বচনিয়ায় জাতিসংঘের সামরিক হস্তক্ষেপে আর কত রক্ত চাই
-আব্দুল্লাহ আল নাসের
==============================================================
আবারও চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিলো বিশ্ব মুসলিম স্বার্থ রক্ষার প্রতিষ্ঠান ওআইসি নামক সংস্থাটি। চিরাচরিত কায়দায় চলতি মাসের ১ ও ২ তারিখে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সম্মেলন শেষে এক খসড়া প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদকে জাতিসংঘ লঙ্গনকারী সার্বীয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ ও বসনিয়ার উপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়, অর্থাৎ পুরনো রেকর্ড গুলি আবার বাজানো হয়েছে। ওআইসির ৬ মাস পূর্বেকার ইস্তাম্বুলের সভা এবং বিভিন্ন সময়কার আহবানেও বারংবার এই রেকর্ডগুলি বাজানো হয়েছিল। বসনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকারের পর সম্মেলন আহবানের সময় ওআইসির মহাসচিব হামিদ আল গাবিদ বলেছিলেন "পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বসনিয়ার সার্বদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে"।
স্বভাবতই আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে এবার বুঝি মুসলিম বিশ্বের ঘুম ভাঙবে। জাতিসংঘ পশ্চিমা জগতের বসনিয়া নিয়ে নাটক করার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেবে। মুসলিম মুজাহিদরা একজন তারিক বা কাসেমের নেতৃত্বে তাদের বসনিয় ভাইদের রক্ষা করতে ছুটে যাবে আবার সেই ঐতিহাসিক বসনিয়ার বুকে। মর্দেমুজাহিদ' তুর্কি সুলতান মুরাদ অথবা সুলতান মুহাম্মদের ন্যায় সার্বদের মাটিতে মুসলিম রক্তপিপাসু সার্বিয় পিশাচদের মিটিয়ে দেবে যুদ্ধের সাধ। কিন্তু না! সম্মেলন শেষে দেখা গেল মহাসচিবের কথা নিছক বাগাড়ম্বরই। অর্থাৎ যত গর্জে তত বর্ষে না। অবশ্য দু একটি দেশ ১৫ই জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংঘ যদি কোনো বাস্তব পদক্ষেপ না নেয়, তবে জাতীয় সংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বসনিয়ায় অস্ত্র প্রেরণের কথা বলেছে। ভালো উদ্যোগ এবং নিঃসন্দেহে এটা একটা ঈমানী কাজ হবে, কিন্তু তা এত বিলম্ব কেন? তাদের এই মুহূর্তে অস্তিত্ব রক্ষায় অস্ত্রের খুবই প্রয়োজন। গত একমাস যাবত ওআইসি সহ সমগ্র বিশ্ব জাতীয় সংঘকে বসনিয়ার আত্মরক্ষার জন্য সে দেশের উপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বলেছে। কিন্তু জাতিসংঘ তাতে কর্ণপাত করেনি বরং সার্বদের হাতে একের পর এক বসনিয় নগরীর পতন করতে দেখেছি। অধিকৃত এলাকার মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করে এলাকা শুদ্ধিকরণ দেখেছে। মুসলিম তরুণী ও কিশোরীদের ধর্ষণ শেষে হত্যা করার জন্য সার্বদের দর্শন শিবির স্থাপন করাও প্রত্যক্ষ করেছে এই জাতীসংঘ। এই জাতিসংঘ এবং সভ্যতা ও মানবাধিকারের আলখেল্লা পরা পাশ্চাত্য দেশগুলি। সার্ব বাহিনী সারাজোভো নগরীর সাথে বহিঃবিশ্বের যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা বন্ধ করে, সেখানে ট্যাঙ্ক মোতায়েন করে, নগরীর অবরুদ্ধ অধিবাসীদের নগর ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়েছে, বিমানবন্দর পূর্বাহ্নেই বন্ধ হয়ে গেছে, সার্বীয়দের চোরাগুপ্তা হামলার জন্য। সুতরাং তীব্র শীতে খাদ্য বস্ত্র পানীয় ও অস্ত্রের অভাবে এমনকি বহিঃবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নগরীর মানুষগুলো কবরের পরিবেশে বাস করছে। এরকম আর কয়েকদিন চললেই সারাজোভোর পতন অনিবার্য। এ পরিস্থিতি উন্নতির জন্য বসনিয়াদের এখন গোলাবারুদের দরকার, অথচ জাতিসংঘ পশ্চিমা বিশ্বের নেই কোনো উদ্বেগ! যেন সারাজোভোর পতনই তাদের একান্ত কাম্য। এই নগরীর পতন ঘটলে তারা বেশি বেশি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে পারবে। মানবসেবার বহরও বৃদ্ধি পাবে! কী বিচিত্র মানবসেবা!!
