JustPaste.it

ইতিহাসের পাতা থেকে

 

প্রকৃত স্বাধীনতা সংগ্রামের চাপা দেয়া ইতিহাস

গোলাম আহমদ মোর্তজা

=======================================================================

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

        ‘কিতাবুত তাওহীদে’ হাম্বল মাযহাব অনুযায়ী আব্দুল ওহাবের পুত্র মুহম্মদ যা যা নির্দেশ দিয়েছিলেন তা ‍বিস্তারিত উল্লেখিত হয়েছে। তবে তার সংক্ষেপ হচ্ছে এইঃ আল্লাহ্‌ ছাড়া কারও কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ; মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে। আল্লাহ্‌ ছাড়া কারও নামে মান্নত করা শেরক। কোরআন হাদীসের সরল অর্থকে বেঁকিয়ে ব্যাখ্যা করা নিষিদ্ধ। তা’ছাড়া জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়া তাঁর সময়ে ছিল জরুরী। ধুমপানকারীদের শাস্তি ছিল বেত্রাঘাত। মুসলমান দাড়ি কামালেও শাস্তির উপযুক্ত। জাকাত ঠিক মত না দিলে সেও শাস্তির যোগ্য। শুধু কলমা পড়ে আল্লাহর নাম নিয়ে কোন হালাল পশু জবেহ করলেও তা হালাল খাদ্য হবে না, যদি তার চরিত্র মোটামুটি কলংকমৃক্ত না হয়। তাছাড়া তিনি কবরের উপর সৌধ নির্মান, কবরকে ইট ও পাথর দিয়ে বাঁধানো প্রভৃতির উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। এগুলো শুধু তার মুখের কথাই ছিল না, বাস্তব রুপ দিতে মক্কা ও মদীনার অনেক নামজাদা মনীষীর কবর তিনি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।

 

        অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দিল্লীর শাহ ওলিউল্লাহ থেকে শুরু করে তাঁর পুত্র-শিষ্য ও ছাত্রগন এমনকি শহীদ সৈয়দ আহমদ এবং তার অনুগামীদের সকলেই মুসলমানদেরকে শরীয়তের উপর প্রত্যাবর্তন করার তাগিদ দিয়েছিলেন।ফলে কবর বাধাঁনো বা কবরের উপর সৌধ নির্মান করা থেকে ক্রমে মুসলমানরা বিরত হতে থাকে। ইংরেজরা মুসলমান বিপ্লবীদের মতিগতি লক্ষ ক'রে, ঐ আন্দোলন যে তাদের বিরুদ্ধে অব্যর্থ আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি করছে তা বুঝতে পেরেছিল। তাই তারা কতকগুলো দরিদ্র ও দুর্বলমনা আলেমকে টাকা দিয়ে মুড়িয়ে তাদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিল-তোমরা যুগ যুগ ধরে যা করে আসছ তা করতে থাক। এই বিপ্রাবীরা আসলে ওহাবী; ওরা নবী, সাহাবী ও ওলীদের কবর ভাঙ্গার দল। ইংরেজ তাদের প্রচারে যোগ দিয়ে বলল, ১৮২২ খৃষ্টাব্দে সৈয়দ আহমদ মক্কায় যান, ওখানে গিয়েই তিনি ওহাবী মতে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অথচ এটা একেবারে মিথ্যা কথা। প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানের জীবনে একবার মক্কায় গিয়ে হজ্জ করা অবশ্য কর্তব্য হিসেবেই তিনি গিয়েছিলেন। তাঁর হজ্জে যাওয়ার পূর্বের এবং পরের কার্যাবলীর সঙ্গে আরবের ‘ওহাবী’ আন্দোলনের কোন যোগাযোগ ছিল না।

 

