আমাদের দেশের চালচিত্র
বক্তা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক নয়ঃ
এ জাতির উত্থানে প্রয়োজন বীর কেশরী এক মুজাহিদ কাফেলা
মোহাম্মদ ফারুক হোসাইন খান
'ইসলাম' একটি ধর্মের নাম একটি আদর্শ, একটি বিপ্লবী চেতনার আধার, একটি জীবন ব্যবস্থা বা একটি সুশৃংখলভাবে মানব জীবন পরিচালনার পূর্ণাংগ মতবাদও বলা চলে। ইসলামের এই বিশাল পরিধিতে বিচরণের একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হল, বিশ্ব ব্যাপী শান্তি স্থাপন ও মানব কল্যাণ। একজন মানুষ যে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেবে সে নিজের জীবন যেমনি ইসলামের ছাঁচে গড়ে তুলবে, তেমনি এ মহা-শান্তিময় পথ থেকে যারা বঞ্চিত রয়েছে তাদের সামনেও এ শান্তির পথ উন্মুক্ত করে দেবে। মুসলমানের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পাবে তখন তারা নিজেরা শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবে যার রূপরেখাও ইসলাম প্রণয়ন করে দিয়েছে। এভাবে সংগঠিত মুসলমানরা সম্মিলিত ভাবে অমুসলিম জনগণের কাছে ইসলামের আদর্শ ব্যাখ্যা করে তাদের শান্তির পথে আসার আহ্বান জানাবে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বিশ্বব্যাপী শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রসার ঘটবে এবং কায়েম হবে শান্তির পৃথিবী। কিন্তু এ কাজ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। এ পথে চলতে গেলে পদে পদে বাধা, অগ্নী পরীক্ষা এমনকি প্রতিরোধের অটল পাহাড়ও মুকাবিলা করতে হয়।
অমুসলিম সমাজ সর্বদাই কোন না কোন জাহেলিয়াত ধ্যান ধারণায় আছন্ন থাকে। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মানুষকে সুপথে পরিচালনার জন্য কিতাব এবং নবী, রাসুল ( আঃ)-গণকে প্রেরণ করেছেন তাঁরা মানুষকে যেমনি সুপথ দেখিয়েছেন, তেমনি কুপথ সম্পর্কে সচেতন করে সে পথ থেকে দূরে থাকারও উপদেশ দিয়েছেন। মানুষের জ্ঞান একেবারেই সংকীর্ণ এবং সীমিত এবং তা ভাল মন্দের মাপকাঠি নির্ণয়ে অপারগ বলেই আল্লাহ নবী রাসূল (আঃ)-গণকে প্রেরণ করে সে সম্পর্কে সুশিক্ষিত করেছেন। যদিও মানুষ স্বল্প পরিসরে ভালমন্দের সংজ্ঞা প্রদান করতে পারে কিন্তু তা আসমানী মাপকাঠির সাথে তুলনারও যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু আল্লাহ কর্তৃক বর্ণিত মানবতার আলোকময় পথ সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ যখন নিজেরাই নিজেদের ভালমন্দের সংজ্ঞা প্রদান করে, নিজেদের জীবনকে মনগড়া আদর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করতে থাকে তারা হারিয়ে যায় জাহেলিয়াতের গোলক ধাধায়। কেননা যে মানুষের ক্ষমতা নেই আজকে কৃত কর্মের ফলাফল আগামী দিন কি হবে সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে সে কিভাবে ক্রম বিবর্তনময় পৃথিবীর সাথে তালমিলিয়ে ভাল-মন্দের ফয়সালা প্রদান করবে? ফলে নিজ প্রবৃত্তি, কুসংস্কার, প্রচলিত চিন্তা চেতনা হয়ে দাঁড়ায় তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের উৎস। তাদের সমাজ বন্ধন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ জাহেলিয়াতের ওপর ভিত্তি করে। বিলাসিতা, দুর্বলকে শোষণ, অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া, ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধি, লালসা চরিতার্থ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়। এ সমাজে দুর্বল মানুষ সর্বদাই মজলুম হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। বুদ্ধিমান, অর্থবান ও লোকবলে বলীয়ান ব্যক্তি এ সমাজে নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে সমাজ ও রাষ্ট্রের হর্তা কর্তা বনে যান। এভাবে আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে দূরে থেকে অমুসলিম সমাজ জাহেলিয়াতের পক্ষপূটে নিজেদের সঁপে দেয়। সমাজের ক্ষমতাবানরা নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সর্বদা জনসাধারণকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে শোষণ করে। তাদের বিশেষ স্বার্থ বিরোধী কোন পথ বা পন্থার দিকে যাতে জনগন আকৃষ্ট না হতে পারে সে জন্য সদা সতর্ক থাকে, প্রয়োজনে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে-ঐ পথ যতই সুন্দর ও বাস্তব হোক না কেন। এ কারণেই অমুসলিম সমাজে যখনই ইসলামের দাওয়াতের বাণী প্রচার করা হয়, সে সমাজের প্রভাবশালীরা শংকিত হয়ে পড়ে, তারা নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন জনগণকে ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে তৎপর হয়ে ওঠে। কেননা, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের মনগড়া আইনের মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নিয়ে মানুষকে আর শাসন করা যাবে না, এ সমাজে শ্রেণী বৈষম্য থাকবে না, আমির গোলাম সব এক কাতারে শামিল হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের শোষণের পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এরা এ আতঙ্কের কারণে শুধু যে নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন মানুষদের ইসলাম থেকে বিমুখ রাখে তাই নয়, ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে এই আতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে সামর্থ্য হলে ইসলামী শক্তিকে নিমূর্ল করতে নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। সুতরাং এই সব জালিম ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কবল থেকে মজলুম মানুষকে মুক্ত করণ এবং এ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ইসলাম ঘোষনা করেছে সুমহান বিধান ‘জিহাদ’। এই বিধান অনুযায়ী মুসলমানগণ বিশ্বে শান্তি স্থাপনের জন্য সর্ব প্রথম সকল অমুসলমানকে ইসলামে বর্ণিত বিধি বিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করে তাদের ইসলাম গ্রহণ তথা সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহর ইবাদতে এবং তাঁর নিকট নিজেদের আত্মসমর্পন করার আহ্বান জানাবে। মানুষের এ পথ অবলম্বন করার পথে যারা ভীতি সৃষ্টি বা বাঁধার কারণ হবে তাদের ইসলাম অনুমোদিত শান্তি চুক্তি সম্পাদনের আহবান জানানো হবে নতুবা তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে জিহাদ চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষন না এদের নাগপাস থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি পায় এবং স্বাধীন ভাবে ধর্ম গ্রহণ বা বর্জনের অধিকার সংরক্ষণ করে। এভাবে শক্তি প্রয়োগ করে জালিমের প্রভাব ও গর্ব চূর্ণ করার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, এর পর অরক্ষিত ও অসহায় মানুষদের ইসলাম গ্রহণের জন্যও শক্তি প্রয়োগ বা চাপ সৃষ্টি করা হবে বরং শক্তি প্রয়োগ করার এটাই উদ্দেশ্য যে, ইসলাম গ্রহণের পথে প্রধান বাধা ও ভীতি সৃষ্টিকারী শক্তিকে নিমূর্ল করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ইসলাম গ্রহণের পথে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। জালিম শক্তি অপসারিত হলে ইসলাম প্রচারকারীরা যেমনি স্বাধীন ভাবে ধর্মীয় বিধানের ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হবে, তদ্রুপ অমুসলিমরাও স্বাধীনভাবে ইসলামের বাণী শ্রবণ করতে পারবে। এর পর তার বিবেক অনুযায়ী ইসলাম গ্রহণ করা বা না করার সিদ্ধান্ত নেবে। ইসলাম এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার দেয়নি বরং তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্ব ব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ববাসীকে আল্লাহর পথে পরিচালনা করার এটাই হল ইসলামের মূল নীতি।
