মুজাহিদের চিঠি
(পত্রখানা বিশিষ্ট তুর্কী মুজাহিদ গাজী আনোয়ার পাশা কর্তৃক লিখিত। আজীবন তিনি ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছেন। রাশিয়ান বলশেভিকদের বিরুদ্ধে জিহাদরত অবস্থায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের মাত্র একদিন পূর্বে তিনি এ পত্রখানা তার প্রিয়তমা স্ত্রী শাহজাদী নাজিয়া সুলতানার নামে প্রেরণ করেন। পত্রখানা তৎকালীন তুর্কী পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। জনগণ কণ্ঠস্ত করে ফেলেছিল এর বিষয় ও শব্দগুলো। অত্যন্ত শিক্ষণীয়, আবেদনপূর্ণ, হৃদয়গ্রাহী ও ঈমান জাগানিয়া সে ঐতিহাসিক পত্রখানা অত্যন্ত সাবলীল ও সরলভাষায় প্রিয় জাগো মুজাহিদ পাঠকদের সমীপে পেশ করা হলো।)
জীবন সঙ্গিনী, প্রিয়তমা নাজিয়া!
মহান আল্লাহ তোমাকে তার সার্বক্ষণিক হেফাজতে রাখুন। এ মুহূর্তে তোমার হাতের লেখা শেষ পত্রখানা আমার সামনে রয়েছে। তোমার এ পত্রের প্রতিটি ছত্র আমার হৃদয়পটে আমৃত্যু লিপিবদ্ধ থাকবে। এ মুহূর্তে তুমি আমার সামনে নেই বটে, কিন্তু তোমার পত্রের ছত্রে ছত্রে আমি তোমার সেই ঝকঝকে খুবসুরত মোলায়েম আঙুলগুলোকে দিব্বি সঞ্চালমান অনুভব করছি, যে মোলায়েম আঙুলগুলো প্রায়শই আমার মাথার চুল নিয়ে খেলত, এখানে তাবুর এই অন্ধকারের মাঝেও প্রায়ই তোমার চাঁদ মুখখানি ভেসে উঠে আমার চোখের তারায়।
হায় আফসোস, তোমার অনুযোগ, আমি নাকি তোমাকে ভুলতে বসেছি এবং তোমার মহাব্বতের কোন তোয়াক্কা না করেই আমি তোমার হৃদয়কে শরবিদ্ধ করে এই দূর দেশে আগুন আর রক্তের খেলায় মেতে আছি। আর এ নিয়ে নাকি একটুও ভাবি না যে, এক অবলা নারী আমারই বিরহ বেদনায় কাতর হয়ে বিনিদ্র রজনীতে বাতায়নে বসে শুধু আসমানের সিতারা গুনতে থাকে। তুমি লিখেছ, আমার সবটুকু প্রেম ভালবাসা আর সখ্যতা নাকি যুদ্ধ আর তরবারীর সাথে।
নাজিয়া! এই কথাগুলো লেখার সময় হয়ত তুমি একটি বারও ভেবে দেখনি যে, তোমার এই অকৃত্রিম ও অমলীন প্রেমোৎসারিত অনুযোগগুলো আমাকে কিরূপ বেদনাহত করতে পারে! তোমাকে আমি কিভাবে বুঝাব, এই দুনিয়াতে আমার কাছে তুমি সব চেয়ে প্রিয়, আত্মার সবচেয়ে নিকটতম আত্মীয়, আমার প্রেম-ভালবাসার সকল পুষ্প পাপড়ির প্রাপ্য একমাত্র তুমিই, তোমার পূর্বে আমি কখনো কাউকে তোমার মত করে ভালবাসিনি। একমাত্র তুমিই ভালবেসে আমাকে ভালবাসা শিখিয়েছো আমার হৃদয় হরণ করেছ, তোমাকে ছেড়ে এ দূরদেশে কিভাবে আমি রয়েছি, এরূপ প্রশ্ন তোমার মনে দেখা দেয়া একান্তই স্বাভাবিক।
শুন নাজিয়া! ধন-সম্পদ লাভের আশায় আমি তোমাকে একাকী ফেলে আসিনি, কিংবা একারণেও নয় যে, আমি নিজের জন্য কোন সিংহাসন লাভের স্বপ্ন দেখছি। যেমনটি আমার শত্রুরা প্রচার করে চলেছে।
তোমার বিরহ- যাতনা বহন করার কারণ, আল্লাহর এক সুমহান ও মহিমান্বিত বিধান-যা আমাকে এখানে আসতে বাধ্য করেছে। জিহাদ ফি সাবিল্লিাহ এর চেয়ে অধিকতর মহান ও কল্যাণকর আমল ইসলামে নেই। এ বিধান ও দায়িত্ব এতই মহিমান্বিত ও মর্যাদাশীল যে শুধু এর নিয়ত ও এরাদাই মুমিনকে জান্নাতুল ফেরদাউস এর হকদার সাব্যস্ত করে। তাই তোমার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় সুসংবাদ, আল্লাহর অনুগ্রহে তোমার প্রিয়তম স্বামী জিহাদের নিছক সংকল্পকারীই নয় বরং জিহাদকে সফলভাবে কার্যে পরিণত করতেও সক্ষম হয়েছে।
নাজিয়া! তোমার বিরহ ব্যথা আমি প্রতি মুহূর্তে গভীরভাবে অনুভব করি। কিন্তু আমি এ বিরহে গর্বিত। কেননা তোমার প্রীতি ও প্রগাঢ় ভালবাসা আমার এই মহান সংকল্পের পথে ছিল অগ্নিপরীক্ষা অনুরূপ। আল্লাহর দরবারে লাখো শুকরিয়া, সে পরীক্ষায় আমি পূর্ণ কৃতকার্যতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছি। আল্লাহর মহাব্বত ও তার আরোপিত এই মহান বিধান জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে তোমার প্রেম-ভালবাসার উর্ধ্বে স্থান দিতে আমি সক্ষম হয়েছি। তোমার জন্যও গর্বের বিষয় হলো, তোমার স্বামী এমন সুদৃঢ় ঈমান ও আল্লাহ প্রেমের অধিকারী যে, তোমার ন্যায় প্রাণ-প্রিয়া স্ত্রীর মহাব্বাতও তার খোদায়ী দায়িত্ব পালনের পথে অন্তরায় হতে পারেনি।