        সৈয়দ নিসার আলীঃ ১৮২২ খৃষ্টাব্দে মক্কায় মাওলানা নিসার আলী সাহেবের সঙ্গে সৈয়দ আহমদ সাহেবের দেখা হয়।নিসার আলী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার আন্দোলন ও আগামী পরিকল্পনা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হন। (দ্রঃ অমলেন্দু দেঃ বাঙ্গালী বুদ্ধিজ্জীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ, পৃষ্ঠা ৯৯) মাওলানা নিসার আলী ১৭৮২ খৃষ্টাদে ২৪ পরগনার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। একে ইতিহাসে ইংরেজরা সম্ভবত হেয় করার জন্য তাঁর উৎকৃষ্ট নামের (সৈয়দ নিসার আলী) পরিবর্তে নিকৃষ্ট নাম (তিতুমীর) ব্যবহার করেছে। কিন্তু অতীব দুঃখের কথা যে, পরবর্তিকালে হিন্দু-মুসলমান ভারতীয় ঐতিহাসিকরাও সেই প্রথাই চালু রেখেছেন।

 

        তাঁর পিতা ছিলেন মীর হাসান আলী, আর মা আবেদা রোকাইয়া খাতুন। মীর নিসার আলীর সমগ্র কোরআন কণ্ঠস্থ ছিল। তিনি কিশোর বেলা থেকেই ধর্মবিমুখ মুসলমানদের ধর্মের দিকে ঘুরিয়ে আনার জন্য কোরআন হতে উপদেশ দিতেন। অবশেষে যৌবনে তাঁর এই চেষ্টা ত্রিমুখী সংগ্রামে রূপ নেয়- একটি হচ্ছে মুসলমানদের অধর্মীয় আচরণ থেকে বাচানো; দ্বিতীয়টি হলো শাসক ইংরেজের ইাঙ্গিতে পরিচালিত অত্যাচারী ও শোষক জমিদারদের হাত থেকে শুধু মুসলমান নয় মিলিত হিন্দু-মুসলমান শোষিত প্রজাদের বাঁচানো এবং তৃতীয়টি হচ্ছে, সারা ভারতবর্ষকে ইংরেজের শাসন মুক্ত করা।

 

        ওদিকে গুরু সৈয়দ আহমদ লড়াই করছেন সীমান্ত প্রদেশে। আর এদিকে সৈয়দ নিসার আলী কাজ শুরু করেছেন অবিভক্ত বাংলায়। ইংরেজের বিরুদ্ধে তখন প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা না করলেও যুদ্ধে প্রাণ দেবার জন্য প্রচুর নওজোয়ানকে তিনি দলে পাঠিয়ে দিতেন, সঙ্গে প্রচুর টাকা পয়সা পাঠাবারও ব্যবস্থা করতেন। সৈয়দ নিসার আলীর একটা বড় সম্বল ছিল, তা হচ্ছে অগ্নিবর্ষক সৃজনশীল বক্তৃতা করার ক্ষমতা। নিসার আলী নিজে একজন বিখ্যাত কুস্তিগীর ও ব্যায়ামগীরও ছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের নিজেই সশস্ত্র ট্রেনিং দিতেন।(দ্রঃশহীদ তিতৃমীরঃআব্দুল গফুর সিদ্দিকী, পৃষ্টা ৩০-৪১)।

 

        নিসার আলী ইসলাম ধর্ষ যেমন ভালবাসতেন তেমনি হিন্দুদের দুঃখ দুর্দশার কথা চিন্তা করতেন এবং নিজে যথাসাধ্য তাদের পাশে গিয়ে দাড়াতেন। তা সত্তেও ইংরেজদের অনুগত জমিদারগণ তার উপর রাগ করতেন এবং তাঁর ধ্বংস কামনা করতেন। এ প্রসঙ্গে একটি মুল্যবান উদ্ধৃতির একাংশ তুলে ধরা হল- “নিসার(তি) আপন ধর্মমত প্রচার করিতেছিল। সে ধর্মমত প্রচারে পীড়ন তাড়না ছিল না। লোকে তাহার বাগবিন্যাসে মুগ্ধ হইয়া, তাহার প্রচার স্তম্ভিত হইয়া, তাহার মতকে সত্য ভাবিয়া, তাহাকে পরিত্রাতা মনে করিয়া তাহার মতালম্বী হইয়াছিল এবং তাহার মন্ত্র গ্রহণ করিয়াছিল।নিসার (তি) প্রথমে শোনিতের বিনিময়ে প্রচার সিদ্ধি করিতে চাহে নাই। জমিদার কৃষ্ণদেব জরিমানার ব্যবস্থায় তাহার শান্ত প্রচারে হস্তক্ষেপ করিলেন।” (অধ্যাপক অমলেন্দু দে,ঐ, পৃষ্টা-১০১; বিহরীলাল সরকারের ‘তিতুমীর বা নারকেলবেড়িয়ার লড়াই, কলিকাতা, ১৩০৪, পৃষ্টা ৪৭)।

