জীবন পাথেয়
মাহে রমযান ও সিয়াম সাধনা
ফাজায়িল ও মাসায়িল
মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন
রমযান সর্বাধিক ফজিলতের মাসঃ
ইসলামী বার মাসের মধ্যে রমযান সবচেয়ে বেশী ফজিলতের মাস। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ মাসে অপরিসীম ফজিলত ও তাৎপর্যের কথা বলা হয়েছে। এ মাসে আল্লাহ্ তায়ালা জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেন, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেন এবং শয়তানকে বন্দী করে রাখেন। এ মাসের একটি নফল ইবাদত অন্য মাসের একটি ফরজের সমান আর একটি ফরজ ইবাদত অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান। এ মাসের একটি রাত এমন আছে, যে রাতে ইবাদত করে এত বেশী সওয়াব পাওয়া যায় যে, হাজার মাস ধরে ইবাদত করেও তা পাওয়া যায় না। সর্বোপরি অসাবধানতা ও অবহেলা বশত পূর্বের এগার মাসের কৃত বান্দার পাপ সমূহ মোচনের জন্য এ মাহে রমযানের আয়োজন।
রমযান কুরআন অবতরণের মাসঃ
রমযান চান্দ্র মাসের নবম মাস। মহান আল্লাহ্ এ মাসের কোন এক বরকতময় রাতে সুস্পষ্ট হেদায়াত ও সঠিক দিক নির্দেশনাসহ মানব জাতির মুক্তি সনদ আল কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে নিম্ন আকাশে বাইতুল ইযযায় অবতরণ করেন। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাব সমূহ তাওরাত, যাবুর, ইঞ্জিল এবং হযরত ইবরাহীরম (আঃ) সহ অন্যান্য নবীদের সহীফা সমুহও এই রমযান মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে। ইমাম হাম্বাল (রঃ) বর্ণিত এক হাদীসে জানা যায় যে, ইবরাহীম (আঃ) এর সহীফা সমুহ পহেলা রমযান, তাওরাত ৬ই রমযান এবং ইঞ্জিল ১৩ই রমযান নাযিল হয়েছে। হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) এর বর্ণনা মতে যাবুর নাযিল হয়েছে ১২ই রমযান।
আল কুরআনের ব্যাপার মহান আল্লাহ্ স্বয়ং বলেন, “রমযান মাস, এ মাসে মানবজাতির দিশারী সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে মিথ্যা সত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।” (বাকারাঃ ১৮৫) “আমি একে নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে।” (দুখানঃ৩) “আমি একে নাযিল করেছি কদরের রাতে।” (কদরঃ১) আল-কুরআন ও অন্যান্য আসমানী কিতাব সমুহ এই রমযান মাসে অবতীর্ণ হওয়া একথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্র নিকট রমযান মাসের মর্যাদা ও শেষ্ঠত্ব অনেক বেশী।
রমযান বাতিলের বিরুদ্ধে হকের বিজয়ের মাসঃ
রমযান বাতিলের বিরুদ্ধে হকের এবং বাতিলপন্থীদের বিরুদ্ধে হকপন্থীদের বিজয়ের মাস। অর্থ্যাৎ যারা নিজেদের ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কুরআন সুন্নাহর আইন তথা ইসলামী অনুশাসন মানে না, মানতে দেয় না, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় ইসলামপন্থীদের বাধা দেয়, তাদের বিরুদ্ধে কুরআন সুন্নায় বিশ্বাসী কুরআনী সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত প্রাণ সংগ্রামী কাফেলার