শ্রদ্ধেয় পাঠক মন্ডলী, আমার দেশের চালচিত্র কলামে যেখানে এ দেশের সমস্যা ও নৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে আলোকপাতই মূখ্য বিষয় সেখানে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ জিহাদ যা একটি বহুল আর্ন্তজাতিক বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করায় আপনারা নিশ্চয় হতবাক হয়েছেন। ইসলামের এ অন্যতম স্তম্ভ জিহাদের নয়া আঙ্গিকে কোন ব্যাখ্যা প্রদান করার কোন স্পর্ধা বা আমার কলামের চৌহদ্দি ডিঙ্গানোরও কোন মতলব আমার নেই। মূলতঃ ইসলামের মূল সংজ্ঞা ইসলাম আমাদের কাছে কি চায়, মুসলমান হিসেবে আমাদের কি করনীয়, ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমি এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের জানার অনাগ্রহ ও উদাসীনতার ফলে ইসলামের নামে আমরা কোন পথে ধাবিত হচ্ছি তা নিজেরাই জানি না। অসচেতনার ক্রম বিবর্তনের ধারায় আমরা ইসলামের মূল স্ট্রিট থেকে বহু দূরে সরে গিয়ে ইসলামের উচ্ছিষ্টকে ধারণ করে আছি মাত্র। ইসলামের মৌলিক ব্যাপারে কেউ কোন আলোকপাত করলে তা এখন আমাদের নিকট নতুন দর্শন বলে মনে হয়। আমাদের সমাজের প্রচলিত চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা যে ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে তাতে জিহাদের যে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার অবতারণা করা হয়েছে তাও নতুন নতুন বলে মনে হতে পারে। আসলে এ ব্যাখ্যা আমার নয়, কুরআন, হাদিসের আলোকে বিগত ১৪ শ বছরে যে সমস্ত ইসলামী চিন্তাবীদগণ জিহাদের ব্যাখ্যা প্রদান করে মুজাহিদদের ইসলাম প্রচারে উৎসাহ যুগিয়েছেন এ সেসব ব্যাখ্যার সংক্ষিপ্ত রূপ মাত্র। আর এরই আলোকে আমরা ১০ কোটি বাংলাদেশী যে মুসলমান বলে দাবী করি, কিন্তু আমাদের দায়িত্ব কতটুকু আদায় করছি সে ব্যাপারেই আলোকপাত করা আমার মূল উদ্দেশ্য।
“অমুসলিম কাফেরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে যুদ্ধ লড়াই চালাতে থাক যাবৎ দ্বীন ইসলামে ও তার বিধান প্রবর্তনে বাধা বিঘ্ন সৃষ্টিকারী শক্তি ও ক্ষমতা বিলুপ্ত ও অপসারিত না হয় এবং একমাত্র আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত না হয়।”[সুরা আনফাল ৩৯ নং আয়াত।
“আহলে কিতাবদের মধ্যে (ইহুদী ও নাছারা) যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়ন করে না, আল্লাহ ও রাসুল যা হারাম করেছেন তা হারাম বিবেচনা করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত না তারা স্বহস্তে জিজিয়া কর দিয়ে অধীনতা স্বীকার করে।" (তওবা,২৯।)
এ হল সর্বকালের সকল মুসলমানদের প্রতি আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ বাক্য। কিন্তু দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের বিশাল মুসলিম মিল্লাতের দ্বারা আল্লাহর এ হুকুম কি বাস্তবায়িত হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব কি হতে পারে?
বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি। আমাদের দেশ স্বাধীন। এ দেশের একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে। আমাদের চিন্তা চেতনার আবর্তন এই নিদিষ্ট ভূ-খন্ডের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারাদীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব সার্বভৌম ক্ষমতা থাকার দরুন আমরা অন্য কোন রাষ্ট্রের ব্যাপারে অবহিত হতে পারব কিন্তু সে দেশের জনগণের সুখ-দুঃখের ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ তো দূরের কথা মন্তব্যও করতে পারব না। 'রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব' নামক আমাদেরই হাতে গড়া এই লৌহ বেষ্টনীতে নিজেদের আবদ্ধ রেখে আমরা প্রত্যেকেই আত্মকেন্দ্রীক হয়ে আছি। তাই মানব কল্যাণ, মানবতা বিকাশ বলতে আমরা যা বুঝি তা সবই আমাদের দেশ সম্পর্কিত ক্ষুদ্র গন্ডির মধ্যে সীমিত থাকে। একজন মুসলমান হিসেবে শুধু নিজের মাতৃভূমি নয় সমগ্র মানব গোষ্ঠীর কল্যাণে আমাদের যে অনেক কিছু করণীয় আছে সে দায়িত্ব আমরা কালের বিবর্তনে ভুলেই গেছি। আমরা ভুলেই গেছি যে, দুনিয়ায় যতদিন ফিতনা-ফাসাদ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক শক্তির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন প্রতিটি মুসলিম জীবনের প্রধান লক্ষ্য হবে জালিম শক্তির নির্মূলে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা। আমরা মুসলমান বলে দাবী করছি কিন্তু আমাদের চিন্তা-চেতনা এত ইসলাম শূণ্য হয়ে গেছে যে, ইসলাম আমাদের জীবনের লক্ষ্য কি নির্ধারণ করেছে তা-ই আমাদের জানা নেই। ইসলামপূর্ব যুগে আরবের জাহেলিয়াতের ধারকরা বা কায়সার ও কিসরা নিজ নিজ সৃষ্ট জাহেলিয়াতের আলোকে ভাল-মন্দের ফয়সালা করত, তারা মনে করত তাদের মতবাদই যুগের শ্রেষ্ঠ মানবতার মতবাদ। এর চেয়ে উন্নতর কোন মতবাদ হতেই পারে না। তদ্রুপ ক্ষুদ্র ভৌগোলিক ভূখন্ড কেন্দ্রিক চিন্তাধারায় পুষ্ট হয়ে আমাদের চিন্তা-চেতনাও এত সংকীর্ণ হয়ে গেছে যে, আঞ্চলিকতা কেন্দ্রিক জাহেলিয়াত হয়ে গেছে আমাদের সকল চিন্তা-চেতনার উৎস। আমাদের যে কোন কর্মকান্ড, যে কোন সিদ্ধান্ত এ দেশের মাত্র ১১ কোটি মানুষের মধ্যেই সীমিত থাকবে, এর বাইরে নয়। অন্যান্য কর্মতৎপরতার ন্যায় ইসলামী কর্মকান্ড বাস্তবায়নের পূর্বেও আমরা বিস্তৃত গবেষণা করে নেই যে, ফলাফল সরকারী নীতি লংঘন করল নাকি, রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে এর কোন প্রভাব পড়বে নাকি। অথচ ইদানীং প্রমাণিত হয়েছে যে তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী সরকার ইসলামী স্বার্থ সংরক্ষণে মোটেই আগ্রহী নয়। তদুপরি, ইসলাম সম্পর্কিত দাবী দাওয়া পূরণে আমাদের দাবী এই সরকার পর্যন্ত গিয়েই শেষ হচ্ছে, প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইনের বেদীতে আমাদের ইসলামী শরিয়ত আইন প্রণয়নের দাবী মাথা কুটে মরছে। আমরাই মানুষের তৈরী আইন এবং তাদের ধারকদের ইচ্ছার ওপর আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নকে ছেড়ে দিয়েছি। অথচ ইসলাম এমন কোন দ্বীন নয় যার নীতিমালা বাস্তবায়ন কোন শাসকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে, বা মানুষের তৈরি আইনের অনুগত থাকবে। বরং ইসলামী আইন বাস্তবায়নের পথে যে অপশক্তিই বাধা হয়ে দাড়াবে তাকে ফিতনা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সাব্যস্ত করে তা নির্মূল করার জন্য রয়েছে আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ।
আমরা মুসলমান দাবী করেও যেমনি আল্লাহর আদেশ বিস্তৃত হয়েছি তদ্রুপ ঐশ্বর্য ও বিলাসিতার চাকচিক্যে আমাদের অনুভূতি হয়ে গেছে অসাঢ়। রং-বেরংয়ের মহলরাজি আমাদের চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে যেমন ঝলসে দিয়েছে তদ্রুপ ইট পাথরের মহলের বাসিন্দা হওয়ার সংকীর্ণ স্পৃহা আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়ায় আমাদের মনটাও ইট পাথরে পরিণত হয়েছে। আমাদের বদ কিসমত, যে হাতগুলি ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে আজ ক্লাশনিকভ নিয়ে খেলা করার কথা সে হাতগুলি সেতারের তার নিয়ে খেলছে। জিহাদের রণসঙ্গীত যে কণ্ঠগুলিতে উচ্চারিত হওয়ার কথা সে কণ্ঠগুলি আজ বাঈজীর নুপুরের ঝঙ্কার আর তবলার বোলের সাথে তাল মিলিয়ে সুর মূর্ছনার