 

        ইংরেজের বলে বলিয়ান বিখ্যাত জমিদার রামনারায়ন বাবু (তারাগুনিয়া),কৃষ্ণদেব রায় (পুঁড়া), গৌরপ্রসাদ চৌধুরী (নগরপুর) প্রভৃতি বিখ্যাত জমিদারগণ মিলিতভাবে নিসার সাহেবের আন্দোলনকে খতম করার জন্য প্রকাশ্যে প্রতিদ্বন্ধিতা শরু করেন। প্রত্যেক জমিদার তাঁর এলাকায় পাঁচটি বিষয়ে আদেশ জারী করলেনঃ

 

        (১) যাহারা নিসার আলীর (তি) শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া অহাবী হইবে, দাড়ি রাখিবে, গোঁফ ছাটিবে, তাহাদের প্রত্যেককে ফি দাড়ির উপর আড়াই টাকা এবং ফি গোঁফের উপর পাঁচ সিকা খাজনা দিতে হইবে।

 

        (২) মসজিদ প্রস্তুত করিলে প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচ শত টাকা ও প্রত্যেক পাকা মসজিদের জন্য এক সহস্র টাকা জমিদার সরকারে নজর দিতে হইবে।

 

        (৩) পিতা-পিতামহ বা আত্মীয় স্বজন সন্তানের নাম যে রাখিবে, সে নাম পরিবর্তন করিয়া অহাবী মতে আরবী নাম রাখিলে প্রত্যেক নামের জন্য খারিজানা ফি পঞ্চাশ টাকা জমিদারের সরকারে জমা দিতে হইবে।

 

        (৪) গো-হত্যা করিলে হত্যাকারির দক্ষিন হস্ত কাটিয়া দেওয়া হইবে, যেন সে ব্যক্তি আর গো-হত্যা করিতে না পারে।

 

        (৫) যে ব্যক্তি সংগ্রামী (অ) নিসারকে (তি) নিজ বাড়ীতে স্থান দিবে তাহাকে তাহার ভিটা হইতে উচ্ছেদ করা হইবে।” (A.R. Mallik: British policy and the Muslim in Bengal, 78-79. সিদ্দিকী প্রণীত “শহীদ তীতুমীর' পৃষ্টা ৪৫-৪৯ এবং অমলেন্দু দে; ঐ, ১০২ ১০৩)

 

        সৈয়দ নিসার আলীর যা প্রস্তুতি ছিল তাতে তিনি একটা হামলা করতে পারতেন।কিন্তু উদ্দেশ্য তাঁর হিন্দু-মুসলমানে লাড়াই নয়  বরং লড়াই হবে মুসলমান ও হিন্দুর সঙ্গে ইংরেজের। ঐ নোটিশ জারি হবার পর তিনি পুঁড়ার জমিদারকে শান্তির জন্য একটা পত্র দিয়েছিলেন। সেই পত্রটির মূল্য অপরিসীম

 