বিজয়ের মাস এ পবিত্র মাহে রমযান। দ্বিতীয় হিজরীর এই রমযান মাসের সতের তারিখে সংঘটিত হয়েছিল ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের। মহানবী (ﷺ) এর সেনাপতিত্বে এ যুদ্ধে ইসলামী শক্তি কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। মুসলিম বাহিনীর এ ঐতিহাসিক বিজয় দিবসকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বা হক বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী দিন হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
রমযান ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের মাসঃ
রমযান বাতিলের বিরুদ্ধে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের মাস। অস্টম হিজরীর রমযান মাসে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে কুফরী শক্তিকে পরাজিত করে মুসমানরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। অতঃপর পবিত্র মক্কায় প্রতিষ্ঠিত হয় মহানবী (ﷺ) এর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শাসন।
রমযান আত্মশুদ্ধি ও সংযম শিক্ষার মাসঃ
মাহে রমযান নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার ও সাধনার মাধ্যমে সংযম শিক্ষা করার মাস। এ মাসে সাময়িকের জন্য এমন সব হালাল বস্তুকেও হারাম করা হয়েছে, যা মূলত হালাল। দিনে পানাহার মূলত হারাম নয়। রাতদিন যেকোনো সময় মানুষ ইচ্ছা করলে পানাহার করতে পারতে। কিন্তু রমযান মাসে রোযা ফরজ করে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার নিষিদ্ধ করে সংযম শিক্ষা দেয়া হয়েছে। যত তীব্র ক্ষুধা ও পিপাসাই হোক শরীয়ত সম্মত ওজর ব্যতীত এ সময়ে পানাহার করার অনুমতি নেই।
সারাদিন রোজা রাখার ফলে রাতে আগে ভাগে শুয়ে একটু আরাম করতে সকলেরই মনে চায়। কিন্তু তারাবীর নামাযের বিধান দিয়ে এখানেও মুমিনকে সংযমের তালীম দেয়া হয়েছে। একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মুমিন তারাবীর নামাযে কুরআন পাঠ করে ও শ্রবণ করে আল্লাহ্র আনুগত্যের কাছে নিজের প্রবৃত্তিকে অবদমিত করে। এভাবে বিছানায় পীঠ ঠেকাতে অনেক বিলম্ব হয়ে যায়। তারপর আবার ভোর রাতে যখন গভির মিষ্টি মধুর ঘুমে অচেতন হয়ে থাকার কথা, মুমিনের প্রতি তখন আদেশ, আর শুয়ে থাকা চলবে না। অঠ, পরের দিন রোযা রাখার নিয়তে সাহরী খাও। এভাবে রমযানের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আল্লাহ তার বান্দাকে সংযম শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
রোযার কতিপয় মাসআলাঃ
*সুবহে সাদিকের পর রাত আছে মনে করে যদি কেউ সেহরী খায় কিংবা সূর্যাস্তের আগে সূর্য অস্ত গেছে ভেবে ইফতার করে ফেলে তাহলে সে রোযার কাযা আদায় করতে হবে।
*রমযানের দিবসে জেনে শুনে রযার কথা স্মরণ থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ পানাহার করে, কিংবা স্ত্রী সহবাস করে তা হলে কাযা, কাফফারা দু’টোই ওয়াজিব হবে।
*রোযা রেখে মেসওয়াক করা, সুরমা ব্যবহার করা প তেল লাগানো দুরস্ত আছে। তবে টুথপাউডার, টুথপেষ্ট ও কয়লা ইত্যাদি ব্যবহার করা মাকরুহ।
