জীবন পাথেয়
ইসলামের দৃষ্টিতে মুরতাদ ও তার শাস্তি
মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ
=====================================================================
[ইদানীং দেশে এক শ্রেণীর মতলববাজ বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে দাবি করছেন যে, ইসলামদ্রোহী মুরতাদ বা কোরআনের অপব্যাখ্যা বা অবমাননাকারীদের শাস্তি দেয়া বা দাবি করার কোনো নির্দেশ কুরআন শরীফে উল্লেখ নেই । তাদের দাবী এসব অপরাধীদের শাস্তি স্বয়ং আল্লাহ দেবেন, জাগতিক শাস্তি প্রদানের কোনো বিধান ইসলামে নেই । তারা যে কুরআন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং নিজেদের মতলব হাসিল করার জন্য কুরআনের নামে জঘন্য মিথ্যাচারে লিপ্ত তা প্রমাণ করেছেন এবং তাদের চ্যালেঞ্জের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন প্রবন্ধক তাঁর এ প্রবন্ধে । ]
মুরতাদ কে?
মুরতাদ শব্দের অর্থ 'যে ফিরে যায়' । অর্থাৎ যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে আবার তা ত্যাগ করল তাকে মুরতাদ বলা হয় । ধর্মত্যাগকে বলা হয় ইরতিদাদ বা রিদ্দা । ব্যক্তির ধর্মত্যাগ এভাবে সাব্যস্ত হবে -যখন সে ঈমানের কোনো নীতিকে অস্বীকার করার ঘোষণা করে বা ঈমানের পরিপন্থী কোনো কাজ করে । যথাঃ কুরআনের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে বা কুরআন শরীফ কোনো নাপাকির মধ্যে ফেলে দেয় বা কুরআনের আংশিক বা পূর্ণ সংশোধন বা পরিবর্তন চায় ও এতে বিশ্বাস করে বা মহানবী সাঃ কে গালি দেয় বা তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে তখন তাকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয় ।
আল্লামা শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহঃ বর্ণনা করেন যে, "মুরতাদের পরিচায়ক হল ইসলাম গ্রহণের পর মুখে কালিমায়ে কুফর উচ্চারণ করা । যথাঃ এমন কথা বলা যাতে আল্লাহকে অবিশ্বাস বা নবীদের বা কোনো একজন নবীকে অবিশ্বাস করা বুঝায় বা অথবা ধর্মের অত্যাবশ্যক ব্যাপারকে অস্বীকার করা অথবা এমন কাজ করা যার দ্বারা ধর্মের সাথে ঠাট্টা বিদ্রুপ করা বুঝায়, এরূপ যে ব্যক্তির থেকে প্রকাশ পাবে সে যদি পাগল বা অপ্রাপ্ত বয়সের না হয় তবে তাকে মুরতাদ ঘোষণা করা হবে । অনুরূপভাবে যদি কেউ আল্লাহ অথবা তাঁর নবীকে মিথ্যাবাদী বলে বা কুরআনের কোনো আইনকে ভুল বলে ঘোষণা করে বা এর পরিবর্তন করার ঘোষণা দেয় তবে সেও মুরতাদ ।
আল-কুরআনে মুরতাদের শাস্তি
পবিত্র কুরআনে মুরতাদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে । যথা-
(১) "তোমাদের মাঝে যে কেউ স্বীয় দ্বীন হতে ফিরে যায় এবং কাফিররূপে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, ইহকালে ও পরকালে তাদের ধর্ম নিস্ফল হয়ে যায়,এরাই জাহান্নামী, সেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে' । (সূরা বাকারাহ,আয়াত ২১৭ এর শেষাংশ) ।
এ আয়াতে বর্ণিত ইহকালে কর্ম নিস্ফল হওয়ার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা ।
(২) "ঈমান গ্রহণের পর এবং রাসূলকে সত্য বলে সাক্ষ্যদান করার পর এবং তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পর যে সম্প্রদায় সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাকে আল্লাহ কিরূপে সৎপথে পরিচালিত করবেন?আল্লাহ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না" । (আলে ইমরান, আয়াত ৮৬) ।
এ আয়াতে মুরতাদকে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে ।
(৩) 'এরাই তারা যাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ তাদের উপর আল্লাহ,ফেরেস্তাগণ এবং মানুষ সকলেরই লানত' । (আলে ইমরান, আয়াত ৮৭)