        “বঃ জনাব বাবু কৃষ্ণদেব রায় জমিদার মহাশয় সমীপে-পুঁড়ার জমিদার বাড়ী। মহাশয়! আমি আপনার প্রজা না হইলেও আপনার স্বদেশবাসী। আমি লোকপরম্পরায় জানিতে পারিলাম যে, আপনি আমার উপর অসস্তুষ্ট হইয়াছেন, আমাকে 'অহাবী' বলিয়া আপনি মুসলমানদের নিকট হেয় করিবার চেষ্টা করিতেছেন। আপনি কেন এইরুপ করিতেছেন তাহা বুঝিতে পারা মুশকিল। আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেহ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট মিথ্যা কথা বলিয়া আপনাকে উত্তেজিত করিয়া কে তাহা হইলে আপনার উচিত ছিল সত্যের সন্ধান করিয়া হুকুম জারি করা। আমি দ্বীন ইসলাম জারি করিতেছি। মুসলমানদিগকে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দিতেছি, তাহাতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকিতে পারে? যাহার ধর্ম সেই বুঝে।আপনি ইসলাম ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করিবেন না। ওহাবী ধর্ম নামে দুনিয়ায় কোন ধর্ম নাই। আল্লাহর মনঃপুত ধর্ম ইসলাম । ইসলাম ধর্মের অর্থ শাস্তি।.....ইসলামী ধরনের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোঁফ ছোট করা, ঈদুল আজাহার কোরবানী করা ও আকীকাতে  কোরবানী করা মুসলমানদিগের উপর  আল্লাহর ও আল্লাহর রসুলের আদেশ। মসজিদ প্রস্তুত করিয়া আল্লাত্র উপাসনা করাও আল্লাহর হুকুম। আপমি ইসলাম ধর্মের আদেশ, বিধি-নিষেধের উপর হস্তক্ষেপ করিবেন না। আমি আশা করি আপনি আপনার হুকুম প্রত্যাহার করিবেন। ফকত-হাকির নাচিজ-সৈয়দ নিসার আলী ওরফে তীতুমীর।” (দ্রঃ অমলেন্দু দে, ঐ, ১০৩-১০৪; শহীদঃ তীতুমীর, পৃষ্টা ৫০-৫১)

 

        সৈয়দ নিসার আলী তাঁর দাড়িওয়ালা, সৎ সাহসী এবং নম্র শিষ্য মুহঃ আমিনুল্লার সাথে পত্র দিয়ে পুঁড়ার জমিদার বাড়ী পাঠান। কৃষ্ণদেব পত্র পরেই তাঁকে জমিদারী জেলে আটক করতে আদেশ দেন এবং সকলের সামনে বন্দী সিংহ মারার মতন আমিনুল্লাকে বাধাঁ অবস্থায় সীমাহীন প্রহার করানো হয় ও অবশেষে হত্যা করা হয়। এই সংবাদ সৈয়দ নিসারের কাছে পৌঁছালে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি এবং ব্যথিত হৃদয়ে প্রথম শহীদ আমিনুল্লাহ'৷

 

        ওদিকে ইংরেজদের চক্রান্তে বড় বড় জমিদারদের একটি গোপন মিটিং হয় 'লাটবাবু'র কলকাতার বাসভবনে। তাতে অংশ গ্রহণ করেন গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়, যদুরআটির দুর্গাচরণ চৌধুরী, পুঁড়ার কৃষ্ণদেব রায়, গোবরডাঙ্গার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, নূরনগর জমিদারের ম্যানেজার, টাকির জমিদারের সদর নয়েব, রানাঘাটের জমিদারের ম্যানেজার, বাড়ীর মালিক লাটবাবু এবং বসিরহাট থানার ইংরেজের অনূগত পুলিশ অফিসার রামরাম চক্রবর্তি (শেহীদ তীতুমী, পৃষ্ঠা ৫২-৫৩)। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ইংরেজ পাদ্রী, ইংরেজ নীলকর ও সমস্ত জমিদারগণ জমিদার কৃষ্ণদেবকে সব রকমের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও সাহায্য করবেন। অধ্যাপক অমলেন্দু দে'র মতে তাঁরা প্রচারের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ‘ত্রাসের সৃষ্টি করেন’ ।

 

