভাই এবং সমর্থকদের উচিত এ ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা, কেননা এই ব্যাপারে আল্লাহর কাছে জিজ্ঞাসিত হতে হবে।
.
একজন আন্তরিক সত্যান্বেষী হয়ত জিজ্ঞেস করবেন, কিভাবে “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি এইরকম একটি মানব রচিত বিধান একেবারে ঘোষণা দিয়ে আরোপ করতে পারে যেটা সরাসরি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার করার আকী’দা ও তাওহীদের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক?

উত্তরটা হচ্ছে, একজন নিরপেক্ষ গবেষক – যিনি অনলাইন সমর্থকদের তর্ক-বিতর্ক, মিথ্যাচার, অপবাদ আর কুযুক্তির মারপ্যাঁচের গোলকধাঁধায় এখনো হারিয়ে জাননি, এবং যিনি জানেন শীঘ্রই তাঁকে আল্লাহর সামনে দাড়াতে হবে, এমন এক দিনে যেই দিন সত্য ছাড়া আর কিছুই তার কাজে আসবে না, এবং আল্লাহ বলবেন: আজকে সেইদিন যেইদিন সত্যবাদীরা তাদের সত্যের জন্য লাভবান হবে” – যদি বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং এগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ত্যাগ করে সম্পূর্ণ চিত্রটি অবলোকন ও অনুধাবন করার চেস্টা করেন তবে তিনি উপলব্ধি করবেন যে এটা (ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি ও তাদের ঘোষিত রাস্ট্র) ইসলামী খিলাফাহ-ও না আবার কোন খাওয়ারিজী রাষ্ট্রও না বরং এদুটো সাংঘর্ষিক ব্যাখ্যা বেশ জোরেশোরে প্রচারিত হলেও এদুটোই সত্য থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। আমি এখানে সংক্ষিপ্তভাবে এই ব্যাপারে আলোচনা করবো, এবং ইন শা আল্লাহ অন্যত্র আমি বিস্তারিত ভাবে এর ব্যাখ্যা করব।
.
ইসলামে খিলাফাহ রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে “উম্মাহর সম্মতি”তে ও পরামর্শের উপর ভিত্তি করে নেতৃত্ব ঠিক করা হবে, যেমনটি আল্লাহ বলেন, “তাদের বিষয়গুলো তাদের মধ্যে পরামর্শ করে হয়।” এবং এই ব্যাপারে আল্লাহ তাঁর নবী ﷺ কে আদেশ করেন, “তাদের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ (শূরা) কর।” এই আয়াতের ব্যাপারে ইব্*ন তাইমিয়্যা বলেন: “নবী (সা) ﷺ ব্যতীত অন্যরা তো তাহলে পরামর্শের (শূরার) ব্যাপারে আরো বেশি দায়বদ্ধ।” (মাজমু আল-ফাতাওয়া: ২৮/৩৮৭)।
.
এবং ইব্*ন তাইমিয়্যা খুলাফা রাশিদা আবু বকর সিদ্দীক (রা) এর বা’য়াহর ব্যাপারে বলেন, “যদি উমার এবং সেখানে থাকা অন্যান্য সাহাবা (রা) ব্যাতীত অন্যান্য সাহাবারা (রা) তাকে বা’য়াহ না দিত, তবে তিনি খলিফা হতে পারতেন না। নিশ্চয়ই তিনি খলিফা হয়েছিলেন যখন বেশির ভাগ সাহাবারাই তাকে বা’য়াহ দিতে একমত হয়ে গিয়েছিলেন।” (মিনহাজুস-সুন্নাহ, ১:৫৩০) এবং তিনি, ইব্*ন তাইমিয়্যা খুলাফা রাশিদা উমার ফারুক (রা) এর বা’য়াহর ব্যাপারে বলেন, “ঠিক তেমনি উমারের ক্ষেত্রে, আবু বকর তাকে নিয়োগ দেয়ায় তিনি শুধু নেতা হয়েছিলেন, একমাত্র বা’য়াহ দেয়ার পরই তিনি খলিফা হয়েছিলেন। যে কারণে আবু বকর তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, তিনি সেটা বজায় না রাখতেন, তবে তাকে বা’য়াহ দেয়া হত না, তিনি খলিফা হতে পারতেন না, সেটা জায়েজ আর নাজায়েজ যাই হোক না কেন। (মিনহাজুস-সুন্নাহ, ১:৫৩০)