এ আয়াতে লানত অর্থাৎ দুনিয়াতে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা ।
(৪) তারা এতে (দোজখে) স্থায়ী হবে । তাদের শাস্তি লঘু করা হবে না এবং তাদেরকে বিরামও দেয়া হবে না' । (আলে ইমরান, আয়াত ৮৮) ।
পরকালের অনন্তকাল শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
(৫) 'তবে এরপর যারা তাওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে নেয় তারা ব্যতীত । আল্লাহ ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু' । ( আলে ইমরান, আয়াত ৮৯) ।
অত্র আয়াতে মুরতাদ হওয়ার পরে যদি তাওবা করে, তবে তাকে ক্ষমা করার কথা বলা হয়েছে ।
(৬) 'ঈমান গ্রহণের পর যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং যাদের সত্য প্রত্যাখ্যান প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে তাদের তাওবা কখনও কবুল হবে না । এরাই পথভ্রষ্ট' । (আলে ইমরান, আয়াত ৯০) ।
অত্র আয়াতে যারা বারবার মুরতাদ হয় অর্থাৎ যাদের ধর্মত্যাগ একাধিকবার ঘটে, তাদের তাওবা কবুল হবে না ঘোষণা করা হয়েছে, অতএব তার মৃত্যুদন্ড কোনভাবেই রহিত হবে না ।
(৭) যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরূপে যাদের মৃত্যু ঘটে, তাদের পক্ষে পৃথিবী পূর্ণ স্বর্ণ বিনিময়স্বরুপ প্রদান করলেও কখনও তা গ্রহণ করা হবে না । এরাই তারা যাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে, এদের কোন সাহায্যকারী নেই' । (আলে ইমরান, আয়াত ৯১)
(৮) যখনই তাদেরকে ফিতনার দিকে আহ্বান করা হয় তখনই এ ব্যাপারে তারা পূর্বাবস্থায় (অর্থাৎ ধর্মত্যাগ, শিরক,কুফুরী) প্রত্যাবৃত্ত হয় । যদি তারা তোমাদের নিকট শান্তির( ইসলাম গ্রহণের) প্রস্তাব না করে তবে তাদেরকে যেখানেই পাবে গ্রেফতার করবে ও হত্যা করবে এবং তোমাদেরকে (মুসলমানদেরকে) এদের বিরুদ্ধাচারণের স্পষ্ট অধিকার দিয়েছি । '(নিসা, আয়াত ৯১) ।
(৯) যারা ঈমান গ্রহণ করে ও পরে কুফরি করে (মুরতাদ হয়ে যায়) এবং আবার ঈমান গ্রহণ করে, আবার কুফরি করে (মুরতাদ হয়ে যায়), অতঃপর তাদের কুফরি প্রবৃত্তি (মুরতাদ হওয়ার প্রবণতা) বৃদ্ধি পায় । আল্লাহ তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করবেন না । '(নিসা, আয়াত ১৩৭)
(১০) 'যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে (বিরোধিতায় লিপ্ত হয়) এবং পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করে বেড়ায় তাদের শাস্তি এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে । দুনিয়ায় এ হল তাদের লাঞ্চনা, পরকালেও তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে । '(মায়িদা, আয়াত ৩৩)
(১১) "হে মুমিনগণ, তোমাদের মধ্যে কেউ স্বীয় ধর্ম থেকে ফিরে গেলে (মুরতাদ হয়ে গেলে), অচিরেই আল্লাহ (মুরতাদদের ধ্বংস করে) এমন সম্প্রদায় আনবেন, যাদেরকে তিনি ভালবাসবেন এবং তারাও তাঁকে ভালবাসবে । তারা মুসলমানদের প্রতি বিনয়-নম্র হবে এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে । তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না । এসব আল্লাহর অনুগ্রহ-যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন । আল্লাহ প্রাচুর্যময়,প্রজ্ঞাময় । " (সূরা মায়েদা, আয়াত ৫৪)
(১২) "অতঃপর তারা (যদিও তারা চুক্তি ভঙ্গকারী, এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারী তবুও) যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে ভাই । আমি তো জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান সম্প্রদায়ের জন্যই আমার নির্দেশসমূহ বর্ণনা করে থাকি । তারা যদি নিজেদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং দ্বীনের অপবাদ রটিয়ে দ্বীন সম্বন্ধে বিদ্রুপ করে তাহলে কাফির (তথা মুরতাদের) নেতাদের হত্যা কর । তাদের ব্যাপারে আর কোন প্রতিশ্রুতি থাকলো না । হতে পারে, তারা (কঠোর শাস্তি প্রয়োগে) নিজেদের অপকর্ম থেকে বিরত হবে ।