*অনিচ্ছাকৃতভাবে যদি আপনা আপনি বমি হয়, তাহলে বমির পরিমাণ যতই হোক তাতে রোযা ভং হবে না। তবে যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করে, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর যদি পরিমাণ কম হয়, তাহলে রোযা ভাঙ্গবে না।
* যদি রাতে গোসল ফরজ হয়ে যায় এবং সুবহে সাদিকের আগে গসল করা সম্ভব না হয়, তাহলে গোসল না করেই রোযার নিয়ত করে ফেলবে। রোযার নিয়ত ও সাহরী খাওয়ার জন্যে আগে গোসল করে নেয়া শর্ত নয়। তবুও গোসল করে সেহরী খাওয়া উচিৎ।
* সাহরি না খেলেও রোযা হয়ে যায়। সাহরী খওয়া মুস্তাহাব। বেশী খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে সামান্য কিছু খেয়ে হলেও মুস্তাহাব আদায় করে নেয়া উচিৎ।
*দিনের বেলা স্বপ্নদোষ হলে রোযা ভাঙ্গেও না মাকরুহও হয় না।
*আতর ও ফুলের সুগন্ধি গ্রহণ করলে তাতে রোযার কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু লোবান ও আগরবাতি ইত্যাদি জ্বালিয়ে যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে তা শুকতে শুরু করে আর তার ধুয়া কন্ঠনালিতে ঢুকে যায়, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। বিড়ি, সিগারেট ও হুক্কা পান করলেও রোযা থাকে না।
*মুখের লালা বা থুথু গিলে ফেললে তাতে রোযার কোন ক্ষতি হয় না।
*রোযা রেখে দিনের বেলা স্ত্রী সহবাস করলে, এমনকি পুরুষের খতবাস্থান স্ত্রীর যোনিদ্বারে প্রবেশ করালেই বীর্যপাত হোক আর না হোক তাতে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাযা কাফফারা দু’ই ওয়াজিব হয়।
*রোযা রেখে যদি রোযার কথা ভুলে গিয়ে কিছু খেয়ে ফেলে বা সহবাস করে বসে, তাহলে রোযা ভং হয় না। আর যদি এমন হয় যে, রোযার কথা মনে আছে, কিন্তু রোযা অবস্থায় পানাহার করলে বা স্ত্রী সহবাস করলে রোযা ভেঙ্গে যায় তা মনে নেই, এমতাবস্থায় পানাহার বা স্ত্রীসহবাস করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে ও কাযা করতে হবে। অনুরুপ ভাবে যদি কাউকে জোরপূর্বক খাওয়ানো হয়, তাতে রোযা থাকবে না, কাযা করতে হয়।
*আপনা আপনি কন্ঠনালিতে মাছি, ধুয়া বা ধূলা প্রবেশ করলে রোযা নষ্ট হবে না। কিন্তু ইচ্ছা পূর্বক এরূপ করলে রোযা ভঙ্গ হয়ে যাবে।
*কোন মহিলার প্রতি দৃষ্টিপাত করার দরুন যদি বীর্যপাত হয়ে যায়, তাতে রোযা ভঙ্গ হবে না। আর যদি কেউ কোন নারীকে চুম্বন করে কিন্তু বির্যপাত না হয়, তাতেও রোযা ভঙ্গ হবে না। পক্ষান্তরে চুম্বন বা আলিঙ্গনের ফলে বির্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। এর ফলে তাকে কাযা আদায় করতে হবে, কাফফারা দিতে হবে না।
* নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে নিশ্চয়তা থাকলে রোযার দিবসে স্বামী-স্ত্রী একত্রে শয়া এবং চুম্বন ও আলিঙ্গন করায় কোন অসুবিধা নেই। অন্যথায় অর্থ্যাৎ আত্মনিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা থাকলে এ সব কাজ মাকরুহ হবে।