বুখারীতে বর্ণিত, উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, “উম্মাহর সাথে পরামর্শ না করে যদি কাউকে বা’য়াহ দেয়া হয়, তাহলে তোমরা সেই ব্যক্তিকে বা’য়াহ দিবে না, এবং তাদের দুইজনকেই (বায়াহ দানকারী ও বায়াহ গ্রহণকারী) হত্যা কর।” (বুখারী: ৬৮৩০) এবং বুখারী খুলাফা রাশিদা উসমান (রা) এর বা’য়াহর ব্যাপারে বলেন, “এবং লোকেরা সেই রাতগুলোতে (উসমান রা. এর নিযুক্তির আগের রাতগুলো) পরামর্শ, আলোচনা ও শূরার জন্য আব্দুর রহমান ইব্*ন আউফ (রা) এর সাথে অবস্থান করেছিল।” (বুখারী: ৭২০৭) আহলুস সুন্নাহর ইমাম আহমাদ ইব্*ন হানবাল বলেন, “তোমরা কি জানো যে ইমাম কে? ইমাম হচ্ছেন তিনি যার ব্যাপারে মুসলিমদের ঐক্যমত এই যে, তারা সবাই বলছে ইনি হচ্ছেন আমাদের ইমাম! এটাই হচ্ছে ইমাম হবার অর্থ।” (মিনহাজুস-সুন্নাহ, ১:৫৩০)

.
ইসলামী খিলাফাহ দ্বারা একটি পরিণতি ও ফলাফলকে বোঝানো হয়। কোন ব্যক্তির ব্যাপারে মুসলিমদের পছন্দ ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে এই পরিনতি ও ফলাফলে (অর্থাৎ খালিফা হিসেবে উক্ত ব্যক্তির নিযুক্তি) উম্মাহ উপনীত হয়। উম্মাহ-র সাথে কোন আলোচনা না করে একজন লোককে “খালীফা” ঘোষণা করা আর তারপর সবার কাছে বা’য়াহ চাওয়ার নাম খিলাফাহ না। এরকম করার হল শক্তিপ্রয়োগের জোর পূর্বক (তাঘাল্লুব) উম্মাহ-র নেতৃত্ব দখল। এটা হল উম্মাহ-কে পরাধীন করে উম্মাহ-র উপর কতৃত্ব গ্রহণ এবং এটা ইসলামী খিলাফাহ না। মুসলিমরা কোন ব্যক্তির খিলাফাহ হবার ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছানোর আগেই কাউকে খালীফাহ বলে ঘোষণা দেয়া, হল কোন ব্যক্তির একটি একটা খালি প্রান্তরকে “প্রাসাদ” বলে ঘোষণা দেয়ার মত। ওই ব্যক্তি ঐ প্রান্তরে একটি সুউচ্চ প্রসাদ নির্মাণের ইচ্ছা থেকে একটা প্রান্তরকে “প্রাসাদ” নামকরণ করে ঘোষণা দিলেই যেমন সেই প্রান্তর একটা সত্যিকারের প্রাসাদ হয়ে যাবে না তেমনি আপনি এরকম একজন ব্যক্তিকে খালীফাহ ঘোষণা করলেই সে রাতারাতি খালীফাহ হয়ে যাবে না । এরকম করা হল নিজের খেয়াল খুশি মত এক ধরনের রূপকার্থে নামকরণ। এটা কোন দ্বীনি বাস্তবতা না, এবং এরকম করার কোন দ্বীনগত ভিত্তি নেই।

ইসলামী খিলাফাহ রাস্ট্রের মৌলিক ও প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি হল, সকল পর্যায়ের, সকল শ্রেনীর, সব রকম মানুষের উপর বৈষম্যহীনভাবে আল্লাহ-র শারীয়াহ প্রয়োগ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এবং এটা করতে হবে ইসলামী নিয়ম-নীতি, হুকুম-আহকামের উপর ভিত্তি করে, শারীয়াহ-র সাথে সাংঘর্ষিক কোন বিদা’ত এবং মনগড়া নিয়ম-নীতি দিয়ে না।
.