মুসলিম দেশগুলিও যদি সারাজোভোর পতন দেখতে না চায় আর যদি জাতিসংঘ প্রস্তাব উপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছে থাকে তাহলে বসনিয়াদের এই মুহূর্তে অস্ত্র সরবরাহ করছে না কেন!? সুদূর ১৫ জানুয়ারির পর সারজোভের যদি অস্তিত্ব না থাকে তবে তারা কোথায় বা কাদের উপকারের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করবে!? ১৫ জানুয়ারি কেন খুব শীঘ্র যে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের সামরিক হস্তক্ষেপের উদ্যোগ নেবে না সে কথা তো ওআইসি সম্মেলনে আগত সাবেক যোগশ্লাভিয়া সংক্রান্তঃ জেনেভা ভিত্তিক সম্মেলনের সহ-চেয়ারম্যান মিস্টার সাইরান্সভান্স এবং ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের দূত মিঃ ওয়েন সাংবাদিকদের কাছে স্পষ্ট বলে গেলেন। তার পরেও কেন এত বিলম্ব?
বসনিয়ায় গত এক বছর যাবত যা কিছু ঘটেছে তার জন্য পুরোপুরি দায়ী জাতীয় সংঘ নামক সংস্থাটি। মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় এ সংস্থাটি সাংঘাতিক বিস্ফোরক জাতীয় কথা বলায় ভারী ওস্তাদ। বিশ্ব বিবেককে বোকা মনে করে মানবাধিকার রক্ষার মোড়কে এযাবত বসনিয়ার বেলায় যতগুলি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার সবই ছিল বসনিয়ার মুসলমানদের স্বার্থবিরোধী। জাতিসংঘের সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু তাদের তদারক করার মতো কাউকে নিয়োগ করেননি। ঐ নিষেধাজ্ঞার আওতায় বসনিয়াকে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ এই সদ্য স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তখন প্রধান জরুরী কাজ ছিল অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহ করা। অথচ চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবিলা করে তারা যাতে টিকে থাকতে না পারে সে জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে মানবধিকার রক্ষার বাহানায় তাকে এক ঘরেকরে রাখা হয়েছে। দীর্ঘ আট মাস পরে যখন যুদ্ধের মোঠ ঘুরে যাচ্ছে বসনিয়রা চোরাচালানের মাধ্যমে কিঞ্চিৎ অস্ত্র পেয়ে আত্মরক্ষা করে চলেছে। ঠিক তখন তাদের সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করার জন্য আড্রিয়াটিক সাগরে নৌ অবরোধ জোরদার করার জন্য পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে। জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীর কানাডা ও ফ্রান্সের সৈন্যদের সার্বদের সাহায্য করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে অন্যদিকে আড্রিয়াটিক সাগরে মোতায়েন পশ্চিমা যুদ্ধজাহাজগুলো কেউ অবরোধ জোরদার করার নামে নিজেরাই সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোতে বিভিন্ন পণ্য ও অস্ত্র সরবরাহ করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। দু'মাস পূর্বে বসনিয়ার আকাশকে বিমান উড্ডয়ন মুক্ত ঘোষণা করেছিল এই জাতিসংঘ। কিন্তু তাও তদারক করার কেউ ছিল না। সার্বীয় জঙ্গিবিমান এ পর্যন্ত ১৪২ বার সে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন নগরে ও স্থাপনায় বোমাবর্ষণ করেছে। দীর্ঘ সময় শেষে নো-ফ্লাইজোন তদারক করার জন্য জাতিসংঘ ভাবছে বসনিয়ার উপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার প্রশ্নে কোনো কোনো কর্মকর্তা দাঁত বের করে জবাব দিচ্ছে। "বসনিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে বলকান এলাকায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে" অর্থাৎ বসনিয়ারা অস্ত্র ফেলে যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হবে তারচেয়ে ওরা বিনা অস্ত্রে একতরফা মার খেয়ে স্বমূলে মারা যাক সেটাই ভালো। তাহলে বলকান এলাকায় আর যুদ্ধ ছড়াবে না। একেই বলে শান্তির পৃথিবী গড়ার নিউ ওয়াল্ড অর্ডার।