তোমরা কী সে সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করবে না, যারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে ও রাসূলকে বহিষ্করণের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়েছে? তারাই তোমাদের সাথে সংঘাত সংঘর্ষের সূচনা করেছিল । এ সকল লোকের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে তোমরা কি ভয় পাচ্ছ?সত্যিকারের মুমিন যদি হও, তবে (তাদেরকে নয়),একমাত্র আল্লাহকেই ভয় কর ।
তোমরা তাদের সাথে জিহাদে লিপ্ত হও । তোমাদের হাতে আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন, তাদের লাঞ্চিত-অপমানিত করবেন । তাদের বিরুদ্ধে জিহাদে তোমাদেরকে আল্লাহ সাহায্য করবেন । এভাবেই (মুরতাদ-কাফিরদের ধ্বংস করে) আল্লাহ মুমিনদের চিত্ত প্রশান্ত করবেন । (সূরা তাওবা, আয়াত ১১-১৪)
১১ নং আয়াতে যে চুক্তিভঙ্গের কথা বলা হয়েছে তাফসিরবিদগণ এর অর্থ ইরতেদাদ তথা মুরতাদ হওয়া অর্থে সাব্যস্ত করেছেন ।
(১৩) "যে ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর আল্লাহকে অস্বীকার করলো (মুরতাদ হয়ে গেল) এবং কুফুরীর জন্য হৃদয় উন্মুক্ত রাখলো তার উপর আপতিত হবে আল্লাহর গজব এবং তার জন্য আছে মহাশাস্তি । তবে এ শাস্তি থেকে সে ক্ষমা পাবে যাকে কুফুরীর জন্য বাধ্য করা হয় কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচল । (সূরা নাহল, ১০৬)
হাদীস শরীফে মুরতাদের শাস্তি
(১) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যে ধর্ম ত্যাগ করে তাকে হত্যা কর অথবা তার শিরচ্ছেদ কর" ।
এ হাদীসটি বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যথাঃ ইবনে মাজাহ,হুদুদ অধ্যায় । নাসাঈ,তাহরীমুদ্দাম অধ্যায়, । তায়ালিমী সংখ্যা ২৬৮৯ । মুয়াত্তা ইমাম মালিক,আকদিয়্যা, হাদীস ১৫ । বুখারী, মুরতাদীন অধ্যায় । তিরমিজি, হুদুদ অধ্যায় । আবু দাউদ,হুদুদ অধ্যায় । ইবনে হাম্বল, ১ম খন্ডঃ ২১৭, ২৮২, ৩২২ নং হাদীস ।
(২)হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ) ও হযরত আয়েশা ( রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায়ঃ "যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করে ও মুসলিম জামাআত হতে আলাদা অবস্থান গ্রহণ করে, মহানবী (সাঃ) তার হত্যার অনুমতি দিয়েছিলেন ।
এ হাদীসটি বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে যথাঃ
বুখারী, দিয়াত অধ্যায় । মুসলিম, কাসামা অধ্যায় । নাসাঈ,তাহরীমুদ্দাম অধ্যায় । ইবনে মাজাহ,হুদুদ অধ্যায় । আবু দাউদ,হুদুদ অধ্যায় । তিরমিজী, দিয়্যাত অধ্যায়;ঐ গ্রন্থের ফিতনা অধ্যায় । ইবনে হাম্বল, ১ম খন্ডঃ৩৮২,৪৪৪ নং হাদীস ।
(৩) বর্ণিত আছে, হযরত আলী (রাঃ) একজন ধর্মত্যাগী মুরতাদকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলেন । হযরত ইবনে আব্বাস ( রাঃ) এ সংবাদ অবগত হয়ে বলেন, " আমি হলে এরূপ করতাম না । কারণ রাসূল (সাঃ) কাউকে জীবন্ত দগ্ধ করতে নিষেধ করেছেন । এ অবস্থায় আমি বরং তাকে তরবারী দ্বারা হত্যা করতাম । কারণ রাসূল (সাঃ) বলেছেন," যে কেউ ইসলাম পরিত্যাগ করে তাকে হত্যা কর" । (বুখারী, হুকমুল মুরতাদীন অধ্যায়, তিরমিজি, হুদুদ অধ্যায়) ।
(৪) হযরত আয়েশা ( রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায় যেঃ মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান খলিফা ধর্মত্যাগীকে অবস্থা বিশেষে হত্যা করতে বা শূলে চড়াতে বা নির্বাসন দন্ড প্রদান করতে পারেন । (নাসাঈ,তাহরীমুদ্দাম অধ্যায়; ঐ গ্রন্থে কাসামা অধ্যায় ; আবু দাউদ,হুদুদ অধ্যায়) ।