ইসলামী খিলাফাহর বৈশিষ্ট্য হল মুসলিমদের প্রতি দয়ালু এবং নম্র হওয়া। এই বৈশিষ্ট্যটিকে ইমাম এবং ফুকাহবৃন্দ যুদ্ধে নেতা হবার জন্যও প্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন,যেমনটা ইমাম আহমাদ বলেছেন, “তারা শুধুমাত্র তাদের অধীনে লড়াই করে যাদের মুসলিমদের প্রতি দয়া এবং যত্ন রয়েছে।” [আল-মুঘনি ১৩: ১৪] মুসলিমদের প্রতি দয়াশীল হওয়া মানে শুধু এই না যে তাঁরা নেতার পক্ষ থেকে কোন ক্ষতির সম্মুখীন হবে না বরং দয়াশীলতার অর্থ এ-ও যে নেতা তাঁদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না। ইব্*ন কুদামা নেতৃত্বের আসনে আসীন ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে বলেন, “তাঁদের ভেতর বিশ্বস্ততা, দয়া এবং মুসলিমদের উপদেশ দেবার গুণ থাকা আবশ্যক … এবং এমন ব্যক্তিকে নেতৃত্বে দিতে হবে যে মুসলিমদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে না।” [আল-মুঘনি ১৩: ১৬]। এবং দ্বীনের শাখাসমূহ যেসব বইয়ে আলোচিত হয়েছে সেগুলোতে জিহাদ বিষয়ক অধ্যায়সমূহে এরকম বিভিন্ন উক্তি রয়েছে।
.
যে-ই প্রকৃত ইসলামী খিলাফাহ এবং ইসলামিক নেতৃত্বের যে বর্ণনা আমরা আমাদের দ্বীন থেকে পাই তার সাথে ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি মিলিয়ে দেখবে, সেই বুঝতে পারবে যে এই দলটির সাথে “খিলফাহ” নামটি যুক্ত করাই চূড়ান্তরকম অপমানজনক এবং এই শব্দের অপব্যবহার। এরা এমন একটি দল যাদের নেতৃত্বের সুন্নাহ হল উম্মাহর সাথে পরামর্শ না, বরং জোর-জবরদস্তি করা। তারা মুসলিমদের উপর যুলুম ও নির্যাতন করে, তারা সমানভাবে সকলের উপর শারীয়াহ আরোপ করে না; বিশেষ করে তাঁদের নিজেদের নেতাদের ব্যাপারে এবং তারা তাওহীদ ও শারীয়াহ-র ব্যাপারে মনগড়া বিদা’তী মূলনীতি আরোপ করে। এগুলোর কোন ইসলামী খিলাফাহ এবং এর নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
.
আর যারা এই দলটিকে ঢালাওভাবে “খাওয়ারিজ স্টেট” বলছেন, তাঁদের বক্তব্যও অনেক দিক থেকে বাস্তবতার সাথে মেলে না। হাদিসে যেই বিদ্রোহী দলের বর্ণনা আছে এবং যাদের পরবর্তীতে “খাওয়ারিজ”, হারুরিয়্যাহ, “শুরাত” এবং “মুহাক্কিমাহ” বিভিন্ন নামে অভিহত করা হয়েছে, তারা ছিল কঠোরভাবে আদর্শিক দল যাদেরকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে চেনা যেত। এই লোকেরা তাদের নেতা এবং তাদের অনুসারী সকলের উপর সমান কঠোরতার সাথে তাদের আদর্শ ও বিশ্বাস প্রয়োগ করতো। এমনকি কোন বিষয়ে তারা তাদের নেতাদেরও বহুবার তাওবাহ করতে বলত ও বাধ্য করতো, আবার তাঁরা যদি সেই অবস্থান থেকে সরে আসে তাহলে যে তাওবাহ করা হয়েছিল সেটার উপর তাওবাহ করতেও নিজেদের নেতাদের বাধ্য করতো। আবুল হাসান আল-আশ’আরী, যিনি মুকালাতুল ইসলামিয়্যীনের ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তি, তিনি কিছু উদাহরণ এনেছেন (মুকালাতুল ইসলামিয়ীন ৯২, ১১০) যেখানে তিনি প্রকৃত খাওয়ারিজ যারা সমান ভাবে সকলের উপর চরমপন্থী আকী’দা প্রয়োগ করে এবং এমন কোন দল যারা নিজের দলের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কপটতার সাথে চরমপন্থী নীতিপ্রয়োগ করে – এই দুই দলের মধ্যে পার্থক্য করেছেন।
.