        জমিদাররা ওপর তলার ঘাঁটি মজবুত করে পুনরায় পূর্ব ঘোষিত নোটিশ অনুযায়ী মুসলমানদের নিকট কর আদায়ের অত্যাচার-অভিযান শুক করলেন। মুসলমানদের অনেকে জরিমনা দিল, আবার  অনেকে গ্রাম ত্যাঁগ করল। বিপ্লবী নেতা কিন্তু তখনো মিলন-মৈত্রীর পথই খুঁজছিলেন। তিনি মোটেই চাচ্ছিলেন না, লড়াই হিন্দু-মুসলমানে হোক বরং চাচ্ছিলেন লড়াই ইংরেজ-মুসলমানে হোক-হিন্দু জনসাধারণ অন্ততঃনিরপেক্ষ থাকুক। কৃষ্ণদেবের জরিমানা/আদায়ের অভিযান যখন সরফরাজপুরে আরম্ভ হল তখন সৈয়দ নিসারের সমর্থকরা বাধা দিলেন কিন্তু টিকলো না। এরপর জমিদারের লাঠিয়ালরা মসজিদে এবং গ্রামে পাইকারি ভাবে আগুন লাগিয়ে দিতে আরাম্ভ করে।অনেকে আগুনে ও অস্ত্রে আহত হয়। অমলেন্দু দের মতে, 'এক সৈণ্যবাহিনী সহ সরফরাজপুর গ্রামে আক্রমন করে’। নিসার সাহেব এ অবস্থায়ও ধৈর্য ধরতে সক্ষম হন এবং কোর্টে মোকদ্দামা করেন।বারাসাত কোর্ট এতবড় নরহত্যা,  মসজিদ পোড়ানো আর গ্রামকে শ্মাশানে পরিণত করার কেস ডিসমিস করলে কলকাতায় আপীল করা হয়। ওখানেও যখন সুবিচার পাওয়া গেলনা দেখে সৈয়দ নিসার সাহেব ক্ষুব্ধ হলেন এবং বুঝলেন, সুবিচার চাইলে অবিচার প্রাপ্য। (দ্রঃ A.R.Mallik p.81)।

 

        অবশেষে ‘মরি বা করি' ভেবে নারকেলবেড়িয়ায় বাঁশের একটি কেল্লা সাধ্যানুসারে তৈরী করা হল। মৈজুদ্দিনের বাড়ীতে সৈয়দ নিসারের আরাম ও গোপন পরামর্শ করবার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর তাঁর সৈন্যাধ্যক্ষ মাসুম আলী ও সেখ মিসকিন  সমস্ত সৈন্যদের একত্রিত করলে সৈয়দ সাহেব সকলকে বললেন, এমন পাঁচজন লোকের প্রয়োজন যাঁরা আজ আজাদী আন্দোলনে প্রাণ দিতে প্রস্তুত। নারায়ে তকবীর ধ্বনির উত্তরে আল্লাহু আকবার বলতে বলতে সহস্র সহস্র হাত জানালো প্রাণ দেবার সংগ্রামী প্রতিশ্রুতি। এবার আদেশ হল কৃষ্ণদেব বাবুর পুঁড়া গ্রাম আক্রমণ করার  সঙ্গে সঙ্গে সংগ্রামী আমিনুল্লা হত্যা, মসজিদ ও গ্রাম জ্বালালো আর অন্যায়ের জরিমানা আদায়ের  প্রতিশোধ নিতে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করল বিপ্লবীরা। জমিদারদের সেনাবাহিনী, নীলকরদের সাহেবদের কর্মচারি এবং পাদ্রীদের দলবল সকলে মিলে প্রতিরোধ করেও কিন্তু বিপ্লবীদের পরাস্ত করা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেকেই অবাক হয় মাসুমের সামরিক কায়দায় সৈন্য পরিচালনা দেখে; ইংরেজরাও কম স্তম্ভিত হয়নি (দ্রঃ শহীদ তীতুমীর, পৃষ্টা ৬৬-৭৩; অমলেন্দু দে, পৃষ্ঠা ১০৬)।