(৫) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, " যে ব্যক্তি মুসলমান হয়েছে এবং এ কথার ঘোষণা দিয়েছে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই,আমি আল্লাহর রাসূলকে নবী বলে বিশ্বাস করি । এমন ব্যক্তিকে তিনটি কারণ ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয় । এক, সে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে । দুই, বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যভিচারে লিপ্ত হলে । তিন, নিজের ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে মুসলিম সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ।
(৬) হযরত আয়েশা ( রাঃ) ও হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, এক মহিলা উহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের পর নিজেকে ইসলামত্যাগী মুরতাদ হিসেবে ঘোষণা করে । মহানবী (সাঃ) এ ঘটনা জানতে পেরে সাহাবীদের বলেন, 'তোমরা এ মহিলাকে ইসলামে পুনঃদীক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানাও । যদি সে ইসলামে পুনঃদীক্ষিত হতে অস্বীকার করে তবে তাকে হত্যা কর' । (বায়হাকী, দারে কুতনী) ।
(৭) অনুরূপ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, উম্মে রুম্মান নাম্নী, জনৈকা মহিলা ইসলাম ত্যাগ করে নিজেকে মুরতাদ ঘোষণা করলো । মহানবী (সাঃ) এর নির্দেশে উক্ত মহিলাকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানানো হলে সে তা অস্বীকার করলো । এ অবস্থায় মহানবী (সাঃ) তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদানের নির্দেশ দিলেন ।
মুরতাদকে তাওবা করার সময় ও সুযোগ দান
ধর্মত্যাগী মুরতাদকে সাথে সাথেই হত্যা করা হবে না তাকে তাওবা করার সুযোগ দেওয়া হবে এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায় । হযরত আবু বুরদা (রাঃ) হতে বর্ণিত একটি হাদীসে জানা যায়, হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) এর সামনে কোন মুরতাদকে হাজির করা হলে তিনি 'আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী' তাকে হত্যা না করা পর্যন্ত আসন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন' । (বুখারী, মাগাযী অধ্যায় । মুসলিম, ইমারা অধ্যায়,হাদীস নং ১৫ । আবু দাউদ, হুদুদ অধ্যায় । ইবনে হাম্বল, ৫ম খন্ড, হাদীস নং ২৩১) ।
বর্ণিত ঘটনা দ্বারা বোঝা যায় যে, মুরতাদকে সাথে সাথেই হত্যা করতে হবে ।
অন্যদিকে, দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার (রাঃ) এর সময়ে এক মুরতাদ ব্যক্তিকে হত্যা করায় তিনি বলেছিলেন, "তোমরা কি তিনদিন আবদ্ধ রেখে তাওবা করাতে চেষ্টা করো নাই? হয়তো সে তাওবা করে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরে আসতো । "
এই ঘটনা দ্বারা বোঝা যায় যে, মুরতাদকে তাওবা করার সুযোগ দিতে হবে । কতিপয় হাদীসের ভাষ্যে জানা যায় যে, মুরতাদের তাওবা আল্লাহ কবুল করেন না । অতঃপর তাওবা করার সুযোগ দানের প্রয়োজন নেই । আবার, কতিপয় হাদীস অনুসারে জানা যায় যে, কোন কোন মুরতাদ তাওবা করে পুনঃ ইসলামে দীক্ষিত হওয়ায় মহানবী (সাঃ) তাদের ক্ষমা করেছেন ।
মুরতাদ ব্যক্তিকে তওবা করানোর প্রচেষ্টা তথা ইসলামে পুনঃদীক্ষিত করার চেষ্টা করা আবশ্যক কি না সে বিষয়ে প্রাথমিক যুগের মুসলিম আইনবিদগণ মতামত ব্যক্ত করেন যে, দু'ধরনের মুরতাদের ভিন্ন ভিন্ন হুকুম । যথাঃ
১ । মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয় তবে তাকে অবিলম্বে হত্যা করতে হবে ।
২ অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণের পর ইসলাম গ্রহণ করে মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে পুনরায় ইসলামে দীক্ষিত করার জন্য তিনবার প্রচেষ্টা চালাতে হবে । অথবা তাকে তিনদিন কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে । যাতে সে এ তিনদিনে তাওবা করার সুযোগ পায়,যদি তাওবা না করে তবে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হবে । (তাবারী, ৫ম খন্ড)
কোন কোন মুসলিম মনিষী অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে,মুরতাদকে ৫ ওয়াক্ত নামায পর্যন্ত তাওবার সুযোগ দেয়া হবে । প্রতিবার নামাযের সময় তাকে নামাযে আহ্বান করা হবে । প্রতিবারই যদি সে অস্বীকার করে তবে তাকে হত্যা করা হবে ।
মুরতাদের শাস্তি প্রসঙ্গে ফিকহবিদদের মতামত
ফিকহ শাস্ত্রবিদ তথা হানাফী,মালেকী,শাফেয়ী, হাম্বলী মাজহাব চতুষ্টয়ের ইমামগণ ও বিষয়ে একমত যে, ধর্মত্যাগী মুরতাদ ব্যক্তি যদি পুরুষ হয় তবে তার শাস্তি হল মৃত্যুদন্ড । অন্যদিকে, মুরতাদ ব্যক্তি যদি মহিলা হয় তবে মাজহাব চতুষ্টয়ের অধিকাংশ ইমামদের মত হলো তাওবা করে যদি ধর্মে পুনঃদীক্ষিত না হয় তবে পুরুষের মতো মুরতাদ মহিলাকেও মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হবে ।
এ মতের পক্ষে প্রমাণস্বরুপ, হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত একখানি হাদীস উপস্থাপন করা হয় যথাঃ হযরত মুয়াজ (রাঃ) কে যখন মহানবী (সাঃ) ইসলামের শাসনকর্তার দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন তখন হযরত (সাঃ) তাকে বলেন যে, "কোন পুরুষ ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে গেলে তাকে ইসলামে পুনঃদীক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানাও । যদি সে পুনঃদীক্ষিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ না করে তবে তাকে হত্যা কর । এবং কোন নারী ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায় তবে তাকে ইসলামে পুনঃদীক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানাও । যদি সে পুনঃদীক্ষিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ না করে তবে তাকেও হত্যা কর ।
অন্য এক হাদীসে জানা যায়,মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ' যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম পরিত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায় (সে নারী বা পুরুষ হোক) তাকে হত্যা কর । (বুখারী)
বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী আইনগ্রন্থ " হিদায়া" তে উপরে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করে মত প্রকাশ করা হয় যে, এ হাদীসে 'মান' দ্বারা নারী-পুরুষ উভয়কেই বুঝাবে । সেহেতু মুরতাদ নারী-পুরুষ উভয়কেই হত্যা করা হবে । (হিদায়া, ২য় খন্ড,পৃঃ৬০০)
উল্লেখ্য যে, নারী যদি গর্ভবতী হয় তবে সন্তান প্রসবের পর তাকে হত্যা করা হবে । (কিতাবুল উম্ম,৬ষ্ঠ খন্ড,পৃঃ১৪৯)
খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রঃ) এর শাসন আমলে মুরতাদকে খুটির সাথে বেঁধে বুকে বর্শার আঘাতে হত্যা করা হতো ।
সুলতান বায়বারস (১৩০৯-১৩১০ খৃঃ) এর সময় এক মুরতাদ মহিলাকে গাধার পিঠে চড়িয়ে কায়রোর রাস্তায় রাস্তায় প্রদক্ষিণ করানো হয়, এরপর নীলনদের মধ্যস্থলে নৌকায় শাসরুদ্ধ করে তাকে হত্যা করা হয় । তুরস্কসহ কিছু কিছু ইউরোপীয় মুসলিম অঞ্চলে মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড রহিত করা হয়েছে,তবে কারাদন্ড ও নির্বাসন দেয়া এখনো প্রচলিত আছে । যদিও ঐ সব অঞ্চলে রাষ্ট্রীয়ভাবে মৃত্যুদন্ড রহিত করা হয়েছে তবুও মুরতাদ ব্যক্তির মুসলমান আত্মীয়রা তাকে বিষ প্রয়োগে বা অন্য কোন উপায়ে হত্যা করতে পারে বলে মুরতাদ ব্যক্তিকে সর্বদা আতঙ্কিত থাকতে হয় ।
দন্ডাদেশ প্রয়োগ করবে কে?