যদিও তরবারীর জিহাদ তোমার উপর ফরজ নয়, তবে তুমিও জিহাদের পরিধি বহির্ভূত নও। মুসলমান পুরুষ হোক কিংবা নারী কোন অবস্থাতেই সে জিহাদের সার্বজনীন বিধান বহিভূর্ত নয়। এই মুহুর্তে তোমার জিহাদ হল তুমিও আল্লাহর মহাব্বতকে স্বীয় নফসের প্রেম ও মহাব্বাতের উর্ধ্বে স্থান দিবে। এর মাধ্যমে তোমার মুজাহিদ স্বামীর সাথে তোমার প্রকৃত মুহাব্বাতের বন্ধনকে আরো মজবুত ও দৃঢ় করবে।
দেখ নাজিয়া! কখনো এরূপ দোয়া করো না যে, কোন উপায়ে আমার স্বামী জিহাদের ময়দান থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ও অক্ষত অবস্থায় আমার প্রেমের তাবুতে প্রত্যাবর্তন করুক, কেননা তা হবে স্বার্থপরতার দোয়া। এরূপ দোয়া হয়ত আল্লাহরও পছন্দনীয় হবে না, বরং সর্বদা এরূপ দোয়া করবে, তোমার স্বামীর এই জিহাদ ও কোরবানীকে যেন আল্লাহ কবুল করে নেন। হয় তাকে বিজয়ী বেশে তোমার কাছে ফিরিয়ে আনেন, অন্যথায় যেন তার অধর স্পর্শ করে শাহাদাতের অমীয় সুধা। আর তুমি তো জান, এই অধরদ্বয় কখনো শরাবের স্পর্শে কলুষিত হয় নি, বরং তা সদা-সর্বদা জিকির ও তেলাওয়াতে ব্যস্ত থাকত।
প্রাণপ্রিয়া! ভেবে দেখ, কতইনা মোবারক হবে সেই সময় যখন আল্লাহর রাস্তায় আমার এ মস্তক যা তোমার দৃষ্টিতে সুগঠিত ও দৃষ্টি নন্দন-তা আমার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে; যে দেহ তোমার কাছে লাস্যময়ী ও রূপসীদের দেহের চেয়ে অধিক আকর্ষণীয় ছিল। তোমার সেই আনোয়ারের বড়ই সাধ, সে শাহাদাতের সুধা পান করে খালেদ বিন ওয়ালিদ-এর সাথে হাশরের ময়দানে পূনরুত্থিত হতে চায়। এই দুনিয়া নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী, আর মৃত্যু তো অনিবার্য, অবধারিত, তবে কেন মুসলিম নওজোয়ান বিছানায় শুয়ে শুয়ে অথর্বের ন্যায় মৃত্যুকে বরণ করবে আর শাহাদাত তো মৃত্যু নয় বরং তা সাক্ষাৎ জীবন, অন্তত অসীম সুখী জীবনের শুভ সূচনা মাত্র।
নাজিয়া! যদি এই যুদ্ধে আমি শাহাদাত বরণ করি, তাহলে তোমার প্রতি প্রথম অসিয়ত হলো, তুমি স্বীয় দেবর নুরী পাশার সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যেও, তোমার পর আমার সবার্ধিক প্রিয় পাত্র হলো নুরী। আমি বিশ্বাস করি, আমার মৃত্যুর পর সে নিষ্ঠা ও কৃতজ্ঞতার সাথে অবশ্যই তোমার সেবা করে যাবে। আমার দ্বিতীয় অসিয়ত, তোমার গর্ভে যে সকল সন্তান-সন্তুতি জন্ম গ্রহণ করবে তাদের সকলকে তুমি আমার জীবন কাহিনী শুনাবে, তাদেরকে তুমি দ্বীন ও মাতৃভূমির খেদমতে জিহাদী প্রেরণায় অনুপ্রাণিত করবে, যদি তুমি এরূপ না কর তবে মনে রেখো, জান্নাতে আমি তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখব।
সুপ্রিয়া! জানিনা, আমার মন বলছে, এরপর হয়ত তোমাকে পত্র লেখার আর সুযোগ আমার হবে না। আশ্চর্যের কী হতে পারে আগামী কালই আমি শহীদ হয়ে যাচ্ছি, আমার শাহাদাতের কথা জানতে পেরে আহাজারী ও শোক-বিলাপ না করে সন্তুষ্টচিত্তে মহান আল্লাহর শুকুর আদায় করবে। কেননা, আল্লাহর রাস্তায় আমার শাহাদাত বরণ তোমার জন্যও মহাগৌরব ও গর্বের বিষয়।
নাজিয়া! ইনশাআল্লাহ, আবার আমরা দু'জনে জান্নাতে মিলিত হব, যে মিলনের পর কোন বিচ্ছিন্নতা নেই, নেই কোন বিচ্ছেদ, নেই কোন বিরহ। সেই মহা-মিলনের প্রত্যাশায় আজ এখানেই বিদায়।
আল্লাহ হাফেজ
ইতি
তোমার আনোয়ার
ভাষান্তরঃ হাবীবুর রহমান