সুতরাং এই মাপকাঠির ভিত্তি সত্যের সবচাইতে নিকটবর্তী কথা হল, “আমাদের সময়ের ঘুলাতদের (চরমপন্থী) কিছু এমন আছে যাদের ঘুলুহ (চরমপন্থ) অনেক দিক দিয়ে পূর্বের হারুরিয়্যাহদের চাইতেও তীব্রতর।” যেমন খাওয়ারিজরা কঠোরভাবে আদর্শ ও নীতি মেনে চলতো, যদিও তাদের আদর্শ ভুল ছিল। একারনে খাওয়ারিজরা তাদের অনুসারী ও তাদের নেতৃবৃন্দ সকলের উপরই তাদের বিদ’আতী নীতিমালা ও আদর্শ সমানভাবে সমান কঠোরতার সাথে প্রয়োগ করতো এবং প্রয়োজনের তাদের তাওবাহ করতে বাধ্য করতো। কিন্তু “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটি তাদের নেতা এবং প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়।

পূর্বের খাওয়ারিজদের বেশীরভাগেরই বৈশিষ্ট্য ছিল কবীরা গুনাহর কারণে মুসলিমদের তাকফির করার আকীদা। কবীরা গুনাহসমূহ বড় রকমের নাফরমানী ও আল্লাহ-র বেধে দেওয়া সীমার লঙ্ঘন। কিন্তু কবীরা গুনাহ করার কারণে কেউ কাফির হয়ে যায় না। আর আমাদের সময়ের এই ঘুলাত চরমপন্থীরা কবীরা গুনাহ তো বটেই, এমনকি কবীরা গুনাহর চেয়েও ছোট ব্যাপারে তাকফির করে। এমনকি তারা এমন অনেক কাজের উপর তাকফির করে যেগুলো হারাম না এবং এই কাজগুলোর করার কারণে কোন মুসলিমের কাফিরে পরিণত হবার প্রশ্নই আসে না।
আরেকটি দিক যেদিক দিয়ে বর্তমান ঘুলাত পূর্বের খাওয়ারিজদের চাইতে ভিন্ন তা হল পূর্বের হারুরিয়্যাহ কুর’আন তিলাওয়াত এবং সালাতে তাদের সময় ব্যয় করতো। তারা ইবাদাতের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিল এবং প্রচুর ইবাদাত করতো। কিন্তু আজকের ঘুলাত-চরমপন্থীদের সময় কাটে নাশীদ শুনে এবং ইন্টারনেটে তাদের দলের সমর্থনে তর্ক-অপমান, গালিগালাজ করে ইবাদাতকে এড়িয়ে যাওয়াদের মাধ্যমে। আরেকটি দিক হল হারুরিয়্যাহ মিথ্যা বলত না, যেখানে আজকে ঘুলাতরা নিজের দলের জন্য কারনে-অকারনে মিথ্যা বলাকে জায়েজ মনে করে, তাই তারা তাদের দলকে ভালো প্রমানের জন্য এবং অন্য দলগুলোকে খারাপ প্রমানের জন্য ক্রমাগত মিথ্যাচার করে।
.
বরং যারা খাওয়ারিজদের এবং “ইসলামিক স্টেট” নামক দলটির সদস্য ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্টদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন তারা অনুধাবন করবেন, আসলে এদের সাথে খাওয়ারিজদের তুলনা করার মাধ্যমে খাওয়ারিজদের অপমান করা হচ্ছে এবং ইসলামিক স্টেট” নামক দলটিকে খাওয়ারিজ বলাটা হবে পূর্বের খাওয়ারিজদের উপর জুলুম।

এটা খেয়াল করাও গুরুত্বপূর্ণ যে, “তায়িফাতুল মারিক্বা” (যে দল দ্বীন ত্যাগ করেছে) এর ব্যাপারে কুরআন এবং সুন্নাতে কি বিধান এসেছে সেই অনুযায়ী আমাদের এই অবস্থাকে বিবেচনা করতে হবে। “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র ব্যাপারে প্রায়ই একটা ভুল করা হয়, আর তা হল “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র যেসব বৈশিষ্ট্যসমূহ আমরা কুর’আন ও সুন্নাহ থেকে পাই, সেগুলোকে শুধুমাত্র পূর্বের খাওয়ারিজদের বৈশিষ্ট্য ও বক্তব্যসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা। শুধুমাত্র খাওয়ারিজরাই কিন্তু “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র অন্তর্ভুক্ত একমাত্র গোষ্ঠী না। এই ভুলটি বেশ বিস্তৃতি লাভ করেছে। কিন্তু আমাদের এই বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
.