বসনিয়ার পরিস্থিতি মার্কিন নীতির খোলস খুলে ফেলছে সার্বীয় বাহিনী গেল সপ্তাহে একটি মার্কিন পরিবহন বিমানকে গুলি করে ক্ষতিগ্রস্ত করার পর বিমানবন্দরে ত্রাণ পরিবহন অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এর পূর্বে একটি ইত্যাদিও পরিবহন বিমান অনুরূপভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল কিন্তু এ সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য কে দায়ী তা তদন্ত করার জন্য ফ্রান্স আমেরিকার কোন উদ্যোগ নেই। অথচ লকারবির বিমান দুর্ঘটনার জন্য নিছক সন্দেহ করে লিবিয়ার ওপর কত অন্যায় ও জঘন্য প্রতিশোধ নিলো। একই সময়ে ফ্রান্স ও বৃটেনের ধারণা যে বসনিয়ায় নো-ফ্লাইজোন কড়াকড়ি করলে বা বসনিয়ার ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে সার্বিয়রা তাদের বাহিনী যা ঐ এলাকায় মোতায়েন আছে তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে। সবচেয়ে বড় সুপারপাওয়ার আমেরিকার যুদ্ধ মন্ত্রীর ভাবনা আরো এককাঠি সরেস। বসনিয়ায় মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে তা তার বোধগম্য হচ্ছে কিন্তু ও মানবাধিকার রক্ষা করার আমেরিকার সৈন্যদের হস্তক্ষেপ করতে দিতে রাজি নন! কেননা বসনিয়া পর্বত্যময় এলাকা, ইরাকের মত সমতল নয় যে কার্পেটিং বোম্বিং করে মানবাধিকার রক্ষা করা যাবে। মার্কিন সৈন্যদের হয়তো পার্বত্য যুদ্ধের কোন ট্রেনিং নেই তাই এই মহা পন্ডিত মার্কিন সৈন্যদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার ঘোরবিরোধী। সর্বপ্রধান কথা বসনিয়ায় কোন মার্কিন স্বার্থ নেই যা আছে সোমালিয়ায়। সোমালিয়ায় অল্প ব্যয়ে এবং কম ঝুঁকি নিয়ে সহজেই মানবাধিকারের ত্রাণকর্তা সেজে বিশ্বের বাহবা করানো সম্ভব। সোমালিয়ার খোলা মাঠে গোল দিতে মার্কিনীদের যত সহজে সম্ভব বসনিয়ায় তত সহজ নয়। এছাড়া বসনিয়ায় হস্তক্ষেপ করার জন্য যে পরিমাণ দুর্ভিক্ষ মহামারী বা খারাপ পরিস্থিতির প্রয়োজন তা নাকি এখনো ঘটেনি। সবেমাত্র না টাইফয়েডের প্রাদূর্ভাবের খবর শোনা যাচ্ছে। প্রচন্ড বোমা বর্ষণের ফলে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লোকজন কেবল দূষিত পানি পান করে তারপরে টাইফয়েডে আক্রান্ত হচ্ছে। মরুক না সোমালিয়ার মত প্রতিদিন হাজার হাজার বসনিয়। তারপরে না হয় মানবাধিকার উদ্ধারে মহামানবদের পাঠানো হবে। আপাতত সোমালিয়ার যাত্রা শুভ।
পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতায় বসনিয়ার উপর আঘাত হানা হয়েছে। ওআইসি সম্মেলন উপলক্ষে বসনিয় প্রেসিডেন্ট আলিজা ইজ্জত বেগ যখন দেশের বাইরে ঠিক তখনি তারা অজ্ঞাতে সারাজোভো বিমানবন্দরে ক্রোট ও সার্ব যুদ্ধ কমান্ডারদের এক গোপন বৈঠক বসে এবং সে বৈঠকে দুপক্ষের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। ইতিপূর্বে বসনীয় ও ক্রোটরা মিলিতভাবে সারাজোভো নগর প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী ক্রোটদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে সার্বরা সারাজোভো সহ বিভিন্ন নগরীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। দখল করে নেয় সারাজোভোর সাথে বাইরের সংযোগ সড়কটি।
সুতরাং বসনিয় মুসলমানরা আজ এক বিরাট ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন একপ্রকার বিনা অস্ত্রে আল্লাহর উপর অটল বিশ্বাস ধৈর্য আর অসীম সাহায্যকে পুজি করে তারা টিকে আছে। কিন্তু পরিস্থিতি বৈরী পরিবেশ কুচক্রীদের অব্যহত চক্রান্তের ফলে তাদের ধৈর্য সাহসের বাঁধ ভেঙে পড়ার উপক্রম। ইতিহাসের অতল তলে হারিয়ে যাওয়ার হুমকির সম্মুখীন ইউরোপের বুকের একটি সভ্য মুসলিম জাতি। আজ আমরা মুসলিম জাতি যদি তাদের এই দুর্দিনে সকল অপশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব যে ফেলে তাদের সাহায্যে ছুটে না যায় আর আমাদের অবহেলা কর্তব্যহীনতায় তাদের উপর নেমে আসে কোন দুঃখ কালো অধ্যায়। তবে তার জন্য আমাদেরই দায়ী হতে হবে! একদিন কৈফিয়ত দিতে হবে।