সৃষ্টি করছে আর সরাবে বুদ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কবি, সাহিত্যিকরা তরুণ-তরুনীদের ব্যর্থ প্রেমের মছিয়া আর শোকগাথা লিখে বাহবা কুড়াচ্ছে আর দু'পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। ইসলামী পুনরুজ্জীবনাকাংক্ষী সমাজে ছিটে ফোটা দু'একজন যারা বেঁচে আছেন তারাও জীবিতদের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে কবরবাসীদের নিয়ে কাব্য লিখছে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরাও কবরবাসীদের নিয়ে বক্তৃতার তুফান বইয়ে দিচ্ছেন। তাদের কথামালায় বার বার ঘুরে ফিরে আসছে অতি পরিচিত ইতিহাসখ্যাত কয়েকটি নাম খালিদ বিন ওয়ালিদ, মুসা নুসাইরী, মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রমূখ। আমরা সেসব মুসলমানেরই উত্তরসূরী, যাদের দৃঢ় ইচ্ছা আর অদম্য মনোবলের সামনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফোরাত, দজলা, জিব্রাল্টার আর রোম উপসাগরের উন্মত্ত তরঙ্গ মালা। আল বুরুজ আর পিরোনীজের দুর্লংঘ প্রাচীর যাদের মনোবল এতটুকু ফাটল সৃষ্টি করতে পারেনি। তারা ছিলেন আমাদের মতই রক্ত-মাংসের মানুষ। কিন্তু একই রক্ত-মাংসের মানুষ হয়েও তাদের সাথে আমাদের মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তাঁরা তখন লক্ষ নয় কোটি নয়, সংখ্যায় হাজার হয়েও জালিমের দম্ভ চূর্ণ করে দিয়েছিলেন। আর আমাদের সংখ্যা লক্ষ ছাড়িয়ে কোটিতে পৌছার পরও বর্তমান বিশ্বে আমরা মজলুম, নিপীড়িত, শোষিত। জালিমের অঙ্গুলি হেলনে আমাদের কিসমতের ফয়সালা হয়। শুধু তাই নয় ইসলামের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা এই তাবেদারীকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি। অথচ ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয়, জুলুমের ভয় নয়, জালিমের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিনা টান করে দাড়ানোর মন্ত্র। প্রবৃত্তির গোলাম হয়ে যারা মানুষের ওপর জুলুম চালায় আল্লাহর বান্দাদের মোকাবিলায় তারা টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু এ দেশে এই ‘আল্লাহর বান্দা মুসলমানদের’ আজ খুব অভাব অনুভূত হচ্ছে। আমরা মুসলমান হিসেবে বহু আগেই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছি, আমাদের সার্বিক যাত্রায় ইসলাম পূর্ণ সত্ত্বায় বিরাজমান নয়। অস্তিত্ব বিলিয়ে দেয়ার এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ঐতিহাসিকরা আমাদের মুসলমানিত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে দ্বিধা করবেন না।
এ হতাশা ও বঞ্চনার লৌহ বেষ্টনী থেকে মুক্ত হওয়ার, ভবিষ্যতের গ্লানি থেকে রেহাই পাওয়ার এখনও সময় আছে, ফুরসত আছে। এজন্য যুগের সমস্ত জঞ্জাল যা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছি তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। ইসলামের নামে যে খোলস আমরা ধারণ করে আছি তা ছেড়ে মূলকে আকড়ে ধরতে হবে। আমাদের জানতে হবে, ইসলাম আমাদের কাছে কি চায়। মনে রাখতে হবে, মুসলমান ধৈর্য্যের সাথে ধ্বংস আর বিপর্যয়ের সয়লাব মুকাবিলা করলে তার জন্য আলোর দিশা নিয়ে নতুন সুবহে সাদিকের আগমন অনিবার্য, এ আল্লাহর শপথ। ইসলামের ইতিহাস এ ধরনের বহু ঘটনায় সমৃদ্ধ। রাসূল (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর পুরো মুসলিম জাতি যে ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তাতে করে তাদের একদিনের জন্যও টিকে থাকাও ছিল কোন মোজেযা। কিন্তু এই প্রলয়কে তারা মুকাবিলা করে টিকে ছিল, তাদের ঘটেছিল বিস্ময়কর উত্থান। একই সাথে তারা কায়সার ও কিসরা এই দুই সালতানাতের বিরুদ্ধে টক্কর লাগানোর হিম্মত দেখিয়েছিল। হোনায়েনের