নবীজী ﷺ আমাদের বিভিন্ন দলের অস্তিত্ব ও আবির্ভাবের কথা বলেছেন। “তায়িফাতুল মারিক্বা”, যার বিরুদ্ধে নবীজী ﷺ যুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন তাদের সুপষ্ট ও প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা দ্বারা তাদের সনাক্ত করা যাবে, তা হল “তারা ইসলামের সন্তানদের (মুসলিমদের) হত্যা করবে”। এটি সহীহ বুখারী এবং মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। এর অর্থ তারা মুসলিমদের হত্যা করাকে ইবাদাত মনে করবে এবং ইবাদাত হিসবে মুসলিমদের হত্যা করবে। এই মূল বৈশিষ্ট্য ছাড়া বাকি বৈশিষ্ট্যগুলো হল গৌণ যেগুলোর ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে এইরকম “তায়িফাতুল মারিক্বা”-দের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই দ্বীন থেকে আমরা “তায়িফাতুল মারিক্বা” সম্পর্কে যা যা জানতে পারি সেটাকে শুধুমাত্র ইতিহাসে কি ঘটেছে সেই আলোকে বিশ্লেষণ করা ভুল। অর্থাৎ আমরা শুধু ঐতিহাসিকভাবে যেসব “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র আবির্ভাব ঘটেছে শুধু তাদের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করবো কুর’আন ও সুন্নাহ থেকে অন্য যেসব বৈশিস্ট্যের কথা আমরা জানতে পাই সেগুলো বিবেচনা করবো না – এরকম মনে করা ভুল।
.
তাই খাওয়ারিজদের ব্যাপারে যে বর্ণনা এসেছে শুধু সেগুলর মধ্যে “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র বৈশিষ্ট্য সীমাবদ্ধ করা যাবে না। কুর’আন ও সুন্নাহ থেকে যেসব বৈশিস্ট্যের বর্ণনা আমরা পাই সেগুলোকে সাধারণভাবে আমরা “তায়িফাতুল মারিক্বা-র বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করবো। শারীয়াহর বিপরীতে শুধুমাত্র ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে সুন্নাহর অস্বীকার অথবা কবীর গুনাহর উপর কাউকে তাকফির করার উপর ভিত্তি করে খাওয়ারিজদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করাটা ভুল। এগুলো কিন্তু হাদিস হতে বর্ণিত নয়। বরং সেগুলো পূর্বের খাওয়ারিজদের চরিত্রে ফুটে উঠেছিল। অর্থাৎ খাওয়ারিজ হতে হলে কবীরা গুনাহ-র উপর তাকফীর করতেই হবে, যদি কেউ এরকম না করে তাহলে তারা খাওয়ারিজ না – ব্যাপারটা এমন না।

আমরা যদি পূর্ববর্তী খাওয়ারিজদের মধ্যে যা প্রকাশ পেয়েছে শুধুমাত্র তার উপর খাওয়ারিজদের বৈশিষ্ট্য সীমাবদ্ধ করি তাহলে তো আমাদের এটাও বলতে হবে যে কেউ যদি কুর’আন সৃষ্ট একথা বিশ্বাস না করে তাহলে সে খাওয়ারিজ না। কারণ পূর্বের সব খাওয়ারিজরা বিশ্বাস করতো কুর’আন হচ্ছে সৃষ্ট (নাউযুবিল্লাহ)। যেমন আল আশা’আরী লিখেছিলেন, “সব খাওয়ারিজই বলে যে কুরআন হচ্ছে সৃষ্ট।” (মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন: ১০৮)। আবার মুশরিকদের সন্তানদের ব্যাপারে শারীয়াহ-র হুকুম কি হবে, এই ব্যাপারে খাওয়ারিজদের মধ্যে প্রবল মতপার্থক্য থাকে। একারনে পূর্বের খাওয়ারিজদের মধ্যে কি কি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে এটর ভিত্তিতে আমরা খাওয়ারিজ এবং “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র সংজ্ঞা তৈরি করবো না। আমরা এটা করবো কুর’আন ও সুন্নাহ-র বর্ণনা অনুযায়ী।
.