*যদি কেউ এমন কোন বস্তু গিলে ফেলে, যা সাধারনত মানুষ খাদ্যরূপে খায় না এবং ঔষধরুপেও সেবন করেনা, (যেমনঃ কংকর, লোহা বা ধাতব মুদ্রা ইত্যাদি) তা হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তার উপর কাযা ওয়াজিব হবে কাফফারা নয়। পক্ষান্তরে যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন জিনিস খেয়ে ফেলে, যা খদ্যরুপে খাওয়া হয় বা ঔষধরূপে সেবন করা হয়, তাহলে কাযা কাফফারা দুই ওয়াজিব হবে।
* রোযা অবস্থায় ইনজেকশন নিলে রোযার কোন ক্ষতি হয় না।
* রমযান মাসে কারণবশত যদি কার রোযা ভেঙ্গে যায় তবুও দিনের বেলা তার জন্য খাওয়া-দাওয়া জায়েজ নয়। সারাদিন রোযাদারের ন্যায় উপবাস কাটানো ওয়াজিব।
*দু’ঈদের দু’দিন এবং কুরবানীর ঈদের পরের তিন দিন; বছরের এ পাঁচদিন রোযা রাখা হারাম।
ঘটনা বহুল মাহে রমযান
*রাসুলের (ﷺ) উপর প্রথম ওহী নাযিল হয় তাই এ মাসকে কুরআন নাযিলের মাস বলা হয়।
* এমাসে উম্মুল মুমেনীন খাদিজা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনিই সর্ব প্রথম রাসূল (ﷺ)-এর উপর ঈমান আনেন। তিনি এ মাসেই ইন্তেকাল করেন।
* এ মাসে হযরত হামযার (রাঃ) নেতৃত্বে ৩০ জন মুসলমানের একটি বাহিনী সিরিয়া থেকে প্রত্যাগত মুশরিকদের একটি ব্যবসায়ী দলের মুখোমুখি হয়। যাতে আবূ জেহেলও ছিল। উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অবশেষে মাজদী বিন আমরের হস্তক্ষেপে যুদ্ধে ছাড়াই উভয় দল নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যায়। এটি ছিল ইসলামের প্রথম বাহিনী।
*যাকাত ও ফিতরা ওয়াজিব হয়। ঈদের নামাযের বিধান নাযিল হয়। (২য় হিজরী)
*জিহাদের অনুমতি দেয়া হয় (২য় হিজরী)
*২য় হিজরী সালের ১৭ই রমযান শুক্রবার ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন। তন্মধ্যে ১৪ জন শহীদ হন। মুশরিকদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার। তাদের ৭০ জন নিহত হয় আর ৭০ জন বন্দী হয়।
*৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় হয়। এ বিজয়কে সকল বিজয়ের শ্রেষ্ঠ বিজয় বলা হয়। এ বিজয়ের পরই দলে দলে দলে লোক ইসলামে প্রবেশ করে। এ মাসেই আবূ সুফিয়ানসহ অনেক কুরাইশ নেতা ইসলাম গ্রহণ করেন। কাবায় সংরক্ষিত সবগুলো প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলা হয়।
*৯ম হিজরিতে ছাকীফ প্রতিনিধিরা ইসলাম গ্রহণ করেন।
* রাসূল তনয়া ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। (১১ই হিজরী)
* কুফায় আবদুর রহমান বিন মুলজিম নামে এক খারেজির হাতে হযরত আলী (রাঃ) শহীদ হন। (৪০হিজরী ১৭ই রমযান)
*উম্মু মুমেনিন আয়েশার (রাঃ) ইন্তেকাল। (৫৮ হিঃ)
*এ মাস ইতেকাফের মাস। রাসুল (ﷺ) এ মাসের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতেন।
* এ মাস লাইলাতুল কদরের মাস। এ রাতটি হাজার রাতের চেয়েও উত্তম।
মাহে রমযানে একজন মুসলিম মহলার দায়িত্ব:
রমযান মাস একজন মুসলিম মহিলার দায়িত্ব কি? এই মোবারক মাসে তার ঈমানী ভূমিকাই বা কী? নিশ্চয়ই তার উপর রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। আর তা হলো আল্লাহ্র ইবাহত ও আনুগত্যের জন্য ঘরকে প্রস্তুত করা এবং শিশুদেরকে নেক কাজ ও দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদ্ব্যাবহারে অভ্যস্ত করে তোলা যেন তারা এমন ভাবে বেড়ে ওঠে যে, তাদের হৃদয় রমযান মাসের ফজিলত লাভে আগ্রহী হয়। এ মাস তো সম্মান ও ভালবাসার মাস। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মাস।
এ মাসে মহিলাদের একটি বিশেষ দায়িত্ব হলো রোজাদারদের উপযোগী বিভিন্ন প্রকারের খাবারের প্রতি চিন্তা করা। রাসূল (ﷺ) এর নিয়ম ছিল তিনি খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন এবং পানি পান করতেন। অতঃপর তিনি মাগরিবের নামাজ আদায় করে অবশিষ্ট খাবার গ্রহণের জন্য ফিরে আসতেন।
মুসলিম মায়েদের উচিৎ এই ব্যবস্থাপনার সঠিক মর্ম উপলব্ধি করা। তাদের আরও উচিৎ বিকেলে কর্মস্থল থেকে ফিরে আসা স্বামীর জন্য কিছুটা বিশ্রামের ব্যবস্থা করা। তাদের আরও কর্তব্য হল সাহরী খাবারের প্রস্তুতি গ্রহণ করা আর পবিত্র সুন্নত অনুসারে বিলম্বে সাহরীর খাবার গ্রহণ করা ও করানো। এত দেখা যায়, ঘরে রোজার পরিবেশ সৃষ্টির সার্বিক দায়িত্ব মহিলাদের।
আমরা মুসলিম মহিলাদের অনুরোধ করব, তারা যেন রমযান মাস বেশি জাকজমক প্রদর্শন না করে। আর রমযান স্বাভাবিকভাবেই কৃচ্ছতা ও সাধনার মাস এবং তাতে রয়েছে এক ধরনের বঞ্চনা; কাজেই রমযানকে বিলাসিতার মাসে পরিণত করা ভুল। সাধারণত এ মাসে এমন বিভিন্ন প্রকারের খাবারের আয়োজন করা হয় যা শুধু আমরা এ মাসেই দেখতে পাই। আবার আমরা এ কথাও জানি যে, পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য হারাম করার ক্ষমতা মাদের নেই। যেমন কুরআনুল কারীম তা বলা হয়েছে।
আবার অন্য দিকে আমরা জানি যে, রোজার অর্থ হলো এক ধরনের ক্ষুধা ও কৃচ্ছতার অনুভুতি। কাজেই রমযান মাস থেকে এ অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে দেয়া নিতান্ত অন্যায়। এসব দিকে মহিলাদেরকে লক্ষ রাখতে হবে। কেননা রমযান মাসে মহিলাদের দায়িত্ব ও অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের পরিবেশ এই আসমানী ফরজ বাস্তবায়নে তার উপর রয়েছে বিরাট দায়িত্ব। গৃহিনীর উচিৎ এই হাদিস শরীফকে স্মরণ করা তাতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার জন্য রয়েছে রোযার সম পরিমাণ নেকী কিন্তু এতে রোজাদারের নেকিতে কোন কমতি হবে না। কাজেই মহিলার কর্তব্য হলো অভাবী রোজাদারদের ইফতারের খবার পেশ করা। যেন মাগরিবের আযান হলে অভাবী রজাদারগণও ইফতার পায়।
উপরন্তু প্রত্যেক মুসলিম মহিলার উচিৎ নিজের ছেলে মেয়ের জন্য সর্বদা বিশেষ করে রমযান মাসের দিনগুলোতে উত্তম আদর্শে পরিণত হওয়া।
অনেক রোজাদার পুরুষ ও মহিলা সামান্য কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং স্বীয় কর্তব্য কাজে অবহেলা প্রদর্শন করেন এই দাবিতে যে, তারা রোজাদার। অথচ রোজা দায়িত্ব সম্পাদনে অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করানোর মত বিষয় নয়। মনে রাখতে হবে, যে রোজা কর্তব্য কাজ পরিত্যাগের প্রতি অথবা মানুষের অনিষ্ট সাধনের প্রতি ধাবিত করে সে রোজার কোন কল্যাণ নেই। যদি আল্লাহ্ তায়ালা মনে করতেন যে, রোজার মধ্যে কষ্ট ও অনিষ্ট সাধন রয়েছে তবে তিনি শরিয়তে এর বিধান রাখতেন না এবং রোজা রাখার নির্দেশও দিতেন না।