 

        এরপরে সৈয়দ নিসার সাহেব আরও ঘোষণা করলেন, ‘আজ থেকে ইংরেজদের সঙ্গে সর্ব প্রকার বিরোধিতা প্রকাশ্যে করতে হবে'। ওদিকে জমিদারবৃন্দ, থানা ইংরেজ অফিসার, ইংরেজ নীলকরদের সুপারিশ এবং ওপর মহলের পরামর্শের পরে ইংরেজ সরকার একদল অশ্বারোহী সৈন্য পাঠালেন মাসুমের সৈন্যদের শয়েস্তা করতে। কিন্তু সৈয়দ নিসার, মাসুম ও মিসকিনের সৈন্য পরিচালনা পদ্ধতি ইংরেজদের চেয়েও উন্নত ধরনের ছিল বলে ইংরেজ সৈন্য পরাজিত হয় এবং অনেকে মৃত্যু বরণ করে।

 

        ইংরেজ সৈন্যের পরাজয়ের সংবাদ কলকাতায় পৌছাবার পরেই এক সুদক্ষ সেনাপতির অধিনে একদল সৈন্য আর উচ্চশ্রেণীর কামান পাঠানো হল নারকেলবেড়িয়ার কেল্লার পতনের উদ্দেশে । এবারেও সৈয়দ নিসার, মাসুম আলী ও মিসকিন খাঁ বিপ্লবী সৈন্যদের বললেন-আমাদের কামান নেই, হয়ত মৃত্যু হতে পারে; যাদের ইচ্ছা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে পার। কিন্তু এমন একটি দুর্বল হৃদয় সেদিন পাওয়া গেলনা, যে প্রাণ দিতে কুন্ঠিত। যুদ্ধ আরম্ত হতেই হুষ্কার ছেড়ে ইংরেজ সৈন্যদের আক্রমণ করলো মুসলিম সৈন্য। ইংরেজ সৈন্য ছত্রভংগ হবার উপক্রম, কিন্তু কাল বিলম্ব না করে বিরাট কামান গর্জে উঠল। কামান পরিচালককে হত্যা করার জন্য সেনাপতি মাসুম বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে গিয়ে কামানের উপর দাড়ালেন। কিন্তু তার কয়েক সেকেন্ড পূর্বেই কামান দাগা হয়ে গিয়েছিল। অজস্র বিপ্লবী সৈন্য ইংরেজের কামানের গোলায় ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে মৃত্যুর কোলে ছিটকে পড়ল। ওদিকে মাসুমতো একে বারে ইংরেজদের কোলে গিয়ে উপস্থিত। আর কয়েক সেকেন্ড আগে লাফ দিতে পারলে হয়তো কামান মাসুমের হাতেই এসে যেত। মাসুম বন্দি হলেন। কেল্লা ধ্বংস হল। ইংরেজের আদালতে মাসুমের বিচারে ফাসি হল। অপরাধ, তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর। রাঙ্গা রক্ত ঢেলে দিলেন শ্রদ্ধেয় শহীদ মাসুম। সৈয়দ নিসার আলীও কামানের গোলায় শহীদ হলেন। জীবন্ত যাদের পাওয়া গেল, বিচারের নামে জাহাজে ভর্তি করে ভারত থেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হল যাবজ্জীবন কারাদন্ডে, বাকি আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার নামে নদীতে নিক্ষেপ করে তারা নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

 

        অবিভক্ত বঙ্গের বিপ্লবী বীরেরা সেদিন শহীদ হলেন ইংরেজ সৈন্য, দেশীয় দালাল ও পাদ্রীদের প্রত্যক্ষ আক্রমণে। এই ইতিহাস-বিখ্যাত বীর শহীদ নিসার আলীর ইতিহাস যে ভাবে মূল্যায়ন করা কর্তব্য সেভাবে করা হয়নি আজও। [চলবে]

 

 

═──────────────═