যে কাফেলা একদিন রক্ত সাগর পাড়ি দিয়ে কায়সারের রাজধানী মাদায়েনের পথ ধরেছিল তার রাহবার ছিলেন বাহরাইনের এক বেদুঈন সর্দার মুসান্না বিন হারিসা (রাঃ)। কবিলার ৫০০ যোদ্ধার এই সর্দার একমাত্র ইসলামের বাণীকে বুলন্দ করার জন্য বিশাল ইরানী সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই শুরু করতে দু’বার চিন্তা করেননি। তিনি ৫০০ অনুগত যোদ্ধা নিয়ে যখন ইরানের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন তখন ইরানের যে কোন একজন জমিদারও মুহূর্তের নোটিশে ৪০ হাজার সৈন্য ময়দানে হাজির করতে পারত। ইসলাম মুন্না বিন হারিসা (রাঃ) কে এমন কোন্ জিনিস প্রদান করেছিল যে সে দুনিয়ার মানুষের দৃষ্টিতে কৌতুককর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন? ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মুসান্নার ন্যায় যে মর্দে মুজাহিদরা আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন তাদের সাথে যুদ্ধ জয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা দ্বীন তাদের হাতেই প্রতিষ্ঠিত হবে এমন কোন ওয়াদাও করা হয়নি। মানুষের উপর মানুষের চাপিয়ে দেয়া শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করে বিশ্ব ব্যাপী আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করা একজন মুসলমানের 'ফরজ'-এ ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন পুরো মাত্রায় সচেতন। আর সবকিছুর ওপর “দ্বীনকে স্থান দেয়ার ফলেই তাদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল ইসলামের সুমহান ইতিহাস।
আমরা যে অচলায়তনের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছি তা ভাঙতে হলে মুসান্না (রাঃ)-দের ইতিহাসের পুনরুত্থান ঘটাতে হবে, আল্লাহর নিকট সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করতে হবে। আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতাকে কোন অবস্থায়ই নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, গোত্রীয় অথবা জাতীয় স্বার্থে ব্যবহার করব না বরং তা আল্লাহর নিকট থেকে আমানত স্বরূপ পাওয়া বলে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে তাঁরই কর্তৃত্বের অধীনে ঠিক ঠিকভাবে প্রয়োগ করব তা নিশ্চিত করতে হবে। আল-কোরআনের প্রতিচ্ছবি রূপে গড়ে তুলতে হবে আমাদের চরিত্র। আল-কোরআনে বর্ণিত বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং সকল জালিম শক্তির কবল থেকে বিশ্ব বাসির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ইসলামের সুমহান আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার পথ প্রশস্ত করার গুরু দায়িত্ব পালনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে রাসূল (সাঃ) এর বানী “জিহাদ ইসলামের শিখর চূড়া।”
শিক্ষক নয়, কবি নয়, সাহিত্যিক নয় এ জাতির উত্থানে এখন প্রয়োজন এমন কয়েকজন মুজাহিদ যারা হবেন বিজয় আর আজাদীর জামিন। গাফলতি থেকে জাতিকে জাগানোর জন্য চাই এমন নকীবদের যাদের শিঙ্গা ধ্বনি চেতনা আর দায়িত্ববোধের প্রতিরোধ্য প্রবাহ সৃষ্টি করবে। এ দেশ থেকেই কাফেলার পর কাফেলা বেড়িয়ে যাবে একাধারে মুসলিম বিশ্বকে গাফলতি থেকে সচেতন করে দায়িত্ববোধে উজ্জীবিত করতে অন্যদিকে অমুসলিম বিশ্বকে শান্তির ললিত বাণী পৌছাতে। প্রয়োজনে কাফনের কাপড় শীরস্থান বানিয়ে জালিম শক্তির উৎখাতে ঝাঁপিয়ে পড়বে এ দেশই হোক সমগ্র বিশ্বের “হোম অফ ইসলাম।” এ দেশের মুজাহিদী কাফেলা শুধু গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র নয় প্রয়োজনে টেমস, মিসিসিপি, আমাজান পাড়ি দিয়ে জালিমের আড্ডাস্থলকে আল্লাহ আকবর তাকবির ধ্বনীতে প্রকম্পিত করে তুলবে। এই হোক আমাদের চিরন্তন কামনা।