কাজেই অনেক সময় লোক এমন ধরনের রোজার রাখেন যা ইবাদতকে গোনাহ ও অনিষ্ট সাধনে পরিণত করে। কাজেই মুসলিম মহিলার স্বীয় স্বামী ও সন্তানদের স্বার্থে উত্তম আচরণ করা কর্তব্য এবং রোজাদার হিসাবে স্বীয় কর্মে নিষ্ঠা প্রদর্শন করা তার নৈতিক দায়িত্ব কেননা রোজা হলো আল্লাহ্র জন্য ইখলাস ও তাঁর নৈকট্য লাভ। এ জন্য তিনি রোজাদার পুরুষ ও মহিলার উপর অশ্লিল কথা বার্তা বলা হারাম করেছেন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “ রোজা ঢাল স্বরূপ, কাজেই তোমাদের মাঝে যদি কেউ রোজা রাখে তবে সে যেন অশ্লিল কথা বার্তা না বলে এবং পাপ কাজ না করে। এবং যখন কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তাঁর সাথে ঝগড়া করতে এগিয়ে আসে, তখন সে যেন বলে দেয়, আমি একজন রোজাদার।”
কোন মুসলিম মা রমযান মাসের কয়েকদিন যখন রোজা ভাংতে বাধ্য হন তখন তার উচিৎ তা প্রকাশ না করা। কেননা তিনি যখন তা প্রকাশ করবেন তখন তার সন্তান ও পরিবারের লোকেরা তাকে রোজা পরিত্যাগকারী অথবা রোজার প্রতি অবহেলাকারী মনে করবে।
রমাযান মাসে যখন নব চন্দ্র উদিত হয়, তখন একজন মুসলিম মায়ের সর্বপ্রথম কর্তব্য হলো তিনি ইমানদার পুরুষ ও মহিলাদের পথ অনুসঅরণ করবেন। কাজেই তিনি ইসলামের নিয়ামতের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার শোকরিয়া আদায় করবেন এবং ছওয়াবের নিয়তে রোজা রেখে রমযান মাসকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবেন।
এমনিভাবে প্রত্যেক মুসলিম মায়ের উচিৎ, এই মোবারক মাসের দিনগুলিতে নিজের জন্য, স্বামীর জন্য, সন্তাদের জন্য, তার পিতা-মাতার জন্য ও সমস্ত মুসলমানদের জন্য দোয়া করা, যেন তারা সুস্থ্য থাকেন ও আল্লাহ্র ইবাদত আদায় করার ক্ষমতা লাভ করেন। আল্লাহ্র নিকট তার আরও কামনা করা উচিৎ, তিনি যেন রমযান মাসকে পুনরায় মঙ্গল ও বরকতসহ ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।
মুসলিম মায়ের কর্তব্য হলো, রমযান মাসে অশ্লীল কথা না বলা, গালি না দেয়া, সব মুসলিম পুরুষ ও মহিলাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা। যদি তাকে কেউ গালি দেয় বা তার সাথে কেউ ঝগড়া করতে আসে তবে সে বলবে, আমি একজন রোজাদার। আর মুসলিম মা রমযান মাসে আল্লাহ্র জন্য রোজা রাখবেন ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের নিয়তে, মানুষ থেকে লজ্জার জন্য নয় অথবা দ্বীনি অনুভুতি ছাড়া অন্ধ অনুকরণের জন্য নয়। কেননা হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রিয় নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের নিয়তে রমযান মাসে রোজা রাখবে তার অতীতের গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।‘