আল-কুরআন ও আল-হাদীসের বিধানের গুরুত্ব কোন বিচারপতি বা রাষ্ট্রপ্রধানের ঘোষণার উপর নির্ভরশীল নয় । আল-কুরআন ও আল-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত বিধান শাশ্বত । এ বিধানের কার্যকারিতার আওতায় যে পড়বে তাকে তা মানতেই হবে ।
এ মুরতাদের মৃত্যুদন্ডাদেশ আল-কুরআন ও আল-হাদীস দ্বারা যখন সাব্যস্ত হলো তখন প্রশ্ন জাগে, এ দন্ডাদেশ কার্যকর করবে কে?যে কেউ কি আইন হাতে তুলে নিয়ে এ দন্ড কার্যকর করার বৈধতা রাখে?
এ ব্যাপারে জানা যায় যে, মহানবী (সাঃ) এর যুগে কোন কোন সাহাবী রাসূল বিদ্বেষীকে নিজেই হত্যা করে ফেলেছেন । পরে যখন মহানবী (সাঃ) এ বিষয়ে অবগত হন তখন মহানবী (সাঃ) উক্ত সাহাবীকে কোনরূপ তিরস্কার করেন নি বরং কোন দন্ডও প্রদান করেন নি । যথাঃ হযরত শ'বী (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, এক ইহুদি মহিলা মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে সম্মান হানিকর কথাবার্তা বলে তাঁর কুৎসা রটিয়ে বেড়াত । একদা জনৈক সাহাবী তার মুখে মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক কথাবার্তা শুনে সাথে সাথে তাকে গলাটিপে হত্যা করে ফেলে । মহানবী (সাঃ) এর সমীপে এ ঘটনার খবর পৌঁছালে তিনি তাতে কোন অসন্তুষ্টিও প্রকাশ করেন নি এবং নবী বিদ্বেষী উক্ত মহিলাকে হত্যাকারী সাহাবীকেও কোন শাস্তি প্রদান করেন নি ।
এরূপ দু'একটা ঘটনা থাকলেও কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য বিধানাবলী পর্যালোচনা এবং মাযহাব চতুষ্টয়ের ইমামদের মতামতের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, মূলত এরূপ দন্ডাদেশ কোন ব্যক্তি আইন হাতে তুলে নিয়ে নিজে তা কার্যকর করতে পারবে না । শরীয়ত এরূপ অনুমতিও দেয় নি । অতএব, মুরতাদের দন্ডাদেশের বিষয়ে কার্যকর করা হবে মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানের বা বিচারকের নির্দেশে । রাষ্ট্র প্রধান বা বিচারকই মৃত্যু দন্ডাদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ।
রাষ্ট্র যদি ইসলামী না হয়?
ইসলামী আইন যদি প্রবর্তিত না থাকে? এখন প্রশ্ন জাগে, দেশ যদি ইসলামী রাষ্ট্র না হয়,কোন কুরআন হাদীসের বিধান কার্যকর আছে এরূপ রাষ্ট্র যদি না হয় অথবা মুরতাদের শাস্তির বিধান সম্বলিত বিধান যদি আইন ব্যবস্থায় না থাকে সে অবস্থায় কী করা হবে?