এবং এক্ষেত্রে যে ভুল ধারণাটা সবচাইতে বেশি পরিলক্ষিত হয় তাহল এই বিশ্বাস যে “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র অন্তর্ভুক্ত হল শুধুমাত্র তারাই, “যারা কবীরা গুনাহর উপর তাকফির করে”। হাদিস এবং ইতিহাস দুটির উপর আলোকেই এরকম ধারণা ভুল। হাদীসে শুধুমাত্র মুসলিমদের হত্যা করার ব্যাপারটা উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে শরীয়াহ অননুমোদিত যেকোন কারণে মুসলিমদের হত্যা করা। এটা কবীরা গুনাহর জন্য, নাকি সগীরা গুনাহ-র জন্য, নাকি মুস্তাহাবের জন্য, নাকি মাকরুহের জন্য, এরকম কোন কিছু নির্দিষ্ট করে হাদীসে বলা হয় নি। তাই আমরা বৈশিষ্ট্য হিসেবে গ্রহণ করবো যে, “তারা মুসলিমদের হত্যা করবে। “ইতিহাস থেকেও দেখে যায় যে সব খাওয়ারিজ কিন্তু কোন বিধি নিষেধ ছাড়া কবীরা গুনাহর উপর তাকফির করত না।

আবুল হাসান আল-আশা’আরী, যিনি এই ব্যাপারে সবচেয়ে বিশুদ্ধ বর্ণানাকারী; বলেছেন, “খাওয়ারিজদের মধ্যে একটা বিষয়ে মতৈক্য ছিল যে সকল কবীরা গুনাহই কুফরী, তবে নাজদী খাওয়ারিজরা ছিল এর ব্যতিক্রম। তারা কবীরা গুনাহ-র কারণে তাকফির করতো না।” (মাকালাতুল ইসলামিয়্যীন: ৮৩)। অর্থাৎ নাজদী খাওয়ারিজরা কবীরা গুনাহ-র কারণে তাকফির না করা সত্ত্বেও তারা খাওয়ারিজ ছিল। যার অর্থ কবীরা গুনাহ-র উপর তাকফির না করলে কোন দল খাওয়ারিজ না – এই কথা ভুল। “তায়িফাতুল মারিকা”,হারুরিয়্যাহ, খাওয়ারিজ – এই দলগুলোর সবার ব্যাপারে যদি এভাবে সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করে ফেলা হয়, “তারা কবীরা গুনাহর উপর তাকফির করে” – তখন এই সমস্যা হয় যে যদি কোন দল যারা কবীরা গুনাহর উপর তাকফির না করে, তবে তাদের “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না, যদিও তাদের মধ্যে “তায়িফাতুল মারিক্বা”-র প্রধান বৈশিষ্ট্য – অর্থাৎ মুসলিমদের হত্যা করা এবং একে ইবাদাত মনে করা ও দাবি করা – বিদ্যমান থেকে । বরং মূল ব্যাপারটা হল যারা মুসলিমদের রক্ত হালাল করে নেয় এবং এটাকে ইবাদাত মনে করে, তারাই হচ্ছে “তায়িফাতুল মারিক্বা”, যেমনটা নবীজী ﷺ বর্ণনা করেছেন।
.
‘খাওয়ারিজ হল তারা যারা কবীরা গুনাহর উপর তাকফির করে’ – এরকম বলার চাইতে বরং এটা বলা অধিক যথার্থ সংজ্ঞা হল, ‘তারা এমন কোন কাজের উপর তাকফির করে,যেটা তাকফির করার মত কাজ না, সেটা হতে পারে কবীরা গুনাহ বা এর চেয়ে ছোট কোন গুনাহ অথবা গুনাহই না।‘ তাই যারা কবীরা গুনাহর উপর তাকফির করে তারা হচ্ছে হারুরিয়্যাহ। আর যারা রিদ্দা না এবং কবীরাহ গুনাহ না এমন কাজের উপর তাকফির করে – অর্থাৎ এমন কিছুর উপর তাকফির করে যা ওয়াজিব, অথবা মুস্তাহাব, অথবা মাকরুহ, অথবা সগীরা গুনাহ – তারা খাওয়ারিজদের চেয়েও বড় শয়তান! আর আজকের ঘুলাত-চরমপন্থীরা যে কাজের জন্য তাকফির করা যায় না সেটার ব্যাপারেও তাকফির করে এবং পরে আবার বলে বেড়ায় যে তারা নাকি কবীরা গুনাহর উপর তাকফির করে না, কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না যে এর ফলাফল হচ্ছে খাওয়ারিজদের চেয়েও ভয়ংকর! কারণ যে কাজ রিদ্দা না, এবং কবীরা গুনাহ না সেই কাজ নিশ্চিতভাবেই এ দুটোর (রিদ্দা ও কবীরাহ গুনাহ) চেয়ে কম গুরুতর বিষয়। অথচ তারা এই কাজের উপর তাকফির করছে।