ব্যাপারটি জটিল । কারণ যেখানে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠসেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে না এটা গ্রহণযোগ্য নয় । অপরপক্ষে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের মুরতাদের শাস্তির বিধান থাকবে না এটাও গ্রহণযোগ্য নয় । এছাড়া আল্লাহ, রাসূল ও ইসলাম ধর্মের কুৎসা রটনা করে, এ ব্যাপারে বিদ্রুপ-ঠাট্টা করে মুসলমানের ধর্মানুভুতিতে আঘাত প্রদানের শাস্তির বিধান আইন ব্যবস্থায় থাকবে না এটাও কোনো ভাবে গ্রহণ করা যায় না । অতএব, আইন না থাকলে আইন প্রণয়ন করে মুরতাদ-ধর্মদ্রোহীর বিরুদ্ধে ইসলাম, আল্লাহ-রাসূল,কুরআন ও হাদীসের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানোর,ইসলামী বিধানাবলীকে হাসি-ঠাট্টা ও বিদ্রুপের বিষয়ে পরিণত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত ।
মুরতাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকরী করার পর
মুরতাদ নর-নারীর মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হয়ে গেলে বা মুরতাদ অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যু মুখে পতিত হলে তাকে ইসলামী মতে দাফন-কাফন করা বৈধ নয় । এরূপ ব্যক্তির সম্পত্তি 'মালেফায়' অর্থাৎ মুসলমান সৈন্যবাহিনী কর্তৃক অধিকৃত রাষ্ট্রদ্রোহী অমুসলিমদের সম্পত্তির অনুরূপ বলে পরিগণিত হবে । অর্থাৎ তা মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে গণ্য হবে । (কিতাবুল উম্ম,১ম খন্ড,পৃঃ২৩১)
অবশ্য কোন কোন মুসলিম ফিকহবিদদের মতে, এরূপ সম্পত্তি ধর্মত্যাগীর আইনসম্মত উত্তরাধীকারীদের মধ্যে যথাযথ বন্টন করে দেয়া হবে । (দারিমী, ফারাইন অধ্যায় দ্রষ্টব্য) মুরতাদের বিবাহ বাতিল বলে ঘোষিত হবে । কোন মুসলিমের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে থাকলে ধর্মত্যাগের সাথে সাথে তাও বিনষ্ট হয়ে যাবে ।
মুরতাদের শাস্তির ব্যাপারে কাদিয়ানীদের বিভ্রান্তি সৃষ্টি
কাদিয়ানীরা এ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে বলে যে, " ধর্মত্যাগের জন্য ইসলামে প্রাণদন্ডের কোন ব্যবস্থা নেই । "জনৈক কাদিয়ানী মুহাম্মদ আলী স্বীয় রচিত 'কুরআনের ভাষ্য' নামক গ্রন্থে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ধর্মত্যাগের অপরাধে মৃত্যদন্ড প্রদান করা বৈধ নয় ।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়, কাদিয়ানীরা যেখানে নিজেরাই ধর্মত্যাগী অমুসলিম সেখানে তাদের দ্বারা এরূপ উদ্ভট কথার অবতারণা করা অসম্ভব কিছুই নয় । গোলাম আহমদ নামক ধর্মত্যাগী কাফেরকে যারা নবী হিসেবে মান্য করে, মুহাম্মদ (সাঃ) কে যারা শেষ নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না তাদের দ্বারা কত কিছুই তো হওয়া সম্ভব । মুহাম্মদ (সাঃ) কে যারা শেষ নবী হিসেবে মানে না তারা কুরআন ও কুরআনের শিক্ষা মানবে কেন?
অতএব, ধর্মত্যাগী অমুসলিম সম্প্রদায় কাদিয়ানীরা যে দাবী করেছে এবং যে বিষয়ে পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করেছে তা সবই মিথ্যা ।
যেখানে কুরআনের অসংখ্য আয়াতে এবং মহানবী (সাঃ) এর অসংখ্য হাদীসে মুরতাদের মৃত্যুদন্ড প্রদানের প্রমাণ রয়েছে সেখানে কাদিয়ানীদের এ দাবী একান্তই বাতিল ও ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হবে ।
তথ্যসূত্রঃ
১ । আল-কুরআন
২ । বুখারী শরীফ
৩ । মুসলিম শরীফ
৪ । নাসাঈ শরীফ
৫ । আবু দাউদ শরীফ
৬ । তিরমিজি শরীফ
৭ । ইবনে মাজাহ শরীফ
৮ । মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল
৯ । মুয়াত্তা ইমাম মালেক
১০ । দারে কুতনী
১১ । বায়হাকী
১২ । হিদায়া
১৩ । আলমগিরী
১৪ । তাফসীরে তাবারী
১৫ । তানজিমুল আশতাত
১৬ । সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ -২য় খন্ড
১৭ । দৈনিক সংগ্রাম-১৫ জুন '৯৪ সংখ্যা
═──────────────═